Site icon অবিশ্বাস

হলি আর্টিজানে হামলাকারী জঙ্গি রিপন গ্রেপ্তার

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিদের ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি)। ওই হামলার জন্য ৩৯ লাখ টাকা আসে পাকিস্তান থেকে। বর্তমানে জেএমবির আমির সালেহীন পাকিস্তানে আল-কায়েদার নিয়ন্ত্রণে থেকে দেশে জঙ্গিবাদের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।

রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে মামলার চার্জশিটভুক্ত পলাতক আসামি মামুনুর রশিদ রিপনকে গ্রেপ্তার করে এসব তথ্য জানতে পেরেছে র‌্যাব। ১৯ জানুয়ারি শনিবার গভীর রাতে গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২০ জানুয়ারি রবিবার তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। গতকাল রবিবার বিকেলে সবুজবাগ থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলায় রিপনের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন মহানগর হাকিম কণক বড়ুয়া। তবে হলি আর্টিজান মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে ধরা পড়তে এখন শুধু বাকি আছে শফিকুল ইসলাম খালিদ। র‌্যাব ও পুলিশ সূত্র এসব তথ্য জানায়।

এদিকে র‌্যাব-পুলিশের গ্রেপ্তার ও সাঁড়াশি অভিযানের মুখেও নতুন নেতৃত্বে আরো শক্তিশালী হয়ে নাশকতামূলক হামলা চালানোর জন্য সংগঠিত হচ্ছে জেএমবি। এরই মধ্যে তাদের একাধিক সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনার কথা গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে। বিশেষ করে সম্প্রতি পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়া বর্তমান আমির সালেহীন পাকিস্তানে আল-কায়েদার নিয়ন্ত্রণে থেকে জেএমবিকে সংগঠিত করছে—এমন তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।

জেএমবি বর্তমানে কার নেতৃত্বে চলছে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে জঙ্গি সালেহীন জেএমবিকে সক্রিয় ও সংগঠিত করার কাজে আছে। তার নির্দেশনায় জামিনে থাকা ও পলাতক জঙ্গিরা জেএমবিকে পুনর্গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে।

সালেহীন সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, সালেহীন দীর্ঘদিন ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে অবস্থান করার পর পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। সে পাকিস্তানে আল-কায়েদার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। পাকিস্তানে থেকেই সে জেএমবিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতনদেরও জানানো হয়েছে।

অন্যদিকে জেএমবির সুরা সদস্য রিপন ও হলি আর্টিজানের আগে জেএমবির পরিকল্পনা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রিপনের দায়িত্ব ছিল গুলশান হামলার অর্থ সংগ্রহ, সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও অস্ত্র সরবরাহ করা। সংগঠনের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তার ভালো যোগাযোগ ছিল। হলি আর্টিজানে হামলার আগে সে ৩৯ লাখ টাকা জোগাড় করে দিয়েছিল জেএমবির শীর্ষ নেতার হাতে। ওই হামলার জন্য পাশের দেশ ভারতে থাকা জেএমবি সদস্যদের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে অর্থ, অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করেছিল। এ ছাড়া কারাগারে থাকা জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার। হলি আর্টিজান হামলা মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু পর সহযোগীদের নিয়ে এই পরিকল্পনা করেছিল সে। এ ছাড়া ২০১৪ সালে ত্রিশালের মতো জঙ্গি হামলা চালিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মেরে হলি আর্টিজান মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিদের ছিনিয়ে আনার পরিকল্পনা ছিল তার। এ ক্ষেত্রে ওই হামলার মাধ্যমে জঙ্গিদের উদ্বুদ্ধ করাই তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এ ছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলার ঘটনায় জড়িত ছিল রিপন।

রিপনকে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে র‌্যাবের কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে হাজির করা হয়। গ্রেপ্তারের ঘটনা ও রিপনের অতীত কর্মকাণ্ড এবং স্বীকারোক্তির কথা তুলে ধরে মুফতি মাহমুদ খান ব্রিফিংয়ে জানান, গাজীপুরের হালুয়াঘাট থেকে ঢাকার দিকে আসার সময় গুলশান হামলা মামলার অন্যতম আসামি রিপনকে (৩০) গ্রেপ্তার করা হয়। মামুনুর রশিদ রিপন ছাড়াও তার একাধিক ছদ্ম নাম রয়েছে। রেজাউল করিম ওরফে রেজা ওরফে আবু মহাজির নামে সে সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে আসছিল। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের সময় রিপনের কাছ থেকে এক লাখ ৪৭ হাজার ৭৫৫ টাকা পাওয়া গেছে। অর্থ ছাড়াও তার কাছ থেকে একটি ডায়েরি, চারটি খসড়া মানচিত্র পাওয়া গেছে। রিপনের বাবার নাম নাছিরউদ্দিন। গ্রামের বাড়ি বগুড়ার শেখেরমাড়িয়ার নন্দীগ্রাম। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে। সেখানে সে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করে। পরে তার বাবা তাকে মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। সে ঢাকার মিরপুর, বগুড়ার নন্দীগ্রাম ও নওগাঁর বিভিন্ন মাদরাসায় অধ্যয়ন করে। সর্বশেষ সে ২০০৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাদরাসাতুল দারুল হাদিস থেকে দাওরা-ই হাদিস সম্পন্ন করে। এরপর সে বগুড়ার সাইবার টেক নামের একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে অফিস অ্যাপ্লিকেশন কোর্স সম্পন্ন করে ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরি শুরু করে।

ব্রিফিংয়ে বলা হয়, সাইবার টেকে চাকরি করা অবস্থায় নজরুল নামে এক চিকিৎসকের মাধ্যমে ২০১৩ সালে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে রিপন। তার আসল নাম মামুনুর রশিদ হলেও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার পর প্রথম সাংগঠনিক নাম দেওয়া হয় রিপন। চিকিৎসক নজরুল ওই সময় জেএমবির একাংশের আমির ছিল। শুরুতে তার প্রাথমিক কাজ ছিল চাঁদা সংগ্রহ করে চিকিৎসক নজরুলের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এভাবে ধীরে ধীরে সে জেএমবির প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। চিকিৎসক নজরুলের আস্থাভাজন হিসেবে রিপন পরে অল্প সময়ের মধ্যে (নজরুলের জেএমবি অংশের) সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরে চাঁদা নিয়ে বিরোধের জেরে ডা. নজরুলকে রিপন ও তার সহযোগীরা হত্যা করেছিল বলে জানতে পেরেছেন র‌্যাব সদস্যরা।

হলি আর্টিজান হামলার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার বিষয়ে রিপন র‌্যাবকে জানায়, তারা ২০১৫ সালে গাইবান্ধায় মিটিং করে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে হলি আর্টিজান হামলার পরিকল্পনা করে। হামলার জন্য তারা তিনটি একে-টু, একটি পিস্তল সরবরাহ করেছিল। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে ফের বাংলাদেশে প্রবেশ করে রিপন। সম্প্রতি তারা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানসহ আদালত প্রাঙ্গণে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা করে।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজান বেকারিতে পাঁচ তরুণের হামলায় ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে জবাই ও গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই হামলায় জড়িত ২১ জনকে চিহ্নিত করে তাদের মধ্যে জীবিত আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। গত বছর ২৬ নভেম্বর আলোচিত এ মামলার বিচার শুরুর নির্দেশ দেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মুজিবুর রহমান। ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী, অপরাধ প্রমাণিত হলে হলি আর্টিজান মামলার আসামিদের সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।

কালের কণ্ঠ

 

Exit mobile version