নির্বাচন-পরবর্তীকালে দেশব্যাপী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যে ‘বিরামহীন নিষ্ঠুর নির্যাতন’ চলছে তারই এক জলন্ত দৃষ্টান্ত রাজশাহীর দুর্গাপুরের আলোচিত ঝালুকা গ্রামের শত বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক দশরথ চন্দ্র কবিরাজ। তার চোখ-মুখে হতাশা আর আতঙ্কের ছাপ থাকলেও মনের জোরের এতটুকুও কমতি নেই। সন্ত্রাসীদের হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও রক্তচক্ষুর কোন তোয়াক্কা না করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে শুয়ে তিনি গতকাল (মঙ্গলবার) দুপুরে এই প্রতিনিধির কাছে জানালেন তার ওপর বিএনপির সন্ত্রাসীদের বর্বর নির্যাতনের কাহিনী। নির্যাতন নিষ্ঠুরতার ভয়াবহতা শুনে সেখানে উপস্থিত শতাধিক লোকের চোখে জল দেখা যায়। তার ছেলে ও নাতিসহ সাতটি পরিবারের ৩১ জন সদস্য এখনও নিজ বাড়িতে যেতে পারেননি। তারা সকলেই বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। শ্রবণ প্রতিবন্ধী দশরথ চন্দ্র কবিরাজ একটি চিরকুটে লিখে জানান, শুক্রবার রাতে বিএনপির লোকমানের বাড়িতে বিএনপি কর্মী-সমর্থকদের এক বৈঠক হয়। সেখানেই দশরথ চন্দ্রের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নেয় সন্ত্রাসীরা। এরপর রাত আনুমানিক দু’টার দিকে বিএনপির আয়েজউদ্দিনের ছেলে জেকের, মজিবর রহমান ও আইয়ুব, হারু মোহাম্মদের ছেলে তামিজউদ্দিন, জেকেরের ছেলে কামাল, রফিকুল ও নজরুল, মুনশেরের পুত্র হাবিবুর, কায়েমউদ্দিনের পুত্র মনির ও নজরুল সহ ২০/২৫ জন সন্ত্রাসী দশরথের বাড়িতে এসে হানা দেয়। তারা প্রথমে দশরথের কাছে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। সন্ত্রাসীদের কথা⎯এখানে থাকতে হলে তাদেরকে ২০ হাজার টাকা দিতে হবে। টাকা দিতে অস্বীকার করলে জেকের ও তমিজ অন্যদের নির্দেশ দেয় শালাকে (দশরথকে) শেষ কর। এই নির্দেশ পাওয়া মাত্র সন্ত্রাসীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে দশরথের ওপর। তারা এলোপাতাড়ি তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে কোপাতে থাকে। এক পর্যায়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সন্ত্রাসীদের ধারণা ছিল দশরথ আর বেঁচে নেই। এসময় তারা দশরথের স্ত্রী লক্ষী রানীকেও মারধর করে পালিয়ে যায়। পরে তাদেরই একজন গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের খবর দেয়, দশরথকে শেষ করে দেয়া হয়েছে। তারাই আশঙ্কাজনক অবস্থায় দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে তাকে নিয়ে যায় ২৭ অক্টোবর ভোরে। তার অবস্থার অবনতি হতে থাকলে ঐদিন তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, দশরথ চন্দ্র কবিরাজের অবস্থা এখনও শঙ্কামুক্ত নয়। তার ফুসফুসে বড়রকমের আঘাত রয়েছে। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। গতকাল দশরথ হাউ-মাউ করে কাদঁতে-কাদঁতে বললেন, বাবা আমি কি বাঁচব, আমরা কি এদেশে থাকতে পারব? সরকারের কাছে কোন দাবি নেই। দাবি শুধু একটাই তা হলো⎯আমরা যাতে ঘর-বাড়ি সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যেতে পারি তার ব্যবস্থা করুক। ঝালুকাতেই থাকব তবে সেখানে নয়। তিনি জানান, তিনশ বছর ধরে আমার বাপ-দাদারা এদেশে বাস করে আসছে। কাজেই তাদের স্মৃতি বিজড়িত এই মাটি ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না। কেন হামলা করলো সন্ত্রাসীরা প্রশ্ন করলে অকপট জানিয়ে দিলেন, আমরা আওয়ামী লীগ করি এবং নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছি বলে এই হামলা চালিয়েছে। সরকারের কাছে কি চান প্রশ্ন করলে ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, সরকারের কাছে কিছুই চাই না। কারণ যে সরকার আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না, সে সরকারের কাছে কি চাইব। হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে আমরা খুশি। দশরথের নাতি দীপক জানালেন, বিএনপি সমর্থকরা নির্বাচনের পর থেকেই তাদেরকে দেড় লাখ টাকার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। না দেয়ায় তারা হামলা চালালে সাতটি পরিবার বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। ফাঁকা বাড়িতে বিএনপির সন্ত্রাসীরা মনের সুখে লুটপাট চালায়। ধান-চাল, পাট, স্বর্ণালংকার, নগদ টাকা, ডাব ও ওল লুট করে। প্রশাসন ও বিএনপির লোকজন নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে দশরথ ও তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনে গ্রামে। এরপর তাদেরকে বিএনপির সমর্থকরা গৃহবন্দী করে রাখে একটানা কুঁড়ি দিন। এরই মধ্যে গত শুক্রবারের নিষ্ঠুর হামলা চালানো হয়। দশরথের পুত্র দীনেশ, যোগেশ, অজিত, সুকুমার, দীলিপ, নাতি দীপক ও দশরথের পরিবার এখন বাড়ি ছাড়া। লোক মারফত প্রতিদিনই হুমকি দেয়া হচ্ছে তাদেরকে আর ঝালুকাতে থাকতে দেয়া হবে না।
সংবাদ, ৩০ অক্টোবর ২০০১