Site icon অবিশ্বাস

যেখানে নির্যাতন চলছে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়নি⎯যেভাবে দুর্গাপূজা দেখিয়ে আনা হলো কূটনীতিকদের

‘মাগো তুমি ফিরে যাও। নির্যাতিত নিপীড়িত মা-বোনদের ঘরে রেখে তোমার আরাধনা সম্ভব নয়। ’এ লজ্জা রাখি কোথায়’⎯ মা দুর্গার উদ্দেশ্যে এই বেদনাবোধ এবং আক্ষেপ জানিয়ে নির্বাচনোত্তর দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক হামলার কারণে এবার হিন্দু সম্প্রদায় এ রকম প্রতিবাদী মনোভাব নিয়ে দুর্গোৎসব উদ্যাপন করছে। নরসিংদী জেলা সদরের পশ্চিম কান্দাপাড়ায় স্থানীয় সংগঠন সেবাসংঘের উদ্যেগে পূজামণ্ডপ করা হয়েছে। মণ্ডপের পাশেই বিরাট একটি বোর্ড। সেখানে সারা দেশে নির্বাচনোত্তর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন-ধর্ষণ-লুটপাটের ঘটনার প্রকাশিত বিভিন্ন ছবি ও সংবাদের কাটিং বুলিয়ে রাখা হয়েছে। এই বোর্ডেই ছিল সে রকম একটি ব্যানার। গতকাল বৃহষ্পতিবার কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করে দেশে প্রথমবারের মতো সরকার বিদেশী কূটনীতিকদের সারাদেশে বিভিন্ন পূজামণ্ডপে নিয়ে যান। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল সারা দেশে সাড়ম্বরে পূজা হচ্ছে এটা দেখানো। একই সঙ্গে দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে খবর প্রকাশিত হচ্ছে তা ঠিক নয় এটা প্রমাণ করা। সারা দেশে ঘটা করে এই পূজা দেখানোর জন্য কূটনীতিক ও সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাদেরকে চারটি দলে ভাগ করা হয়। প্রতিটি দল চারটি করে জেলার বিভিন্ন পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করে। এজন্য চারটি হেলিকপ্টার নেওয়া হয়। এই দলগুলোর নেতৃত্বে ছিলেন তিন প্রতিমন্ত্রী ও একজন বিভাগীয় কমিশনার। মন্ত্রীরা হলেন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাউদ্দিন আহমেদ এবং ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার আমিনুর রহমান। চারটি দল শতাধিক পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করেন। সরকারের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন পূর্বেই স্ব স্ব এলাকার পূজা মণ্ডপগুলো সাজিয়ে রাখে। ব্যাপক লোক সমাগমেরও চেষ্টা করে। কিন্তু অধিকাংশ পূজামণ্ডপেই গতকাল উল্লেখযোগ্য সমাগম লক্ষ্য করা যায়নি। যেসব পূজামণ্ডপে নিয়ে যাওয়া হয় সেগুলো সবই ছিল জেলা সদরে। নির্বাচনোত্তর সংখলঘুদের ওপর যে অকথ্য নির্যাতন চলছে তা অধিকাংশই গ্রামকেন্দ্রিক। সেসব স্থানে স্থানীয় প্রশাসন কুটনীতিক ও সাংবাদিকদের নিয়ে যায়নি। তারপরও শহরের এই মণ্ডপগুলোতে পূজা অর্চনাকারীদের মধ্যে অন্যান্যবারের মতো এবার উৎসাহ- স্বতঃস্ফূর্ততা লক্ষ্য করা যায়নি। পূজামণ্ডপের আশপাশে বহু স্থানে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে ব্যানার-পোস্টার দেখা গেছে। তবে কোথাও প্রকাশ্যে কোনো বিক্ষোভ চোখে পড়েনি। এলাকাবাসী জানান, এবার পূজামণ্ডপের সংখ্যা কয়েকগুণ কমে গেছে। অন্যান্যবার বিভিন্ন মহল্লার স্থায়ী মণ্ডপ ছাড়াও নতুন করে মণ্ডপ করা হতো। এবার ভয়ভীতি ও নানা কারণে তা আর করা হচ্ছে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি এই প্রতিবেদক নরসিংদী, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলার ৬টি পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করেন। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার আমিনুর রহমান। প্রতিমন্ত্রী রেদোয়ান আহমেদ এ দলের নেতৃত্বে থাকার কথা থাকলেও তিনি আসতে পারেননি। প্রতি জেলার ডিসি, এসপি, প্রশাসনের শতাধিক কর্মকর্তা ৩৫/৪০টি গাড়ির বহর নিয়ে এক একটি পূজা মণ্ডপে যান। মণ্ডপে ভিড় না থাকলেও প্রশাসনের লোকজনের আগমনে মণ্ডপে বেশ ভিড় জমে যায়। গোপালগঞ্জ সদরে মাত্র একটি পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করা হয়। এটি ছিল রঘুনাথপুর পূর্ব-দক্ষিণপাড়ায়। এখানে ঢাকঢোল পিটিয়ে পূজা করা হচ্ছিল। কুটনীতিকদেরকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা। রঘুনাথপুরের মৃণাল কান্তি বিশ্বাসসহ বেশ কয়েকজন জানালেন, পঞ্চমীর রাতে এই পূজামণ্ডপের সবগুলো মূর্তি সন্ত্রাসীরা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে যায়। এরপর ডিসি সাহেব আবার টাকা দিয়ে এই মণ্ডপ সাজিয়ে দিয়েছেন। এখানে কমলা রাণী দাশ জানালেন, শহরে তাদের বাসায় কোন হামলা হয়নি। তবে তাদের গ্রামের বাড়িতে সন্ত্রাসীরা হামলা ও লুটপাট করে। মানিকগঞ্জ জেলার সাঁটুরিয়া থানার পালপাড়া পূজামণ্ডপে গিয়ে দেখা যায় এখানে একটি বাড়ির উঠানে পূজামণ্ডপ করা হয়েছে। দোকানদার সতীশ পাল জানালেন, অন্যান্যবার অনেকগুলো পূজামণ্ডপ হতো। এবার তা হয়নি। ভয়ভীতির কারণে এবার খেলার মাঠে মণ্ডপ করা হয়নি বলে তিনি জানালেন।

ভোরের কাগজ ২৬ অক্টোবর ২০০১

Exit mobile version