Site icon অবিশ্বাস

শিল্পমন্ত্রীর কেমিক্যাল জ্ঞান

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ প্রথম আলো

পুরান ঢাকা। সরু রাস্তা আর ঘিঞ্জি লোকালয়। অপরিকল্পিত নগরায়নের বাস্তব উদাহরণ। কোন দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধার কার্য সম্পন্ন করা দুরূহ এক ব্যাপার। সেই দুরূহ কার্য সম্পাদন করার পর আমাদের নীতি নির্ধারকদের যতটুকু মানবিক হওয়ার প্রয়োজন তার বদলে তারা হয়ে ওঠেন হিংস্র এক দানব।

যেমন চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের পর একাধিক সূত্র এবং মিডিয়ার মতে রাসায়নিক এবং দাহ্য পদার্থের কারণে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কিন্তু শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, ‘সেখানে যা ঘটেছে তার সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। সেখানে এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটেছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘সেখানে কেমিক্যালের কোনো গোডাউন নেই, পারফিউম ও কসমেটিক সামগ্রীর গোডাউন আছে। আমি নিজে এটা দেখলাম। কেমিক্যালের সঙ্গে এই ঘটনার সম্পর্ক নেই।’

অথচ ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএম জুলফিকার রহমান সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘এখানে ভবনগুলোর মধ্যে সুগন্ধির ক্যান ছাড়াও লাইটার রিফিল করার ক্যান ছিল। এগুলো সবগুলো অবশ্যই কেমিক্যাল।’

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল ভবনটির নিচতলার গেটের তালা ভেঙে সেখানে রাসায়নিক পদার্থের একটি গুদাম খুঁজে পেয়েছে। সেখান বেআইনিভাবে মজুত করে রাখা ছিলো শত শত দাহ্য রাসায়নিকের কনটেইনার এবং প্যাকেট।

আমাদের শিল্পমন্ত্রী জানেন না এবং বোঝেন না পারফিউমের সাথে রাসায়নিক পদার্থের কী সম্পর্ক! শুধু শিল্পমন্ত্রী কেন, দেশের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে এরকম বিবেকবর্জিত অর্থব লোকজন বসে আছে।

পুরান ঢাকার প্রতিটি ভবন এখনো অরক্ষিত ও অনিরাপদ। রাস্তা থেকে ভবন কিংবা দুই ভবনের মধ্যে যেটুকু খালি জায়গা রাখার কথা, তা-ও রাখা হয়নি। পুরান ঢাকার প্রত্যেকটি সড়ক সরু, দুটো গাড়ি পাশাপাশি যেতে পারে না। অথচ সেসব সড়কের দুই পাশে একের পর এক উঁচু ভবন নির্মিত হচ্ছে। এক ভবনের গায়ে লাগা আরেকটি ভবন। এরই মধ্যে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন, গ্যাসের লাইন, ওয়াসার লাইন। আর এসব ভবনের নিচতলা, দোতলায় রাসায়নিক পদার্থের গুদাম। তার পাশেই মানুষের বসবাস। আইন অনুযায়ী, প্রতি ভবনে অগ্নিনির্বাপণ–ব্যবস্থা থাকার কথা। পুরান ঢাকা কেন, নতুন ঢাকায়ও সব ভবনে সেই ব্যবস্থা নেই।

সরকারের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। অথচ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকার শীর্ষে এখন ঢাকা। তাহলে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় আমাদের দুজন মেয়র ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সেবা সংস্থাগুলো কী করছে? 

৯ বছর আগে নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ‘সরকার ইতিমধ্যেই পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থের দোকান ও গুদাম সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই এলাকায় বর্তমানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে ১০৪টি মামলা করে ৩৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।’

সরকার জরিমানার টাকা আদায় করেছিলো ঠিকই কিন্তু সিদ্ধান্ত আর বাস্তবায়ন হয়নি। বাস্তবায়ন হয়নি বলেই একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে যায় যেমন, তাজরীন গার্মেন্টস অগ্নিকাণ্ড, রানা প্লাজা ধ্বস। মানুষের জীবনের মূল্য সরকারের কাছে নেই বলেই কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয় নি।

আমাদের দেশের সমস্যাগুলো অতি পুরোনো। সমস্যা সমাধানে সরকারের মন্ত্রীরা-কর্তাব্যক্তিরা বড় বড় কথা বলেন। কিন্তু কাজ করেন না। দুর্ঘটনার পর মন্ত্রী-মেয়ররা ঘটনাস্থলে যান, কমিটি করেন। কিন্তু দুর্ঘটনা ঠেকানোর জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ তারা নেন না। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না। ফলাফল আবারও দুর্ঘটনা ঘটে। আবারও কমিটি করেন। কিন্তু পুরোনো কমিটির জবাবদিহিতা আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

এর মাধ্যমে দেশের মানুষের সাথে যে তারা তামাশা করছে এবং এটা যে এক ধরণের প্রতারণা এটা বোঝার মত উপলব্ধি সরকারের নেই। 

 

 

Exit mobile version