Site icon অবিশ্বাস

প্রাণভয়ে পালিয়েছে কয়েক শ’ মানুষ কক্সবাজারের জলদাসপাড়ায় সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব, চাঁদার দাবিতে ঘরে ঘরে হানা, মন্দিরে আগুন

কক্সবাজার সদরের ইসলামাবাদ ইউনিয়নের বোয়ালখালী জলদাসপাড়ায় গত কয়েকদিন ধরে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নারকীয় তাণ্ডবে ৫ সহস্রাধিক সংখ্যালঘু আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। সন্ত্রাসীরা চাঁদা না পেয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে জলদাসপাড়ার সংখ্যালঘুদের একমাত্র দুর্গামন্দিরটি। আনুমানিক ৩০ জনের সশস্ত্র সন্ত্রাসী পালাক্রমে হানা দেয় এই পাড়ায়। তারা জলদাসদের কাছে পূজা ট্যাক্স, কন্যার ও পুত্রের বিয়ের ট্যাক্স নাম দিয়ে তিন প্রকারের ট্যাক্স বসিয়েছে। সন্ত্রাসীদের ট্যাক্স দিতে না পেরে জলদাস পাড়ায় বেশ কিছুদিন ধরে পালন করা যাচ্ছে না পূজা-পার্বন তথা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বন্ধ বিয়ে শাদীও। এমনকি ট্যাক্স না দেয়ায় বিয়ের অনুষ্ঠান পর্যন্ত ভণ্ডুল হয়ে যাবার ঘটনা ঘটেছে এ পাড়ায়। সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে কয়েকশ’ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববর্তী এক ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িতে। কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ইসলামাবাদ ইউনিয়নের বোয়ালখালী গ্রামের জলদাসপাড়ায় শনিবার দুপুরে সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে কয়েক শ’ নরনারী তাদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী জানাতে ভিড় করে। পার্শ্ববর্তী ইসলামপুর এবং ইসলামাবাদ ইউনিয়নের প্রায় ৩০ জনের একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল গত প্রায় ২ মাস ধরে জলদাসপাড়াটিকে টার্গেট করে চাঁদার দাবিতে অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে। পাড়ার সবাই পেশায় জেলে। সাগরে মাছের আকাল দেখা দেয়ায় জলদাস সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। তাদের প্রতে ̈কেরই সংসার চলছে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থার মধ্যে দিয়ে। আর এমন দুর্গতির সময় তারা কোপানলে পড়েছে ৩০ জনের সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলের। ইসলামাবাদ ইউনিয়নের চৌকিদার এবং জলদাসপাড়ার বাসিন্দা হরি শঙ্কর জানান, সন্ত্রাসীরা দফায় দফায় চাঁদার দাবি নিয়ে হানা দিচ্ছে পাড়ায়। চাঁদা না দিলে জলদাস সম্প্রদায় সেখানে থাকতে পারবে না বলে সন্ত্রাসীরা হুমকি দিচ্ছে। জাহাঙ্গীর, জয়নাল ও রমজান আলীর নেতৃত্বে এই সন্ত্রাসী হামলা চালানো হচ্ছে বলে তারা অভিযোগ করেছেন। সন্ত্রাসীরা গত এক মাস ধরে প্রায় প্রতিদিনই হামলা চালাচ্ছে। গত ২৬ জুন রাতে ১০/১২ জনের সন্ত্রাসী দল গিয়ে পাড়াটির ৬০টি পরিবারের মধ্যে ১৫/১৬টি ঘরে গিয়ে হামলা চালিয়েছে। সন্ত্রাসীরা চাঁদা না পেয়ে ওই দিন রাত ৮টার দিকে দুর্গামন্দিরটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে মন্দিরটি পুড়ে যায়। তারা পাড়ার ঘরে ঘরে হানা দিয়ে দরজা-জানালা ভাংচুর করে। সন্ত্রাসীরা মারধর করেছে গোপাল বাঁশি, প্রফুল্ল দাশ, চরমধোলা, ধ্রুব জলদাস, রায় মঙ্গলসহ অনেককে। কুসুম বালাকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত করে তারা। ওই রাতেই সন্ত্রাসীদের নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য কয়েক শ’ নারী-পুরুষ পার্শ্ববর্তী ঈদগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান এবং সাবেক সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এজেডএম শাহজাহান চৌধুরীর ঘরে আশ্রয় নেয়। তারা পরের দিন নিরাপত্তার আশ্বাস নিয়ে ফিরে গেলেও সন্ত্রাসীরা হুমকি দিয়ে বলেছে, চাঁদা ছাড়া তাদের রক্ষা নেই। শনিবার সকালে এএসপি সার্কেল মোজাম্মেল হক এবং সদর থানার ওসি নবজ্যোতি খীসা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলেও থানায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি রেকর্ড করা হয়নি। এমনকি পুলিশ এর আগেও সন্ত্রাসীদের দমনে নেয়নি কোন পদক্ষেপ। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানও একবারের জন্য আসেননি পাড়ার নির্যাতিত লোকজনদের দেখতে। জলদাসপাড়ার অনেক বাসিন্দা জানান, সন্ত্রাসীদের ভয়ে তাঁদের যুবতী মেয়েরা ঘরের বাইরে যেতে পারছে না বহুদিন ধরে। জলদাসপাড়ার বাসিন্দারা তাঁদের পূজা পার্বনও করতে পারছেন না। মেয়ের এবং ছেলের বিয়ে শাদীও বন্ধ রয়েছে। সন্ত্রাসীরা এই তিন কাজেই চাঁদা ধার্য করেছে। চাঁদা যেহেতু দিতে পারছে না সেহেতু পূজা পার্বনসহ বিয়ে-শাদীও হচ্ছে না। গত ৬ জুনও তাদের একটি নির্ধারিত পূজা তাঁরা করতে পারেননি। জলদাসপাড়ার লোকজন জানেন না, সন্ত্রাসীরা তাঁদের ওপর এভাবে চাঁদার দাবিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কেন। পাড়ায় এখনও পুলিশ পাহারা দেয়া হয়নি।

দৈনিক জনকন্ঠ, ৩০ জুন ২০০২

Exit mobile version