নৌকার ভোটার আর সংখ্যালঘুদের জন্য গোটা কালিয়াকৈরই এখন যেন জিম্মি এক জনপদ। সেখানকার কোথাও এখন এই দুই পরিচয়ের মানুষের নিরাপদ চলাচলের কোন সুযোগ নেই। কালিয়াকৈর প্রশাসনের লোকজনও জনকন্ঠের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বিষয়টি স্বীকার করেছেন। স্থানীয় বেশ কিছু শান্তিপ্রিয় মানুষ সেখানকার পরিস্থিতির বৃত্তান্ত জানিয়ে কয়েকদিন আগে একটি আবেদন লিখে পাঠিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরীর কাছে। ওই আবেদন পত্রের একটি অনুলিপি পাঠানো হয়েছিল জনকন্ঠ অফিসেও। ঘটনাগুলো তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। কিন্তু সরেজমিন এলাকাটিতে গিয়ে দেখা গেছে পরিস্থিতি সেখানে কোন কোন ক্ষেত্রে সেই আবেদনে লেখা বিবরণের চাইতেও ভয়ঙ্কর। বংশী নদীর তীরের জনপদ কালিয়াকৈর মূলত ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাজারের ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের। নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে তাঁরা পড়েছেন বেশি সমস্যায়। অব্যাহত সন্ত্রাসী হামলা, চাঁদাবাজি ও হুমকির মুখে তাঁরা নিজেদের এবং পরিবারের সদস্যদের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা শঙ্কায় ভূগছেন। উপজেলা শহরটির বেশির ভাগ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত, পরিচালিত হচ্ছে সেখানকার বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে। প্রায় ৬শ চালক, হেলপার , শ্রমিকের রুটি রুজি এই বাসস্ট্যাণ্ডের মাধ্যমে পরিচালিত, নিয়ন্ত্রিত হয়। বিএনপির সন্ত্রাসীদের দাপটে চাঁপরাইসহ কয়েকটি এলাকার শতাধিক চালক, হেলপার, শ্রমিক এখন বাসস্ট্যান্ডে আসতে পারছেন না। ‘হিন্দুরা ধানের শীষে ভোট দেয়নি ’ এই অপরাধের কথা বলে তাদেরকে এখন সেখানে ভারতে বা শ্রীপুর চলে যাবার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে- এখানে তোদেরকে থাকতে দিতে পারি, তবে দিতে হবে…! এই দিতে হবে মানেই হচ্ছে চাঁদা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগীদের একজন তাঁর হতাশার কথা জানিয়ে বললেন-হায়! আজ জন্মভুমিতেও আমাদের থাকতে দেবার সুযোগের নামে দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের চাঁদা।’ এসব নানা উৎপীড়ন, নির্যাতনে অতিষ্ঠ সংখ্যালঘুদের অনেকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, দেলদুয়ার, বাসাইল সহ বিভিন্ন এলাকায় চলে গেছেন। অনেকে নীরবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যাবার জন্য। কেউ কেউ মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়ে বা দেয়ার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে কোন রকমে আত্মরক্ষা করে চলছে। ভৃঙ্গরাজ এলাকায় একটি সূত্রের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে ধানের শীষের ভোটার এক যুবক রিক্সাচালক চাঁপাইর, সূত্রাপুর এলাকার বৃত্তান্ত দিয়ে বলে, ওইখানকার হিন্দু মালাউন সব ভাগছে। ভোট ধানের শীষে দেয়নি। এখন যুবতি মেয়ে ছেলে নিয়ে সব ভাগছে। পরে ওই রিক্সাচালককে নিয়েই এলাকাটিতে গিয়ে প্রায় বিরান জনপদ দেখার সুযোগ হয়। এ ছাড়া কালিয়াকৈরের সাহাপাড়া, পালপাড়া ও বালিয়াদিসহ বিভিন্ন এলাকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এরূপ নানা নির্যাতনের প্রত্যক্ষ শিকার। মেদী অশুলাইর জেলে সম্প্রদায় এখনও অবরুদ্ধ সন্ত্রাসীদের হাতে। সন্ত্রাসীরা তাদের আয়ের উৎস আলই বিলে মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, অনেকের মাছ ধরার জাল, নৌকা কেড়ে নিয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি থানার এক কর্মকর্তাও নিজে দেখে এসেছেন। ̄স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এলাকা থেকে পাঠানো অভিযোগে বলা হয়েছে⎯ হুমায়ুন কবির খান, হেলাল উদ্দিন, শফিকুল ইসলাম স্বপন, পারভেজ প্রমুখের নামে, তত্ত্বাবধানে চলছে সেখানকার সকল সন্ত্রাস। এরা সবাই কালিয়াকৈরের বিএনপি, যুবদল, ছাত্র দলের সঙ্গে জড়িত। নির্বাচনে বিএনপির এমপি পাস না করুক তাতে কি হয়েছে⎯ এদের অনেকের দাপটে এখনই থরথর কাঁপে কালিয়াকৈরের মাটি। রবিবার আমরা যখন প্রথম কালিয়াকৈর প্রেসক্লাবে যাই তখন ভবনটি তালাবদ্ধ দেখি। পাশের প্রেসক্লাব পাঠাগার লেখা সাইনবোর্ডের একটি কক্ষে বসা ছিল কয়েকটি যুবক। কিন্তু কথিত সেই পাঠাগারে কোন বই নেই। এক পর্যায়ে যুবকরা মজা করে বলে, তারা সেখানকার পাহারাদার ছাড়া কেউ নয়। পাশের আরেকটি ঘর তালাবদ্ধ। কয়েকদিন আগে ছাত্রদলের ছেলেরা সেটি এসে দখল করে সাইনবোর্ড লাগিয়েছিল। খবর পেয়ে প্রশাসনের লোকজন বিএনপির নেতাদের নিয়ে এসে সাইনবোর্ড নামালেও রুমের দখল কিন্তু এখনও দখলদারদের কর্তৃত্বেই রয়ে গেছে। সন্ত্রাসীরা সেখানে এখন প্রেসক্লাবের রুম দখল ছাড়াও ব্যবসায়ী মতিলাল সাহার দোকান থেকে ২০ হাজার টাকা লুট, পালপাড়া সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে। কথিত প্রেসক্লাবের পাঠাগারে বসা এক যুবক আমাদের জানালেন ব্যবসায়ীদের জন্য তৈরি চাঁদার তালিকাটি তিনি নিজে দেখেছেন। তিনিও ব্যবসা করেন। পরিচিত বন্ধু-বান্ধবরা থাকায় অবশ্য তার কোন সমস্যা হচ্ছে না। তবে চাঁদার ভয়ে অনেকে এখনও দোকান খুলতে পারছে না। চাঁপাইর ইউনিয়নের রশিদপুর, গোবিন্দপুর, কোটবাড়ি, ঠাকুরচালা ছাড়াও গোয়ালবাথান, বড়ইতলী, মেদী, গোসাত্রা এবং খোদ কালিয়াকৈর বাজার এখনও সন্ত্রস্ত থমথমে। বলা হচ্ছে, ওই পুরো এলাকাকে আগামীদিনে নৌকার ভোটশূন্য করার জন্য শুরু করা হয়েছে বিশেষ মিশন। যদিও ওই এলাকার অনেক ক্ষেত্রে গত নির্বাচনে নৌকার পক্ষে ভোট পড়েছে মাত্র ২% থেকে ৭% ভোট। এটাও যাতে আগামীতে না পড়তে পারে সে জন্য এলাকায় এলাকায় ‘নৌকার ভোটার সন্দেহভাজনদের’ তালিকা করা হয়েছে। কালিয়াকৈর আসার জলপথের ঘাটগুলোতে তারা বসিয়েছে মাস্তান প্রহরা। নৌকার সমর্র্থক সন্দেহভাজনদের পাওয়া গেলেই তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। তাদের হয়রানির ভয়ে অনেকে বাড়িঘর থেকে বেরুতে, কর্মস্থলে যাবার সাহস পাচ্ছে না। সরেজমিন অনুসন্ধানে সোমবার পালপাড়ায় গেলে ভীতসন্ত্রস্ত্র এলাকাটির বাস্তবতা অনুধাবনের সুযোগ হয়। এলাকার বাসিন্দারা মূলত কুমার সম্প্রদায়ের। বাড়িতে বাড়িতে তৈরি নানান অবিক্রীত পাত্রের স্তুপ জমে আছে। যা সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সেই পাড়ার মানুষজনের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রমাণবাহী।
দৈনিক জনকণ্ঠ, ৩১ অক্টোবর ২০০১