খুলনার গাজীরহাট ইউনিয়ন, নাটোরের লালপুর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নির্যাতন, বাড়ি দখল, লুটপাট ও চাঁদাবাজির ঘটনা এখনও অব্যাহত রয়েছে। খুলনা থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, খুলনার গাজিরহাট ইউনিয়নের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা চারদলীয় জোটের কর্মী পরিচয়দানকারী সন্ত্রাসীদের অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। চাঁদা দাবি, ভাংচুর ও মারপিট প্রভৃতি ঘটনা প্রতিদিনই কোন না কোন এলাকায় ঘটছে। ইউনিয়নের প্রায় সর্বত্রই সংখ্যালঘুরা নিজ নিজ বাড়িতে অবরুদ্ধ অবস্থায় আতঙ্কিত জীবনযাপন করছে। প্রাণভয়ে কেউ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করতেও সাহস পাচ্ছে না। চাঁদা দাবি ও হুমকির মুখে অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হবার পরপরই খুলনার দিঘলিয়া থানাধীন গাজিরহাট এলাকাতেও চারদলীয় জোটের কর্মী পরিচয়দানকারী সন্ত্রাসীদের দৌরাত্য বেড়ে যায়। অন্যান্যদের মতো ভীতিকর পরিস্থিতি এখানে সৃষ্টি না হলেও নৌকার পক্ষে কাজ করা ও নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার অপরাধে সন্ত্রাসীরা একের পর এক হামলা চালাতে থাকে। বহু সংখ্যালঘুকে সন্ত্রাসীরা মারপিট করে। বাড়ি বাড়ি ও দোকানে গিয়ে চাঁদা দাবি করা হয়। চাঁদা না দিলে মারপিট করা হচ্ছে। এলাকা থেকে জোর করে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে । মহিলাদের সঙ্গে অশালীন আচরণ ও কটুক্তি করা হচ্ছে। এলাকায় থাকতে গেলে তাদের কথা শুনতে হবে। তাদের চাঁদা দিতে হবে বলে শাসানো হচ্ছে। এ অবস্থায় সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যদের চলাফেরা সীমিত হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসীদের ভয়ে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না। পুলিশকেও অভিযোগ করতে পারছে না। সম্ভ্রমহানীর ভয়ে অনেকে কিশোরী ও যুবতী মেয়েকে আত্মীয় স্বজনের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। ভূক্তভোগী এলাকাবাসী এ অভিযোগ করেছেন। অভিযোগে জানা যায়, গত ৪ অক্টোবর সন্ত্রাসীরা ২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রমথ নাথ রায়ের পুত্রকে বেদম মারধর করেছে। সেনাকুড় গ্রামের বিশ্বনাথ সরকারের কাছে ২৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে না পেয়ে সন্ত্রাসীরা তাঁকে বেদম মারপিট করেছে। স্থানীয় ফাঁড়ির পুলিশ তাকে সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে উদ্ধার করলেও পুলিশ এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। ঘটনার দিন রাতেই সন্ত্রাসীরা সেনাকুড় চৌরাস্তার মোড়ে অবস্থিত বিশ্বনাথ সরকারের দোকান থেকে মালামাল লুট করে দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়। সন্ত্রাসীদের ভয়ে বিশ্বনাথের পরিবারের সদস্যরা আত্মগোপন করে আছে। সন্ত্রাসীরা গাজিরহাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি অরুণ কুমার বিশ্বাস ও ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি বিপদ অধিকারীকে মারধর করেছে। বিপদ অধিকারীর একটি ঘেরের চিংড়ি লুট করে নিয়েছে। গাজীরহাটের উত্তর পাশের অমর দাসের বাড়ি থেকে একটি বকনা বাছুর ও পুকুরের মাছ জোর করে ধরে নিয়েছে। মাঝিরগাতিহাটের নিকটবর্তী অনন্ত বিশ্বাসের পরিবারের সদস্যরা সন্ত্রাসীদের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। মাঝিরগাতির গ্রামের নেপাল বিশ্বাসের ভাই কালুকে সন্ত্রাসীরা মেরেছে। গোপাল বিশ্বাসের কাছে চাঁদা চাওয়া হয়েছে। না দিলে ভারতে চলে যাওয়ার জন্য শাসানো হয়েছে। এ ছাড়াও অনেককে পিটানো হয়েছে। বহু লোকের কাছে চাঁদা দাবি করা হয়েছে। চাঁদা আদায়ও করা হয়েছে অনেকের কাছ থেকে। নানাভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েও ভূক্তভোগীরা মুখ খুলতে পারছে না। সন্ত্রাসীদের এলাকাবাসী যেমন চেনে, পুলিশের তালিকাতেও এদের অনেকের নাম রয়েছে । কিন্তু পুলিশ চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। নাটোর থেকে সংবাদদাতা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত টানা আট ঘন্টা তাণ্ডবে লালপুরের কৃষ্ণরামপুর গ্রামের সংখ্যালঘুরা হারিয়েছে সর্বস্ব । এ সময় সন্ত্রাসীরা তাদেরকে গ্রামে অবরুদ্ধ করে রাখে। লুট পাট শেষ করে সন্ত্রাসীরা চলে যাওয়ার পর তারা পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ জানায়, মোমিনপুর গ্রামের সামাদ ও রেজাউলের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কৃষ্ণরামপুর গ্রামে ব্যাপক লুটপাট ও ভাংচুর করে। রাত ৮টার পর পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায়। সংখ্যালঘুদের মারপিট, বাড়িঘর ভাংচুর, রেডিও-টেলিভিশন, চাল, ডাল, গরু, বাছুর ও নগদ টাকা সন্ত্রাসীরা লুট করে নিয়ে গেছে। সন্ত্রাসীদের মারপিটে সন্তোষ, নগেন ও প্রভাত মণ্ডলসহ আহত হয়েছে প্রায় ১০জন। বর্তমানে তারা চিকিৎসাধীন আছে। এ ব্যাপারে কৃষ্ণরামপুরের খগেন্দ্রনাথ বাদী হয়ে সামাদ ও রেজাউলসহ ১৩ জনকে আসামী করে একটি মামলা রুজু করেছেন। নরসিংদী থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, বৃহস্পতিবার বিকালে বিএনপির ক্যাডাররা মনোহরদী উপজেলার কাচিকাটা গ্রামে গোপীনাথের পুত্র নরেন নাথের বাড়িতে হামলা চালিয়ে লুটপাট ও তার স্ত্রী পুত্রসহ পরিবারের সবাইকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তারা তার পর চারটি নারিকেল, ১২টি সুপারি ও ১৬টি কাঁঠাল গাছসহ অনেক ফলের গাছ কেটে ফেলে। জেলার ৬টি উপজেলার সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হামলাসহ সদর উপজেলার পাঁচদোনা, ভাটপাড়া, পলাশ উপজেলার ভাঙ্গা ও শিবপুর উপজেলার জয়নগর, যশোর ও নোয়াদিয়া; মনোহরদি উপজেলার দৌলতপুর, চালাকচর, খিদিরপুর, রামপুর, সাগরদী, বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর, আমলাব, পোড়াদিয়া, ওয়ারী; রায়পুরা উপজেলার হাসনাবাদ, রহিমাবাদ, আদিয়াবাদ, মির্জাপুর, পিরিজকান্দি, নিলক্ষ দক্ষিণ মির্জানগর এলাকায় হামলা, নির্যাতন ও চাঁদাবাজি অব্যাহত রয়েছে। ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, নবীনগর উপজেলার ভোলাচং গ্রামে একদল সন্ত্রাসী কয়েকদিন আগে ব্যবসায়ী বাদল পালের বাড়ি দখল করে নেয়। এর পর থেকে বাদল রায় বাড়ি ছাড়া।
দৈনিক জনকণ্ঠ, ২০ অক্টোবর ২০০১