পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটায় রাতের আধাঁরে রাখাইন আদিবাসীদের দেবালয় সম্পত্তি, একটি হাউজিং কোম্পানীর জমিসহ ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। প্রায় পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের এ সম্পত্তি দখলে উপেক্ষা করা হয়েছে আদালতের নিষেধাজ্ঞা। মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ন এ সম্পত্তি দখল করছে স্থানীয় প্রভাবশালী চিহ্নিত একটি ভূমিদস্যু চক্র।
স্থানীয়সহ ভূক্তভোগীরা জানান, কলাপাড়া-কুয়াকাটা মহাসড়ক লাগোয়া কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টে লতাচাপলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন ওই জমিতে বিদ্যমান ডোবাটির বিএস জরিপে মালিক হাজী আ. মন্নান হাওলাদার, ইলিয়াস হোসেন, সোহেল হোসেন, তেমং রাখাইন ও শহিদ দালাল।
আদালতে ৪/৫টি চলমান মামলা নিয়ে বিরোধপূর্ন ওই জমিতে রয়েছে রাখাইন আদিবাসীদের পুরাতন বৌদ্ধ বিহার। দেড়শ’ বছরের পুরাতন এই বিহারের সীমানা নির্ধারণ জটিলতায় সংস্কার কাজ না হওয়ায় দীর্ঘ বছর ধরে পরিত্যক্ত রয়েছে। এরপাশেই রয়েছে ওয়েস্টার্ন রিয়েল এস্টেট কোম্পানীর ৩০ শতাংশ এবং জয়নাল আবেদীন খানের সাড়ে ১২ শতাংশ জমি।
ক্ষতিগ্রস্থদের অভিযোগ মহিপুরের জাহাঙ্গীর মৃধা, বালিয়াতলীর সোহেল তালুকদার, আলীপুরের সাদা জাহাঙ্গীর, আলী হোসেন, আলমগীর হোসেন এবং কুয়াকাটার কালা রহিম জাল কাগজ তৈরি করে গায়ের জোরে এ জমি দখল করেছেন। যারা নিজেদের পূর্বাচল মেরিন সিটি কোম্পানীর বেতনভোগী কর্মচারী বলে দাবি করছেন। বালু দিয়ে ডোবা ভরাট করে র্নিমান করা হয়েছে দুটি একতলা সেমিপাকা স্থাপনা।
ক্ষতিগ্রস্থ জমির মালিক শহীদুল ইসলাম বলেন, চলতি বছরের ১১মার্চ থেকে শুরু হওয়া এ দখল প্রক্রিয়া এখনও চলমান রয়েছে। সর্বশেষ শনিবার (১০জুলাই) রাতে প্রায় অর্ধশত শ্রমিক লাগিয়ে তাদের জমি বালু দিয়ে ভরাট করে দখল করেছে স্থানীয় ওই চক্রটি। এসময় বাঁধা দিতে গেলে তারা মামলা-হামলার হুমকি দেয়।
ওয়েস্টার্ন রিয়েল এস্টেট কোম্পানীর ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান বলেন, দলিলপত্রসহ প্রমাণাদি দেখানোর পরেও আমাদের কোম্পানীর জমি দখল করে নেয়া হয়েছে।
বৌদ্ধ বিহার কমিটির সভাপতি এমং তালুকদার বলেন, বৌদ্ধ বিহারের জায়গা বাদ দিয়ে কাজ করতে অনুরোধের পরেও দখলদাররা জোড়পূর্বক বেড়া দিয়ে বালু ভরাটের কাজ করছে।
কুয়াকাটা পৌর মেয়র আনোয়ার হাওলাদার বলেন, ওই সম্পত্তি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলে দুই দফা কাজ বন্ধ করে দিয়েছি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য মেইনথেইন প্রমিলা আইপিনিউজকে বলেন, একের পর এক তো জমি দখল হয়েই যাচ্ছে। যেখানে সারা দেশে মডেল মসজিদ নির্মাণের কাজ চলছে সেখানে অন্য নাগরিকদের মন্দির দখল হয়ে গেলে সেটা কিছুতেই রাষ্ট্রের জন্য সুনামের কিছু নেই। দখলকৃত মন্দিরটি একটি প্রত্নতাত্মিক নিদর্শন হিসাবেও সংরক্ষণ করা যেত। তিনি এ বিষয়ে প্রশাসনের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রাখাইনদের জমি, শশ্মান,মন্দির দখলের কাজটি চলছে। তাদেরকে সেখানে সংখ্যালঘু থেকে সংখ্যাশুন্য করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটাকে ‘আনপিপলিং’ বলে। কোনো মতেই ‘দেবোত্তর সম্পত্তি’ হস্তান্তরযোগ্য বা বিক্রয়যোগ্য নয়। এটি দ্রুত রাখাইন আদিবাসীদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসন, দায়িত্বশীল মহল ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণও করেন ঢাবির এই শিক্ষক।
উল্লেখ্য যে, কুয়াকাটার রাখাইনদের ঐতিহাসিক এই পুরাকীর্তি গৌতম বুদ্ধের শয়নরত বুদ্ধমূর্তিটিসহ বিহার এলাকাটি অরক্ষিত পড়ে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। জীর্ণদশায় পরিণত হয়েছে দেড় শ’ বছরেরও বেশি প্রাচীন বুদ্ধমূর্তিটিও। সরকারি অর্থায়নে এই বুদ্ধ মূর্তিটি সংরক্ষণসহ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হলেও দখলদারসহ নানা জটিলতায় তা আর হয়নি। এখন বৌদ্ধ বিহার এলাকার জমিজমা দখল করে করা হয়েছে স্থাপনা। স্থানীয় রাখাইনরা কুয়াকাটা পুরাতন বৌদ্ধ বিহার নামের এটি ২০১৪ সালের ২৬ আগস্ট সীমানা নির্ধারনে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন।কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।
এছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এই পুরনো বৌদ্ধ বিহার রক্ষণাবেক্ষন, মেরামতসহ এলাকাটি সংরক্ষণ করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তিন লাখ টাকা বরাদ্দও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সীমানা জটিলতা নিরসন না করায় প্রাচীন পুরাকীর্তিটি সংরক্ষণে কোন কাজ করা যায়নি বলে রাখাইন নেতৃবৃন্দের দাবি। এটি এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে জায়গা দখল করে নেয়া হচ্ছে।