Site icon অবিশ্বাস

আমার মতো কেউ যেন অত্যাচারের শিকার না হয় ঃ পূর্ণিমা

‘আমার মতো এমন অত্যাচার যেন আর কারো ওপর না হয়। দেশের সব মানুষ প্রধানমন্ত্রী, সরকার, সবার কাছে আমার একটাই অনুরোধ।’ কথাগুলো পূর্ণিমা রাণী শীলের। নির্বাচনের পর দেশজুড়ে সংখ্যালঘুদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের যে উল্লাস চলছে দুর্বৃত্তদের, তারই নির্মম শিকার পূর্ণিমা। গতকাল বিকেলে স্থানীয় একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে তার ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। ওর নিষ্পাপ সরল চোখের জল সংক্রমিত হয় উপস্থিত সবার মধ্যে। পূর্ণিমা এবং তার মা বাসনা রাণী শীল যখন নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরেন তখন হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সংবাদ সম্মেলনে। সাংবাদিকদের কলম থেমে যায়, ফটোগ্রাফার ক্যামেরা ক্লিক করার আগে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে নেন। গতকাল পূর্ণিমা রাণী শীলের বাবা, মা ও ভাইসহ এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির। উপস্থিত ছিলেন শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, রবিউল হুসাইন, আরোমা দত্ত প্রমুখ। নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে গতকাল বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেই সাথে পাশবিক নির্যাতনের শিকার পূর্ণিমা রাণী শীল ও তার পরিবারের নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তাদেরও হাজির করে। লিখিত বক্তব্য এবং পূর্ণিমা ও তার মায়ের বিবরণ থেকে জানা যায়, গত ৮ অক্টোবর রাতে ২৫/৩০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল হামলা চালায় সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার পূর্ব দেলুয়া গ্রামের অনিল কুমার শীলের বাড়িতে। সন্ত্রাসীরা বেধড়ক পিটিয়ে মারত্মক আহত করে অনিল কুমার শীলকে। বেদম প্রহার করে তার মেজ মেয়ে গীতা রাণীকে। এরপর তারা অপহরণ করে ছোট মেয়ে দশম শ্রেণীর ছাত্রী পনের বছরের পূর্ণিমা রাণী শীলকে। অপহরণের সময় তার মা বাসনা রাণী শীল বাধা দিলে তাকেও নির্মমভাবে পিটিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে সন্ত্রাসীরা। এরপর পূর্ণিমাকে তুলে নিয়ে অন্যত্র যায়। প্রায় দু’ঘন্টা ধরে দুবৃত্তরা পূর্ণিমাকে ধর্ষণ করার পর তাকে বিবস্ত্র অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনা যাতে প্রকাশ না হয় সেজন্য দুর্বৃত্তরা ৯ অক্টোবর সকাল পর্যন্ত ওই পরিবারটিকে অবরুদ্ধ করে রাখে। সন্ত্রাসীরা এবং তার অভিভাবকরা অনিল কুমারের ওপর চাপ দিতে থাকে ঘটনাটি মিটিয়ে ফেলার জন্য ; কিন্তু ঘটনা জানাজানি হয়ে যায়। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। স্থানীয় উল্লাপাড়া থানা পুলিশ মামলা করার উদ্যেগ নেয়; কিন্তু থানায় ধর্ষণের মামলা নেয়া হয়নি। পরবর্তীতে সিরাজগঞ্জ জেলা শাখার ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম চৌধুরী উদ্যেগী হয়ে পূর্ণিমাকে সিরাজগঞ্জ জেলা শহরে নিয়ে এসে সিভিল সার্জন অফিসে মেডিক্যাল চেকআপ করান। ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের চিহ্ন পাওয়া যায়। শেষ পর্যন্ত আমিনুল ইসলামের সহযোগিতায় গত ১৪ অক্টোবর পূর্ণিমা বাদি হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে একটি মামলা দায়ের করে। ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন এবং ১৫ জনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। পুলিশ এ পর্যন্ত আব্দুর রব নামে একজন আসামিকে গ্রেফতার করেছে। এদিকে মামলা করার পর থেকেই এই পরিবারটির ওপর সন্ত্রাসীদের চাপ আর হুমকি বেড়ে যায়। সর্বস্ব হারিয়ে তারা একবাড়ে গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। সন্ত্রাসীদের আক্রমণে প্রায় পঙ্গু পূর্ণিমার বাবা ও মা পরিবার নিয়ে এখন আশ্রয় নিয়েছে উল্লাপাড়া সদরে এক আত্মীয়ের বাসায়। এখানেও সন্ত্রাসীদের তৎপরতা থেমে নেই। থানা থেকে পুলিশ আসে, স্থানীয় বিএনপির এমপি আকবর আলী লোক পাঠান যেন মামলাটি মিটমাট করে নেয়। তারা হুমকি দিচ্ছে মামলা তুলে না নিলে পরিণতি খুব খারাপ হবে। সন্ত্রাসীরা এখন দফায় দফায় লোক পাঠাচ্ছে। পূর্ণিমা তার জবানবন্দিতে বলেছে, তার ওপর পাশবিক নির্যাতনকারীদের মধ্যে কয়েকজনকে সে চিনেছে এবং এরা সবাই বিএনপির কর্মী। গত ১৯ অক্টোবর অনিল কুমার শীল ও তার পরিবারের নির্যাতিতদের জবানবন্দি ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে রেকর্ড করা হয়। পূর্ণিমার পরিবারের ঘটনা ছাড়াও নির্মূল কমিটির প্রতিবেদনে নিরাজগঞ্জের নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি তুলে বলা হয়, সিরাজগঞ্জে বিএনপির নেতা-কর্মীরা হিন্দু সম্প্রদায়কে হুমকি দিচ্ছে সাড়ম্বরে দুর্গাপূজা করার জন্য। অন্যথায় তাদের দেশছাড়া করা হবে বলে হুমকি দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিএনপি কর্মীরা বলপূর্বক চাঁদা তুলছে এবং চাঁদা তোলার সময় তারা বলে, ‘এটা নৌকায় ভোট দেয়ার মাসুল।’ সিরাজগঞ্জের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে সংবাদপত্রে খুবই কম তথ্য প্রকাশিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে সিরাজগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ঘোষপাড়ার চিত্তরঞ্জন ঘোষের বাড়িতে ১৮ অক্টোবর মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের হামলার বিবরণ তুলে ধরে বলা হয়, চিত্তরঞ্জন ঘোষের বাড়িতে রক্ষিত গ্রামের হিন্দুদের পূজা উদযাপনের নগদ ৫০ হাজার টাকা, ৭/৮ ভরি স্বর্ণালংকারসহ ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র সন্ত্রাসীরা লুট করে এবং থানায় না জানানোর হুমকি দেয়। হুমকির মুখেও তারা থানায় মামলা করেছেন। নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরতে গিয়ে পরিবারের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা নির্মূল কমিটির সদস্যদের জানান, ‘কিভাবে পূজা করব, মায়ের কাপড় পর্যন্ত নিয়ে গেছে।’ সংবাদ সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর নিরাপত্তা ও পুনর্বাসনের জন্য সরকারের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দাবি করা হয়। এ প্রতিবেদনে যারা থানায় অভিযোগ করেছে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করা হচ্ছে⎯মামলা তুলে নেয়ার জন্য এবং পত্রিকার প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানানোর জন্য উল্লেখ করে সমস্যাটির রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক দিকগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতি ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়। গতকাল পূর্ণিমার পরিবারকে ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন এবং নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে দশ হাজার করে টাকা দেয়া হয়।

সংবাদ, ২১ অক্টোবর ২০০১

Exit mobile version