এই প্রবন্ধটি ড. পৃথ্বিলা নাজনীন নীলিমা সম্পাদিত ও আগামী প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত ‘আহমদ শরীফ রচনাবলী ৭ম খণ্ড’তে অন্তর্ভূক্ত আছে। প্রবন্ধে লেখকের ব্যক্তিগত চিন্তা ও ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের মনে হয়েছে ১৯৯৩ সালে রচিত এই প্রবন্ধের সাথে ২০১৯ সালের নাস্তিকদের চিন্তার কতটুকু বৈপরিত্য সৃষ্টি হয়েছে, তা মূল্যায়নের জন্য লেখাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নাস্তিকতার চর্চা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বেশি সক্রিয়তা লাভ করেছে। -সম্পাদক
নাস্তিকের জীবনচেতনা আছে, জগৎভাবনা আছে, ধর্মচিন্তা নেই। নাস্তিকের অবশ্য ধর্ম সম্বন্ধে চিন্তা আছে। ‘নাস্তিক’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অভিধা হচ্ছে ‘বেদের অপৌরুষেয়তায় আস্থাহীন’ অর্থাৎ যে বেদকে আসমানী বাণীরূপে মানে না, সেই নাস্তিক। এখন শব্দটি অর্থান্তর লাভ করেছে। এখন নিরীশ্বরকেই নাস্তিক বলা হয়, যারা নাস্তিক তারা শাস্ত্রের সত্যতায় আস্থা রাখে না। তাদের মতে ঈশ্বর যদি এক এবং চিরন্তন হন, তাহলে তিনি জনবহুল য়ুরোপে, আফ্রিকার কালো মানুষের মধ্যে, আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের কাছে কিংবা চীন-জাপান-অস্ট্রেলিয়া-নিউগিনিতে নবী-অবতার পাঠাননি কেন, কেবল পুরোনো কেনান তথা আধুনিক ইজরাইল থেকে সুয়েজ অবধি একটা বিরল বসতি অঞ্চলে এবং ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যেই শুধু এক লক্ষ চব্বিশ/চল্লিশ কিংবা দুইলক্ষ চব্বিশ/চল্লিশজন নবী পাঠালেন কেন? ভারতেই কৃর্ম বরাহ নৃসিংহ ও রামকৃষ্ণকে পাঠালেন কেন? মানুষের কাছে ঈশ্বরই যদি তাদের হিতার্থে আদেশ-নির্দেশ পাঠাতেন, তাহলে সে-বাণীর মধ্যে পার্থক্য ও বৈপরীত্য থাকত না। আর থাকত না সাময়িকতা। অন্তর্যামী ঈশ্বর কেন কালে কালে স্থানে স্থানে স্ববিরোধী বিপরীতমুখী বাণী পাঠাবেন মানুষের মধ্যে বিরোধ-বিবাদ- বিচ্ছেদ এবং নিত্যকালের সংঘর্ষ-সংঘাত ঘটানোর জন্যে? অজ্ঞ মানুষের কল্পনাপ্রসূন বলেই ঈশ্বর সাকার কি নিরাকার, নারী কি পুরুষ তা আজো নির্ণীত হয়নি। তিনি কেন কি উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করলেন বিশ্বজগৎ সে সম্বন্ধেও কেউ একমত নয়। শাস্ত্রগ্রন্থগুলোর মধ্যে সমকালের পৃথিবীর মানুষের গৌত্রিক গৌষ্ঠীক এবং অবস্থানগত ভৌগোলিক পরিচিতিও নেই। নেই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যর বয়ানও। তাছাড়া আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত তত্ত্ব, তথ্য এবং সত্যও দুর্লভ দুনিয়ার সব চালু শাস্ত্রগ্রন্থে। এজন্যে শাস্ত্রগ্রন্থগুলোকে মানবমনীষা প্রসূত বলে সহজেই লোকে চিহ্নিত করে, আস্তিক মাত্রই স্বশাস্ত্র ব্যতীত অন্যদের শাস্ত্রকে ভুল, ক্রুটিপূর্ণ কিংবা সরাসরি বানানো শাস্ত্র বলেই জানে। শৈশব-বাল্যের মগজ-ধোলাইয়ের ফলে বিশ্বাস-সংস্কার পুষ্ট মানুষ তার ইহ-পরকালে প্রসূত জীবনে জ্ঞান-বুদ্ধি-যুক্তি প্রয়োগে স্বশাস্ত্র যাছাই-বাচাই করার সাহস পায় না আত্মপ্রত্যয়ের ও সাহসের অভাবে। অতএব, কেউ অন্য কারো শাস্ত্র সত্য বলে জানে না, মানে না। কাজেই গড়ে শাস্ত্রমাত্রই মিথ্যা, বানানো, কেবল একটি বিশেষ দলের কাছেই এক একটি শাস্ত্র সত্যমাত্র। ফলে যুক্তিযোগে কোন শাস্ত্রই সত্য বলে এমনকি সর্বকালের সর্বমানবের জীবনে প্রয়োজনীয় বলে প্রমাণ করা যায় না। বিশ্বাসকে যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসমাত্রই পুতুলে হাতপা-চোখ-কান-নাক-মুখ-বসিয়ে তাকে জীবন্ত মানুষ প্রমাণ করার নামান্তর মাত্র।
এখনকার শাস্ত্রগুলোকে সত্য ও আসমানী বাণীভিত্তিক মনে করলে মানতেই হবে যে ঈশ্বর একজন বহুরূপী এবং বিচিত্র মতলবে স্ববিরোধী আদেশ-নির্দেশদাতা ঈশ্বরের নীতিনিয়মে কোন সঙ্গতি-সামঞ্জস্য নেই বলেই তাকে লীলাময় বলে। বহুকাল আগে ১৯০৪ [১৩১১ সনের] সালের ভাদ্রসংখ্যা মাসিক নবনুর নামের সাহিত্য পত্রিকায় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন লিখেছিলেন,
আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন—- পুরাকালে যে ব্যক্তি প্রতিভাবলে দশজনের মধ্যে পরিচিত হইয়াছেন, তিনিই আপনাকে দেবতা কিংবা ঈশ্বর প্রেরিত দূত বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।—– এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ রচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।—ঈশ্বর কি কেবল এশিয়ারই ঈশ্বর?
নাস্তিক শাস্ত্র নির্দেশে চালিত নয় বটে, তবে নাস্তিকমাত্রই ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, বিচার-বিবেচনা করেই কর্ম-আচরণ করে। আত্মরতি বশে পরের ক্ষতি করে না, জ্ঞানবুদ্ধি-যুক্তির আলোকে নৈতিক চেতনা নিয়ে সামাজিক, আর্থিক ও রাষ্ট্রিক ন্যায়ের অনুগত থাকে। নাস্তিক সমস্বার্থে সংযমে সহিষ্ণুতায় সহযোগিতায় সহাবস্থানের তত্ত্বে ও আবশ্যিকতায় আস্থা রাখে। নাস্তিক ‘Live and let others live’ আদর্শে গুরুত্ব দেয়। যে-ক্ষতি, যে-যন্ত্রণা যে-পীড়ন সে নিজের জন্যে অনভিপ্রেত বলে জানে, বোঝে ও মানে, তা সে তার প্রতিবেশীর জন্যেও অকারণে কামনা করে না। কাজেই নাস্তিক যুক্তিবাদী আত্মপ্রত্যয়ী আত্মমর্যাদা সচেতন বলেই সে অন্যায়-অপকর্ম থেকে বিরত থাকে। পক্ষান্তরে শাস্ত্রে আস্থাবান আস্তিক ঈশ্বর অন্তর্যামী বলে জেনে-মেনেও করে না হেন অপরাধ-অপকর্ম-অন্যায় নেই। আস্তিকেরা কেবল সামান্য পরিমাণে বা মাত্রায় লোকনিন্দার ও রোষের এবং বহুল মাত্রায় সরকারী শাস্তির ভয়েই নানা অপকর্ম থেকে বিরত ও সংযত থাকার চেষ্টা করে মাত্র। তবু প্রলোভন প্রবল হলে সেশ্বর আস্তিক মানুষ করে না হেন অপকর্ম জগতে নেই।
মানুষের জীবন ঈশ্বর না রাশিচক্র নিয়ন্ত্রণ করে, তাও নিয়তিতে ও জ্যোতিষগণনায় আস্থাবানেরা নিশ্চিত করে বলতে পারে না। আজ অবধি আমরা পৃথিবীর প্রাচীন ও আধুনিক ইতিবৃত্তে যত নাস্তিকের সন্ধান পাই, তারা মানুষ হিসেবে সাধারণভাবে উদার ও মহৎ, অনন্য ও অতুল্য। ভারতের বৈশেষিক, সাংখ্য, চার্বাক ও মীমাংসা দর্শন আর বৌদ্ধ-জৈন দর্শনও সাধারণ সংজ্ঞায় নাস্তিক্য দর্শন। কিংবা মিল বেন্থাম কোঁতে স্পিনোজো নিটসে কার্ল মার্কস প্রমুখের দর্শনও মানুষকে মনুষ্যগুণরিক্ত হতে তথা মনুষ্যত্বের মানবিকতার-মানবতার অনুশীলনে নিরুৎসাহ করেন না। বহুজনহিতে বহুজনসুখে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক নীতি নিয়ম চালু করার কথাই বলেন। মানুষ মতবাদীর দলীয় জীবনে ভরসা রাখে, তাই স্বশাস্ত্র-মানা চোর-ডাকু-মিথ্যেবাদী, মস্তান-গুণ্ডা-খুনীদের ঘৃণা মনে করে না, সহ্য করে স্বদলীয় বলে। কিন্তু নিরপরাধ শিক্ষিত ধনী, গুণী, জ্ঞানী নাস্তিককে একেবারেই সহ্য করে না। হত্যা না করে, পতিত না করে, বিতাড়িত না করে অন্তত পীড়িত-লাঞ্ছিত না করে আস্তিকেরা স্বস্তি পায় না। উল্লেখ্য যে, গত শতকের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয় কুমার দত্ত প্রমুখ নাস্তিক ছিলেন, অনেকেই ছিলেন প্রত্যক্ষবাদী ও সংশয়বাদী এবং তারা ছিলেন ভাব-চিন্তা-কর্ম-আচরণে-চরিত্রে, আদর্শে ও নৈতিক চেতনায় জ্ঞানে-গুণে-মনীষায় মহৎ মানুষ। লেনিন-স্টালিন-মাও সে তুং-জওয়াহের লাল, সার্ত্র, বাট্টাও রাখেনি প্রমুখও নাস্তিক, কিন্তু মানবপ্রেমী। অমানুষ নন কেউ। আজো দুস্থ মানুষকে শোষণ-পীড়ন পেষণ-দমন-লাঞ্ছনামুক্ত করার জন্যে যারা প্রাণপণ সংগ্রামে রত, তারা হচ্ছে মানবদরদী নাস্তিক-নিরীশ্বর কম্যুনিস্টরাই। কম্যুনিস্টরা কি নিরীশ্বর বলে অমানুষ?
মনোবিজ্ঞানীর ও দার্শনিকের মতে অজ্ঞ-অসহায় ক্ষতিভীরু মানুষের ভীরুতা থেকেই ঈশ্বরতত্ত্বের উদ্ভব। তাই কল্পনাসৃষ্ট বিভিন্ন কালের ও স্থানের ঈশ্বরে কোন সাদৃশ্য নেই। মানুষকে ও শয়তানকে কেন সৃষ্টি করা হল, মানুষকে কেন পাপ করার অধিকার দেয়া হল, শাস্তিই বা দেয়া হবে কেন? তাতে কার কি উপকার বা লাভ? এসব প্রশ্নের উত্তর মেলে না। যুক্তিবাদী আত্মপ্রত্যয়ী সাহসী মানুষমাত্রই তাই নাস্তিক নিরীশ্বর।