Site icon অবিশ্বাস

বাগেরহাটের সংখ্যালঘু গৃহবধূর প্রশ্ন⎯এত চাপের মধ্যে আমরা কীভাবে থাকব, আমরা শুধু শান্তি চাই

বাগেরহাটের সংখ্যালঘু গ্রামগুলো এখন আতঙ্কিত জনপদ। সন্ধার পর এই গ্রামগুলো ভুতুড়ে গ্রামে পরিণত হয়। অন্ধকারের মাঝে চাপা আতঙ্ক গ্রাস করে গ্রামগুলোকে। এদিকে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের নানা ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর তারা এখন দ্বিমুখী চাপের মুখে পড়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখানোর জন্য একদিকে পুলিশ, অন্যদিকে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘুদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। ফলে এই দ্বিমুখী চাপে পড়ে সংখ্যালঘুরা আরও অসহায় হয়ে পড়েছে। এই অসহায়ত্ব আরও করুণ হয়ে ওঠে যখন আঙ্গারিয়া গ্রামের অচিন্ত্য দেবনাথের স্ত্রী বলে ওঠেন⎯ এত চাপের মধ্যে এভাবে কিভাবে আমরা থাকব? জানি না কত দিন এভাবে থাকতে হবে। আমরা তো বেশি কিছু চাই না, শুধু শান্তিতে বসবাস করতে চাই । বাগেরহাটের গ্রামগুলোতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নির্যাতনের ব্যাপারে এলাকার লোকজন বিএনপি ও জামায়াত নামধারী সন্ত্রাসীরা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে বলে জানিয়েছেন। রামপালের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের এক বয়স্ক গৃহবধূ বলেন,‘যারা তাউরাস (ত্রাস) করতিছে তারা কমবয়সী, কিন্তু এগ পিছনে বড় মানুষ আছে’। বাগেরহাটের সন্ত্রস্ত জনপদগুলো ঘুরে হামলার শিকার নর-নারী, স্থানীয় প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এই প্রতিবেদকেরও মনে হয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোটের দ্বিতীয় সারির নেতাদের ছত্রছায়ায় থাকা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এই নারকীয় ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় এই চক্রে বেপরোয়া মনোভাব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসব খবর লেখালেখি হওয়ায় প্রশাসন আবার নড়েচড়ে বসে। তারা বাস্তবিক হয়ে পড়ে সবকিছু স্বাভাবিক দেখাতে। চাপের মুখে থাকা আতঙ্কিত এই মানুষেরা বর্তমানে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের চোখ রাঙানিতে প্রশাসনের কর্তাদের বলছে, ‘তাদের কোন সমস্যা নেই’। বাইরের যে কোন মানুষকেও একই কথা বলে। আর প্রস্তুতি নেয় এ সন্ত্রাসীদের হিংস্র থাবার তীব্র আঁচড় থেকে নিজেদের বাঁচানোর। এলাকাবাসীর অভিযোগ, রামপাল এলাকার সকল সন্ত্রাসী ঘটনার নায়ক রাজ্জাক হাওলাদার। তার দক্ষিণ হস্ত বলে পরিচিত নজরুল মোড়ল শতাধিক সন্ত্রাসীর একটি দলকে পরিচালনা করছে। পুলিশ তিনদিন আগে তাকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তুু তার বাহিনী সমানতালে এলাকা দাবড়ে বেড়াচ্ছে। হুমকি দিচ্ছে মানুষদের। ‘নজরুল ভাইয়ের বিরুদ্ধে কেউ মামলা বা সাক্ষ্য দিলে তাদের খবর আছে’ বলে শাসানো হচ্ছে। এদের সঙ্গে আছে আবিদ মল্লিক, মোশারফ হোসেন, হাবিব সর্দার, আখতার , সালাম পাটোয়ারী, মজনু চেয়ারম্যান, শাহরিয়ার মোল্লা, রেজাউল তরফদার, ওয়াজেদ শেখ প্রমুখ। রামপালের গৌরম্ভা এলাকায় বিএনপি আশ্রিত মীর মোহম্মদ, ছালাম লস্কর, লিয়াকত, আসলাম, আছাদ, টিটু প্রমুখ এলাকায় অব্যাহতভাবে হুমকি দিয়ে চলেছে। মংলার সোনাইতলা ইউনিয়নে রাজ্জাক হালদারের ভাইপো রফিক হালদারের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ৬০ সদস্যের লুটপাট বাহিনী। এই বাহিনীর অন্যতম পাণ্ডা ফকির তৈয়েবুর রহমানকে মংলা থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। বিএনপি নেতারা তাকে ছাড়িয়ে নিয়েছে বলে এলাকাবাসীর মুখে মুখে ফিরছে। মিঠেখালি ইউনিয়ন এলাকায় আনিস শেখ, ইউনুস শেখ, মিজান মোল্লা অত্যাচার করে চলেছে। এই ইউনিয়নটি রামপালের ভোজপাতিয়া এবং মোড়েলগঞ্জের জিউধরা ইউনিয়ন সংলগ্ন। রামপাল এবং মোড়েলগঞ্জের সন্ত্রাসীরাও এই এলাকায় এসে নানা ধরনের অত্যাচার করে থাকে। চিলা ইউনিয়নে চলছে খোকন মেম্বারের নেতৃত্বে তাণ্ডব। দু’দিন আগে মংলা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। নজির মৃধা ও হানিফের নেতৃত্বে সুন্দরবন ইউনিয়নে হামলা চালানো হচ্ছে। মোড়েলগঞ্জের জিউধরা এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করছে রিপন। তার নেতৃত্বে লিটন, কামাল, ফারুক, চুন্নু মেম্বারসহ ২০/২৫ জনের একদল বেপরোয়া ব্যক্তি হামলা ভাংচুর করে চলেছে। এই রিপন সোমদ্দারখালি কালী মন্দিরের পূজারী সুধাংশু ঠাকুর হত্যা মামলার আসামী। মন্দির এলাকার ২২ একর জমি আত্মসাতের উদ্দেশ্যে পূজারীকে হত্যা করা হয় বলে এলাবাসী অভিযোগ করেন। নির্বাচনের আগের দিন জামিনে মুক্ত হয়ে এসেই সে আবারও সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার শুরু করেছে। জিউধরা এলাকার সাধারণ মানুষ হামলা-নির্যাতনকারীদেরকে সাবেক চেয়ারম্যান মোজাম্মেল খাঁর ‘দালাল’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই মোজাম্মেল খাঁর ছেলেই রিপন।

দৈনিক জনকন্ঠ, ১৮অক্টোবর ২০০১

Exit mobile version