সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিডিআরের যৌথ অভিযানের মুখে ফেনী থেকে আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগ নেতা-কর্মীরা বিতাড়িত হওয়ায় বিএনপি সন্ত্রাসীরা পুরো জেলায় সন্ত্রাস কায়েম করছে। তারা বিনা বাধায় জেলার বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলার পাশাপাশি লুটপাট চালাচ্ছে। সোনাগাজী ও দাগনভূইয়া থানা এলাকার অনেক সংখ্যালঘু পরিবার সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে চট্টগ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছে। আগামী নির্বাচনে সংখ্যালঘু লোকজনের ভোট পাবে না জেনে সন্ত্রাসীরা নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে বলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন অভিযোগ করেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ফেনী জেলার দক্ষিণাঞ্চলে সোনাগাজী থানা এবং দাগনভূইয়া থানার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যেমন নির্মম অত্যাচার নির্যাতন চলছে, তা যেন ‘৭১-এর চিত্রকেও ম্লান করে দিচ্ছে। এসব এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হয়ে আতংকগ্রস্ত অবস্থায় দিনযাপন করছে। মমতাজ মিয়ার হাটের শহীদুলল্লা এবং ধলিয়া বাজারের
জসিমের নেতৃত্বে মমতাজ মিয়ার হাট, ধলিয়া বাজার, ভোরবাজার, বক্তারমুন্সি বাজার, গুণক ঈদগাতে এসব অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীর পদচারণায় থমথমে ভাব বিরাজ করছে। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রকাশ্যেই ঘুরাফেরা করছে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করছে। এসব সন্ত্রাসী হত্যা, রাহাজানিসহ অসংখ্য মামলার আসামি। অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা ভেঙ্গু হাজারী, মমতাজ মিয়ার হাটের হুমায়ুন কবির, সোনাগাজী উপজেলার ৪ নং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রাজ্জাককে ফেনী থেকে সোনাগাজী যাওয়ার পথে কালিপাল রাস্তার ওপর যাত্রীবাহী টেম্পো থেকে অপহরণ করে নির্মম এবং নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে দীর্ঘদিন যাবৎ গা ঢাকা দেয়ার পর হঠাৎ করে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সংখ্যালঘু
অধ্যুষিত এলাকায় চাঁদা আদায়, অপহরণ ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে চলেছে। তারা ইতোপূর্বে দৌলতপুর গ্রামের পুস্প রঞ্জন বসাকের কাছ থেকে বিশ হাজার টাকা, যোগেশ চন্দ্র বসাকের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা, অপূর্ব বসাককে বেদম মারধর করে পঞ্চাশ হাজার টাকা, মজুপুর গ্রামের সচিনন্দন বসাক বাড়ির নদিয়া বিহারী বসাককে অপহরণ করে এক লাখ টাকা, নবাবপুর হাইস্কুলের সম্মানিত শিক্ষক লালমোহন নাথকে বেদম মারধর করে নব্বই হাজার টাকা চাঁদা উত্তোলন করে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদেরকে পাঁচ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দাবি করে চিঠি দেয়। তাদের ভয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকে আজ বসতভিটা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। তারা সমপুর গ্রামের ডা. নারায়ণ নাথের থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা, খোকন মাস্টার থেকে চল্লিশ হাজার টাকা, সতীশ চন্দ্র নাথের ছেলেকে অপহরণ করে ফেনীর রামপুর নিয়ে আটক করে রাখে এবং পঞ্চাশ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়। একই গ্রামের মানিক লাল নাথের কাছ থেকে এক লাখ টাকা দাবি করে। তাদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ওলিপুর গ্রামের ডা. হরিপ্রসাদ বসাক দেশত্যাগ করেন এবং অনেকে
দেশত্যাগের অপেক্ষায় দিন গুণছেন।
গত ১৯শে আগস্ট দাগনভূইয়া উপজেলার রাজাপুর উনিয়নের লতিফপুর গ্রামের পোদ্দার বাড়িতে সন্ত্রাসীরা রাতে অন্ধকারে ঢুকে ৩টি পরিবারের সর্বস্ব লুটপাট করে নিয়ে যায়। ১৮ই আগস্ট সন্ত্রাসীরা হিন্দুরপুর ইউনিয়নের মাছিমপুর গ্রামের সুনীল মাষ্টারকে বেদম মারধর করে ও অর্জুন চন্দ্র বৈষ্ণবকে বোমা মেরে হত্যা করে এবং মূল্যবান স্বর্ণালংকার কাপড় চোপড় নিয়ে যায়। এসব সন্ত্রাসীর অত্যাচারে প্রতাপপুরসহ অধিকাংশ এলাকার ধর্মীয় সংখ্যালঘু বাড়িঘর বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। সন্ত্রাসীরা একই কায়দায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করে নিচ্ছে ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করছে।
একই কায়দায় সোনাগাজী উপজেলার চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা দিনকয়েক আগে সোনাগাজী বাজার আদর্শ হিন্দু হোটেল ভাঙচুর করে ও মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এছাড়া চর দরবেশ ইউনিয়নের চর সাহাভিখারি গ্রাম, চান্দিয়া ইউনিয়নের চর চান্দিনা গ্রাম, চর ভৈরব, মুতিগঞ্জ ইউনিয়নের সাতবাড়িয়া গ্রাম, মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের আনন্দিপুর, সমপুর ও লক্ষ্মীপুর গ্রামসহ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় সন্ত্রাসীরা সশস্ত্র অবস্থায় গিয়ে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করছে এবং আদায় করছে।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ফেনী শাখার নেতা তুষার কান্তি বসাক জানান, এসব এলাকায় সংখ্যালঘু ভোটাররা ‘৮৬ সাল থেকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। ভোটের প্রাক্কালে তাদেরকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে ভোট কেন্দ্রে আসতে বাধা প্রদান করা হয়। এভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলতে থাকলে এবারও তারা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। সন্ত্রাসীদের এসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো সত্ত্বেও এর কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ভীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। সামনে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে পূজা উদ্যাপনও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
সংবাদ, ২৬ আগস্ট ২০০১
কৃতজ্ঞতা: শ্বেতপত্র-বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিন