Site icon অবিশ্বাস

৫ শতাধিক ধর্ষণ ঃ সরকারের চোখ এখনো বন্ধ!

নির্বাচনের পর সারা দেশে ৫ শতাধিক সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত কোনো ধর্ষণের ঘটনার কথা সরাসরি স্বীকার করেনি। পুলিশ সদর দপ্তর মধ্য ডিসেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনায় মামলার দলিলপত্র থেকে এ সংখ্যা ৪টি বলে উল্লেখ করে। তবে ধর্ষণপীড়িত এলাকাগুলো সরজমিন পরিদর্শনকারী সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, মহিলা পরিষদ এবং সিটিজেন ভয়েজ সুত্রগুলো ৫০০ থেকে ১ হাজার বলে দাবি করে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে মন্ত্রী পুরো বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে, ভোরের কাগজকে বলেন, ‘আপনি কি নিজের চোখে ধর্ষিত হতে দেখেছেন? আমি তো দেখিনি। যদি নিজের চোখে দেখে থাকেন তাহলে সেটা উল্লেখ করেন। কয়েকজন মানবাধিকার কর্মী কর্তৃক ঢাকায় নিয়ে আসা ধর্ষণের শিকার তিন নারীর সঙ্গে কথা বলে, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ৫টি গ্রাম ঘুরে ঘুরে এবং সরজমিন পরিদর্শনকারী দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ধর্ষণের ঘটনা স্বাধীনতা উত্তর বিগত যে কোন সময়ের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি। সরজমিন সূত্র জানায়, কেবল মাত্র ভোলার অন্নদা প্রসাদ গ্রামেই অক্টোবরের ২ তারিখ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে ১০০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সূত্রগুলো জানায়, ভোলার লালমোহন থানার লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নে, বরিশালের আগৈলঝাড়া, রামশীল, গৌরনদী, বাগেরহাটের রামপাল, ফকিরহাট, মোল্লার হাট, বরগুনার বামনা, পাথরঘাটা, পাবনার সিরাজগঞ্জ, যশোরের কেশবপুর, রাজশাহীর নাটোর গাজীপুরের কালিয়াকৈর চাঁদপুরের কচুয়া, সদর থানা, চট্টগ্রামের রাউজান এলাকায় সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সূত্রগুলো জানায়, এখন পর্যন্ত এসব জনপদ ধর্ষণসহ সব ধরনের যৌন সন্ত্রাসে আতঙ্কিত। সরজমিন পরিদর্শনকারী সামাজিক আন্দোলনের নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ৮ বছরের শিশু থেকে ৫৫ বছরের পৌঢ় পর্যন্ত কেউই যৌন হয়রানি থেকে রক্ষা পায়নি। সরজমিন পরিদর্শনকারী মহিলা পরিষদ নেত্রী আয়শা খানম বলেন, ৭২-এ ধর্ষিতা পুনর্বাসনের কাজে নিযুক্ত ছিলাম। কিন্তু এবার যে সব নারকীয় ঘটনা ঘটানো হয়েছে তা তখনও দেখিনি। ভোলার লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের অন্নদা প্রসাদ গ্রামের ধর্ষণের শিকার এক নারী (৩২) জানান, শুধু এলাকার নয়, দুই দিন দুদফায় এসে তাকে কয়েকজন মিলে ধর্ষণ করে। প্রথমবার দিনের বেলায় এবং দ্বিতীয় বার রাতের বেলায়। বাড়ির একমাত্র পুরুষ তার স্বামীকে বেঁধে রেখে তার চোখের সামনেই তাকে ধর্ষণ করা হয়। বরিশালের আগৈলঝাড়ার ধর্ষণের শিকার কর্মকারের মেয়ে (২২) জানান, নির্বাচনের আগেই আমাদের ওপর (হিন্দু সম্প্রদায়) নির্যাতন হবে শুনেছিলাম। কিন্তু এ রকম বেইজ্জতি করবে তারা, কখনই বুঝি নাই। তিনি বলেন, ওরা আমাদের এলাকারই, কিন্তু আমার বাবা বা ভাই কারো পক্ষেই সহজ হবে না তাদের বিরুদ্ধে বিচার চাওয়া। বাগেরহাটের ফকিরহাটের স্কুল পড়ুয়া (১৪) ছাত্রী জানান তার গণধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা। স্কুলছাত্রীটি জানান, হিন্দু এবং চক্রবর্তী পরিবারের মেয়ে হওয়ার কারণে তার ওপর আক্রোশটা অনেক বেশি ছিল। তিনি জানান, তাকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে ধর্ষণ করে সন্ত্রাসীরা। তিনি বলেন, কতটা নিরাপত্তাহীন হলে বাগেরহাট ছেড়ে ঢাকায় নিরাপত্তার জন্য থাকতে হচ্ছে বোঝেন। ‘এ বিষয়ে সম্প্রতি সংখ্যালঘু নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের বিরুদ্ধে রিট পিটিশনকারী আইন ও শালিস কেন্দ্রের এডঃ সুলতানা কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ধর্ষণসহ হত্যা, চাঁদাবাজি শারীরিক নির্যাতন সব ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে স্পষ্ট বক্তব্য চেয়ে হাইকোর্টে আমরা রিট করেছি। ১৫ জানুয়ারি হচ্ছে সরকারের বক্তব্য প্রদানের শেষ দিন, সে পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করবো। ডঃ কামাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের জবাব শোনার কথা বলে বললেন, সরকার অস্বীকার করল, অথচ পত্রিকায় তো প্রায় প্রতিদিনই এ ঘটনাগুলো ঘটার কথা উল্লেখ হচ্ছে, তাহলে সরকার সেটুকু যাচাই করুক। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদকে পরিস্থিতির বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, আমিওতো খুব নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ১টা হোক আর পাঁচটা হোক সরকারের উচিৎ এটা স্বীকার করা। ব্যারিস্টার ইশতিয়াক বলেন, আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। এ বিষয়ে আইনের তেমন কিছুই করার নেই, যতোক্ষণ পর্যন্ত না আইন নিয়ন্ত্রণকারী ক্ষমতাধররা কিছু করেন। মহিলা পরিষদ নেত্রী আয়শা খানম বলেন, সরজমিন অভিজ্ঞতা থেকে অবশ্যই বলবো এটা কোন সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ফল নয়। এটা পুরোপুরিই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ঘটনা। কারণ অনেক মুসলিম পরিবারকে দেখা গেছে নির্যাতিতদের আশ্রয় দিতে। নারী নেত্রী ফরিদ আক্তার বলেন, ইয়াসমিনের ধর্ষণের ঘটনাকে অস্বীকার করে যেমন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পার পেতে পারেননি, এবারো এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পার পেতে দেওয়া যাবে না। তাকে স্বীকার করতেই হবে যে, নির্বাচনের পর হিন্দু নারীরা রাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিকার হয়ে ধর্ষিত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম নেত্রী শামসুন্নাহার জোৎস্না বলেন, সম্মিলিত নারী সমাজ জানুয়ারিতেই এই ইস্যুতে কঠিন কর্মসূচি দেবে। সরকারের স্বীকার করে নেওয়া এবং ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন করতেও সরকারকে চাপ দেওয়া হবে।

ভোরের কাগজ, ২৫ ডিসেম্বর ২০০১

Exit mobile version