Site icon অবিশ্বাস

বরগুনা জুড়ে দুর্গোৎসব পালন করাতে প্রশাসন যতটা উৎসাহী, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে ততটা নয়, স্থানীয় বিএনপি বলছে, সবই অতিরঞ্জিত

লাকায় দুর্গোৎসব অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে সরকারি দল ও স্থানীয় প্রশাসন। তবে আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে তেমন কোন পদক্ষেপ নেই। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নির্যাতন চললেও এখনো পর্যন্ত দুষ্কৃতকারীরা ধরা না পড়ায় চলমান আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে হিন্দু সম্প্রদায় সাড়ম্বরে উৎসব উদ্যাপন করার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। বরগুনা জেলা সদরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও গ্রামে ও অন্যান্য উপজেলায় নির্বাচন-পূর্ব ও পরবর্তী অবস্থা এখনো খারাপ। নির্বাচনী প্রতিপক্ষশক্তি হিসেবে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছেন। ধর্ষণের মতো ঘটনার পরও আসামীরা গ্রেফতার না হওয়ায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। বরং প্রশাসনের কেউ কেউ বিষয়টি আমলে না নিয়ে সন্ত্রাসীদের আশ্রয়দাতা সরকারি দলকে সহযোগিতা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বরগুনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিগত পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে নির্বাচনের আগের দিন জেলা স্কুল সংলগ্ন সাহাবাড়ির অমল সাহাকে মারপিটের ঘটনার ভিতর দিয়ে। নির্বাচনের দিন আটক করা হয় জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ভুবন চন্দ্রকে। সংখ্যালঘুদের ভোট দানে বাধা দেয়ার ঘটনা নির্বাচন পরবর্তীকালে নির্যাতনের রূপ লাভ করে। বরগুনা জেলায় সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি ছিল বরগুনা ২-আসনে। বিজয়ী প্রার্থী নির্বাচন চলাকালেই ঘোষণা দিয়েছিলেন সংখ্যালঘুদের ভোট তিনি চান না। তবে সংখ্যালঘুরা তাকে ভোট দিয়েও রেহাই পাচ্ছে না। শিকার হচ্ছে ধর্ষণেরও। নির্বাচনের পর পাথরঘাটায় বিজয়ী সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মনির উম্মত্ত কর্মীদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে ১০ টি সংখ্যালঘু পরিবার। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৫ বছরের এক যুবতী। তাদের অপরাধ, তারা নির্বাচনে নৌকা মার্কাকে সমর্থন করেছিল। আহত সংখ্যালঘুদের মধ্যে কাঁঠালতলী ইউনিয়নের পরীকাটা গ্রামের মনা মণ্ডল, রায়হানপুর গ্রামের গুনধর মিস্ত্রীর ছেলে গৌতম মিস্ত্রী, সূর্য মালাকারের ছেলে পঙ্কজ মালাকার, রসিক চক্রবর্তীর ছেলে রতন চক্রবর্তী, সুরেশ হালদারের ছেলে সুশান্ত, সখানাথ বেপারির ছেলে রিপনকে বিএনপি কর্মীরা মারধর করেছে। তাছাড়া কাঁঠলতলীর সুজন বেপারী ও চরদুয়ালীর নারায়ণ ঘরামির ছেলে অমলকেও মারধর করে। গত ৬ অক্টোবর চরদুয়ানী ইউনিয়নের হোগলপাশা গ্রামে বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে ধর্ষিত হয় কাকচিড়ার চিত্তরঞ্জন চক্রবর্তীর মেয়ে। আইনগত সহায়তার জন্য বর্তমানে তাকে ঢাকায় নিয়ে গেছেন সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষে পঙ্কজ ভট্টাচার্য ও জিয়াউদ্দিন তারেক আলী। এ ঘটনার বাদি ধর্ষিতার বোন পাথরঘাটা কোর্টে মামলা করলে মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট কৌশলে আসামিদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। এলাকার সাংসদ এ ঘটনা সাজানো এবং তার কর্মীদের নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করলে এলাকার পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। পাথরঘাটার কাকচিড়ার বশির উদ্দিন নামে নুরুল ইসলাম মনির একজন ক্যাডারের দাপটে এলাকাবাসী সন্ত্রস্ত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চরদুয়ানি ইউপি চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান ফিরোজ এ ঘটনার ন্যায় বিচার দাবি করেছেন। তিনি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে জানতে পেরেছেন। আতঙ্কে আছেন হোগলপাশা ইউনিয়নের আদর্শ পল্লীর বিভা রানী। তাকে ধর্ষণের হুমকি দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। বরগুনা ৩-আসনে বিএনপি কর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আমতলী উপজেলার শারিকখালী, কচুপাত্রা ও চাউলপাড়া গ্রামে প্রায় ৩শ’ সংখ্যালঘু পরিবার কুখ্যাত ভিপি মজিবরের তাণ্ডবে রীতিমতো জিম্মি জীবন যাপন করছে। খেপুপাড়া উপজেলার চাকামাইয়া ইউনিয়নের সন্ত্রাসী মজিবরকে পুলিশ গ্রেফতার করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। বিএনপি নেতা এই মজিবরের রয়েছে সশস্ত্র বাহিনী। গত ৮ অক্টোবর মজিবর বাহিনী চাউলপাড়া গ্রামের সংখ্যালঘুদের বাড়ির পুকুর থেকে ২০ হাজার টাকা মূল্যের মাছ, ৩টি গরু ও ছাগল লুট করে নিয়ে যায়। পরের দিন এলাকার নৌকার সমর্থক শরীফকে অপহরণ করে নিয়ে মারপিট করে মজিবর বাহিনী। এছাড়া বেতাগীর নোকামীয়া ইউনিয়নেও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। দেশব্যাপী নির্যাতন ধর্ষণের খবর পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়া ও সংখ্যালঘুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় দুর্গাপূজা অসম্পন্ন হওয়ায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে সরকারি দল ও স্থানীয় প্রশাসন। প্রেস কনফারেন্স ও বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে সংখ্যালঘুদের বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, নির্যাতন ধর্ষণের খবর অতিরঞ্জিত ও বানোয়াট। এর ফলে সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে সন্ত্রাস আপাতত থামলেও শঙ্কা বেড়েই চলেছে। ইতোমধ্যে সরকারিদল বিএনপি, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও জেলা প্রশাসন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের সাথে ঘন ঘন বৈঠক করছে ও পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করছেন। বৈঠক করছেন, অর্থ সাহায্যের আশ্বাস দিচ্ছেন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা বলছেন; কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায় নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিজনিত অভিজ্ঞতা বুকে নিয়ে হাসিমুখে কিভাবে উৎসব করবে, এ প্রশ্ন তাদের মনে জ্বলজ্বলে এখনো পর্যন্ত।

সংবাদ, ২০ অক্টোবর ২০০১

Exit mobile version