৭ অক্টোবর রাতের কথা বলতে গিয়ে বাহাদুরপুর গ্রামের উপেন্দ্রনাথ সরকারের কন্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসছিল। ১৯৬২ সাল থেকে শিক্ষকতা করছেন বলে শত শত ছাত্রছাত্রীর শিক্ষক হিসাবে তার মনে যে অহঙ্কার ছিল সে রাতে মাত্র আধঘন্টার মধ্যে লুটেরা বাহিনী তা ধুলিস্যাৎ করে দিয়ে গেছে। ১ অক্টোবর নির্বাচনের পর থেকেই হম্বিতম্বি, আতঙ্ক ছড়ানো ও টাকা আদায়ের চাপে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন একের পর এক গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। উপেন্দ্রনাথ সরকার গ্রাম ছাড়েননি। তার স্ত্রী ও পুত্রকন্যারা বাড়ি ছেড়ে যান এবং তাকেও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তিনি ভেবেছিলেন, সমাজে যার বহু ছাত্র সুপ্রতিষ্ঠিত, তার ক্ষতি করার সাহস কারো হবেনা। সে বিশ্বাস এলাকার গুটি কয়েক সন্ত্রাসীর আক্রমণে ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে। ৭ অক্টোবর রাত সাড়ে ৯টার পরে অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত হয়ে তারা প্রবীণ শিক্ষকের বাড়িতে হামলা করে। হামলাকারী লুটেরাদের দল বাড়ির টিনের বেড়া কাটতে উদ্যত হলে তিনি নিজেই ঘরের দরজা খুলে দেন। দরজার মত আলমারির পাল্লাজোড়াও খুলে দিতে বাধ্য হন তিনি। লুটেরা বাহিনী আলমারি থেকে ৩ হাজার টাকা ও বেশ কিছু স্বর্ণালংকার বের করে নিয়ে যায় এবং ৫০ হাজার টাকার চেক লিখে দিতে বাধ্য করে তাকে। তিনি সোনালী ব্যাংকের মেদাকুল শাখার অ্যাকাউন্টে ৫০ হাজার টাকার চেক লিখে দিলেও অবশ্য এ পর্যন্ত কেউ সে টাকা তুলতে যায়নি। উপেন্দ্রনাথ সরকারের স্ত্রী ও পুত্রকন্যার মতো বাহাদুরপুর গ্রাম ছেড়ে যাওয়া সংখ্যালঘুদের আরো অনেকেই বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) পর্যন্ত ফিরে আসেনি। গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার রামশীল গ্রাম ও গৌরনদী উপজেলার চারটি গ্রামে ঘুরে দেখা গেছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকে বাড়ি ফিরে যায়নি। এই গ্রাম চারটি হলো বাহাদুরপুর, গোয়াইল, বাকাই ও ধানডোবা। তবে রামশীলে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, আগৈলঝাড়া ও গৌরনদী এলাকার সংখ্যালঘু নারী-পুরুষ যারা রামশীলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন তারা প্রশাসনের উপর্যুপরি চাপের কারণে সংলগ্ন এলাকার অন্যান্য গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। রামশীলের অধিবাসীরা জানায়, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন ‘শরণার্থীদের মধ্যে সন্ত্রাসীরা লুকিয়ে আছে’ বলে এক ধরনের হুমকি দিতে থাকলে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তারা মসুরিয়া, সইলদহ, শশীকর, পীরারবাড়ি, জহরেরকালি, কারইল্লাবাড়ি, ভাঙ্গারহাট ও রাধাগঞ্জ প্রভৃতি গ্রামে চলে গেছেন। অবশ্য গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা অর্ধেন্দু শেখর রায় এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম এলাকাবাসীর দেওয়া এসব তথ্যকে ‘অতিরঞ্জন’ বলে অভিহিত করেছেন। গত বুধবার সকালে রামশীল যাওয়ার পথে খেয়ানৌকার মাঝি পরিতোষ ও সহযাত্রী মনিকা রানী এই প্রতিনিধিদ্বয়কে জানান, গত কদিন ধরে রামশীলে মানুষের ভিড়ে হাঁটাচলা করাও সম্ভব ছিল না। ̄স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী রামশীলে আসবেন ঘোষণা দিয়েও না আসায় এ এলাকার মানুষ হতাশ হয়েছে। তার এসেই দেখে যাওয়া উচিত ছিল আশ্রয়প্রার্থীরা এসেছিল কিনা এবং কতজন ফিরে গেছে। রামশীল থেকে নৌকায় প্রায় ২ ঘন্টার পথ বাহাদুরপুর গ্রামের হাটে নেমে দেখা গেল অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। এ বাজারের অধিকাংশ দোকানি হিন্দু সম্প্রদায়ের। নরেন পাণ্ডের দোকানের দরজা ভাঙ্গা ও বেড়া কেটে শতচ্ছিন্ন করা। বাজার থেকে অল্প দুরেই বাহাদুরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক উপেন্দ্রনাথ সরকারের বাড়ি। পাশেই অখিল সরকারের বাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত। গ্রামের মধ্যে তুলনামূলক অবস্থাপন্ন অখিল সরকারের বাড়ি থেকে ৭ অক্টোবর রাতে আক্রমণকারী লুটেরা বাহিনী নগদ ১৬ হাজার টাকা এবং টেলিভিশন ও বৈদ্যুতিক ফ্যানসহ মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে গেছে। এ সময় তারা আশেপাশে আরো কিছু বাড়িতে লুটের জন্য হামলা করে। পালিয়ে বাঁচতে গিয়ে সত্তরোর্ধ্ব বিধবা ব্রাহ্মণ নীরোদা গাঙ্গুলী হাত ভেঙ্গে ফেলেছেন। ৭ অক্টোবর রাতের কথা বলতে গিয়ে ছোট্ট মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী মলিনা হালদার শুধু কাঁদতেই থাকে। মলিনা জানায়, ‘ওরা আমার মাকে টাকা না দিলে বোমা খাওয়ার জন্য রেডি থাকতে বলেছে।’ গ্রামজুড়ে নীরোদা গাঙ্গুলীর মতো বৃদ্ধা আর মলিনার মতো ছোট্ট শিশুদের দেখা পাওয়া গেছে। তরুণ-তরুণীদের চোখেই পড়ল না। বাহাদুরপুরের পাশের গ্রাম গোয়াইলের দুই ভাই জানান, পালিয়ে গিয়ে পরে গ্রামে ফেরার জন্য তারা ইতোমধ্যে ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। তারা নিজেদের নাম ও কাকে টাকা দিয়েছেন তা ভয়ে জানাতে রাজি হলেন না। অন্য গ্রামগুলোতেও শোনা যায় যে, ফিরে আসতে দুর্বৃত্তদের টাকা দিতে হচ্ছে। বাহাদুরপুরসংলগ্ন অন্য একটি গ্রাম বাকাই। এখানে টোলের শতবর্ষী পণ্ডিত নিরঞ্জন ভট্টাচার্যের এখন স্মৃতিভ্রম ঘটেছে। নির্বাচনের দিন সকাল বেলা এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় এ বৃদ্ধকে প্রহার করা হয়েছে। বাকাই গ্রামেও কোন তরুণ-তরুণীকে দেখা যায়নি। ইতিপূর্বে রামশীলে আশ্রয় গ্রহণকারী একটি গ্রামের যে দুজন তরুণী (নাম অনুল্লেখ রাখা হলো) তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে বলে প্রথম আলোর কাছে জানিয়েছিলেন (১০ অক্টোবর খবর প্রকাশিত) তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আশ্রয়দাতারা জানান, এরা দুজনই নিজ গ্রামে ফিরে গেছেন কিন্তু ওই গ্রামে (নাম অনুল্লেখ) গিয়ে তাদের বাড়ির কাউকে পাওয়া যায়নি। সংখ্যালঘুদের প্রায় বাড়িই খালি।
প্রথম আলো, ২০ অক্টোবর ২০০১