Site icon অবিশ্বাস

অনন্ত বিজয় দাশ | আমাদের জন্য ভোর আনতে বেরিয়েছিলেন তিনি

ভোর, আলো, শিখা, মুক্তি, সাম্য, যুক্তি, জেগে ওঠা —এসবের সাথে তার বসবাস। তিনি ইতিবাচক, তিনি স্বপ্নবান, তিনি পরিশ্রমী এক নিরব বিপ্লবী, যিনি আমাদের জন্য ভোর আনতে বেরিয়েছিলেন। তিনি অনন্ত বিজয় দাশ। যুক্তির আলোয় মুক্তির অন্বেষণে একনিষ্ঠ সমর্থক। লেখক, গবেষক, সম্পাদক —অনেক পরিচয় তার। প্রতিটি পরিচয়ে তিনি সমান উজ্জ্বল। যেখানে বুদ্ধির মুক্তির জন্য কেউ কিছু করছে, সেখানে অবশ্যই অনন্ত বিজয় দাশকে পাওয়া যাবে -বিষয়টা এমন ছিলো। এই মানুষটি আমাদের সময়ের সংগঠক। এতটা দায়িত্ব নিয়ে, এতটা ভালোবেসে সমসাময়িক কেউ অতীত ঐতিহ্যের সাথে বর্তমানের যোগসূত্র স্থাপন করেনি। আমাদের সমাজকর্মীরা, সংগঠকরা যখন শিকড় ভুলে, গৌরব অস্বীকার করে এক কিম্ভুতকিমাকার লক্ষ্যকূপে তলিয়ে যাচ্ছেন, অনন্ত তখন হৃষ্ট অতীতের সাথে অন্ধকার বর্তমানের সম্পর্ক স্থাপন করে এক অনিন্দ্যসুন্দর ভবিষ্যতের রূপরেখা তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন।

১৯৮২ সালের ৬ অক্টোবর সিলেটের সুবিদবাজার এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন অনন্ত বিজয় দাশ। পিতার নাম রবীন্দ্র কুমার দাশ এবং মাতার পিযুষ রানী দাশ। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। শৈশবকাল থেকেই তার বই পড়ার অভ্যাস। টিফিনের টাকা জমিয়ে বই কিনতেন, সুযোগ পেলেই অন্যের কাছ থেকে নিয়ে এসে পড়তেন। বই সংগ্রহ ও পড়া তার প্রথম নেশা। বাড়িতে অনন্ত’র থাকার ঘর ছিলো একটা সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজের পর বিশ্ববিদ্যালয় শেষ হয়। অনন্ত যত বড় হয়, তার বই পড়ার অভ্যাসও তত বিস্তৃত হয়।

অনন্ত উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্ম বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর সুনামগঞ্জের জাউয়াবাজারে পূবালী ব্যাংকের ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে যোগ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এখানেই কর্মরত ছিলেন।

অনন্ত বিজয় লেখালেখি শুরু করেন মূলত মুক্তমনা দিয়ে। ড. অভিজিৎ রায় তাকে মুক্তমনায় লিখতে উৎসাহিত করেন। তখন মুক্তমনা ব্লগ ছিলো না, সাধারণ ওয়েবসাইট ছিল। সেখানে দেশ-বিদেশের অনেক লেখক নানাবিধ বিষয় নিয়ে লিখতেন। এর মধ্যে লেখালেখি শুরু করেন অনন্ত বিজয়ও। মুক্তমনার চিন্তা-চেতনা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তিনি ছিলেন বদ্ধ পরিকর। তার লেখনী ছিলো কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে; মানবতা, বিজ্ঞান, মুক্তচিন্তা ও শোষণহীন সমাজের পক্ষে। তিনি চাইতেন মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশ হয়ে উঠুক মানুষের বাসযোগ্য সবুজাঞ্চল।

অন্য কেউ দেশ ও সমাজে পরিবর্তন নিয়ে আসবেন, অনন্ত বিজয় দাশ সেই অপেক্ষায় থাকতে পছন্দ করতেন না। বরং পরিবর্তনের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। মুক্তমনা সাইটে ব্লগ চালু হলে অনন্ত’র প্রথম পোস্ট প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালের ২০ ডিসেম্বর। প্রথম পোস্টেই পাঠকের জন্য নিয়ে আসেন একটি বিশেষ খবর, অনুপ্রেরণা এবং দৃষ্টান্ত। সিলেটেস্থ ‘বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলের’ নয়জন সহকর্মী মরনোত্তর চক্ষুদান করেছেন। অনন্ত ছিলেন এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক।

এই পোস্টে অভিজিৎ রায় মন্তব্য করেছিলেন-

এটা একটা খুবই ভাল কাজ হয়েছে, অনন্ত। এভাবেই মানুষের সচেতনতা জাগাতে হবে। শুধু চোখ না, আমি তো চাই সকলে মরণোত্তর দেহদান করে যাক। যাত্রা শুরু হোক এখান থেকেই। মনে আছে তো আরজ আলী মাতুবুবর তার মৃতদেহ মেডিকেলে দান করা নিয়ে কি লিখেছিলেন?

“…আমি আমার মৃতদেহটিকে বিশ্বাসীদের অবহেলার বস্তু ও কবরে গলিত পদার্থে পরিণত না করে, তা মানব কল্যাণে সোপর্দ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। আমার মরদেহটির সাহায্যে মেডিক্যাল কলেজের শল্যবিদ্যা শিক্ষার্থীগন শল্যবিদ্যা আয়ত্ব করবে, আবার তাদের সাহায্যে রুগ্ন মানুষ রোগমুক্ত হয়ে শান্তিলাভ করবে। আর এসব প্রত্যক্ষ অনুভূতিই আমাকে দিয়েছে মেডিকেলে শবদেহ দানের মাধ্যমে মানবকল্যাণের আনন্দলাভের প্রেরণা।”

শুধু আরজ আলী মাতুব্বর নয় – ড. আহমেদ শরীফ, ড. নরেন বিশ্বাস, ওয়াহিদুল হক কিংবা গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী যা করেছেন তা হোক সকলের অনুপ্রেরণা।

মরনোত্তর চক্ষুদানের খবর দিয়ে শুরু করা অনন্ত মুক্তমনায় লিখেছেন ২৭টি পোস্ট। এর মধ্যে আছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদ। আর অধিকাংশ পোস্ট নিজের সম্পাদিত ‘যুক্তি’ পত্রিকা বিষয়ক। ‘বিবর্তন’ ছিলো অনন্তের অন্যতম আগ্রহের বিষয়। বিদেশি ভাষায় রচিত বিবর্তন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলো সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য অনুবাদ করেছেন তিনি। শুধু ব্লগ পোস্ট নয়, জীববিবর্তন নিয়ে ফ্রান্সিসকো জে. আয়াল এর লেখা একটি ইংরেজি ভাষার বই ‘জীব বিবর্তনের সাধারণ পাঠ’ নামে অনুবাদ করেন। তার সহ-অনুবাদক ছিলেন আরেক তরুণ মুক্তমনা সিদ্ধার্থ ধর। বইটি ২০০৪ সালে সিলেটের চৈতন্য প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়।

এর আগে সহ-লেখ সৈকত চৌধুরীর সাথে যৌথভাবে ‘পার্থিব’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে শুদ্ধস্বর থেকে। অবসর প্রকাশনী থেকে একই বছর তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘ডারউইন: একুশ শতকের প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা’। এর পরের বছর ২০১২ সালে গবেষণা গ্রন্থ ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব : লিসেঙ্কো অধ্যায়’ এককভাবে প্রকাশিত হয় শুদ্ধস্বর থেকে।

খেয়াল করে দেখবেন এর একটি বইও প্রত্যক্ষভাবে ধর্ম বিষয়ক নয়। সবগুলো বই বিজ্ঞান ও জীবন নিয়ে রচিত। আমাদের সময়ের অথর্ব চিন্তাবিক্রেতা বুদ্ধিজীবীরা শাসকের সাথে সুর মিলিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেন ‘ব্লগাররা সীমা লংঘন করে তাই তারা খুন হয়।’ এ কী ধরণের সীমা এঁকে দেন তারা! তারা কি মনে করেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে বিজ্ঞান নিয়ে লেখা যাবে না? যদি বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখিতে বুদ্ধিজীবীদের বেঁধে দেয়া সীমা লঙ্ঘিত না হয়, তাহলে অনন্ত বিজয় দাশকে কেন ‘ইয়াসিন আল কুরআনুল হাকীম’ অনুসারীদের হাতে খুন হতে হলো? কারণ এখানে সীমা পরিসীমার কোন বিষয়ই নেই। সীমার কোন অস্তিত্ব নেই। ধর্ম কাউকে বিজ্ঞানচর্চার জন্য এক ইঞ্চি সীমাও দেয় না। দেয় না মুক্ত ও স্বাধীনভাবে চিন্তা করার জন্য বাধাহীন এক সেকেন্ড সময়। যেখানে বিজ্ঞান, যেখানে মুক্তচিন্তা, সেখানে ধর্মের দম বন্ধ হয়ে আসে। টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যায়।

অনন্ত বিজয় দাশ ছিলেন সিলেট থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার ছোটকাগজ ‘যুক্তি’র সম্পাদক। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার সম্পাদনায় বের হয় ‘বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল’ এর মুখপত্র ‘যুক্তি’ নামক ছোটকাগজ যা অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিল। ‘যুক্তি’ ম্যাগাজিনে সংগঠনটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে সংক্ষেপে বিবৃত হয়েছে—

আমরা চাই চিন্তার চর্চা ও প্রকাশের স্বাধীনতা। ঘটাতে চাই মুক্তচিন্তার বিপ্লব; সাংস্কৃতিক বিপ্লব। চাই এই বেনিয়াবাজির সমাজ পরিবর্তন। আমাদের দর্শনে বিজ্ঞানমনস্কতা আর যুক্তিবাদ। গাহি মোরা সাম্যের গান।

আমরা মনে করি অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার আর চিরাচরিত প্রথার প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যই মানুষের এগিয়ে যাবার পথে প্রধান অন্তরায়। আরো মনে করি, এই প্রশ্নহীন, যুক্তিহীন বিশ্বাস আর সংস্কারাবদ্ধ জীবনাচরণ কাটিয়ে উঠার একমাত্র পথ হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদের প্রসার।

আমরা মনে করিনা অলৌকিক বলে কিছু ছিল বা আছে। জানি এ নিয়ে আছে শুধু অতিকথন, মিথ্যাচার আর কিছু লৌকিক কৌশল। আমাদের কাছে বিজ্ঞান আন্দোলন নয় কোন খেলা কিংবা প্রযুক্তির সবচেয়ে বেশি সুবিধা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই দায়িত্ব সরকার এবং প্রশাসনের।

আমাদের কাছে বিজ্ঞান আন্দোলনের অর্থ হচ্ছে-কুসংস্কার, অপবিশ্বাস দূর করে যুক্তিবাদী-বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ার আন্দোলন।

বাংলাদেশের অপরাপর মুক্তমনার মত অনন্ত বিজয় দাশও দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন। চিন্তার দাসত্ব থেকে দেশের মানুষের মুক্তির জন্য আন্তরিকতার সাথে কাজ করে গেছেন। শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও কখনো থেমে যাওয়ার কথা ভাবেননি। তার সম্পাদিত যুক্তি পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার পর অসংখ্যবার মামলা ও মৃত্যুর হুমকী পেয়েছেন। কিন্তু এসব হুমকি তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। উল্টো তাদেরকে ভোরের সন্ধানে বেরিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন। যুক্তির প্রথম সম্পাদকীয় শুরু হয়েছিলো এভাবে —

আন্ধারে ভরা রাতি, আলেয়া জ্বালায় বাতি।
বল না, বল না, কে যাবি আনতে ভোর—।।

আর শেষ হয়েছিলো —

প্রথাবিরোধী বিরুদ্ধস্রোতের যাত্রী তালিকা কিন্তু নেহায়েতই কম নয়। এই তালিকায় যেমন রয়েছেন খ্রিস্টপূর্বের অনেক মনীষী তেমনি বর্তমান তালেব অনেক জ্ঞানী-গুণী; যেমন গৌতম বুদ্ধ, চার্বাক, বৃহস্পতি, মহাবীর, অজিত কেশকম্বল, মক্ষলি গোশাল, কপিল, হেরাক্লিটাস, এনাক্সিগোরাস, পিথাগোরাস ডেমোক্রিটাস, সক্রেটিস, হাইপেশিয়া, আল্লাফ আবুল হুজৈল আল আল্লাফ, নজ্জাম, জাহিজ, আবু হাসিব, ওমর খৈয়াম, ইবনে সিনা, কোপার্নিকাস, ব্রুনো, গ্যালিলিও, নিউটন, ডারউইন, কার্ল মাক্স, মেরী ওলস্টোনক্র্যাফ্ট, সিমোন দ্য বোভোয়ার, আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, আব্দুল কাদির, আবুল ফজল, আরজ আলী মাতুব্বর, আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরিন প্রমুখ। এভাবে ক্রমেই তালিকা দীর্ঘায়িত করা যায়। আমরা ঐতিহ্যগতভাবে  তাঁদেরই উত্তরসূরী। বুদ্ধির মুক্তি এবং মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনে, বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ বিনির্মাণে আমরা প্রেরণা পাই এই দৃঢ়চিত্ত মুক্তচিন্তার মনীষীদের কর্মস্পৃহা থেকে। আমাদের চেতনায় মুক্তমন, চর্চা করি বিজ্ঞানমনস্কতা আর যুক্তিবাদিতার।

অনন্ত তার পূর্বসূরীদের সম্পর্কে অবগত ছিলেন, জানতের তাদের কী পরিণতি সম্পর্কেও। সবকিছু জেনে বুঝেই তিনি বিরুদ্ধস্রোতে গা ভিজিয়েছেন। নিজ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে সততার সাথে নিবিষ্ট থাকার কারণে তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ, খ্যাতির প্রতি নির্লিপ্ত। তিনি অর্থবহ সৃষ্টির পক্ষে ছিলেন। বেশ কয়েকজন লেখককে গড়ে তুলেছেন নিজ হাতে। সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। অনেক সাধারণ প্রবন্ধ-নিবন্ধ-বই তার হাতে পড়ে অসাধারণ হয়ে উঠতো। বাংলা অনলাইন জগতের অনেক খ্যাতিমান লেখক রয়েছেন, যাদের পাঠক-নন্দিত বেশ কিছু লেখার পেছনে অনন্ত বিজয়ের উৎসাহ ও প্রণোদনা কাজ করেছে।

২০১৩ সাল থেকে ইসলামী সন্ত্রাসীরা মুক্তমনা ব্লগারদের তালিকা তৈরি করে সিরিজ হত্যাকাণ্ড শুরু করে। প্রথমে ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হয় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনের উপর। জঙ্গিরা ব্যর্থ হয়, আসিফ প্রাণে বাঁচেন। এর পরের মাসে আর জঙ্গিরা ব্যর্থ হয়নি। ১৫ ফেব্রুয়ারি তাদের হাতে খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার (থাবাবাবা)। সহযোদ্ধাদের উপর একের পর এক আক্রমণও অনন্ত’র কাজের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। তাকে যদি কেউ সাবধানে থাকার জন্য বলতেন, তিনি হেসে উড়িয়ে দিতেন।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি যখন অভিজিৎ ও বন্যা আহমেদ জঙ্গিদের দ্বারা আক্রান্ত হলেন এবং অভিজিৎ রায় মারা গেলেন, তখনও অনন্ত বিজয় নির্ভয়চিত্তে লেখালেখি চালিয়ে যান। কিন্তু সঙ্গত কারণে অভিজিৎ হত্যার পর অনন্ত’র পরিবার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কারণ অভিজিৎ ও অনন্ত পাশাপাশি উচ্চারিত নাম। অনন্ত ছিলেন অভিজিতের প্রত্যক্ষ সহকর্মীদের একজন। মা বাবার ধারণা ছিলো অভিজিৎকে যেহেতু বাঁচতে দেয়নি, অনন্তকেও দিবে না। পরিবার ও স্বজনের অনুরোধে অনন্ত বিজয় দাশ ‘আইকর্ন’ নামে নরওয়ের একটি ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তির স্থানান্তরকারী সংগঠনে আবেদন করেন। তারা অনন্ত’র আবেদন গ্রহণ ও অনুমোদন করলেও কবে নাগাদ স্থানান্তর করবে, তার কোন নিশ্চয়তা দেয়নি।

অতঃপর মুক্তমনা দলের কয়েকজন অগ্রজ ‘সুইডিশ পেন’ এর সাথে যোগাযোগ করে ‘আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত একটি সেমিনারে অংশ নেয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সুইডিস সরকার অনন্ত বিজয়কে ভিসা দেয়নি। ফলে তার আর নিরাপদে যাওয়া হলো না। চাকরি ছেড়ে আত্মগোপনে যাওয়ারও সুযোগ ছিলো না। অনন্ত’র উপার্জনের উপর তার পরিবারের বিশেষ নির্ভরতা ছিলো। যে কারণে নিজ নিরাপত্তার জন্য বাধ্যগত স্বাভাবিক জীবনযাপনের বাইরে কিছুই করতে পারেননি তিনি।

এমন অনিরাপত্তার মাঝে থেকেও তার কলম থেমে থাকেনি। ধর্মান্ধতা, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে পুরো রাষ্ট্রের নুইয়ে পড়ার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে একাধিকবার হত্যার হুমকি পান। তবুও চুপ হননি। বলতেন “ধুৎ! হুমকী দিয়ে কেউ কিছু করতে পারবে না!” ১১ মে তিনি পুলিশের সমালোচনা করে ফেসবুকে লিখেন —

অভিজিৎ রায়কে যখন খুন করা হয়, অদূরেই পুলিশ দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছিল। খুনিরা নিশ্চিন্তে খুন করে চলে গেল। পরে পুলিশ বলে তাদের নাকি দায়িত্বে অবহেলা ছিল না। বড় জানতে ইচ্ছে করে তাদের দায়িত্বটা আসলে কী!

ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে যখন খুন করে খুনিরা পালিয়ে যাচ্ছিল তখনও কিন্তু পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু পুলিশের কপাল খারাপ, তারা বলতে পারলো না— এক্ষেত্রেও তাদের কোনো দায়িত্বে অবহেলা ছিল না। কারণ, লাবণ্য নামের তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানবিক মানুষ খুনিদের ধরে ফেলেন। খুনিদের শ্রীঘরে পাঠিয়ে দেন।

বর্ষবরণে হাজার হাজার মানুষের সামনে যখন নারীদের একে একে লাঞ্ছনা করা হচ্ছিল পুলিশ তখন নিধিরাম সর্দার। তারা তখন মূলত দায়িত্ব অবহেলা না করতে সচেষ্ট ছিল। যৌনসন্ত্রাসী গুলোরে পালিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করে দিতেই তারা ব্যস্ত ছিল। তাইতো লিটননন্দীসহ আরো কয়েকজন মিলে কয়েকটা যৌনসন্ত্রাসীকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন, পুলিশ কিছুসময় পরে এদের ছেড়ে দেয়। মিডিয়ায় এবিষয়ে যখন হৈচৈ, পুলিশ তখন সাফ অস্বীকার করে এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। কেউ তাদের কাছে কোনো অভিযোগ করেনি!! সিসিটিভির ফুটেজে যখন অপরাধীদের দেখা গেল, তখন তারা চুপ। পুরানো গিটার আবার বাজালো। কেউ তাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসেনি। সোশাল মিডিয়ায় এতোদিনে কয়েকটা যৌনসন্ত্রাসীকে চিহ্নিত করার পরও পুলিশ নিষ্ক্রিয়। তাদের কোনো দায়িত্বে অবহেলা নেই।

ছাত্র ইউনিয়নসহ কয়েকটি বামসংগঠন ডিএমপি পুলিশের কাছে প্রতিবাদ লিপি দিতে গেল, অপরাধীদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না, নিদেনপক্ষে কোনো উদ্যোগ কেন নেই…. পুলিশ তখন ঝাপিয়ে পড়ে। লাথি দিয়ে, বন্দুকের বাঁট দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আহত করে!! এক্ষেত্রেও আমি শুনতে পাই… আসলেই পুলিশের দায়িত্ব অবহেলা নেই! কিন্তু বড়ই জানতে ইচ্ছে করে ….পুলিশের দায়িত্বটা আসলে কী!!

পুলিশের ধর্মানুভূতি, সরকারের ধর্মানুভূতি ও রাষ্ট্রের ধর্মানুভূতি অনন্তকে ধাপে ধাপে মৃত্যুর মঞ্চে ডেকে নিয়ে যায়। ২০১৫ সালের কথা কখনো ভুলতে পারা যাবে না। সেসময় দেশে সবচে সহজ ক্রাইমের নাম ছিলো ‘ব্লগার হত্যা’। ব্লগার খুন হলে তার পুরো দায় নিহত ব্লগারকে নিতে হতো। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরাও স্পষ্টভাবে খুন হওয়া ব্যক্তির উপর দায় চাপিয়ে দিতেন। খুনীরা ছিলো সমালোচনার উর্ধ্বে, বাধাহীন, মুক্ত, স্বাধীন।

২০১৫ সালের ১২ মে। অফিসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন অনন্ত। বের হয়ে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে আসা মাত্র তার উপর হামলে পড়ে ‘আনসার বাংলা’ নামের এক ইসলামী ঘাতক সংগঠনের চার মুখোশধারী। একজন প্রত্যাক্ষদর্শী চা বিক্রেতা সুবহান আলীর বর্ণনায় জানা যায় আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে অনন্ত প্রধান সড়ক থেকে সুবিদবাজার তার বাসার দিকে দৌড় দেন। তবে বেশি দূর তিনি যেতে পারেননি তিনি। নূরানি দিঘিরপাড় এলাকায় যাওয়ার পর পেছন থেকে তার মাথায় এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। এতে মাথা থেকে মগজ বেরিয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়ে। তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।

বরাবরের মত এই হত্যারও কোন দায় রাষ্ট্র নেয়নি। রাষ্ট্র তার পবিত্র দায়িত্ব পালন করে নির্লিপ্ত থেকেছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর টালী খাতায় আরো একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে লিপিবদ্ধ হলো অনন্ত’র মৃত্যু। কিন্তু আমাদের কাছে এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলো না। বরং অন্যান্য মুক্তচিন্তার মানুষের হত্যাকান্ডের মত এই হত্যাকান্ডও রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের বন্ধ চোখের অন্ধকারে একটি বিশেষ মৃত্যু। যে মৃত্যুর ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়।

অনন্ত বিজয়ের নির্মম হত্যার এক বছর পরে স্মৃতিচারণায় বন্যা আহমেদ লিখেছিলেন —

কিছু কিছু সম্পর্ক আছে ব্যাখ্যা করা যায় না। জীবনে মাত্র কয়েকবার দেখা হয়েছে অনন্তের সঙ্গে। কিন্তু ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা সে রকমই ছিল। কী দেব এর নাম? বন্ধু, ভাই, কমরেড? জানি না। দরকারও নেই বোধহয়।

অনেকেই ব্লগে লেখালেখি করে, অনেকেই ফেসবুকে অনেক কিছু লেখে। কিন্তু মৌলিক চিন্তার অধিকারী খুব কম লেখকই হয়ে উঠতে পারে। ওর সঙ্গে আমার চিন্তার পার্থক্য ছিল অনেক কিছুতেই, কিন্তু ওর অমায়িকতা এবং স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারার ক্ষমতায় মুগ্ধ হতাম সব সময়। এই বয়সেই সে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার ছোট কাগজ ‘যুক্তি’ বের করত। ‘পার্থিব’, ‘ডারউইন: একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা’, ‘জীববিবর্তন: সাধারণ পাঠ’সহ বেশ কয়েকটা বইও প্রকাশ করেছিল।

শুধু বন্যা নয়, অনন্তকে নিয়ে এরকম স্বীকারোক্তি দেয়ার মত অসংখ্য মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে আছেন। অনন্ত একজন মানুষ-ঘনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। তিনি মানুষের মঙ্গলের জন্য মানুষের মাঝে কাজ করতেন। তাই চারপাশের মঙ্গলকামী মানুষের জীবন-সড়কে অন্তত একটি অনন্ত-মাইলফলক খুঁজে পাবেনই। অনন্ত তার স্বজন বন্ধুদের অগ্রযাত্রায় সবচে কাছের সহযাত্রী চিলেন। তাই অনন্তকে ভুলে যাওয়া মোটেও সহজ নয়। সহযাত্রীদের দৈনন্দিন কাজকর্ম, হাসি তামাশার মাঝে অনন্ত বিজয় দাশ সবচে পরিচিত দীর্ঘশ্বাসের নাম।

পৃথিবীতে খুব কম মানুষ আছেন মৃত্যু যাদের জন্মের চেয়ে বেশি ঔজ্জ্বল্যতা ধারণ করে। অনন্ত তাদের একজন।

Exit mobile version