Site icon অবিশ্বাস

নগরকান্দায় এক সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর হামলা ’৭১-এর ঘটনাকেও হার মানিয়েছে

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনারা গুলি করে মেরেছিল যে নিতাই মণ্ডলকে, তাঁরই সন্তানের ওপর ত্রিশ বছর পর নির্মম হামলা হয়েছে এবার। হামলাকারীদের ধাওয়ায় শহীদ নিতাইয়ের দুই পুত্র সঞ্জিত ও নিরঞ্জন পালিয়ে বাঁচলেও সঞ্জিতের স্কুল পড়ুয়া পুত্র সুজন মারপিটে আহত হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি ও মৌলবাদী চক্রে সন্ত্রাসীরা বাড়ির লোকজনকে প্রাণে মারতে না পারলেও দেড় ঘন্টাব্যাপী ভাংচুর-লুটপাটের মাধ্যেমে ৭ লক্ষাধিক টাকা মূল্যের সম্পদ ধ্বংস করে সংখ্যালঘু পরিবারটিকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। এমনকি বাড়িটি সম্পূর্ণরূপে ভাংচুর করে বসবাস অনুপযোগী করে ফেলায় ঘটনার চারদিন পরেও আতঙ্কিত পরিবারটি মানবেতর জীবনযাপন করছে অন্যের ওপর নির্ভর করে। ঘটনাটি ঘটে গত ৯ অক্টোবর ভোরে নগরকান্দা উপজেলার তালমা ইউনিয়নের বড় মানিকদী গ্রামে। বাড়ির বর্তমান গৃহকর্তা রঞ্জিত কুমার মণ্ডল ভাঙা কেএম কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক। হৃদরোগী রঞ্জিত স্ত্রী, পুত্র, কণ্যা নিয়ে ভাঙ্গা উপজেলা সদরে বসবাস করেন। তার দুই ভাই সঞ্জিত, নিরঞ্জন, বিধবা মাতা রেনু বালা মণ্ডল এবং জ্ঞাতি সুভাষ মণ্ডল, ননী মণ্ডলের পরিবার পরিজন মিলে ২১ জন বড় মানিকদী গ্রামে থাকেন। ঘটনার ব্যাপারে গত বুধবার ১০ অক্টোবর এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শনকালে জানা যায়, আগের দিন মঙ্গলবার ভোর সাতটায় পার্শ্ববর্তী শাকপালদিয়া গ্রামে হামলাকারীরা তিন দিক থেকে এক যোগে হামলা চালায়। হামলাকারীরা ঢাল, কাতরা, শাবলসহ মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত হয়ে আক্রমণ করার সময় সঞ্জিত ও তাঁর পুত্র নবম শ্রেনীর ছাত্র সুজন কুমার মণ্ডল (১৪), নিরঞ্জন কুমার মণ্ডলসহ আশপাশের কয়েকজন প্রতিবেশীকে হত্যার উদ্দেশে ধাওয়া করে। বাকিরা কোনমতে পাশের বিল-চক-ধানক্ষেত দিয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে বাঁচলেও হামলাকারীরা সুজনকে ধরে নির্মমভাবে পিটায়। তালমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফিরোজ খানের নেপথ্য ইন্ধনে এ হামলা হয় বলে এলাকাবাসী জানায়। ক্ষতিগ্রস্তরা আতঙ্কে হামলার নেতৃত্বদানকারীদের নাম বলতে সাহস পায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, শাকপালদিয়া গ্রামের চান মিয়া, ইউসুফ মোল্লা, ফিরোজ খানের ভাই রহমান খা, কুটি খা, ভাতিজা কেটু খা, এবং মানিকদী গ্রামের দবিরউদ্দিন মোল্লা, রাজ্জাক ভূইয়া প্রমুখ হামলায় নেতৃত্ব দেয়। দেড় ঘন্টাব্যপী হামলাকালে সন্ত্রাসীরা ১৬০ মন ধান, ৫ মন মুসরি, শ্যালো মেশিন, ৪০ মন পেঁয়াজ, ৩৪ কেজি পেঁয়াজের দানা, ৭ ভরি স্বর্ণালঙ্কার লুট করে। এদের ভয়ে ৪০ হাজার টাকা মূল্যের দুটি গরু পাশের মাঠে বেঁধে রাখা হয়েছিল। হামলাকরীরা টের পেয়ে গরু দুটি নিয়ে শাকপালদিয়া গ্রামে গিয়ে জবাই করে খেয়ে ফেলে। সবচেয়ে মর্মান্তিক যেটি সেটি হচ্ছে, রঞ্জিত মণ্ডল চিকিৎসার জন্যে ভারত যাবার উদ্দেশ্যে বাড়িতে টাকা চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। এ বাড়ির লোকজন আগের দিন ধান, পিঁয়াজ বিক্রি করে এক লাখ টাকা রেখেছিল। হামলাকারীরা সে টাকাও নিয়ে যাওয়ায় মরণাপন্ন রঞ্জিত মণ্ডলের চিকিৎসায় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কেন এই বর্বরতম হামলা-এর জবাবে লোকজন জানায়, নৌকায় ভোটদানের অপরাধে এ নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। শনিবার এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার গুলো অন্যের বাড়িতে চেয়েচিন্তে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। বুধবার জেলা প্রশাসক ও উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাবৃন্দ এলাকা পরিদর্শন করেন। তিন উপজেলার পুলিশ এলাকা ঘিরে রেখেছে। পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৯ জনকে আটক এবং লুটকত কিছু মালামাল উদ্ধার করেছে। তা সত্বেও আতঙ্কিত এলাকার সংখ্যালঘুরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় বসবাস করছে।

দৈনিক জনকন্ঠ, ১৫ অক্টোবর ২০০১

Exit mobile version