সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত ‘জাগো মানুষ’ শীর্ষক সম্প্রীতি সমাবেশে উপস্থিত জনতা সাম্প্রদায়িক পাশবিকতার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছে। দেশ বরেণ্য শিল্পী সাহিতি ̈কদের অংশগ্রহণে বৃহস্পতিবার বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে ধ্বনিত হয়েছে ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলিম, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রীস্টান, আমরা সবাই বাঙ্গালী’ শ্লোগান। সম্প্রীতি সমাবেশে বত্তৃতা, গান, কবিতা ও নাটকের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানো হয়। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সমাবেশে বলেন, হাজার বছরের বাঙালী ঐতিহ্য হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে থাকা। এই ঐতিহ্য আমাদের গর্ব। আমাদের এই গর্ব মাঝেমধ্য ধুলিস্যাৎ হয়েছে। তবে এবারের মতো কখনই হয়নি। কবীর চৌধুরী বলেন, আগেকার নির্যাতনের চেয়ে এবারের নির্যাতনের মাত্রা অনেক বেশী ও ভিন্নতর। আজ মন্ত্রীরা হেলিকপ্টারে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু নির্যাতন দেখছেন না। একটা অকল্পনীয় অবস্থার মধ্যে আমরা বাস করছি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান কোটালীপাড়ার রামশীলে গিয়ে তাঁর সরেজমিন দেখে আসার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, সহজে কেউ নিজের বাড়িঘর ছেড়ে অচেনা-অজানা জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নেয় না। তিনি বলেন, এই অমানবিকতা প্রশ্রয় পেলে আমরা বিশ্বে মুখ দেখাতে পারব না। এ পর্যন্ত প্রশাসনের গৃহীত পদক্ষেপ নিন্দনীয়। প্রশাসন স্বীকারই করছে না যে নির্যাতন হয়েছে এবং হচ্ছে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে তাদের পূনর্বাসন, ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান। সমাবেশে সূচনা বত্তৃতা করেন গোলাম কুদ্দুস। কবিতা আবৃত্তি করেন মোহাম্মদ রফিক, মোহাম্মদ সামাদ, রামেন্দু মজুমদার, সঙ্গীত পরিবেশন করেন অজয় রায়, ফকির আলমগীর ও রথীন্দ্রনাথ রায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দেন সাংবাদিক রাজিব নুর ও কৈলাস সরকার। সমাবেশে ঘোষণা পাঠ করেন সারা যাকের। ঘোষণায় বলা হয়, ক্ষুদ্ধ ও ব্যথিত চিত্তে বাংলাদেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষ লক্ষ্য করছে, মুষ্টিমেয় কিছু সন্ত্রাসী ও বিপথগামী লোকের দ্বারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব, বিশেষ ধর্মগোষ্ঠির সদস্যদের ওপর ঢালাও হামলা, বলপূর্বক অর্থ আদায়, বেদখল, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, শারীরিক হামলা থেকে শুরু করে নারী ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ ব্যাপকভাবে সংঘটিত হচ্ছে। দেশের এক বিপুল সংখ্যক জীবন তছনছ হয়ে গেছে, উৎসব-আনন্দে নেমে এসেছে বিষাদের কালো ছায়া। কোন জাতির নৈতিক মান প্রকাশ পায় সে দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির প্রতি অনুসৃত আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে। সেই বিবেচনায় সাম্প্রতিক সহিংসতা জাতি হিসাবে, দেশ হিসাবে আমাদের কলঙ্কিত করেছে। মানবতার এই অবমাননা দেশকে ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যাবে। তাই আমরা তা নীরবে মেনে নিতে পারি না। সম্প্রীতির আদর্শকে পদদলিত করে পীড়ন ও সংঘাতের যে মনোভাব সাম্প্রদায়িকতা লালন করে তার ফলে কলুষিত হয় গোটা সমাজমানস। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতি ধিক্কার উচ্চারণ করে তা রুখে না দাঁড়ালে গোটা জাতির মানস বিকৃত হবে এবং পরিণামে তা সুস্থ-সুন্দর- স্বাভাবিক জীবন গঠনের প্রয়াস বিনষ্ট করবে। আধুনিক মানবতাবাদী রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণের সকল প্রয়াস মুখথুবড়ে পড়বে যদি আমরা মানবতার শক্তিতে সাম্প্রদায়িক পাশবিকতা রুখে না দাঁড়াই। হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতি মিলনে-মিশ্রণে-বৈচিত্রে ̈-বিপুলতায় সমৃদ্ধ হয়ে বহমান রয়েছে। সম্পীতি ও সৌহার চেতনায় পুষ্ট সংস্কৃতির এই মূল আদর্শকে আঘাত করে সাম্প্রদায়িকতা। তাই আমরা শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীরা দেশবাসীর সঙ্গে মিলে বিপন্ন মানবতা রক্ষার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি। সাম্প্রদায়িক বর্বরতার বিরুদ্ধে জেগে ওঠা মানুষের দলমত, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে গড়ে তুলবে সম্মিলিত প্রতিরোধ, সম্প্রীতি ও মানবতার শক্তি জোরদার করে বিকশিত হবে সুস্থ সমাজ। আজকের দুর্গত পরিস্থিতিতে সেই প্রত্যয় আমরা পুনর্ব্যক্ত করছি। সম্প্রীতি সমাবেশের আয়োজনে সহযোগী উদ্যেক্তা সংগঠন হিসাবে ছিল বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ ও বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ।
দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৬ অক্টোবর ২০০১