Site icon অবিশ্বাস

আদেশের নিগ্রহ | আবুল হুসেন

প্রবন্ধটি ১৯২৭ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম অধিবেশনে পাঠ করেন আবুল হুসেন এবং ১৯২৯ সালে ঢাকার ‘শান্তি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হবার সাথে সাথে মুসলিম সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। মৌলবাদী কবি গোলাম মস্তফা এবং তার চেলা চামুণ্ডারা প্রবন্ধটির উর্দু সংস্করণ প্রকাশ করে ধর্মান্ধ মুসলমানদেরকে আবুল হুসেন বিরুদ্ধে উস্কে দেয়। ফলশ্রুতিতে, জনৈক খান বাহাদুর আবদুল হাফিজ পিস্তলসহ আবুল হুসেনের বাসায় গিয়ে হত্যার হুমকি দেয় এবং পরবর্তীতে এই ধরণের লেখা আর তিনি লিখবেন না, জোরপূর্বক এই মর্মে প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। একই বছরের ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় আহসান মঞ্জিলে আবুল হুসেনের বিরুদ্ধে বিচার সভা বসে।  বিচারে তাঁর  বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহ এবং মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগ এনে লিখিতভাবে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। একইসাথে এই ক্ষমাপত্র জনসাধারণকে অবগত করার উদ্দেশ্যে অনুমতি প্রদানের জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। সহযোগী সংগঠকদের অনুরোধে আবুল হোসেন অভিযোগ স্বীকার করে ক্ষমা চান এবং তা মুদ্রণের অনুমতি দেন। আবুল হুসেনের এই বহুল আলোচিত লেখার আবেদন আজও ফুরিয়ে যায়নি। মুক্তচিন্তার বিকাশ ও প্রসারে লেখাটি আজও প্রাসঙ্গিক।প্রবন্ধটি বেনজীন খান সম্পাদিত “বুদ্ধিরমুক্তি শিখা ও আবুল হুসেন” (২০০৬, সংবেদ প্রকাশনা, ঢাকা) গ্রন্থে পুনঃ মুদ্রিত হয়েছে। আমরা এই ওয়েবসাইটে লেখাটি হুবহু প্রকাশ করছি।


 

মানুষ মাত্রেরই একটা না একটা ধর্ম-বিশ্বাস আছে; অর্থাৎ মানুষ মাত্রই কোন না কোন ধর্মগুরুর আদেশ মেনে চলে। তার বিশ্বাস, সেই ধর্মগুরু বিধাতার প্রেরিত শ্রেষ্ঠ পুরুষ, তার খাস উপকরণ দিয়ে সৃষ্ট এবং সাধারণ মানুষ ঢের নিকৃষ্ট উপকরণে গঠিত। এই ধর্ম-বিশ্বাস আদিম মানবপ্রকৃতির একটি প্রধান লক্ষণ। ভয়, দুর্বলতা ও অজ্ঞতা, এই তিনটি মনোভাব ধর্ম-বিশ্বাসের জননী। যে জাতি অর্থাৎ যে জাতির মন এখনও ন্যাংটা বর্বর যুগের কাছাকাছি পড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে সে জাতির ভয়, দুর্বলতা ও অজ্ঞতা তত বেশি। সুতরাং তার ধর্মবিশ্বাসও তত প্রগাঢ়, অর্থাৎ ধর্মগুরুর আদেশ অক্ষরে-অক্ষরে পালনে সে তত তৎপর এই ভয়ে, পাছে তার কোন অনিষ্ট ঘটে কিংবা তার ধর্মগুরু প্রদর্শিত পরলোকে দুর্গতি হয়। বলা বাহুল্য, ধর্মগুরুর আদেশ নানা অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে পালিত হয়। এক কথায়, যে জাতি যত আদিম প্রকৃতি বিশিষ্ট, সে জাতি তত অনুষ্ঠানপ্রিয়। এই অনুষ্ঠান অর্থে আমি ধর্মানুষ্ঠান মনে করছি।

জাতির মনই তার প্রকৃতি নির্ধারণ করে। শুধু বয়সে তার প্রকৃতি নিরূপিত হয় না। একটি জাতির বয়স দু‘তিন হাজার বৎসর হতে পারে, কিন্তু তার মন হয়ত এখনো শিশু। কাল-প্রবাহের অনন্ত পরিবর্তন, ভাঙাগড়া সে মনকে স্পর্শও করেনি। তার কারণ, এই বয়সে প্রবীণ কচি-মন বিশিষ্ট জাতি তার ধর্মগুরুকে ও তার প্রচারিত বাণীর পূজায় মনকে নিশ্চেষ্ট রেখেছে―সে মন সেই ধর্মগুরুর নামের পূজায় মুষড়ে বিমোহিত হয়ে পড়েছে। সে মনে প্রকৃতির নিত্যনৈমিত্তিক ভাঙাগড়া কোন চেতনা সঞ্চার করতে পারেনি। তার ধর্মগুরুর আদেশ যে অনন্তকালের জন্য, এই উৎকট ধারণার দৌরাত্ম্য তার মনকে সজাগ হতে দেয়নি। তার মনের এই অসারতার ফলে বাহ্য অনুষ্ঠানের প্রতি তার মমতা অত্যন্ত নিবিড় হয়ে ওঠে; মন যখন ধর্মানুশাসন মেনে চলতে-চলতে অভ্যস্থ হয়ে ওঠে, তখন নিয়ত পরিবর্তনশীল এই জগতের সঙ্গে তার সম্বন্ধ কি তা বোঝাপড়া করবার মত শক্তিও ক্রমশঃ তার বিলুপ্ত হয়ে যায়। তখন বিধাতার দেওয়া এই অনন্ত সম্ভাবনাপূর্ণ মানবজীবনের একমাত্র সম্বল তার পক্ষে হয়―কয়েকটি ধর্মসূত্র ও গুটিকতক ধর্মানুষ্ঠানে আসক্তি। সে মনে করে, এই আসক্তিতেই তার মুক্তি, উহা যে মুক্তির সহায় মাত্র এই ধারণা হতেও সে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। এবংবিধ ধর্মাসক্তির সঙ্গে পরধর্মের প্রতি বিদ্বেষ হাত ধরাধরি করে চলে। তাই দেখতে পাই, মানবের ইতিহাস ধর্ম-বায়ুগ্রস্ত মানুষের পরস্পর দ্বন্দ্ব-দ্বেষাদ্বেষি কলঙ্কে অতি নির্মমভাবে কলঙ্কিত। এ কলঙ্ক অপনোদন করতে হলে মানবের প্রতি পরস্পর প্রীতিই চরম ধর্ম বলে ধরতে হবে। বিশেষ-বিশেষ ধর্মের বিশেষ-বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। সেই উদ্দেশ্যটিকে লক্ষ্য করে বর্তমান জগতের সঙ্গে পরিচিত হয়ে মানুষের প্রীতির বন্ধন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কোন ধর্ম সর্বকাল সর্বদেশ ও সমস্ত মানবজাতির জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এ ধারণা যেজাতির আছে সে জাতি নিতান্ত হতভাগ্য এবং বলতে হবে মন সভ্যতার নিম্নস্তরে পড়ে নীরস ধর্মাদেশের মরু-বালুকায় আপনার জীবনস্রোত হারিয়ে ফেলেছে।

ধর্মের বৈশিষ্ট্য প্রণিধান করলে দেখতে পাওয়া যায়, সমস্ত ধর্মেরই মূলসূত্র হচ্ছে দুইটি, যথা―(১) বিশ্বের সমস্ত বস্তুর স্রষ্টা একজন আছেন এবং (২) মানব মাত্রই মৃত্যুর অধীন। এই হেতু মৃত্যু পর মানুষ অন্যলোকে প্রবেশ করে। এক কথায় বিশ্বস্রষ্টা (রব্বুল আলামিন) ও পরলোক এই দুইটিতে বিশ্বাস। এ হতে এই মনে হয়, মানুষের আদি মাতাপিতা ও আত্মীয়বর্গের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মলাভ করেছিল আর আমরা পুরুষানুক্রমে বিভিন্ন দেশ-কালের মধ্য দিয়ে এই আদিম বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে দেশকালের প্রয়োজন-অনুসারে বিভিন্ন ধর্ম সৃষ্টি করেছি। এ ধারণা যদি সত্য হয়, তবে বলতে হবে দেশ-কালের প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য যে ধর্ম-বিধিসমূহ সৃষ্ট হয়েছিল তা কখনও সনাতন হতে পারে না। সে বিধি-বিধান কালের পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তন লাভ করতে বাধ্য, নতুবা এই পরিবর্তন সুলভ মানবের নব-নব প্রয়োজন তাতে মিটতে পারে না। মানুষের প্রয়োজন ও জাগতিক অবস্থা দু’টির সম্বন্ধ অবিচ্ছেদ্য। জাগতিক অবস্থা নিয়ন্ত্রিত করবার ক্ষমতা মানুষের নাই, তবে মানুষ তার প্রয়োজন নিয়ন্ত্রিত করতে পারে; কিন্তু সেই প্রয়োজনও জাগতিক অবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সুতরাং মানুষ তার প্রয়োজন চিরদিন বেঁধে সীমাবদ্ধ করে রাখতে পারে না। কাজেই যে যুগে যে প্রয়োজন নির্ধারিত করতে যে-ধর্মাদেশ প্রচারিত হয়েছিল সেই ধর্মাদেশ পরবর্তী পরিবর্তিত নব প্রয়োজন সিদ্ধ করতে পারে না,―যদি না সেই ধর্মাদেশ ত্যাগ করা হয় কিংবা নূতন করে তার ভিন্ন অর্থ দেওয়া হয়। এই ত্যাগ করতে কিংবা নূতন অর্থ দিতে যে ধর্মভীরু জাতি অপারগ বা শঙ্কিত সে জাতি দুনিয়ার পরিবর্তনে কোন সাড়া দিতে পারে না; যদিও এই পরিবর্তনের প্রয়োজন তাকে গ্রহণ করতেই হয়। স্রেফ তার জীবনধারণের বা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। সে পরিবর্তন তার জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করেই, কিন্তু সে ভীরু বলে তা স্বীকার করে না। তখন সে মুখে ধর্মাদেশ আওড়ায় কিন্তু কাজে সে করে তার বিপরীত অর্থাৎ যুগের প্রয়োজনকে বেশি সত্য বলে সে তার কাজ দ্বারা তা সপ্রমাণ করে এবং এ-ও প্রমাণ করে যে, যে যুগে সেই ধর্মাদেশ জারি হয়েছিল সে যুগের অবস্থা এখন আর নাই; কিন্তু বলতে ভয় পায় যে এখন আর সে ধর্মাদেশেরও প্রয়োজন অনেকখানি কমে গেছে এবং বর্তমান প্রয়োজনের সঙ্গে খাপ খাওয়াবার জন্য তার অনেকখানি রূপান্তর করা আবশ্যক। এই ভীরুতাই ধর্মান্ধতা ও ভণ্ডামির জনক। তাই দেখতে পাই, খ্রিস্টান পাদ্রি বাইবেল হাতে করে শপথ নিয়ে মিথ্যা বলছেন―মুসলমান  মোল্লাজির ধর্মোপদেশ দিয়ে তার উল্টা কাজ করছেন―হিন্দু পুরোহিত মন্দির প্রাঙ্গনে বীভৎস লীলায় প্রমত্ত। এগুলি ভণ্ডামির চরম দৃষ্টান্ত বটে, কিন্তু বিশেষ বিশেষ উদাহারণ খুঁজবার জন্য আদৌ পরিশ্রম করতে হবে না। ধরুন, হিন্দুর ছোঁয়াছুঁয়ি, মুসলমান ঘৃণ্য, তার ছোঁয়া মহাপাপ; কিন্তু হিন্দু আজ স্টিমারে মুসলমান বাবুর্চির হাতের শুরুয়া খাচ্ছেন, তার হাতের পানির লেমোনেড খাচ্ছেন ইত্যাদি, অর্থাৎ খেতে বাধ্য হচ্ছেন, কারণ সেটা যুগের প্রয়োজন। সেইরূপ মুসলমানের জীবনে নামাজ-রোজার সঙ্গেও নানা প্রকার অনাচার-ব্যভিচার বেশ মিশ খেয়ে রয়েছে। তার কৈফিয়ত দিতে গিয়ে মুসলমান বলেন, ধর্মাদেশ পালনের সওয়াব (সুফল) পরকালে মিলবে, এ জগতের কাজের সঙ্গে তার কোন সম্বন্ধই নাই। সুতরাং এ জগতে জীবনের ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ ও প্রবৃত্তি চরিতার্থ যেমন করে হোক করা যেতে পারে। প্রায় সমস্ত ধর্মাবলম্বী মানুষেই এইরূপে ধর্মানুষ্ঠান পালন ও অন্য কাজ দুইটি পৃথক করে ফেলেছে। তাই দেখতে পাওয়া যায়, অনেক ক্ষেত্রে পাপকেও ধর্মসঙ্গত বলে চালিয়ে নেওয়া হয়েছে, ও হচ্ছে। সুতরাং আসল কথা এই, যে যুগে যে কাজকে পাপ বলা হত যে অবস্থায়, সে অবস্থার পরিবর্তনবশতঃ সে কাজটি আজকের পরিবর্তিত অবস্থায় মানুষের প্রয়োজন বলে গণ্য হওয়ায়, সেটিকে আর পাপ বলে ধরা হয় না। এতে বুঝা যাচ্ছে, মানুষ প্রচলিত ধর্মের পরিবর্তন কাগজে কলমে না করলেও বা না-করতে রাজি হলেও হাতে-কলমে তার পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে যুগ-ধর্মের নিপীড়নে। আমার মনে হয়, যদি মানুষের সমাজ এই হাতে-কলমের পরিবর্তনগুলির সঙ্গে সঙ্গে কাগজে-কলমে চালিয়ে নিত, তা হলে মানুষের ধর্মের নিগ্রহ ও বিড়ম্বনা অনেক কমে যেত এবং ধর্মের নামে মানুষের রক্তারক্তি ও নানা অধর্মের ইতিহাসও অনেক ছোট হয়ে পড়ত। দুইটি দৃষ্টান্ত দিলে কথাটি বোধহয় আর একটু পরিষ্কার হয়ে আসবে। আমার এক আত্মীয় খুব বনিয়াদি ঘরের সন্তান বলে বড়াই করতেন এবং পীরগোষ্ঠীর বংশধর বলে সকলের সামনে আস্ফালন করতেন, কিন্তু বর্তমান যুগোপযোগী শিক্ষা তার কিছুই ছিল না। অগত্যা পেটের দায়ে তিনি চৌকিদারের কর্তা দফাদার হয়ে বসলেন। গ্রামের গণ্ডমূর্খ লোকের নিকট তার প্রতিপত্তি কি! যে তার অবাধ্য হয়ে বসত তাকে তিনি পিঠামোড়া দিয়ে বাঁধতেন এবং চোর সাব্যস্ত করবার জন্য মিথ্যা প্রমাণ খাড়া করতেন। বেচারা তখন তাকে কিছু দক্ষিণা দিয়ে রেহাই পেত। এই ছিল তার পেশা। অথচ তিনি পূর্ব-পুরুষ হতে উত্তরাধিকার-সূত্রে প্রাপ্ত একটি জীর্ণ মসজিদের খাদেম বলে পরিচিত থাকায় লোকে তাকে পীরের মত মান্য করত ও কেউ-কেউ তার নিকট হতে দোয়া, তাবিজ, পানি-পড়া, তেল-পড়া,ও তার শ্রীচরণ-ধূলা পর্যন্ত নিতে দ্বিধাবোধ করত না। মসজিদে যে-সব সিন্নি, ছাগল মানত হত, তাও তার উদরস্থ হত। তার মসজিদ-সেবা-করা আয়ের দিক থেকে দফাদারির চেয়ে যে নিতান্ত মন্দ পেশা ছিল না, তা সহজেই অনুমান করা যায়। তিনি অনেক সময় তার অপকর্মের ধিক্কার বা লজ্জা ঢাকাবার জন্য মসজিদের প্রাঙ্গনে বসে-বসে ধর্ম ও সংসার দুইটি পৃথক বস্তু কেমন করে ও কেন, তাই সপ্রমাণ করবার জন্য খুব গলাবাজি করতেন। মূর্খ মুসলমান নামাজ পড়ে বেরিয়ে তার ধর্মকথা শুনে দিব্যি নিশ্চিত মনে বাড়ি যেত! একবার তার এই মূর্খতার বাড়াবাড়ির জবাব দিতে গিয়ে আমাকে নিতান্ত লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল। গ্রামের মূর্খ মুসলমান তার দলে ভিড়ে বসল। মনে-মনে এই বলে সান্তনা পেলাম, “আহ্! ইসলাম কি বিকট মৃত্যুর চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়েছে এই বাঙলার মুসলমান নামীয় কতকগুলি জীবের কাছে।”

এই লক্ষ্য করে বোধহয় আজ একদল মুসলমান বলছেন, “হাঁ ঠিক ত মুসলমান গোল্লায় গেছে, কিন্তু তাতে ইসলামের দোষ কি?” তাঁরা এই বলতে চান―ইসলাম একটি সনাতন ধর্ম, সর্বকালে সর্বদেশে সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু এই দাবি গায়ের জোরেই করা চলতে পারে, যুক্তি বা মানব-ইতিহাসের ধারা বা প্রকৃতির নিয়মানুসারে সে দাবি টিকতে পরে না। আজ মুসলমান কেন ইসলামের আদেশ পুরোপুরি পালন করতে পারছে না, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে; আর এও দেখতে হবে, সপ্তম শতাব্দীর আরব মরুর ইসলাম বিংশ শতাব্দীর শস্য-শ্যামল উর্বর দেশে কতখানি কার্যকরী হতে পারে। যদিও ইসলাম অপরিবর্তনীয় অখণ্ড সত্য সনাতন ধর্ম বলে তাকে হুবহু জীবনে গ্রহণ করবার জন্য চেষ্ট করা হয়, সে চেষ্টা নিছক অত্যাচারেই পরিণত হবে, এবং যার উপর সে চেষ্টা হবে সে বিদ্রোহী হয়ে তার জীবন দিয়ে দেখাবে যে, ‘আমি ইসলাম মানি না; কারণ মানতে পারি না বা মানতে ইচ্ছা হয় না।’ বর্তমান মুসলমান সমাজে এই ধর্মদ্রোহী মুসলমানের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে; তার কারণ ধর্মানুষ্ঠানের প্রতি অনুরাগ জন্মাতে গিয়ে ধর্মপুরোহিতগণ তাদের শিষ্যগণের জীবনকে চেপে মেরে ফেলবার উপক্রম করেছেন। তারা জীবনের সহজ গতিকে রোধ করেছেন! এই ধর্মদ্রোহিরা সমাজের বুকে দিব্যি আরামে দিন কাটচ্ছে, কিন্তু তারা মুখে স্বীকার করছে না যে তারা ধর্মদ্রোহী; কারণ ইসলামের প্রশংসায়, ইসলামের অনুষ্ঠানগুলির ফজিলত বর্ণনে তারা শত-মুখ। সমাজপতিগণ এই মৌখিক প্রশংসায় মুগ্ধ হয়ে তাদের শত ছিদ্র, শত অপরাধ তুচ্ছ বলে গণ্য করে সুখে নিদ্রা যাচ্ছেন। ‘ইসলাম যে মানুষের জন্য, মানুষ যে ইসলামের জন্য নয়’―এ কথা বুঝবার মত বুদ্ধি তাদের আজও হয় নাই। তাই দেখি, শুধু অনুষ্ঠান পালনে বড় অথচ মানুষ হিসাবে পাষণ্ড নরাধম এমন মুসলমানও মাত্র বাহ্যিক নিদর্শনের বলে সমাজে বেশ খাতির পায়।

কিছুদিন পূর্বে জনৈক আমেরিকান পর্যটক মধ্য-এশিয়া ঘুরে পারস্যের উত্তর সীমান্তে এসে একজন অগ্নি-উপাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার লাভ করলেন। তার সঙ্গে তিনি কিছুদিন পারস্যের নানাস্থানে নানা লোকের সাথে আলাপ করে ও পারসিদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যবস্থা লক্ষ্য করে একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “প্রাচীন পারসিদের চেয়ে বর্তমান পারসিগণ মিথ্যাবাদী বলে আমার মনে হচ্ছে, এর কারণ কি?” উত্তরে তিনি বললেন, “হ্যাঁ, ঠিক ত, তার কারণ আবহাওয়ার পরিবর্তন। সে জেন্দাবেস্তার যুগ আর নাই। আবেস্তা আমাদের বর্তমান সমস্যা কিছুই সমাধান করতে সহায় হয় না। মানুষের পেটের দায় এমন নিষ্ঠুর হয়েছে যে, মিথ্যা এখন অবলম্বন না করে উপায় নাই।” পর্যটক শুনে তাঁর খাতায় নোট করে রাখলেন তাঁর প্রতিপাদ্য বিষয় প্রমাণের জন্য। প্রতিপাদ্য বিষয়টি এই যে, “দুনিয়ার সর্বত্র আবহাওয়া পরিবর্তন লাভ করেছে ও করছে এবং সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতার পরিবর্তন ঘটেছে ও ঘটছে।” অধ্যাপক Huntington সাহেবের, ‘Pulse of Asia’ ও ‘Climate and Civilisation’ নামক দুইখানি গ্রন্থে এই পর্যটকের কথা ও এই দৃষ্টান্তটির উল্লেখ আছে। আমি বলছিলাম, কালের পরিবর্তনের, অবস্থার বিপর্যয়ে ধর্মশাস্ত্রের কথা মানুষ পুরোপুরি পালন করতে পারে না। তখন ধর্মভীরু ব্যক্তি ধর্মশাস্ত্রকে অপরিবর্তনীয় মনে করে মানুষের প্রতি দোষারোপ করে। আজ মুসলমানদের মনোভাবও ((attitude) তাই। মুসলমান আজ তেরশত বৎসরে আদর্শ অক্ষরে-অক্ষরে পরিবর্তিত অবস্থায় প্রয়োগ করতে সামর্থ হচ্ছে না। ‘এজন্য দোষ মুসলমানের, ইসলামের নয়; ইসলাম-বিধি অপরিবর্তনীয়।’―এই attitude-এর ফলে মুসলমান আপন দোষ দূরীভূত করতে সক্ষম হচ্ছে না; তারা অনুষ্ঠানগুলি পালন করছে নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে―কেবল অভ্যাসের বলে; কিন্তু বুদ্ধি ও অন্তর তাতে নাই। তাই তাদের নিকট ধর্ম ও সংসার বিভিন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। “সংসারের উন্নতির জন্যই মূলত ধর্ম-বিধানের সৃষ্টি”―এ-কথা তারা স্বীকার করতে চাচ্ছে না। ধর্ম- বিধির এবংবিধ ব্যবহার লক্ষ্য করেই আমি এই প্রবন্ধের অবতারণা করেছি। এই বিধি-বিধান বা ধর্মগুরুর আদেশের নিগ্রহ হতে মুক্তি না পেলে মুসলমানতো মানুষ হবেই না, বরং ইসলামও কেবল পুঁথিগত dead letter হয়েই থাকবে, যেমন কোরান-হাদিস বাঙলার সাধারণ মুসলমানের নিকট বন্ধ-করা (sealed) একখানি পুস্তক ব্যতীত আর কিছুই নয়, যে-পুস্তক হতে তারা কিছুই গ্রহণ করতে পারে না বা যার কথা শুনেও তারা তাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারে না অর্থাৎ পারছে না। তবে অনুষ্ঠান পালনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে তারা এখনও মুসলমান। তাই মাত্র টুপি, লুঙ্গি, দাড়ি, এই বাহ্যিক নিদর্শন দ্বারাই তারা তাদের মুসলমানত্ব প্রমাণ করছে। কোরান-হাদিসের সমস্ত বিধি-নিষেধের ফল মুসলমানের জীবনে শুধু টুপি, লুঙ্গি, দাড়িতেই প্রকাশ পেয়েছে; তার বাইরে মুসলমানের আর কি-কি নির্দশন চাই মানুষের দিক থেকে, তার প্রতি লক্ষ্য আমাদের সমাজপতিদের আছে বলে মনে হয় না। তা যদি থাকত তা হলে মসজিদের সামনে বাজনা এই অতি সামান্য ব্যাপার নিয়ে নরহত্যায় আমরা প্রবৃত্ত হতাম না। এ কথা আরো মনে হয় যখন দেখি মসজিদের উপাসকগণের অনেকেই গুণ্ডামি জিনিসটা একটা আমোদজনক ও কতকটা প্রয়োজনীয় ব্যাপার বলে মনে করে।

অন্যান্য ধর্মের ন্যায় ইসলামও কতকগুলি আদেশ ও নিষেধের সমষ্টি মাত্র। এই আদেশ-নিষেধ মেনে চললে অনন্ত সুখ (বেহেশত) ও লঙ্ঘন করলে অনন্ত দুঃখ (দোজখ) ভোগ করতে হয়। দোজখের ভয় ও বেহেশতের লোভই মুসলমানকে ইসলামের আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে প্রবৃত্ত করে। কিন্তু দোজখ ও বেহেশ্তের বর্ণনা হতে কোন মুসলমানই তার প্রকৃত স্বরূপ বুদ্ধির দ্বারা ধারণা করতে পারে না, কেবল বিশ্বাসই একমাত্র সম্বল। প্রকৃতপক্ষে, বুদ্ধি যে বস্তুকে ধরতে পারে না, বিশ্বাস দ্বারা তাকে বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায় না। বুদ্ধির প্রয়োগ যেখানে অনাবশ্যক বা অনর্থক সেখানে বিশ্বাস শিথিল হতে বাধ্য। তাই মুসলমানদের কার্যকলাপ দেখলে বেশ বুঝা যায় যে, সাধারণ মুসলমান দোজখ-বেহেশ্তের বিশেষ পরোয়া করে না। কোন অজ্ঞেয় কালে মৃত্যুর পর সেই দোজখ-বেহেশতের বাটোয়ারা হবে। এই বিশ্বাস মানুষকে তার নিত্য-প্রয়োজনের পীড়াপীড়ি হতে উদ্ধার করতে পরে না। সুদূর-ভবিষ্যতের অনন্ত সুখের লোভ ত্যাগ করে আশু সুখপ্রয়াসী হওয়া মানুষের প্রকৃতি। সুতরাং সুদূর ভবিষ্যতে সুখের লোভ দেখিয়ে যে ধর্মগুরু বর্তমানের সুখ ত্যাগ করতে হুকুম করেন। তিনি মানুষের প্রকৃতিকে অস্বীকার করেন। ফল দাঁড়ায় এই, তার জীবদ্দশায় তাঁর প্রতি নিবিড় শ্রদ্ধাবশতঃ শিষ্যগণ তার হুকুম-মত চলে ও বর্তমান সুখের লোভ ত্যাগ করে বটে, কিন্তু তার মৃত্যুর পর তারা (শিষ্যগণ) চরম স্ফূর্তিতে আপনআপন প্রকৃতির হুকুমই মেনে চলে। এতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, মানুষের প্রকৃতি জিনিষটি ধর্মগুরুর বুদ্ধি-কল্পনা-অনূভূতি প্রসুত হুকুমের চেয়ে অনেক বেশি সত্য, এবং এই সত্যই যুগে যুগে মানুষের সমাজে বিভিন্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। যে ধর্মগুরু এই সত্যের প্রকাশকে চিরস্তায়ী কতকগুলি বিধি-নিষেধের দ্বারা সীমাবদ্ধ করতে চান, তার সম্বন্ধে এইটুকু বলতে চাই যে, স্বরচিতি বিধি-নিষেধগুলির প্রতি তার অত্যন্ত মোহ জন্মে যায় এবং সেই মোহের দুর্বলতাই তার ব্যক্তিত্বেও প্রাণ ও রসকে অনেকখানি চেপে রেখে দেয়। তজ্জন্য তার অনুভুতি ও প্রাণের রস তার অনুবর্তিগণের জীবনে সঞ্চারিত হতে পারে না। কারণ তারা সেই হুকুমগুলিই চরম বলে ধরে বসে কিন্তু তার উৎপত্তির কারণ ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে একেবারে উদাসীন হয়ে পড়ে। স্পষ্ট বলতে যে অনুভূতির বহ্নিতে ধর্মগুরু দগ্ধ হয়ে তার বিপদগামী সমাজকে পদ দেখিয়ে ছিলেন তার রূপ সম্বন্ধে তার শিষ্যগণ ধারণাও করতে সমর্থ হয় না। কারণ সে আপন কৃতিত্বে মুগ্ধ ধর্মগুরুর জীবন তাদের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে না। সে জীবনের ভয়-উল্লাস, শঙ্কা-উদ্বেগ আবেগ উৎসাহ প্রভৃতির ধারা যদি জীবন্ত হয়ে শিষ্যগণকে অনুপ্রাণিত করতে না পারে এবং তার রচিত বিধি-নিষেধগুলির উদ্দেশ্য তারা ধরতে না পারে, তবে সে বিধি নিষেধ কলের পুতুলের মত শুধু পালন করার জন্যই পালন ক’রে যাওয়া চরম আহাম্মকি। তাতে বুদ্ধি বিকশিত হতে পারে না, বরং তাতে মানব-প্রকৃতির সহজ গতি রুদ্ধ হয়ে যায় ও ধর্মনিষ্ঠতার দাম্ভিকতা ও আস্ফালনই প্রবল হয়ে ওঠে; ফলে সকল শুভ চেষ্টায় শৈথিল্য ঘটে। পক্ষান্তরে শিষ্যগণ ধর্মগুরুর ব্যক্তিত্বে অসাধারণত্ব প্রমাণ করার জন্য নানা কাব্য-উপকথা আবর্জনায় তার মনুষ্য-প্রকৃতি বিশিষ্ট জীবনের বহুধা বিকাশকে ঢেকে ফেলে। এতে করে হুকুমই বেশি করে তাদের পেয়ে বসে তার জীবনের চেয়ে যে জীবনের সমস্যা ও প্রয়োজন সেই হুকুমের জন্ম দিয়েছিল। সেই সমস্যা ও প্রয়োজন নিয়ত পরিবর্তনশীল, সুতরাং পরবর্তী যুগে যদি ঐ সমস্যা ও প্রয়োজন পরিবর্তন লাভ করে থাকে, তবে সঙ্গে-সঙ্গে সে হুকুমেরও পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। কিন্তু এ-কথা ধর্মের জোশে প্রমত্ত শিষ্যগণ কিছুতেই বোঝে না। তারা সেই হুকুমকেই চরম বলে মনে করে।

সকল ধর্মাবলম্বিদের পক্ষেই এ-কথা খটে। খ্রিস্টানগণ যিশুর জীবন ফেলে তার হুকুমকে আঁকড়ে ধরেছিল, কিন্তু তারা যখন দেখল সে হুকুম বর্তমান জীবনায়োজনে সাহায্য করতে পারছে না তখন তারা হুকুমের বিপরীত কাজ করতে বাধ্য হল; তা সত্ত্বেও তারা খ্রিস্টান রইল। ভাল করে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বর্তমান জীবনের সত্যকে শ্রদ্ধা করতে গিয়ে তারা যিশুর অনেক আদেশ অমান্য করতে বাধ্য হয়েছে এবং মুখেও সে-কথা তারা স্বীকার করেছে। সেইরূপ হিন্দু, ধর্মগুরুর হুকুমকে চরম বলে ধরেছে তার জীবনের সমস্যা ও বিকাশের ভঙ্গিমতার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে! ফলে হুকুম পুরোপুরি পালন করতে না পারায় বর্তমান সত্যকে আশ্রয় করে নূতন হুকুম সৃষ্টি করছে ও জীবনায়োজনকে পরিপুষ্ট করে তুলছে। প্রাচীন আদেশ অমান্য করেও হিন্দু হিন্দুই থাকছে।

মুসলমানও তার ধর্মগুরুর জীবনের সমস্যা ও বিকাশের দিকে ভ্রক্ষেপ না করে তার হুকুমকে চরম বলে ধরেছে। কিন্তু বর্তমান জীবনসমস্যায় সে হুকুম কাজে লাগাতে পারছে না। ফলে সে মুখে বলছে, সে হুকুম মানছে, কিন্তু কাজে তার বিপরীত করছে, কারণ সে জানে না সে হুকুমের উদ্দেশ্য কি ছিল এবং কোন অবস্থার জন্য তার সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ বুদ্ধি প্রয়োগ করে সে সেই আদেশের ব্যবহার করে না। কিন্তু হিন্দু ও খ্রিস্টানের সঙ্গে মুসলমানের প্রভেদ এই যে, মুসলমান মুখে স্বীকার করে না যে, সে হুকুম অমান্য করছে। সে নিজের অপরাগতার দোষ দিয়ে বলে “হুকুম কি বদলাতে পারে? ইসলামের বিধি-নিষেধ কি পরিবর্তিত হতে পারে? কখনও না।” আবার যদি কোন মুসলমান বলে, “হ্যাঁ হুকুম বদলাতে হবে, দরকার হয় ছাড়তেও হবে;” তার প্রতি মুসলমান সমাজ খড়গহস্ত হয়ে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে উদ্যত হয়।

মুসলমানও অন্যান্য ধর্মাসক্ত জাতির মত অনুষ্ঠান-প্রিয়―নানা আদেশ পালনে সতত উদ্বিগ্ন। এই সমস্ত আদেশের মধ্যে নামাজ, রোজা, অজু, গোসল, তেলায়ত, খোতবা, আজান, দরুদ, কলমা প্রভৃতি সম্বন্ধে কড়া আদেশ জারি আছে। কিন্তু উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্য না রেখে শুধু তাদের বুদ্ধির-অগম্য সওয়াবের লোভে এই সমস্ত আদেশ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করতে গিয়ে মুসলমানের যে চেহারা হয়েছে তা আজ অত্যন্ত চোখে লাগছে। তা দেখলে মনে হয়, ইসলাম যে সদুদ্দেশ্যে অর্থাৎ মানুষ করবার উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত হয়েছিল তা একবারে ব্যর্থ হয়ে গেছে। যে-সমস্ত মুসলমান এই সমস্ত অনুষ্ঠান কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব করে পালন করতে ব্যস্ত, তাদের অধিকাংশের জীবন নিতান্ত সঙ্কীর্ণ ও নোংরা। কিন্তু যারা এই অনুষ্ঠানগুলি অক্ষরে-অক্ষরে পালন না করে স্বেচ্ছামত পালন করে বা অমান্য করে, তাদের প্রতি মৌলানা সাহেবদের ফতোয়ার তীর নিক্ষিপ্ত হয় রুচিগর্হিত কদর্য ভাষার ভিতর দিয়ে। তার মজা এই যে, আজ মুসলমান সমাজ যাদের নিয়ে গর্ব করে তাদের অনেকেই অনুষ্ঠানের তোয়াক্কা রাখেন না। তারা মৌলানা সাহেবদের রম্ভা দেখিয়ে কোরান-হাদিসের কথা সিকেয় তুলে রেখে দিয়ে যুগ-ধর্মের দাবি-অনুসারে কাজ করে চলেছেন―অবশ্য চুপে-চুপে। তা হলেও এই সমস্ত সাহেবিয়ানা-পরস্ত অর্থাৎ যুগধর্ম-পরস্ত মুসলমানকে মৌলানা সাহেবেরা খুব খাতিরও করেন। অনেক সময় নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয়, এই সমস্ত অনুষ্ঠানদ্রোহী মুসলমান কর্তারা মৌলানা সাহেবদের কথায় সায় দিয়েই চলেন। যদি তারা সাহস করে তাদের একটু ধমকে দিতেন যে, “আপনারা করছেন কি? আর কতকাল অজু করে মসলা, হায়েজ-নেফাজের মসলা, জিহাদের মসলা শুনিয়ে বেড়াবেন? মানুষ অজু করে করুক, না-করে না করুক, দেখুন তারা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে জানে কিনা, কেমন করে তা হওয়া যায় তাই বলুন। শুধু বার কয়েক পানি হাতে-পায়ে দিলেই যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া যায় না, তা জোর করে বলুন। শরীর ও মনের পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যই প্রকৃত লক্ষ্য―অজু একটি উপায়। নামাজ-রোজা ইত্যাদি সম্বন্ধে তার মূল উদ্দেশ্য কি ও তা হচ্ছে না কেন, তা বুঝিয়ে দেন। তা না করে নামাজ পড়লে সত্তর হাজার সওয়াব হয়, দরুদ পড়লে ফেরেশতা এসে আর্শীবাদ করে, এসব কথা শুনিয়ে লাভ কি? এগুলির দ্বারা বর্তমান জগতে আমরা কতদূর মনুষ্যত্ব লাভে সক্ষম হতে পারি, সেইটিই দেখিয়ে দিন। যদি এগুলি ছেড়ে দিয়ে আমরা অন্য সহজ উপায়ে সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে তবে পুরাতন অনুষ্ঠান পালনের জন্য তত বেশি কড়াকড়ি প্রয়োজন নাই”―তা হলে মুসলমান সমাজের চেহারা ফিরে যেত। অনুষ্ঠান পালন ব্যাপারে ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে অকুতোভয়ে স্বীকার করে নিতে হবে। অনুষ্ঠানই চরম নয়, অনুষ্ঠানের যে উদ্দেশ্য সেই উদ্দেশ্যটি প্রধান―তাই হাসিল করার জন্য বিধি-নিষেধ ও ধর্মগুরুর আদর্শ মাত্র একটি উপায়। সুতরাং অনুষ্ঠান পালন করলেই যে সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়ে যাবে, এরূপ ধারণাও ভুল। পালন করার সময় বুদ্ধি যদি ঘুমিয়ে থাকে, তবে তাতে সে উদ্দেশ্য কখনও সিদ্ধ হতে পারে না। বস্তুতঃ দেখা যায় পুরাতন অনুষ্ঠানাসক্ত মানুষের বুদ্ধি জাগ্রত নয়, এজন্য সে অনুষ্ঠানের খাতিরেই অনুষ্ঠান পালনে হাজির হয়েই কর্তব্য সারা করে; বুদ্ধি দ্বারা সে অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য বিচার করতে সমর্থ হয় না, বিচার করতে চায় না।

এই উদ্দেশ্যের প্রতি উদাসীন অনুষ্ঠান-প্রিয়তার বিষময় ফল কিরূপ হয়, তা বর্তমান বাঙলার সাধারণ মুসলমানের জীবন ও তাদের অনুষ্ঠানাসক্তি দুইটি মিলিয়ে দেখলে বেশ বুঝতে পারা যায়। শুক্রবারে মসজিদে গেলে চোখে এসে ঠেকবে এমন কতকগুলি চেহারা―যার প্রায় প্রত্যকের মাথায় একটি তৈল্লাত টুপি―গায়ে একটি ঘর্ম-তিক্ত গন্ধ-বিশিষ্ট পিরহান বা চাদর বা গামছা, পরিধানে একখানি মলিন-কৃষ্ণ লুঙ্গি। কিন্তু এদের অজু গোসলের মস্লা কণ্ঠস্থ। এরাই তিনবার নাকে পানির স্থানে যদি অন্যমনস্ক হয়ে চারবার নাকে পানি দিয়ে বসে তবে তারা পুনরায় সময় নষ্ট করে অজু দোহরায়। ফলে, অজু করতে গিয়ে যথার্থ পরিচ্ছন্নতার দিকে খেয়াল করার পরিবর্তে তারা শুধু খানিক গণিত প্র্যাকটিস করে। নামাজের সময়ও তাই―রেকাত গুণতে-গুণতে প্রাণান্ত-দরুদ-কলমা পড়ার সময়ও শ, হাজার, লাখ ঠিক করতেই তার উদ্দেশ্য উবে যায়। শুক্রবারের দিন খোতবার প্রহসনও কি চমৎকার! মোল্লাজি মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে লহন দোরস্ত করে সুর-ঝঙ্কারে মান্ধাতার আমলের রচিত কতকগুলি আরবি বাক্য পাঠ করেন―কি বুঝেন, না বুঝেন―তিনিই জানেন আর তার আল্লাই জানেন―আর মোকাদির দল বসে-বসে হয় হাই তোলে, না-হয় সংসারের ব্যাপার খানিক বসে-বসে―ভাবতে থাকে, আর যারা একটু বুদ্ধিমান তারা বেশ খানিক ঝিমিয়ে-ঝিমিয়ে ঘুমিয়ে তাদের শ্রমক্লান্ত দেহকে বিশ্রাম দিতে থাকে।

মোট কথা, মুসলমানদের অনুষ্ঠানাসক্তির দৌড় পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, তাদের জীবনের ধারা অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য-মোতাবেক ত নয়ই বরং তার ঠিক বিপরীত। সোজা করে বললে এই দাঁড়ায়, অজু কর কিন্তু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হও আর না-হও তার দিকে খেয়ালের দরকার নাই; নামাজ পড় কিন্তু— নম্র, শিষ্ট, সত্যভাষী, দয়ার্দ্রচিত্ত, সময়নিষ্ঠ, ভক্তিমান হওয়ার জন্য তার দিকে খেয়ালের দরকার নাই, নামাজই পড় রেকাতের পর রেকাত, সে তাড়াতাড়িই হোক আর ধীরে-ধীরেই হোক তার বিশেষ হিসাবের প্রয়োজন কি? খোতবা পড়, বুঝবার দরকার নাই; জামাতে নামাজ পড়—কিন্তু একতা হোক আর না হোক তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে কাজ নাই; রোজা রাখ কিন্তু রাত্রিতে যা ইচ্ছা তাই করতে পার। ইত্যাদি…। এই সমস্ত আদেশের অর্থ যে ঐরূপই মুসলমানদের জীবনে দাঁড়িয়েছে। সত্যই যদি অনুষ্ঠান পালন সত্ত্বেও এইরূপ বিপরীত ফলই তাদের জীবনে দেখা যায়, তবে যত শীগগির এই অনুষ্ঠান পালনের দৌরাত্ম্য ও নিষ্ঠুরতা হতে তাদের রেহাই দেওয়া যায় ততই তাদের মঙ্গল, মানুষের পক্ষেও কল্যাণকর। এই অত্যাচার হতে মুক্তি পেলে তাদের বুদ্ধি আর ঝিমিয়ে-ঝিমিয়ে বেহেশ্তের হুর-গেলমানের স্বপ্ন দেখবে না। তারা তখন দেখবে ও বুঝবে তাদের এই দুনিয়াই বেহেশ্ত, কত সুন্দর! কত মধুর! কত হৃদয়গ্রাহী! এই দুনিয়া-বেহেশতের সুখ-ঐশ্বয্যের লোভই যদি তাদের দেখান হয় তা হলেই তারা সহজে তাদের বুদ্ধি প্রয়োগ করে তাদের জীবন বৈচিত্র বিপুল-ঐশ্বর্য্যে ভরপুর করতে পারবে এবং তখনই তারা এই ঐশ্বর্য্যরে স্রষ্টাকে ভাল করে উপলব্ধি করতে পারবে। এবং আরও পরিষ্কার করে বুঝতে পারবে যে, ধর্মের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে এই মানবজীবনকে তার সমস্ত শক্তির উৎকর্ষ দ্বারা সুন্দর ও শ্রীসম্পন্ন করে তোলা। এ জীবনকে তুচ্ছ করে কোন ধর্ম-সাধনাই সার্থক হতে পারে না। যে ধর্ম মানুষের এই বিপুল জীবনের সম্পদ ও শ্রীকে বিকশিত করতে সাহায্যে করে না সে ধর্ম মিথ্যা এবং তার পূজা মানুষকে অধঃপতনের চরমে নিয়ে যায়। কিন্তু মোল্লাজি অজ্ঞেয় বেহেশতের লোভ দেখিয়ে মুসলমানকে বেশি করে ক্ষুৎপিপাসা ক্লিষ্ট করে তুলেছেন। তাতে তারা অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য ভুলে গেছে এবং তাদের নিদারুণ দুঃখ ক্লান্ত জীবন দিয়ে তারা সজোরে ধর্মশাস্ত্র, ধর্মগুরু ও ধর্মপ্রচারক এই তিনকে উপহাস করে বলছে “ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত যারা, তাদের আবার ধর্ম কিসের?” কিন্তু মুসলমান ধর্মের পুরোহিত এই মূক প্রতিবাদের অর্থটি বুঝবেন কি?

এখন আর বোধহয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না যে, আমাদের দৈনন্দিন জীবন সুন্দর করবার উদ্দেশ্যে যে-সমস্ত ধর্মাদেশ ইসলামের মারফতে প্রচারিত হয়েছিল তার পরিণতি আজ সাধারণ মুসলমানের জীবনে কি কদর্য চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়েছে―সে জীবনে সত্যকার ধর্মস্পৃহা ঘুচে গেছে, সে জীবন এখন আস্ফালন, অভিমান, মিথ্যা গর্ব, ভণ্ডামি, মূর্খতা ও রুচিহীনতায় পূর্ণ হয়ে উঠছে। এ-স্থলে আরও কয়েকটি আবশ্যকীয় আদেশের পরিণতি কিরূপ হয়েছে তার আলোচনা করা নিতান্ত প্রয়োজন মনে করি; যথা :―হজরত বলেছেন, (১) বিধবা বিবাহ দাও। (২) নারীকে পর্দায় রাখ। (৩) জাকাত, ফিৎরা, সাদকা দাও। (৪) তেলায়ত (কোরান ইত্যাদি পাঠ) কর। (৫) একাধিক বিবাহ করতে পার এবং আবশ্যক হলে তালাকও দিতে পার। (৬) পৈত্রিক সম্পত্তি ফারায়েজ-মত ভাগ-বাটোয়ারা কর।

এক-একটি করে ধরা যাক। এই যে বিধবা-বিবাহ ব্যাপারটি, যার প্রবর্তনের জন্য হিন্দুসমাজ আজ প্রায় একশত বৎসর ধরে নানা প্রকার চেষ্টা করছেন, এমন কি রাজ-সরকারের মারফতে আইন পর্যন্ত রচিত হয়েছে, সেই বিধবা-বিবাহ আজ মুসলমান সমাজে অনেকটা ঘৃণ্য ও লজ্জাকর ব্যাপার হয়ে উঠেছে। বিশেষতঃ শিক্ষিত ও বনিয়াদি ভদ্র মুসলমানই এ বিষয়ে অগ্রণী। তারা বিধবা-বিবাহ দিতে পর্যন্ত অত্যন্ত কুণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন, ক্রমে তাদের দৌর্বল্য দারুণ হয়ে উঠছে। সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে কেবল কৃষিজীবী মুসলমানদের মধ্যেই বিধবা-বিবাহ একটু চলছে, কারণ বিধবা একটু বয়স্কা বলে তাদের সংসারের উন্নতির জন্য বিশেষ কাজে লাগে কিন্তু তারাও আজকাল সভ্য-ভদ্র মুসলমানকে অনুকরণ করতে অগ্রসর হচ্ছে। তাছাড়া, একটু উচ্চস্তরের বিপত্মীক মুসলমান বিধবাকে স্ত্রীরুপে গ্রহণ করার প্রস্তাবে নাক-মুখ কুঁচিয়ে ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেন। এমন কি, দুই বা ততোধিক স্ত্রী-বিয়োগ-কাতর ভদ্র মুসলমানও কুমারীর (Virgin) জন্য লালায়িত হয়ে উঠেন। কিন্তু লজ্জা ও পরিতাপের বিষয়, মুসলমানের অনেকের বিধবার সঙ্গে পাশবিক সম্বন্ধটি প্রতিষ্ঠা করতে দ্বিধাবোধ করেন না, বরং বেশ লজ্জতের সঙ্গে আঁধারে সে ব্যাপার পাকা করে তোলেন এবং বৈধঅবৈধ সম্পর্কে ভীষণ পরিণামও তারা মাথা পেতে গ্রহণ করেন। তারা বিধবাকে স্ত্রী-রূপে বাঁধাবাঁধির মধ্যে গ্রহণ করতে নারাজ। ফলে মুসলমান বিধবাগুলি নির্লজ্জ হয়ে ক্রমশঃ তাদের শরীর পুরুষের পাশবিক ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যই উন্মুক্ত করতে বাধ্য হচ্ছে―স্ত্রীত্বের পবিত্রতা ও মাধুর্য হতে তারা দ্রুত বঞ্চিত হচ্ছে। এ-বিষয়ে সমাজপতিরা উদাসীন তো বটেই, বরং তারা ঐ সমস্ত অবৈধ আচারপরস্ত ভদ্র মুসলমানকেই আদর্শ মুসলমান বলে ধরেন, কারণ তারা নামাজ পড়েন। নামাজ পড়লেই সাত-খুন মাফ। কুকর্মের চূড়ান্ত করো কিন্তু মসজিদে এসে মাথা ঠুকে যাও, তোমার সমস্ত পাপ ধুয়ে যাবে। কি চমৎকার ধর্ম! এইরূপ নামাজের দোহাই দিয়েই মুসলমান আজ নানাপ্রকার অনাচার-অপকর্মে নিপুণ হয়ে উঠছে। তাই বলতে ইচ্ছা হয়, “এ নামাজ এখন উঠিয়ে দিলেই বোধহয় মুসলমান তার জীবন একটু শোধরাতে পারত। নামাজ আর কু-কর্মে যেন মিতালি করে বসেছে!” পর্দা আজ মুসলমান নরনারীর পাশবিক প্রবৃত্তি প্রখর করে তুলবার জন্য একটি ব্রহ্মাস্ত্র হয়ে উঠেছে। এতে তাদের দুর্বলতা, নির্লজ্জতা, সঙ্কীর্ণচিত্ততা, হৃদয়হীনতা, রুচি-বিকৃতি, কাপট্য, স্বাস্থ্যহীনতা, মস্তিঙ্ক-চর্চার প্রতি ঔদাসীন্য, কর্মে বিগতস্পৃহা ও আলস্য দিন-দিন বেড়ে চলেছে। নারীকে পর্দায় রাখা হয় এই উদ্দেশ্যে যে তার প্রতি পুরুষের দৃষ্টি না পড়ে এবং তার সতীত্ব নষ্ট না হয় অর্থাৎ তার দ্বারা এমন কোন সন্তান-সন্ততির সৃষ্টি না হয় যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার জন্য সমাজে তাদের জন্মদাতাকে খুঁজে বের করতে কষ্ট হয়। এই সতীত্ব রক্ষার উপায় পর্দা; কিন্তু বর্তমান মুসলমান সমাজে পর্দা এই সতীত্ব নষ্ট করাবার চমৎকার একটি উপায়ে পরিণত হয়েছে। পর্দার অন্তরালে মুসলমান নারীর দুর্বলতা এরূপে লালিত হতে থাকে যে, তার ব্যক্তিত্য একেবারে পুষ্টিলাভই করতে পারে না, ফলে সামান্য ইঙ্গিতে বা প্রলোভনেই সে পাশবিক লালসার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে―কারণ পর্দা তাকে অতি শৈশব হতেই ঐ একটি মাত্র বস্তু অর্থাৎ সতীত্বের কথা ভাবতে অভ্যস্থ করতে গিয়েই ঐ লালসাকেই পুষ্ট করে তুলে। এছাড়া অন্য বিষয় চিন্তা করা তার ভাগ্যে জুটে না―কিংবা অন্য বিষয়ে মনোনিবেশ করার সুযোগও তার মিলে না; কারণ তা হলে পর্দা তুলতে হয়, যেমন তার বিদ্যাচর্চার পরিধি বাড়াতে হলে পর্দার সীমা অনেকখানি খর্ব করতে হয়। মুসলমান নারীর অবরোধের পরিণাম যে কি বিষময় হয়েছে তার হিসাব দেওয়া এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়, মাত্র তার ইঙ্গিত করলেই যথেষ্ট হবে। নারী পর্দার অন্তরালে কেমন করে স্বাস্থ্য হারাচ্ছে, অকাল-মৃত্যুর কবলে পড়ছে, সন্তান-সন্ততির হীনস্বাস্থ্য নিয়ে অহর্নিশ জ্বালা-যন্ত্রণা ভোগ করছে, দ্রুত মেজাজের মাধুর্য ও মানসিক স্ফূর্তি খুইয়ে ফেলে স্বামীর জীবনের কাঁটাস্বরুপ হয়ে উঠছে, তার প্রমাণ সংগ্রহ করতে হলে উচ্চশিক্ষিত কতিপয় উচ্চপদস্থ ব্যক্তির জীবন-ইতিহাস ঘেটে দেখলেই আমার কথার সত্যতা প্রমাণিত হবে। এবংবিধ নারীর সঙ্গে থেকে মন ও মস্তিষ্কের চর্চা মুসলমান পুরুষের পক্ষে একরূপ অসম্ভব। প্রায় মুসলমানের সংসারে আনন্দ, স্ফূর্তি ও স্বাস্থ্যের পরিবর্তে নিরানন্দ ঝগড়াঝাটি ও রোগ-যন্ত্রণা বিদ্ধমান। এ সমস্তই কঠোর অবরোধ প্রথা বা পর্দার আশু বিষময় ফল।

আজকাল বোরকার পক্ষপাতী হয়ে অনেকে পর্দা-সমস্যা সমাধান করতে চান। অবশ্য মুসলমান নারী বহুকাল হতে বোরকা ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু এখন স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রী-স্বাধীনতার ধূয়ায় তারা বোরকা দ্বারা পর্দা বা অবরোধে কড়াকড়ি একটু হালকা করতে চান। কিন্তু আমরা মনে হয়, ‘বোরকা’ও পুরুষের, বিশেষতঃ নারীর পক্ষে অপমানজনক ও লজ্জাকর। এতে করে বৈচিত্র্য-সুখ-বিমুখ নারী স্বীয় স্বাধীনতার অপব্যবহারের পথ সহজ করে তুলতে পারে। প্রকৃতপক্ষে মুসলমান বোরকাওয়ালিদের জীবন-কাহিনী কিছু কিছু শুনলে Reynolds সাহেবও লজ্জা পাবেন। সত্য বলতে, আজ বোরকা মুসলমান নারীর দুর্বলতার চরম নিদর্শন হয়ে উঠেছে।

জাকাৎ, ফিৎরা ও সাদকা প্রভৃতির প্রচলনের দানের বহর যে বেড়ে চলেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব-জ্ঞানহীন মূর্খ ভিক্ষুকের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে সে কথা আর বেশি বলবার প্রয়োজন নাই। রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে থাকলে হাজার-হাজার অস্থি কঙ্কালসার মুসলমান নরনারীর কুৎসিত চেহারা চোখে এসে একাধারে ক্ষোভ, লজ্জা ও ঘৃণার উদ্রেক করে। এই নিদারুণ ভিক্ষাবৃত্তির অনেকখানি যে বিচার বুদ্ধিহীন বদান্যতার হুকুম হতে উৎপত্তি লাভ করেছে; সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নাই।

কোরান শরিফ পাঠ (তেলায়ত) করার হুকুম আজ যেরূপভাবে পালন করা হচ্ছে, তাতে মনে হয়, তেলায়ত বন্ধ করে দিলেই মন ও মস্তিষ্কের পক্ষে পরম কল্যাণকর হবে। সকালে মসজিদের মধ্যে কেরাত করে দলে-দলে এক বর্ণ না-বুঝে শুধু সওয়াবের লোভে যারা তেলায়ত করে, তাদের বুদ্ধি যে সিকেয় তোলা থাকে, তা বলাই বাহুল্য। এই হুকুমের নিগ্রহ প্রকাশ পায় ঐ সমস্ত তেলায়তকারির মূর্খতা ও অজ্ঞতার ভিতর দিয়ে।

একাধিক বিবাহের হুকুম ও তালাকের হুকুম প্রায় সমভাবেই পালিত হয়। এই ব্যাপারেই আদর্শটি যেন পুরোপুরি পালিত হয়ে থাকে। মুসলমান বিবাহ করতেও বিলম্ব করে না, আবার তালাক দিতেও দ্বিধাবোধ করে না। দুঃখের বিষয়, বিবাহের পবিত্রতার প্রতি শ্রদ্ধা হওয়া ও তালাকের প্রতি ঘৃণা মুসলমানের জীবনে অতীব বিরল বললে বোধহয় অতুক্তি হয় না। অথচ বিবাহ ও তালাকের হুকুমের উদ্দেশ্য ছিল ‘বিবাহ’কে অধিকতর পবিত্র ও দায়িত্বপূর্ণ ব্যাপার বলে গ্রহণ করে তার উপর প্রীতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু আজ ‘বিবাহ’ পুরুষের পশুবৃত্তি চরিতার্থ করবার এবং তালাক তার স্বেচ্ছাচারিতা, পত্মীর প্রতি দৌরাত্ম্য ও অবিচারকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য প্রকৃষ্ট উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পৈত্রিক সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারার হুকুমও অনেক ক্ষেত্রে যথার্থভাবে পালিত হচ্ছে না। এর ফলে অহর্নিশ ভাই-এ ভাই-এ কাটাকাটি মারামারি চলছে। আদালত তার সাক্ষী। উপসংহারে এই বললে যথেষ্ট হবে যে, আজ মুসলমান ইসলামের বিধি-নিষেধ লঙ্ঘন করে দিব্যি খোশমেজাজে দিন কাটাচ্ছে; আর মোল্লাজির দল চেঁচিয়ে বেড়াচ্ছেন যে ইসলাম-তরী ডুবলরে ডুবল। তারা আস্ফালন করে বলেন, “ইসলাম সনাতন, ইসলামকে মজবুত করে ধর। ইসলামকে ছেড়ে মুসলমান বরবাদ হয়ে যাচ্ছে।”

কিন্তু প্রশ্ন এই যে, যখন দেখছি মুসলমান নামধেয় মানুষগুলির মধ্যে শতকরা ৯০ জন ঠিক ইসলামের উদ্দেশ্য-সম্মত বিধি-নিষেধ মেনে চলছে না অর্থাৎ চলতে পারছে না, তখন কি করে বলি―ইসলাম সনাতন, উহা চিরকাল সর্বত্র সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য? বরং বলতে চাই, তারা মানছে না, কারণ তারা মানতে পারছে না। এতে আমি এই ইঙ্গিত করতে চাই যে, এর জন্য মানুষ যতই দোষী হউক না কেন, বিধি-নিষেধেরও কিছু কিছু দোষ আছে। মোদ্দা কথা, ইসলামের বিধি-নিষেধ পালন করতে গিয়ে মুসলমান আজ কতকগুলি ভণ্ড, প্রাণহীন, গর্হিতরুচি, বুদ্ধি-বিবেকহীন জীবে পরিণত হয়েছে। মুসলমান নেতৃবৃন্দ এদিকে দৃক্পাতও করছেন না; বরং সমস্তই ধামাচাপা দিয়ে তারা সমাজে সাচ্চা বনে বসেছেন।

এর চেয়ে গভীর পরিতাপের ও লজ্জার বিষয় আর কি হতে পারে ? এতে মুসলমান সমাজ পরকালে দোজখে যাবে কি বেহেশতে যাবে তা বলতে পারি না, তবে এখানেই যে, দুনিয়া-দোজখে দ্রুত চলেছে তা আর বলতে হবে না। বাঙলার জেল, হাসপাতালগুলো তার প্রমাণ!


লেখাটি নির্বাচন, সংগ্রহ ও কম্পোজ করেছেন মহিউদ্দিন শরীফ

Exit mobile version