পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ৩৬ দিনের মাথায় আগুনে পুড়ল অভিজাত এলাকা বনানীর বহুতল ভবন এফআর টাওয়ার।
২৮ মার্চ বৃহস্পতিবার দুপুরে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাদের মৃত্যু হয়েছে আগুনে পুড়ে, ধোঁয়ায় শ্বাসরোধ হয়ে অথবা যাদের মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে বাঁচার চেষ্টায় লাফিয়ে পড়ে।
এই সংখ্যা আরও বাড়বে জানিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগীয় উপ পরিচালক দেবাশিষ বর্ধন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভবনের ভেতরে উদ্ধার কাজ চলছে, সেখানে আরও কিছু মৃতদেহ আছে।”
কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের ৩২ নম্বর হোল্ডিংয়ে ২২ তলা ওই বাণিজ্যিক ভবনের সবগুলো ফ্লোরেই দোকান ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিস। সপ্তাহের শেষ দিন দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকের আগে আগে সব অফিসেই তখন দারুণ ব্যস্ততা।
ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা এরশাদ হোসাইন জানান, বেলা ১২টা ৫২ মিনিটে আগুন লাগার খবর পেয়ে প্রথমে তাদের ১৩টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে কাজ শুরু করে। পরে আরও ১২টি ইউনিট তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
চার ঘণ্টা চেষ্টার পর বিকাল পৌঁনে ৫টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার কথা জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। তবে তখনও কয়েকটি ফ্লোর থেকে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছিল, ধোঁয়া বের হচ্ছিল ভবনের বিভিন্ন অংশ থেকে।
অগ্নিকাণ্ড থেকে বেঁচে ফেরা কেউ কেউ বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুন লাগার ধারণা দিলেও দেবাশিষ বর্ধন অগ্নিকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলতে চাননি।
বিকালে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার আগে আমরা আগুনের উৎস বা ক্ষয়ক্ষতির সুনির্দিষ্ট তথ্য বলতে পারব না।”
অগ্নিকাণ্ডে সবচেয়ে বেশিক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সপ্তম থেকে দশম তলা। ওই চারটি ফ্লোরে বিভিন্ন অফিসে সোফাসহ আসবাবপত্র থাকায় প্রচুর ধোঁয়া সৃষ্টি হয়। তাতে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়েছে বলে জানান দেবাশিষ বর্ধন।
তিনি বলেন, ওই ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি ছিল কি না- তা তদন্ত শেষ হলে বলা যাবে।
মো. গিয়াস উদ্দিন নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ওই ভবনের সপ্তম তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হওয়ার পর তা উপরের দিকে ছড়াতে থাকে। আতঙ্কে বিভিন্ন ফ্লোরে শুরু হয়ে যায় হুড়োহুড়ি, তাতে বেশ কয়েকজন আহতও হন।
ততক্ষণে ভবনের সামনে বিপুল সংখ্যক উৎসুক জনতার ভিড় জমে যায়। টেলিভিশনগুলো ঘটনাস্থল থেকে সরাসরি সম্প্রচার শুরু করে। দূর থেকেও বনানী এলাকার আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখা যায়।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত আমাদের একজন প্রতিবেদক জানান, ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা পানি ছিটিয়ে সপ্তম তলার আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনার পর উপরের ফ্লোর জ্বলতে দেখা যায়। সেখানে পানি ছিটানোয় আগুন কমে এলে আবার সপ্তম ও অষ্টম তলায় আগুন জ্বলতে দেখা যায়।
এদিকে উপরের ফ্লোরগুলোর অনেকে বাঁচার আশায় ছাদে উঠে যান। ১২ তলায় কাচ ভেঙে বেশ কয়েকজনকে হাত নেড়ে উদ্ধারকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দেখা যায়।
এরই মধ্যে বাঁচার মরিয়া চেষ্টায় বিভিন্ন ফ্লোর থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে গুরুতর আহত বা নিহত হন বেশ কয়েকজন। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা জনতা আর ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা চিৎকার করে নিষেধ করেও তাদের থামাতে পারেননি।
এফআর টাওয়ারের একপাশের আহমেদ টাওয়ার এবং অন্যপাশের আওয়াল সেন্টারেও তখন আগুন ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। দুই ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে থাকা বাসিন্দারাও ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছেন। ওই দুই ভবনে থাকা দুরন্ত টিভি ও রেডিও টুডের সরাসরি সম্প্রচারও সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।
মিজান নামের একজন নিরাপত্তাকর্মী জানান, এফআর টাওয়ারের নিচতলা থেকে তিন তলা খাবার, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন সামগ্রীর দোকান এবং একটি মানি এক্সচেঞ্জ রয়েছে। তৃতীয় থেকে অষ্টম তলা পর্যন্ত রেস্তোরাঁ আর একটি কনভেনশন সেন্টার।
এরপর নবম তলা থেকে উপরের ফ্লোরগুলোতে বিভিন্ন বায়িং হাউস ও ট্র্যাভেল এজেন্সি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিস। তার মধ্যে উই মোবাইল ও আমরা নেটাওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার লিংক থ্রির অফিসও রয়েছে।
ঠিক কতগুলো প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ওই ভবনে ছিল তা জানা না গেলেও সব মিলিয়ে ওই ভবনে এক হাজারের বেশি মানুষ নিয়মিত যাতায়াত করত বলে নিরাপত্তাকর্মী মিজানের ধারণা।
অগ্নিকাণ্ডের সূচনার ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে যাওয়ার পর সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর উদ্ধারকর্মীরাও অভিযানে যোগ দেন। হেলিকপ্টার থেকেও ওই ভবনের ওপর পানি ছিটাতে দেখা যায়।
আইএসপিআরের সহকারী পরিচালক রাশেদুল ইসলাম খান জানান, সামরিক বাহিনীর পাঁচ হেলিকপ্টার এ কাজে অংশ নেয়।
বেলা ৩টার দিকে আগুনের তীব্রতা কমে আসার পর ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা মই লাগিয়ে উপরের ফ্লোরগুলোতে আটকা পড়া মানুষকে নামিয়ে আনতে শুরু করেন। তখনও অষ্টম তলায় দেখা যাচ্ছিল আগুনের শিখা।
টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা সেইসব দৃশ্যে ভাঙা কাচের ওপারে দাঁড়ানো অনেককে সাহায্যের আকুতি জানাতে দেখা যায়।
ভবনের সামনে উৎকণ্ঠিত ভিড়ের মধ্যে মহিউদ্দিন নামের একজন জানান, তার ভাই মোতাহার এফআর টাওয়ারের ১৪ তলায় একটি বায়িং হাউজে কাজ করেন। বেশ কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে তিনি ভেতরে আটকা পড়েছেন। ফোনে ভাইয়ের সঙ্গে তার কথাও হয়েছে।
কাফরুল থেকে আসা তিথি নামের এক তরুণী জানান, তার খালাতো বোন তানজিলা মৌরি এফআর টাওয়ারের দশম তলার ট্র্যাভেল এজেন্সি হেরিটেজ এয়ার এক্সপ্রেসে কাজ করেন। আগুন লাগার পরপরই বাসায় ফোন করে আকা পড়ার কথা জানান মৌরি। কিন্তু বনানীতে আসার পর তারা আর যোগাযোগ করতে পারছেন না।
ইরফান নামে একজন জানান, তার বাবা ১৪ তলার একটি অফিসে কাজ করেন। আগুন লাগার পর তিনি ছাদে উঠে ফোন করে খবর দিয়েছিলেন। সেই খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ল্যাডারে উঠে ১৪ তলা পর্যন্ত দেখেছেন ইরফান।
“আমি দেখেছি ভেতরে অনেকে আটকা পড়ে আছে। কাচ ভাঙতে না পারায় তারা বের হওয়ার চেষ্টাও করতে পারছে না। ধোঁয়ার কারণে অনেকে অচেতন হয়ে গেছে।”
ভবনের সামনে জড়ো হওয়া জনতার অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছিলেন, ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের দেরির কারণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে বেশি। তবে ঘটনাস্থলে অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর কর্মীদের চেষ্টায় কোনো ত্রুটি দেখা যায়নি। মই দিয়ে কয়েক দফায় অন্তত ৪০ জনকে তারা ওই ভবন থেকে নামিয়ে আনেন।
বিকাল পৌনে পাঁচটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে বিভিন্ন ফ্লোরে ঢুকে তল্লাশি শুরু করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক কর্নেল এসএম জুলফিকার রহমান সে সময় সাংবাদিকদের বলেন, “শতাধিক মানুষকে আমরা রেসকিউ করেছি। ভেতরে কেউ আটকা থাকলে বা হতাহত থাকলে আমরা উদ্ধার করব। সেই সঙ্গে ডাম্পিংয়ের কাজও চলবে।”