সুদীর্ঘ ৫৪ বছর পর দিনাজপুরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আবারও বর্বরোচিত হামলা শুরু হয়েছে। অনেক বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তির মন্তব্য, ’৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময়ও সংখ্যালঘুদের ওপর এমন হামলা হয়নি। একটি দলের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা নির্বাচনের নামে অ্যাকশন কর্মসূচি ঘোষণা করায় ভোটের আগের রাত থেকেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিরলে এক গৃহবধুর শালীনতাহানি এবং অনেক নারী ও শিশু হামলার শিকার হয়েছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকে প্রাণভয়ে ভারতে চলে গেছেন। যারা রয়েছেন তারাও খুবই নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। অধিকাংশ বাড়ির যুবতী মেয়ে ও গৃহবধুদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখা হয়েছে। তরুন ও যুবকরাও রয়েছে ঘরছাড়া। শনিবার জনকন্ঠের প্রতিনিধিসহ একদল সাংবাদিক দিনাজপুরের বিরল ও বোচাগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে নির্যাতনের বিভিন্ন তথ্য জানতে পারেন। এসব গ্রামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়িঘরে হামলা ও শারীরিকভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে। এসব গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠেছে। ৯নং ইউপির মহিলা মেম্বার কুমদিনী রায় অভিযোগ করেছেন, কছিমুদ্দিন আহমেদের ছেলে সালামের নেতৃত্বে ভোটের আগের দিন রবিবার রাত ১টার দিকে ৩’শ থেকে ৪’শ সন্ত্রাসী শিকারপুর গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে হামলা করে। তিনি জানান, যেন’৭১-এর মত বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। হামলাকারীরা ৪টি ককটেল নিক্ষেপ করলে বিকট শব্দে তিনটির বিস্ফোরন ঘটে, ১টি বিস্ফোরিত হয়নি। তা তারা কুড়িয়ে পেয়েছে। শিলাবৃষ্টির মত পাথর নিক্ষেপ করা হয়। এখানে তাকেও মারধর করা হয়। তা ছাড়া আরও কয়েকজন গৃহবধু ও তরুণীকে লাঞ্চিত করা হয়। এখন এ গ্রামের যুবতী মেয়ে ও গৃহবধুদের অন্যত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখা হয়েছে। গ্রামবাসী জানায়, নির্বাচনের আগে শনিবার রাত ৯টার দিকে ৪/৫টি মোটরসাইকেল নিয়ে মুখোশ পরা কয়েকটি যুবক তাদের গ্রামে এসে ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য বলে। ‘ যদি ভোট দিতে যাস তাহলে তোদের অবস্থা খারাপ করে দেয়া হবে’ হুমকি প্রদর্শন করে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে চলে যায়। কুলীন চন্দ্র রায় নামে এক ব্যক্তি জানায়, মঙ্গলবার রাতে ধনগ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে হামলার সময় সন্ত্রাসীরা তার স্ত্রী মালা রানীর (২৫) শালীনতাহানি করে। ঘটনার পর মালা বাড়ি ছেড়ে ভয়ে অন্যত্র চলে গেছে। একই গ্রামে গীতা রানী নামে এক গৃহবধুর পরনের কাপড়চোপড় খুলে বিবস্ত্র করার অভিযোগ করা হয়েছে। শিকারপুর গ্রামের সমারু(৫০), চম্পা, মহেশ, নরেন্দ্রনাথ রায়, পাথারু, স্বপন, ধনগ্রামের সলিল এখনও নিখোঁজ রয়েছে। এসব গ্রামের বয়স্ক মহিলারা জানায়, তারা গত ৪দিন ধরে রাতের বেলায় হামলার ভয়ে বাচ্চাদের নিয়ে ধানক্ষেতে পানিতে বসে রাত কাটাচ্ছে। যুবতী মেয়ে ও বৌদের তারা অন্যত্র নিরাপদ স্থানে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। অনেকে ভয়ে গ্রাম ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে। এসব গ্রামে এখন সর্বত্র চলছে আতঙ্ক। এদিকে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দিনাজপুর প্রেসক্লাবে সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও দিনাজপুর-২ (বিরল-বোচাগঞ্জ) আওয়ামী লীগ প্রার্থী সতীশ চন্দ্র রায় এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, ৪ দলীয় জোট তথা বিএনপির প্রার্থী লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান তার সন্ত্রাসীবাহিনী ও ভাড়াটে মস্তান নিয়ে সমগ্র আসনের নির্বাচনী এলাকায় সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে । এছাড়াও বিরল উপজেলার ৯নং ইউপি চেয়ারম্যান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী কছিম উদ্দিন শুকু ও তার ছেলেদের সন্ত্রাসী দল প্রকাশ্যে বেআইনি অস্ত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ৯নং ইউপির মঙ্গলপুর, বাহারীগ্রাম, শীষগ্রাম, শিকারপুর, হরিশচন্দ্রপুর ও নশুগ্রাম, ১০ নং ইউপি বিএনপি প্রার্থী মাহবুবুর রহমানের নিজগ্রাম জগৎপুর, ৮নং ইউপির ধর্মপুর, ধর্মজাইনসহ বোচাগঞ্জ উপজেলার মোল্লাপাড়া, নেহালগাঁওসহ বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু ভোটারদের অস্ত্রের মুখে নির্বাচনী কেন্দ্রে আসতে বাধা প্রদান করে। এ ব্যাপারে তিনি স্থানীয় প্রশাসনকে জানানোর পরও তারা কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
দৈনিক জনকন্ঠ, ৮ অক্টোবর ২০০১