Site icon অবিশ্বাস

সুবর্ণচরে সংঘটিত ধর্ষণ নিয়ে গণ-প্রতিবেদন

সুবর্ণচরে সংঘটিত ধর্ষণ নিয়ে গণ-প্রতিবেদন
 
প্রিয় গণমাধ্যমকর্মী ও সহযোদ্ধাবৃন্দ,
আপনারা অবগত আছেন যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে নোয়াখালির সুবর্ণচরে একজন নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। দেশের সর্বত্র এ নিয়ে প্রতিবাদ চলমান, এমনকি দেশের বাইরেও অনেকে রাস্তায় নেমেছেন এই ঘটনার প্রতিবাদে। গণধর্ষণের প্রতিবাদ ও ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীজোট- এর প্রতিবাদ সমাবেশও অব্যাহত রয়েছে। গত ৪ জানুয়ারি শুক্রবার শাহবাগের মানববন্ধন থেকে আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম সুবর্ণচরে যাবার। পরবর্তীতে গত ৬ জানুয়ারি রবিবার, যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীজোট- এর পক্ষ থেকে সরেজমিনে সুবর্ণচর উপজেলায় যাওয়া হয় এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। আমরা মনে করছি, গণমাধ্যমের রিপোর্টে যা পড়েছি বা দেখেছি বাস্তবের চিত্র সব কিছুকেই হার মানিয়েছে।
 
ঘটনার ধারা বিবরণ-
গণধর্ষণের শিকার চার সন্তানের জননী নোয়াখালির সুবর্ণচর উপজেলার পাংখারবাজার এলাকায় বসবাস করেন। ভূমিহীন সংগঠনের একজন সদস্যই শুধু না বরং প্রতিবাদী এক চরিত্রের অধিকারী তিনি। আর তাই রুহুল আমিনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর চক্ষুশূলে অনেক আগেই পরিণত হয়েছিলেন তিনি। ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধর্ষক রুহুল আমিনের পছন্দের প্রতীকে ভোট না দেয়ায় সেই ভোটকেন্দ্রেই রুহুল আমিন তাকে হুমকি দেয়। ভোটকেন্দ্রের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভূমিহীন সংগঠনের প্রতিবাদী মুখগুলোকে বন্ধ করে দেয়ার এক হীন উদ্দেশ্যে রুহুল আমিনের সন্ত্রাসী বাহিনী সে রাতেই হামলা চালায় গণধর্ষণের শিকার নারীর বাড়িতে। প্রায় ১৪জনের একটি দল স্বামী সন্তানকে বেঁধে তার উপর চালায় অত্যাচার, ধর্ষণের শিকার নারীকে ভয়াবহ কায়দায় পেটানো হয় এবং গণধর্ষণ করা হয়। আসামীদের মধ্য থেকে ৯ জন মিলে পালাক্রমে ওই গৃহবধূকে গণধর্ষণ করে। একপর্যায়ে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর তারা ওই গৃহবধূর ১৪ বছরের শিশুকন্যাকে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু শিশুটি কৌশলে পালিয়ে গেলে তাকে না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে পুনরায় তার ওপর নির্যাতন চালায়। এরপর ওই নারীকে বেধড়ক পেটানো হয় এবং হাতসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে কামড়িয়ে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়। একপর্যায়ে তাকে মৃত ভেবে ধর্ষকরা পালিয়ে যায়। বর্তমানে গণধর্ষণের শিকার নারী নোয়াখালি জেনারেল হাসপাতালের ভিআইপি কেবিনে রয়েছেন।
 
প্রশাসনিক তৎপরতা –
ঘটনার পর পরই সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা করা হয় যেখানে মূল পরিকল্পনাকারী, উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক রুহুল আমিনসহ বেশ কজন আসামীকে বাদ দিয়ে মামলা নথিভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ঘটনা নিয়ে দেশব্যাপী যখন তোলপাড় শুরু হয় তখন দ্রুত প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে বাকিদের নামও অন্তভুর্ক্ত করা হয়। আমাদের তদন্তে যে ১৪ জনের সংশ্লিষ্টতা উঠে এসেছে তাদের নাম নিম্নে দেয়া হলো।
  • মূল পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা রুহুল আমীন, প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সুবর্ণচর উপজেলা শাখা।
  • মোশারফ হোসেন, পিতা তোফায়েল
  • সালাহ উদ্দীন, পিতা আলমগীর ।
  • সোহেল, পিতা ইসমাইল।
  • হেঞ্জু মাঝি, পিতা চাঁন মিয়া।
  • বেছু, পিতা আবুল কাসেম
  • জসিম, শ্বশুর- আনিসুল হক মাঝি।
  • মোঃ সোহেল, পিতা আবুল কালাম।
  • আবু চৌধুরী।
  • স্বপন, পিতা আবদুল মন্নাছ।
  • আনোয়ার, পিতা ইউছুপ মাঝি।
  • বাদশা, পিতা আহমদ উল্ল্যাহ।
  • হানিফ, পিতা বাগন আলী।
  • আমির হোসন, পিতা নুরুল হক।
এখনো প্রায় ৩ জন অপরাধী গ্রেফতার হয়নি, যা উদ্বেগজনক। যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীজোট জেলা প্রশাসনের সাথেও কথা বলেছে এবং উদ্বেগের বিশয়গুলো উপস্থাপন করেছে। উল্লেখ্য, প্রশাসন খুব দ্রুততার সাথেই এই মামলাকে পরিচালনা করছেন। এখন পর্যন্ত নোয়াখালি প্রশাসনের তৎপরতা ও পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। তবে আমরা এও লক্ষ্য করেছি, প্রশাসনের ক্ষুদ্র একটি অংশ রাজনৈতিকভাবে রুহুল আমিনের পক্ষে এবং তাকে বাঁচানোর একটা চিন্তা তাদের কথাবার্তায় স্পষ্ট!
 
একজন ‘ধর্ষক ও ভূমিদস্যু রুহুল আমিন’ হয়ে উঠার পেছনে রাজনৈতিক দলের অবস্থান-
 
আজকের রুহুল আমিন একদিনে হয়নি বরং দীর্ঘ সময় ও দলীয় সুযোগের কারণেই ধর্ষক রুহুল আমিনের জন্ম। ‘হোটেল বয়’ থেকে কোটিপতি রুহুল আমিন হবার পেছনে রয়েছে দলীয় প্রভাব। স্থানীয়দের উদ্যোগে এক সমাবেশে অংশ নিয়ে ‘যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীজোট’ স্বচক্ষে দেখে আসে ধর্ষক রুহুল আমিনের নির্যাতনের চিত্র। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে অনেক তথ্য। রামগতি-চরজব্বার সড়কের পাংখার বাজার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে তার নামে গড়ে তোলা হয়েছে রুহুল আমিন নগর। সেখানে রয়েছে রুহুল আমিনের বিলাসবহুল বাড়ি, আছে একটি ইটভাটা, দোকানপাটসহ ব্যবসায়িক ঘর। অসংখ্য মানুষের জমি দখল, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত এই রুহুল আমিন। বনদস্যু ও জলদস্যুদের নিয়ে রয়েছে তার ‘রুহুল আমিন বাহিনী’। আর রুহুল আমিনের এসব অপকর্মের শক্তির উৎস স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগ এর সাধারণ সম্পাদক হানিফ চৌধুরি। দলীয় আশ্রয়ে থাকায় কেউই তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায়না।
 
গণধর্ষণের ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত রুহুল আমিন সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছে মূলত চেয়ারম্যান হানিফের মাধ্যমেই। স্থানীয় এমপি’র সাথে চরজুবলী ইউপি চেয়ারম্যান হানিফের সখ্যতার সূত্র ধরেই রুহুল আমিন ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সম্পাদকের দায়িত্ব পায় এবং দলীয় প্রভাব খাটানো শুরু করে। ২০১১ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৫ নম্বর চরজুবলী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়। দলীয় ফোরামের অনেক বিরোধীতা সত্ত্বেও সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও চরজুবলী ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হানিফ চৌধুরী, রুহুল আমিনকে সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক করে। মূলত এই হানিফের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রুহুল আমিন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করেছে এবং এলাকায় অপরাধের রাজত্ব কায়েম করে। রুহুল আমিনের সকল অপরাধের পাওয়ার হাউস হচ্ছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হানিফ চৌধুরি।
 
আমাদের দাবীসমূহ-
সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীজোট মনে করছে, গণধর্ষণের শিকার নারী, তার পরিবার ও মামলার স্বার্থে খুব দ্রুতই বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
  • ভিক্টিমকে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে আসা এবং ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস’ এ স্থানান্তর।
  • গণধর্ষণের শিকার নারী ও তার পরিবারের নিরাপত্তা এখনো সঠিকভাবে নিশ্চিত করা হয়নি তাই দ্রুত ভিক্টিম ও পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
  • মামলার সকল আসামীদের গ্রেফতার ও ‘রুহুল আমিন বাহিনী’র সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেফতার। অন্যথায় একের পর এক হুমকিতে সমস্যায় পড়তে হবে গণধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার এই পরিবারটিকে এবং মামলা ভিন্নখাতে প্রবাহিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
  • স্বচ্ছ ও দ্রুত সময়ে ৯০ দিনের মধ্যে সুবর্ণচরে সংঘটিত গণধর্ষণের মামলার রায় প্রদান।
  • সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ধর্ষক রুহুল আমিনের সকল অপকর্মের মূল হোতা, চরজুবলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হানিফ চোধুরীকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার। অন্যথায় এ মামলা দলীয় প্রভাবযুক্ত হবে বলে আমরা আশংকা প্রকাশ করছি।
  • আমরা ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী করছি, বিনা বিচারে হত্যাকান্ড যেনো না ঘটে। আমরা দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেখতে চাই।
যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীজোট এই গণধর্ষণের বিচার দ্রুত সময়ের মধ্যে হবার দাবী জানাচ্ছে। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রীতার মাধ্যমে যেনো ন্যায়বিচার আটকে না পড়ে। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এ দেশ কোন ধর্ষকের চারণভূমি হতে পারেনা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত সেখানে কোন নারী নিপীড়ক ও ধর্ষকের স্থান হতে পারেনা। জয় আমাদের হবেই- জয় বাংলা।
 
আহবায়ক,
যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীজোট- Students Community against Rape and Sexual Violence (SCaRSV)
Exit mobile version