নদী যে দেশের শিরা-উপশিরা, সে দেশের অনেক মানুষ নদী দেখেনি। কথাটা শুনতে যেন কেমন লাগে। আজব শোনালেও এ কথার ভিতর এতটুকু বাড়াবাড়ি নেই। অনেকের কথা বাদ দিলেও একজন সম্বন্ধে এ কথা জোর দিয়েই বলা চলে। ইনি রাজাপুরের মীরহাবেলীর মৌলবী দাদী। ষাট বছরের ওপর বয়স হয়েছে, তিনি নদী দেখেননি। অথচ এ বাড়িরই ছেলে কামাল সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে এসেছে।
দাদীর নদী না দেখার কারণ আছে বৈকি। ছ’হাত উঁচু দেয়াল-ঘেরা এ মীরহাবেলী তাঁর বাপের বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ি। তাই কৈশোরের পর তাঁকে এ দেয়ালের বাইরে যেতে হয়নি কোন দিন। মীরহাবেলীতে মৌলবী দাদী বলে একজন আছেন, এটুকুই বাইরের লোকে জানে। তারা কেউ তাকে কখনো চোখে দেখেনি। দেখবে কেমন করে? গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তিনি ভুলেও একবার বাড়ির বৈঠকখানায় ঢোকেননি। এ বাড়িতে যারা বউ হয়ে এসেছে, পর্দার কড়াকড়িতে তাদের শ্বাসরোধ হওয়ার যোগাড়। দাদীর চোখ-রাঙানির ভয়ে মীর খানদানের পর্দার মর্যাদা এতটুকু ক্ষুন্ন করতে সাহস হয়নি কারো।
দাদীর পর্দানিষ্ঠার অনেক কাহিনী উপমা হিসেবে মোল্লা-মৌলবীরা তাঁদের ওয়াজে বয়ান করে থাকেন। গাঁয়ের লোক এসব কাহিনী শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
একদিনের ঘটনা। দাদী চুল আঁচড়াচ্ছিলেন। সেটা দাদীর কাঁচা চুলের যুগ। বিয়ে তখনো হয়নি। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে খালি মাথায় তিনি সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর চাচাত ভাই মীর আদিল ঐ অবস্থায় তাঁকে দেখে ফেলেছিলেন।
জানতে পেরে দাদী মাথা ন্যাড়া করে ফেললেন তক্ষুণি। পর-পুরুষের দেখা চুল রাখতে নেই, রাখলে প্রত্যেকটা চুল সাপ হয়ে কামড়াবে হাশরের দিন। মীর আদিলও ছিলেন একগুঁয়ে লোক। শুনে তার রোখ চেপে গেলো। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, বিয়ে ওকে করা চাই-ই চাই। বিয়ে শেষ পর্যন্ত করে তবে ছেড়েছেন তিনি। বাসর-রাতে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে স্বামীর প্রথম কথা কি ছিল, কারো জানবার কথা নয়। তবে অনুমান করা যায়, স্বামী হয়তো বলেছিলেন, -এবার দেখব কতবার মাথা ন্যাড়া করতে পার তুমি।
শোনা যায় আর একবার তাঁকে মাথা ন্যাড়া করতে হয়েছিল। টাইফয়েড হয়েছিল সেবার। সদর থেকে বড় ডাক্তার এলেন বাড়িতে। খবরটা তাঁর ঘরে দিয়ে গেল এক বাঁদি। আধা হুঁশ অবস্থায় কথাটা তাঁর কানে গেল। তিনি আচমকা উঠে বসলেন। বাদীকে হুকুম করলেন, দরজা বন্ধ কর।
বাধ্য হয়ে ডাক্তারকে ফেরত দিতে হল। তারপর এলেন মেয়ে-ডাক্তার। পরীক্ষা করে তিনি রোগ নির্ণয় করলেন। কিন্তু বিপদ এবার আরো ঘোরালো হয়ে উঠল। দাদী ডাক্তারী অষুধ খান না। ওতে কি না কি আছে, বলা যায় না তো? -হারাম জিনিস ছাড়া নাকি অষুধই হয় না। তাঁকে অনেক বোঝান হল, শিশুদের মত চামচে করে মুখে ঢেলে দেয়ার চেষ্টাও হল কয়েকবার। কিন্তু গলার ভেতরে অষুধের এক ফোঁটাও গেল না। নিরুপায় হয়ে হেকিম আনা হল। কিন্তু তাঁরও তো আবার প্রবেশ নিষেধ। ডাক্তার আর হেকিম দু’জনে আলোচনা হল। ডাক্তারের কাছ থেকে রোগের বিবরণ জেনে হেকিম দাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। রোগ সারতে অনেকদিন লাগল ।
কোনরকমে বেঁচে গেলেন সে যাত্রা। তারপর গোছায় গোছায় চুল উঠতে আরম্ভ করল। কিন্তু চুল উঠবার কারণ কি ? দাদীর সন্দেহ হল, নিশ্চয়ই বেগানা কেউ দেখে ফেলেছে যখন তার জ্ঞান ছিল না অসুখের সময়।
অষুধের মত অনেক কিছুই দাদী খান না। যেমন প্যাকেট করা বিস্কুট, কৌটোয় ভরা মাখন, লেবেল-লাগান বোতলের চাটনী, মোরব্বা, জেলী আরো কত কি! তাঁর মতে এগুলো সব বিলেতী। নাম-না-জানা চকমকে ঝলমলে নতুন কিছু হলেই সেটা বিলেতী এবং হারাম। তিনি নিজে তো খানই না, আর কারো খাওয়াও পছন্দ করেন না। একদিন কামালের ছোট ভাই জগলু চকোলেট মুখে পুরে তাঁর ঘরে গিয়েছিল। চকোলেটের রঙিন কাগজটা ওর হাতে। ওর মুখনাড়া দেখে সন্দেহ হল তাঁর।
— কিরে, কি খাস ?
— চকোলেট।
— চকোলেট। সেইটা আবার কি নিয়ামত?
নামটা অপরিচিত। সুতরাং বিলেতী না হয়ে যায় না। তিনি খপ করে জগলুর হাত ধরে ফেললেন।
— এই ফ্যাল। ফ্যালাইয়া দে ওটা। বাড়িটায় হারামখোর জুটেছে যতসব! দীন-ধর্ম আর রাখল না। ফ্যাল, ফ্যালাইয়া দে।
জগলুর মুখে তখন চকোলেটের স্বাদ জমে উঠেছে। এ অবস্থায় ওটা মুখ থেকে ফেলা তার পক্ষে অসম্ভব। সে জোর করে মুখ বুজে রইল।
দাদী ওর মুখে আঙ্গুল দিয়ে চকোলেটটা বের করে ফেলে দিলেন। জগলু হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে লাগল। কান্না শুনে কামাল এসে ওকে ঘরে নিয়ে গেল। ওর কান্না থামাতে দিতে হল দুটো চকোলেট। চকোলেট দুটো দু’গালে পুরে চলল আবার দাদীর ঘরের দিকে। এবার বাইরে থেকে দাদীর দন্তহীন মুখের পান চিবানো ভঙ্গি নকল করে ডাকলো,
—ও-ও বুড়ি, বুড়ি, খাবে ? সাথে সাথে জোরে চোঁ চোঁ করে চুষতে লাগল চকোলেট নির্ভয়ে। পাঁচ বছরের জগলুও জানে দাদীর দৌড় ঐ দোরগোড়া পর্যন্তই।
মীর-গৃহে গৃহ-বিবাদ হয়েছে অনেকবার। এই বিবাদকে দাদী বলেন জেহাদ। জেহাদ হয়েছে ছেলেদের ইংরেজি পড়া নিয়ে, গ্রামোফোন-রেডিও বাজানো আর দেয়ালে ছবি টাঙ্গানো নিয়ে। দাদী তাঁর দলবল নিয়ে বাধা দিতেন। সুবিধে না হলে কথা বন্ধ বা কখনো কখনো দরজা বন্ধ আন্দোলন শুরু করতেন। দাদী বাড়ির মেয়ে মহলের একচ্ছত্র নেত্রী। বাড়ির মেয়েরা তাঁকে ভয় করে, ভক্তি করে। তাঁর নেত্রীত্বের ওপরে তাদের আস্থা অসীম, অটল। পুরাতন দিনের রীতি-নীতি আচার-আচরণ তিনি সদলবলে আঁকড়ির মত ধরে আছেন। তাঁর মতে পুরোনো সবকিছুই ভালো। তিনি প্রায়ই আক্ষেপ করে বলেন,
—সেই সোনার দিন কি আর আসবে ? সেই দিনই নাই, দুনিয়াও নাই। সব পাপে ছাইয়া গেছে। দুনিয়াদারী শেষ হইয়া আসছে। কিয়ামতের আর দেরি নাই।
দাদী অনেক জেহাদ ফতে করেছেন। মদিনা মনওয়ারা ও কাবাশরীফের তসবীর ছাড়া মীরহাবেলীর কোন দেয়ালে একখানা ছবি খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছবির ওপর চোখ পড়লে নাকি ওজু নষ্ট হয়। তাঁর ভয়ে হাবেলীর চৌসীমানার মধ্যে কেউ রেডিও গ্রামোফোন বাজাতে সাহস করে নি কোনদিন। তাঁর এক নাতি আলমগীর একটা রেডিও কিনে এনেছিল। দাদীর ফৌজের হাতে সেটার দফা ঠাণ্ডা হয়েছিল আর একটু হলেই। আলমগীর রেডিওটা মাথায় নিয়ে দে দৌড়। হাঁপাতে হাঁপাতে সে ক্লাবঘরে গিয়ে উঠেছিল। হাবেলী থেকে অনেক দূরে ক্লাবঘর। সেখানেই এখন রেডিও বাজে।
একবার মেঘের জন্যে ঈদের চাঁদ দেখা গেল না। রেডিওর ঘোষণা শোনা গেল— বোম্বাইয়ে চাঁদ দেখা গেছে, কাল ঈদ।।
খবর শুনে দাদী বললেন,—কাল ঈদ! তোমরা চাঁন দেখছ?
– না।
– তবে?
– বোম্বাইতে চান দেখা গেছে। রেডিওতে খবর আসছে।
– রেডুতে! না রেডু-ফেডুর খবর মানি না। রেডু হইল শয়তানের কল। ওর মইদ্যে শয়তান বইসা বইসা কথা কয়। শয়তানই এই খবর দিছে ইনসানকে দাগা দিবার জন্য।
মীরহাবেলীতে ঈদ হল ঈদের পরের দিন।
মীরহাবেলীর মেয়েদের ইংরেজি তো দূরের কথা, বাঙলা পড়বারও অধিকার ছিল না। মৌলবী দাদীর ফতোয়া লঙ্ঘন করে কার এমন বুকের পাটা! তাঁর মতে ওগুলো সব কুফরী এলেম। আরবী অক্ষর চিনে কোরান শরীফ পড়তে পারলেই যথেষ্ট। অর্থ বুঝবার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে তার ফতোয়া শোনা যায় নি কখনো। তবে মেয়েদের এভাবে তোতার বুলি শেখালেও ছেলেদের তিনি মাদ্রাসায় পাঠাতে পারেন নি। মেয়েদের চার দেয়ালের মাঝে বন্দী করে রাখলেও ছেলেরা বেরিয়েই পড়েছিল। তাঁর পুতের ঘরের নাতি কামাল তো বিলেতই ঘুরে এল।
বিলেত যাওয়ার দিন দাদীর কাছ থেকে বিদায় নিতে পারে নি কামাল। দাদী সেদিন তার ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল না, কামাল বিলেত যায়। বিলেতী জিনিসের ওপর যার এত বিদ্বেষ, বিলেতের ওপর তার মনোভাব যে কেমন হবে, সহজেই বোঝা যায়।
বিলেত থেকে এসেও যে দাদীর সাক্ষাৎ পাবে, ভরসা ছিল না কামালের। সে দাদীর ঘরের সিড়িতে এসে দাঁড়ায়। সুমুখে বাঁদীকে পেয়ে বলে,—মধুর মা, দাদীকে বলোগে, তাঁর সাথে দেখা করতে চাই।
দাদীর সাথে দেখা করতে নাতিদেরও অনুমতি নিতে হয়।
দাদী বসে বসে তসবীহ্ জপছিলেন। মধুর মা এসে খবর দেয়,-বড় আম্মা, মাইজ্যা সাবের বড় পোলা আপনার লগে দ্যাখা করতে আইছে।
— কে? কামাল? তুই কারে দেইখা কার কথা কইতে আছস?
— উঁহু, আপনে দেখেন গিয়া।
— দুও বেটি। সেই দিন তো মাত্র ওর চিঠি আসলো। বিলাত কি আর দুই-চার মাসের পথ! মক্কাশরীফ যাইতে তো ছয় মাস লাগে।
দাদী আর তাঁর সেজবউ-এর মধ্যে কথা হচ্ছিল একদিন। দাদী বলেছিলেন,— মক্কাশরীফ যাইতে ছয় মাস লাগে। সেজবউ বলেছিলেন, আমার বাবা আমগাছে বোল দেখে মক্কাশরীফ যাত্রা করেছিলেন, আবার হজ করে এসে বোশখী খেয়েছেন।
দাদী বলেছিলেন, বিশ্বাস করি না। তোমার বাবা বৈশাখী খাওয়ার লেইগ্যা আধা পতের থিকা ফিরা আসছিলেন।
মধুর মা তাগিদ দেয়,
— তারে আসতে কইমু, বড় আম্মা?
— না, আগে নাম জিগাইয়া আয়।
মধুর মা নাম জিজ্ঞেস করে আসে। শুনে আশ্চর্য হন দাদী! তিনি তসবীহ হাতে দাঁড়ান। দরজা বন্ধ করতেই এগিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু দেখেন পাজামা-শেরওয়ানী পরে, টুপি মাথায় দিয়ে কামাল দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর স্বামী মীর আদিল এ পোশাক পরেই চলাফেরা করতেন। দরজা আর বন্ধ হল না। তিনি এগিয়ে গিয়ে ডাকলেন,—কামাল, আয় ঘরে আয়।
ঘরে ঢুকতেই দাদী বলেন,—কি রে একা যে, মেমসাব কই ? আমি তো ভাবছিলাম—
নতজানু হয়ে কদমবুসি করায় তাঁর কথায় বাধা পড়ে।
— থাউক, থাউক লাগব না আর। বাঁইচ্যা থাক। খোদায় বাঁচাইয়া রাখুক। তার ঘরে গিয়ে বসে কামাল। তার আম্মা, চাচীআম্মা, আরো অনেকে এলেন।
দাদী বলেন,—এত তাড়াতাড়ি ক্যামনে আসলি ? এই তো মাত্র ছয়-সাত দিন আগে তোর চিঠি পইড়া শোনাইল তোর আব্বাজান।
— ঐ দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তাই উড়ে এলাম প্লেনে- উড়ো জাহাজে।
তড়াক করে দাদীর মাথার ভেতর যেন ঘুরপাক শুরু হয়ে গেল । ওপর থেকে ঘুরতে ঘুরতে নিচে পড়ে যাচ্ছেন, এমনি একটা ভাব। একটু সামলে নিয়ে বলেন,—মাগো মা, উড়োজাহাজ! ডর করল না? আমার তো ভাই দোতলার তন্ নিচে মাটির দিগে চাইলে কলিজা কাইপা ওঠে। মাথার মধ্যে ভোঁ-ভোঁ ভোমরা ডাকতে থাকে। তখন আর খাড়া থাকতে পারি না।
— আপনাদের তো ওরকমই। দুনিয়ার কিছু দেখলেন না, কিছু শিখলেন না। জানেন দাদীআম্মা, ওদেশের মেয়েরা উড়ো জাহাজ চালায়।
দাদীর সাথে এভাবে কথা বলতে ভালো লাগে কামালের। তাঁর উত্তর শুনে হাসি আসে, আমোদ পাওয়া যায় ।
— ওই সব বে-দীন আওরতের কথা কইস না আমার কাছে। ওদের তো আর আল্লা খোদা নাই—মইরা গেলে ফেরেশতারা যখন গুর্জু দিয়া পিটাইব, তখন বুঝব কেমন মজা।
— কেন? তুরস্কের মেয়েরা তো মুসলমান। তারাও তো আজকাল উড়োজাহাজ চালায়।
অবাক হয়ে শুনছিলেন দাদী। ভাগ্যিস তিনি খবর রাখেন না। খবর রাখলে নিশ্চয়ই বলতেন,—সেই জন্যেই তো খোদার গজব নাজিল হইছে, ভূইকম্পে রসাতল কইরা নিয়া আই দেশটারে।
আশ্চর্যের ভাবটা কেটে গেলে দাদী বলেন,—খোদার সঙ্গে কি রকম আড়ি লাগাইছে, দ্যাখো। মানুষ আসমানে উড়তে যাইব ক্যান্? আসমানে উড়বার জন্যে খোদা পক্ষী পয়দা করছেন, তার পাখনা লাগাইয়া দিছেন।
কামালের মা বলেন,—কতই শোনলাম, আর কতই শোনতে হইব! ছবিতে নাকি আবার কথা কয়! কি সব শেরেকী কারবার। কিন্তু আমি কই, কথা কওয়াইলে কি হইব? রুহু তো আর দিতে পারে না। খোদার লগে আড়ি দিলেই হইল!
মৌলবী দাদী নদী দেখেন নি। এবার নদীই এসেছে তাঁর কাছে দর্শন দিতে। দু’মাইল দূরে ছিল যে পদ্মা, ভাঙতে ভাঙতে সে এখন মীর হাবেলীর কাছাকাছি এসে গেছে। সরীসৃপের মত বুকে হেঁটে ক্রমেই এগিয়ে আসছে। দু’শো বছরের পুরাতন জরাজীর্ণ হাবেলী পদ্মার শোঁ-শোঁ আওয়াজ শুনে কাঁপছে থরথর করে।
নদীর উত্তর পারে বাড়ি ঠিক হয়েছে। সেখানে রাতারাতি টিনের ঘর ওঠে গেছে কয়েকটা। মীরহাবেলীর লোকজন নৌকা করে নতুন বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে।
দাদীর যাবার সময় হয়েছে। পালকি আসে তাঁর ঘরের দরজায়। তিনি উঠলে পালকির দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। অল্প দূরে নদী। পালকি এনে নামান হয় পানসিতে, পালকি আর পানসির দরজা এক করে দাদী নৌকার খোপে ঢোকেন। দরজা বন্ধ হয়।
ভাদ্র মাস। পদ্মা অসম্ভব ফুলে উঠেছে। দুই পার ডুবে যাওয়ায় ধু-ধু দেখা যায় অন্য পার। দাদী তাঁর ঘোলাটে বুড়ো চোখ মেলে তাকান খিড়কির পর্দা ফাঁক করে। ভয় ও বিস্ময়ের ছাপ তার চোখে মুখে। বলেন,—এত পানি! খোদার কি কুদরত! এত পানি কোনখান থিকা আসে, আবার কোথায় যায়, খোদা ছাড়া কেউ জানে না।
সেদিন তেমন হাওয়া ছিল না। পানসিখানা এগিয়ে চলছে মৃদু ঢেউএর তালে তালে। আশেপাশে ইলিশ মাছ ধরার ছোট ছোট নৌকাগুলো দোল খাচ্ছে অবিরাম।
দাদী আর চাইতে পারেন না। তাঁর মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
ওয়াক—ও—ওয়াক!
কামাল ছৈ-এর বাইরে ছিল। শব্দ শুনে সে খোপের ভেতর যায়।
—এ কি! দাদী বমি করে দিয়েছেন!
সমুদ্রপীড়া সম্বন্ধে কামালের অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু নদীতে এ রকম হয়, সে শোনে নি তো! আর ঢেউও তো তেমন নেই এখন। দাদীকে তাড়াতাড়ি ধরে শুইয়ে দিতে দিতে আরো বার দুই বমি হয়। তাঁর অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায় কামাল। নৌকা জোরে চালাবার জন্যে সে মাঝিদের তাড়া দেয়।
কামাল পাখা করতে থাকে, আর দাদীর তুলোর মত সাদা চুলের মাঝে আঙুল চালায় বাঁদী।
আরো বার কয়েক বমি করেন দাদী। ভোরে যা খেয়ে বেরিয়েছিলেন, সবই যায় বেরিয়ে । অ-চিবানো আস্ত ভাতগুলো বিছানায় পড়ে ঘিন ঘিন্ করতে থাকে।
ওপারের ঘাটে পানসি ভিড়ে। কোন রকমে তাঁকে পালকিতে তুলে নতুন বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। ধরাধরি করে যখন তাঁকে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হয়, তখন তার হুশ নেই।
দাদীর নদীদর্শন এখানেই শেষ হয়। কিন্তু এ নদীদর্শনই কাল হয় তাঁর। ঐ দিনই আছরের নামাজের পর দাদী ইন্তেকাল করেন।
নারায়ণগঞ্জ