Site icon অবিশ্বাস

সিমি ইন্দ্রানীর পর এবার কাঞ্চন

সংখ্যালঘু এক যুবকের করুণ পরিণতির কথা শুনে এবার চট্টগ্রামের মানুষ স্তম্ভিত, ব্যথিত। ঢাকায় সিমি, বাগেরহাটে ইন্দ্রানীর আত্মাহুতির ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই বর্তমান সময়কে প্রশ্নবিদ্ধ করল আরেকটি আত্মহত্যার ঘটনা। জীবনযুদ্ধে পরাজিত এই যুবকের নাম কাঞ্চন বড়ুয়া। আত্মহত্যার আগে সে লিখে গেছে ডায়েরি। তাতে ফুটে উঠেছে নির্মম ও বেদনাময় এক চিত্র। সৃষ্টি হয়েছে চাঞ্চল্য। ডায়েরিতে বিবাহিত এই যুবক রেখে গেছে কিছু প্রশ্ন, এই সমাজের কাছে। অভিযোগ করেছে ক্ষমতাসীন দলের লোকদের হাতে বর্বরোচিত নির্যাতনের। সোমবার রাতে চট্টগ্রামের একটি হোটেল কক্ষ ভাড়া নিয়ে আত্মহত্যা করেছে সে। আত্মহত্যার আগে হোটেল কক্ষে বসে শিক্ষিত এ যুবক একটি ডায়েরিতে বিএনপি সন্ত্রাসীদের হাতে কিভাবে সে প্রহৃত হয়েছে, পুলিশ কি ভূমিকা নিয়েছে, তার স্ত্রীর কাছে সংসার জীবনে সে কীভাবে নিগৃহীত হয়েছে এবং সর্বোপরি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন সদস্য হওয়াতে এ নির্যাতন কি-না এমন প্রশ্ন রেখে তার জীবন কাহিনী অতি সংক্ষেপে বর্ণনা করে মৃত্যুর হিমশীতল পরশকে আলিঙ্গন করেছে। তার মৃত্যুর পর হোটেল কক্ষ থেকে উদ্ধার করা এ ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ কাহিনী যারাই পড়েছে, তারা হয়েছেন নিদারুণ ব ̈থিত। এ যুবক তার ডায়েরিতে কিছু প্রশ্নও করে গেছে। লিখেছে- “আমার অপরাধ কি? আর যদি অপরাধ করেই থাকি, তার জন্য কি আইন-বিচার দেশে নেই? আমার বাচ্চাদের এখন ভরণ-পোষণ কে দেবে? আমি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলাম কেন? এ দেশে আমার মত কেউ যেন আর নির্যাতিত না হয়। হে প্রভু আমাকে ক্ষমা করে দিও।’ তার লেখার একেবারে শেষে সে লিখেছে ‘চোখের জলের জন্য লিখতে পারছি না। আরও অনেক ক্ষোভের কথা ছিল। সব লিখতে পারছি না। এ মুহূর্তে আবার ছেলেদের মুখ বারবার ভেসে উঠছে এখন রাত ১০টা ২০ মিনিট। বুক ফেটে যাচ্ছে। আনুমানিক ৩৭ বছরের হতভাগ্য যুবকের নাম কাঞ্চন বড়ুয়া। পিতা- মৃত হেমেন্দ্র লাল বড়ুয়া। গ্রাম-জামুয়াইন, পোঃ বিনাজুরি, থানা-রাউজান, চট্টগ্রাম। শহরে তার বাসস্থান-জানে আলম ভবন প্রথম তলা, দক্ষিণ হালিশহর, লোহারপুল, ইশান মিস্ত্রীরহাট, সল্টগোলা ক্রসিংয়ের উত্তর দিকে। এ ঠিকানা সে ডায়েরিতেই লিখে গেছে। ডায়েরিতে ৪০ পৃষ্ঠা জুড়ে কাঞ্চন বড়–য়া তার শিশুকালে মায়ের মৃত্যু, শিক্ষাজীবন, বিয়ে, চাকরি, চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় নিয়োজিত হওয়ার আদ্যপান্ত সংক্ষেপে লিখে গেছে। ১৯৮৩ সালে ডিপ্লোমা ইন কমার্স পাস করে। এর পরে চাকরি করে ’৯৩ সালে বিকম পাস করে। এর পর এক বছর বেকার। পরে জমানো প্রাইবজবণ্ড, টাকা এবং মায়ের দেয়া টাকা দিয়ে নগরীর বন্দরটিলায় ফোন-ফ্যাক্সের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। ডায়েরিতে সে লিখেছে “গত এক বছর ধরে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জমিদার ইলিয়াছ, ইউুসফ, জাহাঙ্গীর গং আমাকে দোকান থেকে উচ্ছেদ করার বিভিন্ন ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা বহুবার আমার ফোনের লাইন, বিদ্যুত লাইন কেটে দিয়েছে। এ ব্যাপারে বন্দর থানায় অভিযোগও করেছি। গত নির্বাচনের পর তারা আরও প্রচণ্ডভাবে আমার পিছনে লাগে, আমার নিকট বড় অঙ্কের চাঁদা চায় তারা। যেহেতু আমি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, তারা আমার স্ত্রীকে বিভিন্ন কু-মন্ত্রণা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। গত ৯/২/০২ রাত সাড়ে ৯টায় আমার স্ত্রী আমার অফিসে গিয়ে হাজির হয়। সাথে ছিল আমার এক ছেলে। সে সময় আমার এক মহিলা গ্রাহক ফোনে কথা বলছিলেন। আমার স্ত্রীর সাথে বাদানুবাদ চলতে থাকার প্রেক্ষাপটে জমিদার ইলিয়াছ, জাহাঙ্গীর, ইউসুফ এবং আরও ৫/৬ জন দোকানে প্রবেশ করে আমাকে মারধর শুরু করে। ক্যাশবাক্স ভেঙ্গে টাকা পয়সা নিয়ে যায়। মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন তাদের মধ্য থেকে একজন বলে যে, আমার কাছ থেকে স্ট্যাম্পে সই করিয়ে নিতে। তারা জোরপূর্বক ভয়ভীতি দেখিয়ে আমার এবং ঐ মেয়ের (গ্রাহক) কাছ থেকে স্ট্যাম্পে সই নেয় (স্ট্রাম্প নং জ ১০৮৮৭১০, ১০০ টাকা মূল্যের)। তারপর তারা আমাকে দোকান বন্ধ করতে বলে। আমি দোকান বন্ধ করি। এর পর সে লিখে গেছে, “ইত্যবসরে এলাকার বিএনপি কর্মী জাবেদ আনসারী তার দলবল নিয়ে দোকানের সামনে আসে। তারা আমার মাসুম দুই বাচ্চার সামনে কোমর থেকে বেল্ট খুলে নিয়ে আমাকে মারধর শুরু করে। মারের যন্ত্রণায় কাঁদতে কাঁদতে আমি জাবেদকে বললাম, তুমি আমাকে মারছ কেন? সে বলে ‘শালার ব্যাটা আবার দোকান খোল’। দোকান খোলার পর সে বন্দর থানার ওসির কাছে ফোন করে। ওসি বলে যে, ‘আমার স্ত্রীকে থানায় পাঠানোর জন্য।’ এর পর আবার দোকান বন্ধ করি এবং আমার জমিদার গং আমার থেকে দোকানের চাবি কেড়ে নেয়ার অনেক চেষ্টা করে। আমি কোন রকমে পালিয়ে একটা ট্যাক্সি করে এলাকা ত্যাগ করি। আমার স্ত্রীকে বন্দরটিলার বিএনপির ছেলেরা জাবেদ আনসারীসহ গোপন স্থানে নিয়ে যায়। সাথে ঐ গ্রাহক মহিলাসহ। এরপরে সে লিখেছে আমার মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী ঃ ১। আমার লাকী বড়ুয়া, ২। জাহাঙ্গীর, ৩। ইলিয়াছ, ৪। ইউসুফ ৫। জাবেদ আনসারী বিএনপি কর্মী ৬। শাহজাহান বিএনপি কর্মী। এরপর সে লিখেছে- কি নির্মম এ অত্যাচার-নির্যাতন তা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। আমার ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে আমি স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক। একজন ̈ কি অত্যাচার-নির্যাতন?” সে আরও লিখেছে “একটু সুখ-শান্তির আশায় আমি অনেক নির্যাতন সহ্য করেছি। কিন্তু পেলাম কি? আমি হোটেলের বইতে ভুল নাম ঠিকানা দিয়েছি। কারণ গত রাত (৯/২/০২) সাড়ে ১১টায় বন্দর থানার একজন এসআই আমাকে ফোনে জানিয়েছে, আমার স্ত্রী থানায় মামলা করতে আসছে। তিনি মামলা নেবেন কি-না? আমি বললাম উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ যদি ঠিক থাকে অবশ্যই মামলা নেবেন। এসআই আমাকে বললেন, তথ্য প্রমাণ ঠিকই আছে, থানায় এনে পাছায় লাথি মারলে সব ঠিক হয়ে যাবে। হায়রে অভাগা এদেশ। অভাগা দেশের প্রশাসন।” সে আরও লিখেছে⎯ “একশ্রেণীর লোক আইনকে তার নিজের গতিতে চলতে দিচ্ছে না। আর ইদানীং আইনকে নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা স্বাধীন দেশের কোন নাগরিকের কাম্য নয়। যারা আমার ওপর হামলা করেছে আমি তাদের বারবার অনুরোধ করেছি, কেউ আমার কথা শোনেনি। সে আরও লিখেছে, “আমার দোকানে জমিদার গং আমার স্ত্রীকে আমার বিরুদ্ধে ট্রাম্পকার্ড হিসাবে ব্যবহার করেছে। কারণ আমার স্ত্রী অশিক্ষিত ও বাচাল স্বভাবের। আমার দোকানের জমিদারের ছোট ভাই একজন অবৈধ আদম ব্যবসায়ী। ফেনসিডিল ব্যবসায়ীও। দুবাই পাঠাবে বলে অনেকের কাছ থেকে আগাম টাকা নিয়ে মেরে দিয়েছে। বন্দর থানায় তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ লিপিবদ্ধ আছে। মার্কেটের নিচে সিঁড়ির সামনের দোকানে চলে তার ফেনসিডিল ব্যবসা। রাত ৯টার পর থেকে চলে ফেনসিডিল সেবন সেই দোকানে। ইলিয়াছ আমার দোকানে সেই ব্যবসা করতে চেয়েছিল। আমি রাজি হইনি বলে সে আমার ওপর ক্ষিপ্ত।” রবিবার রাত অনুমানিক সাড়ে ১০টায় অন্তর্জ্বালায় দগ্ধ এ যুবক বিষপানে কাঞ্চন হোটেল কক্ষে আত্মহত্যা করে। হোটেল মিডটাউনের ম্যানেজার জনকণ্ঠকে জানান, ৯ ফেব্রুয়ারি রাত ১টায় কাঞ্চন ‘রিমন চৌধুরী ১৭/এ লালবাগ ঢাকা (মিথ্যা নাম ও ঠিকানা) দিয়ে ৪৮০ নম্বর কক্ষ ভাড়া নেয়। রাত কাটানোর পরদিন কাঞ্চন বড়ুয়া লাগেজ এনে রুমে ঢুকে। সকাল থেকে সে দু’বার বাইরে যায়। রাত ৯টা নাগাদ সে বাইরে থেকে এসে রুমে ঢোকে। পরে কাউন্টারে এসে কোথাও ফোন করে। এর পরই রাত ১১টা নাগাদ পুলিশ এসে রুমের লক খোলে। তখন কাঞ্চন বিষের যন্ত্রণায় কাতর। দ্রুত তাকে চমেক হাসপাতালে নেয়ার পথে সে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। সোমবার দুপুরে কোতোয়ালি পুলিশ লাশের ময়না তদন্ত সম্পন্ন করে। থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা রুজু হয়েছে। পুলিশ কাঞ্চনের লেখা ডায়েরিটি উদ্ধার করেছে। পুলিশের কাছ থেকে তার স্ত্রী লাশ গ্রহণ করেছে। এদিকে যে এলাকায় এ ঘটনা সেই বন্দর থানা-পুলিশ বলেছে, কাঞ্চন বড়ুয়া তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ করেনি। তবে ডিসি (বন্দর) নাঈম আহমদ জানিয়েছেন, নিহত কাঞ্চন বড়ুয়ার লেখা তথ্যের ভিত্তিতে বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে কারও প্ররোচনা বা নির্যাতনে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।

দৈনিক জনকণ্ঠ, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০২

Exit mobile version