লেখাটি ২০০০ সালের ২৩ নভেম্বর সাপ্তাহিক বর্তমান সংলাপে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে লেখকের প্রবন্ধ সংকলন ‘ঈশ্বর, সৃষ্টি ও ধর্ম’ গ্রন্থেও অন্তর্ভূক্ত করা হয়। আমরা এই ওয়েবসাইটে লেখাটি প্রায় হুবহু প্রকাশ করেছি।
আমার নাম ঈশ্বর। নামটা যে কে রেখেছিল জানি না। কারণ আমি জানি না আমার বাবা ও মা কে এবং তাদের কি নাম। অভিধান থেকে যে অর্থ সংগ্রহ করা হয় তা থেকে আমার নামের অর্থ অনেক – যেমন ভগবান, জগৎ স্রষ্টা, প্রভু, স্বামী (প্রাণেশ্বর) অধিপতি, রাজা (ভারতেশ্বর), শ্রেষ্ঠ বা প্রধান ব্যক্তি (যোগীশ্বর) ওঁ – তাই চন্দ্রবিন্দু – অর্থাৎ মহিমাসূচক চিহ্ন।
অনেকে বলে আমি নাকি স্বয়ম্ভু – অর্থাৎ আপনা-আপনি জন্মেছি। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? কেউ কি কখনো আপনা থেকেই জন্মগ্রহণ করতে পারে? আচ্ছা বলুনতো, এমন কথা বললে যুক্তিমান মানুষে পাগল বলবে না? তাই মাঝে মাঝে ভাবি আমি কিভাবে জন্মালাম। আমি যদি স্বয়ম্ভু হই, তাহলে ভগবান বিষ্ণু জলের মধ্যে ব্রহ্মাণ্ডের বীজ নিক্ষেপ করলে একটি সোনার ডিম হয় এবং জলের উপর ভাসতে থাকে। সেই অণ্ড থেকে ব্রহ্মা স্বয়ং বের হয়ে আসে। সোনার ডিম জলে ভাসবে কি করে? ডিম সাধারণ পচা হলে জলে ভাসে। ভালো ডিম ডুবে যায়। আর সোনার ডিমতো আরো ভারি জিনিস, ভাসে কি করে জলে? অগ্নিপুরাণের এ কাহিনী কি বিশ্বাসযোগ্য? তাছাড়া ভগবান বিষ্ণু ব্রহ্মাণ্ডের বীজ পেলেন কোথায়? তার কোন তথ্য নেই।
এদিকে ব্রহ্মের অর্থ হল- অব্যয়, অব্যক্ত, চিরন্তন, সর্ব সৃষ্টিকর্তা, সর্বব্যাপক, স্বয়ম্ভু। ইনি অদৃশ্য, আদি ও অন্তহীন। ইনি কালের ও সীমার অতীত। ত্রিমূর্তির প্রধান অংশ। ইনি বিষ্ণুর সৃষ্ট ডিম্ব থেকে উৎপন্ন। তাহলে ডিম্ব আসছে বিষ্ণু আসছে কর্তৃক জলে নিক্ষেপিত ব্রহ্মাণ্ডের বীজ থেকে। এখন প্রশ্ন হতে পারে এই বীজটি বিষ্ণু পেলেন কোথায়?
এবার আসুন বিষ্ণুকে চিনবার চেষ্টা করি। বিষ্ণু-নারায়ন কৃষ্ণ। ইনি ত্রিমূর্তির এক অংশ ও সৃষ্টির পালক। বিষ্ণুর পিতার নাম কশ্যপ, মাতা অদিতি। এঁর দুই স্ত্রী, লক্ষ্মী ও সরস্বতী। প্রলয় সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় নারাণরূপে শিষ নাগের উপর শায়িত ছিলেন। তাঁর নাভিপদ্ম থেকে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার উৎপত্তি হয়। ইনি দশবার অবতার হয়ে পৃথিবীতে আসবেন – নয়বার এসে গেছেন। শুরু কল্কি অবতার বাকি।
বিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে যদি সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর ব্রহ্মার উৎপন্ন হয় তাহলে স্বর্নডিম্ব থেকে স্বয়ম্ভরূপে প্রকাশ ব্রহ্মার কাহিনী বিপরীতমুখী হয়ে যায় না কি?
ঈশ্বরের আর এক নাম হল একাদশ তনু। কারণ এগারোবার ভিন্ন ভিন্ন রুদ্র মূর্তি ধরে ঈশ্বর আগমন করেছেন। এর নাম মহাদেব যিনি মহেশ্বর – অর্থাৎ মহা-ঈশ্বর। এই মহাদেব ত্রিমূর্তির অংশ। হিন্দুধর্মে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে নিয়ে ত্রিমূর্তি সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা ও ধ্বংসকর্তা। ঈশ্বর শব্দটি এসেছে সংস্কৃতি √ঈশ + বর (র্তৃ) থেকে। বুঝুন ব্যাপারটা। সুতরাং আমি ঈশ্বররূপে নিজের ঠিকুজি খুঁজে পাচ্ছি না।
আর্যদের অন্যান্য শাখায় আমাকে বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন গ্রিকদের জিউস, রোমানদের জুপিটার, হিন্দুদের দেবরাজ। এর পূর্বে আকাশের বিশাল আকার দেখে এবং সূর্যের গতিপথ ভেবে আকাশকে মানুষ ঈশ্বর বলে ফেললো – নাম দিলো দাইউস, পিতার আর ধরিত্রী মাথা। গ্রিকদের ঈশ্বর যে জিউস তার পিতা মাতা ছিল টাইটান ক্রোনাস, আর তার স্ত্রী রিয়া।
এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আমার বিভিন্ন নাম দেয়া হয়। যেমন, পেরুর ইনকাদের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা উইরাকোচা বা পাকহাকামাক; গ্রিকল্যান্ডের অধিবাসীদের প্রধান দেবতা টর্নগারসুক, মেক্সিকোয় তোলাকু নাহুয়াকু, তেজকাৎ লিপোকা পলিনেশীয়দের মধ্যে টাঙ্গারোয়া; হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে কানারোয়া; পশ্চিম আফ্রিকায় নিয়োংমাই; জাপানের সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা ইজানাগি, ইরানিদের আহুরা মাজদা ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে আমার বিচিত্র নামকরণ ও বৈশিষ্ট্য অনেক পরের ব্যাপার এবং সবক্ষেত্রেই যে সাধারণ যোগসূত্র ছিল তা পুরোপুরি কল্পনা নির্ভর, বাস্তব নয়। ইংরেজরা আমার নামকরণ করলো god ছোট ‘g’ দিয়ে। ‘god’ শব্দটা কিন্তু old english, জার্মানিতে ‘gott’। এসব শব্দের উৎস হচ্ছে গথিক শব্দ ‘guth’ – ঈশ্বের নাম। মজার কথা হচ্ছে ‘guth’ বা ‘god’ শব্দের সাথে ‘good’ শব্দের কোনো সম্পর্ক নেই।
‘god’ এর ছোট ‘g’ থেকে বড় ‘G’ -তে পৌঁছাতে হলে একটু পিছনে ফিরে যেতে হয়। ধর্মে ‘ISM’ এর পরিধিটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে – যেমন Animism (সর্বপ্রাণবাদ)- Pantheism (সর্বেশ্বরবাদ)- P0lytheism (বহু ঈশ্বরবাদ) তারপর একেশ্বরবাদ- Monotheism । এই একেশ্বরবাদে ঈশ্বরের ছোট ‘g’ টা বড় ‘G’ হয়ে গেলো। কারণ এই বড় ‘G’-‘র ঈশ্বর অনেক ছোট ঈশ্বরের (gods) প্রধান হয়ে গেলেন। আমাকে এক ঈশ্বরবাদে দাঁড় করিয়ে দিলেও আমার দ্বিত্ববাদ রয়ে গেল- কারণ ‘আমি’ থেকে অনেক সময় ‘আমরা’ হয়ে গেছি। এই দ্বিত্ববাদ থেকে মানুষের আবার বিশ্বাস জন্মালো বহু ঈশ্বরবাদে। এই বিশ্বাসে লিঙ্গভেদে শুরু হল দেব-দেবীদের স্তবস্তুতি। গ্রিক, রোমান ও হিন্দু দেব-দেবীরা শক্তিধর হয়ে গেল। তার মাঝে নারীরাও অনেক ক্ষেত্রে প্রধান হয়ে গেছেন। গ্রিকদের ভেনাস, এথেনি, আর্টেমিস, হিন্দুদের দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী তাদের নিজস্ব ক্ষেত্রে প্রধান হয়ে গেল। প্রাক-ইসলামী যুগে আল-ইলা দেব-দেবীদের প্রধান ছিল। অনেকে বলেন-হুবাল দেবতা প্রধানের তিন কন্যা লা’ত, মানাত আর উজ্জ্বা গ্রিক দেবী ভেনাস, এথেনি ডিমেটার ও আর্টেমিসের মত স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রধান ছিলো। হুবালের সেখানে কোন পাত্তাই ছিল না। আবার অনেকে হুবালের সাথে আল-ইলা অর্থাৎ আল্লাহর তুলনা করে থাকেন এবং এর আকার ছিল মানুষের্ মতো। কোনো কোনো ভাষাবিদর মতে ইলাহা শব্দের আদিতে আলিফ ও লাম যোগে আল্লাহ শব্দ গঠিত। আমাকে শোনানো হয়েছে যে, সেমেটিক ভাষাসমূহ ইব্রানি, সুররানি, আরামি, কালদানি, হিমিয়ারিও আরবি ভাষায় দেখা যায়। উপাস্য বা মাবুদের অর্থ প্রকাশের জন্য সাধারণত যে শব্দ ব্যবহৃত হয় তা আলিফ, লাম ও হা, এই তিন অক্ষর সংযোগে গঠিত হয়। কালদানী ও সুররানী ভাষায় ‘আলাহা’ বা ‘লাহা’ এবং ইব্রানী ভাষায় ‘আলুহা’ – ঐ মূলেরই রূপান্তর মাত্র। তবে এই উপাস্য আল্লাহ ছাড়া বহু প্রকার জীবন বা পদার্থ হতে পারে, কিংবা প্রতিমাও হতে পারে। ইসলামের পূর্বে আল্লাহ শব্দটি আরবদের কাছে অজানা ছিল না। মানুষ যে আল্লাহর দাস, এও জানা ছিল। আবদুল্লাহ নাম হতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
‘ইলাহ’ ও হিব্রু ‘এলোহা’ নিঃসন্দেহে অভিন্ন। উভয়ের আদি বুৎপত্তি নির্ণয়ের সমস্যাও একই (Ency, Bibilica) । প্রফেসর হিট্টির কথা আপনারা শুনেছেন। তিনি বলেন – আল্লাহ শব্দটি অতী প্রাচীন। এই শব্দ দুটি দক্ষিণ-আরবীয় উৎকীর্ণ লিপিতে-একটি মিনারেল অন্যটি সাবিয়েন- দেখা যায়। কিন্তু এর উৎস খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর লিহিয়ানাইট ফলকে উৎকীর্ণ HLH আকারে পাওয়া যায়। লিহিয়ানরা সিরিয়ার নিকট থেকে ঈশ্বর বা গড – এর ধারণা পেলেও আরবে এই ঈশ্বরের (diety) পূজার প্রথম কেন্দ্রস্থল ছিল। পরবর্তীতে এই নাম ইসলামের পূর্বে সাফা উৎকীর্ণ লিপিতে হাল্লা (Hallah) রূপে প্রকাশ পায়। সৈয়দ আমীর আলীও ‘বানাত-উল্লাহ’র কথা উল্লেখ করে বলেছেন সেমাইটস, ফোনিশিয়ান ও ব্যাবিলনিয়ানদের মতো এসব দেবদেবীর পূজা ছিলো প্রধানত লিঙ্গভিত্তিক (Phallic)। ‘বানাত উল্লাহ্-য় অন্তর্ভূক্ত তিন কন্যা লাত, মানাত ও উজ্জ্বা। কিন্তু এদের মায়ের কথা কেউ উল্লেখ করেনি। বুঝুন ব্যাপারটা।
ইহুদিদের একেশ্বরবাদে বিশ্বাস জন্মালো বলতে গেলে ব্যাবিলনে নির্বাসনকালে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দিতে। কারণ ব্যাবিলনে বিভিন্ন দেবদেবী থাকলেও প্রধান একজনকে বেছে তারা পূজা করতো, অন্য সব ছোটদের কোন গুরুত্ব দিত না। এইসব ছোট ছোট দেব-দেবীকে ছোট ‘g’ দিয়ে ‘god’ লেখা হতো। এই অবস্থাকে ব্যাবিলনে হেনোথেইজম (henotheism) বলা হয়। গ্রিক শব্দ ‘hen’ অর্থ একক এবং ‘theos’ শব্দের অর্থ দেবতা বা ঈশ্বর। যেমন ‘প্রিস্ট’ এবং ‘হাইপ্রিস্ট’। এই ব্যবস্থা পুরণের নিয়মে ‘Old Testament’ পাওয়া যায়।
পুরনো নিয়মে দেখা যায় Moleck (মোলেক) আম্মানদের জাতীয় দেবতা ছিল মার্ডক (Marduk) ব্যাবিলনীয়দের প্রধান দেবতা, আর Baal (বাল) ক্যানানাইটদের পধান বায়ু দেবতা, এছাড়া EL (এল) ক্যানানাইটদের দেব-দেবীদের প্রধান ছিল। সুতরাং হেনোথিইজম প্রাচীন ইসরাইলিদের মধ্যে অজানা ছিল না। সত্যি বলতে কি, বাইবেল বিশেষজ্ঞরা পুরানো নিয়মের ‘god’ এর ধারণা সম্বন্ধে monolatry-‘র অর্থাৎ অনেকের মধ্যে একজনের পূজার কথা বলেছেন, নির্জলা একেশ্বরবাদ নয়। তাঁরা দাবি করেন যে, আব্রাহামের (খ্রিস্টপূর্ব ১০০) ঈশ্বর এবং মোসেসের (খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০) ঈশ্বরকে পুরোপুরি একেশ্বরবাদ বলা যায় না। বাইবেলের মূল কিতাব হল জেনেসিস। আব্রাম রাজি হলেন ঈশ্বরকে জাতীয় দেবতা বলতে। কিন্তু ঈশ্বর হিসাবে আমি শর্ত দিলাম, তোমাদের খৎনা করতে। আব্রাম রাজি হয়ে খৎনা করলো এবং অন্য সবার করালো। আমি তাকে তখন বহু জাতির পিতা করে দিয়ে আব্রাম নাম বদলে দিলাম আব্রাহাম। এর ৪০০ বছর পন খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ সাথে মাউন্ট সিনাই-এ জ্বলন্ত ঝোপের মধ্যে আমি মোসেসকে বললাম মিশরে বসবাসকারী সব ইসরাইলিদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করো। মোসেস প্রশ্ন করলো আমার ঈশ্বরের নাম কী? আমি দুর্বোধ্য ভাষায় বলেছিলাম তোমার ঈশ্বরের নাম হলো YHWH- ইয়াহু। এর অনেক অর্থই হতে পারে। যেমন- আমি আমিই- আমি যা ইচ্ছা তা করি, আমি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। ‘ইয়াহু’ ক্রিপদে হয় ‘To be’-‘র সাথে নাকি জড়িত এবং পৃথিবীতে যা কিছু ঘটছে তার সাথে নাকি আমি জড়িত। তারপর আমি নাকি মোসেসকে দশটি আদেশ দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম – আমি ছাড়া তোমার আর কোন ঈশ্বর নেই। ইহুদিরা তাই ইয়াহুকে Adonai অর্তা} Sovereign বা Lord বলে থাকে।
এর এক শতাব্দি পর গ্রিক ভাষাভাষী ইহুদিরা হিব্রু কেতাবকে গ্রিক ভাষায় অনুবাদ করে- যার নাম সপ্তপুস্তক। এখানে Adonai কে বলা হলো Kyrios (কাইরিওস) অর্থাৎ Lord। পরে প্রথম দিকে ক্রিশ্চান চার্চের বিশপরা, যারা ল্যাটিন ভাষা বলতো, তারা Lord এর পরিবর্তে Dominius বলতে শুরু করে। মজার ব্যাপার হলো ইংরেজি L-o-r-d পুরোনো ইংরেজি ভাভা ‘hlaford’ থেকে নেয়া হয়েছে যার অর্থ অন্নদাতা- মুসলমানরা বলে রব। প্রতিপালক।
ষষ্ঠ শতাব্দি থেকে দশম শতাব্দিতে ইহুদিরা বাইবেল গ্রন্থকে (তানাকা-Tanaka) সংশোধন করে অবোধ্য তথা YHWH ইয়াহু’র সাথে তিনটি স্বরবর্ণ যোগ করে YeHoWaH- তে রূপান্তর করে Adoni ও Elohim-‘র (ইহুদিদের ঈশ্বর) সমতুল্য করে। রেনেসাঁর সময় আবার ক্রিশ্চান পাদ্রীরা YeHoWaH থেকে করে ফেলে Jahova। এখন যিহোভার অর্থ ঈশ্বর বলে ধরা হয়।
ঈশ্বরকে ইহুদিরা Elohim বলে যাকতো। Elohim বহুবচন, একবচনে ‘eloha’ ইলোহা- যা বাইবেলে খুব কম ব্যবহার করা হয়েছে। Elohim কে ইংরেজি শব্দে বহুবচনে ‘gods’ বরলে গিয়ে ছোট ‘g’ ব্যবহার করা হয়েছে।
নিকট প্রাচ্যে (Near East) বিধর্মীদের (Pagans) দেব-দেবীদের Elohim বলা হতো। কিন্তু বাইবেল বিশেষজ্ঞরা মনে করেন পুরোনো নিয়মে এই বহুবচনের ব্যবহার একেশ্ববাদের বিরুদ্ধে নয় – অর্তাৎ বহুদেবতাবাদ বোঝায় না। যেহেতু বহু দেব-দেবীর ক্ষমতা ঈশ্বরের মধ্যে কেন্দ্রীভূত, তাই বহুবচন দ্বিত্ত্ববাদ হয় না। Elohim সেমেটিক শব্দ EL শব্দের প্রলম্বিত ব্যবহার। কারণ EL ক্যানানাইটদের দেব-দেবীদের মধ্যে প্রধান দেবতা। সুতরাং ‘Old Testament’ একই ঈশ্বরের বহুবচন ব্যবহার একেশ্বরবাদের ‘শেরেক’ বোঝায় না। যেমন- আদম ঈশ্বরের আদেশ না মেনে নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করায় ঈশ্বর হিসাবে আমি নাকি বলেছিলাম – Be hold the man is become as one us to know good and Evil (Gen-3:22)। কোরানেও অনেক স্থানে ‘আমি’র স্থলে ‘আমরা’ ব্যবহার করা হয়েছে।
ভারতে প্রাচীন সভ্য জাতি যে ঈশ্বরের পূজা করতো, তিনি ছিলেন দেবী (মাদার গডেস) শিংযুক্ত উর্বতার দেবী। তাছাড়া পবিত্র বৃক্ষ এবং জানোয়ারও পূজ্য ছিলো। এদের ধর্মীয় জীবনে হস্তপদ ধৌত করে বিশুদ্ধ হওয়ার রীতি ছিল- (নামাজের আগে ওজু করার মত)। এসব খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর থেকে খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার সাল অব্দের কথা।
ভারতের প্রাচীন দর্মী পুস্তক হিসাবে আর্যরা যে পুস্তক ব্যবহার করতো তা ছিল ঋকবেদ। এতে ১০২৮টি স্ত্রোত্র ছিল – যা সম্ভবত ১৫০০ থেকে ৯০০ খ্রিস্টপূর্ব’র মধ্যে রচিত ও গ্রন্থিত। পরে যে তিনটি বেদের কথা বলা হয়, তা মূলত ঋকবেদের ধারক ও বাহক বলা যেতে পারে। যেমন- শামবেদ ঋকবেদের কয়েকটি স্তোত্র সংকলিত যা ঐতিহাসিকদের কাছে মূল্যগীন। যজুর্বেদে (ঋকবেদের দুই শতাব্দি পর সংকলিত) ঋকবেদের বলিদান বিষয়ক বিস্তৃত ব্যাখ্যা ও প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। আর অথর্ব বেদ বল পুরোহিতদের ব্যবহারিক বিধানমালা (হ্যান্ডবুক) বলা যায়। ঋকবেদে আরো কয়েকটি দেবীর কথা আছে- যেমন পৃথ্বী, অদিতি, ঊষা, রাত্রি ও অরণ্যানী (বনদেবী)।
বহু বছর পর আর্য জাতির বংশধররা ইরানিয়ান, গ্রিক, রোমান, জার্মান স্লাভ ও কেল্ট-এদের ধর্মীয় বিশ্বাস সমতুল্য না হলেও কাছাকাছি। কিন্তু ভারতে যখন আর্যদের এই শাখা প্রবেশ করে তখন ইন্দো-ইউরোপয়ী ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে গ্রিক জিউস ও রোমান জুপিটারের ধারায় পুরুষ-প্রকৃতিকে ধরে মাদারগডের স্থলে ফাদারগড করে ফেলে। এবং স্বর্গ দেবতা দাইউস-এর আবির্ভাব হয় ও পরবর্তীতে ইন্দ্রের রূপ ধারণ করে। তারপর বায়ু, বিষ্ণু, অগ্নি, অশ্বিনী ইত্যাদির কথা এবং আরো আনুষঙ্গিক…। বুঝুন, আমি ঈশ্বর এখন কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম।
আমার কোন রূপ নেই, আমি অদৃশ্য, কিন্তু মানুষেরা আমাকে পুরুষের রূপ দিয়েছে। আমার হাত আছে, পা আছে, চোখ, কান, স্বর ইত্যাদি সবই আছে। আমার বসার জন্য সিংহাসন আছে- আমার রাজ্য আছে- Kingdom of God – যেখানে আমার মন্ত্রী, সেনাধ্যক্ষ, পদাতিক কর্মচারি সবাই Angel, এরাও অদৃশ্য কিন্তু উড়ে চলে, যারা কথাও বলে। আমাকে কেউ দেখেনি। শুধু বাইবেলে আছে কোনো কোনো প্রফেট যাদের আমি নির্বাচন করি, তাদের কাছে শুধু আমার শরীরের কিছু অংশ প্রদর্শন করেছি মাত্র। কারোর সাথে কথাও বলেছি। যেমন –
-মোসেস আমার পিঠ দেখে।
-য্যাকব স্বপ্নে দেখেছে পৃথিবী থেকে একটা সিঁড়ি স্বর্গের দিকে উঠে গেছে – আর সিঁড়ির উপর আমি দাঁড়িয়ে আছি। ব্যস্।
-মিখাইয়া দেখেছে আমি সিংহাসনে বসে আছি। আর আমার ডাইনে বাঁয়ে আমার সাঙ্গপাঙ্গরা দাঁড়িয়ে আছে।
-ইসাইয়া আমাকে চেয়ারে রাজকীয়ভাবে বসে থাকতে দেখেছে।
-য়িহিস্কেল আমাকে মানুষের আকৃতির মত চেয়ারে বসে থাকতে দেখেছে, এসব পুরোনো নিয়মের তথ্য।
নতুন নিয়মে সাধুজন ভাসাভাসা আভাস দিয়েছে যে আমি আত্মা (Spirit) স্বরূপে ছিলা, আর আমার আগে স্বর্গ একটা চেয়ার ছিল, সেখানে কে যেন বসে।
কিন্তু যিশু কখনো বলেননি চার সুসমাচারে যে তিনি তার পিতার কোন সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন কিনা।
তাহলে আমি কেমন? অনুমান করুন সকলেই আমাকে কল্পনা করেছে। কেউ দেখেনি।
আমার মনে হয় কি জানেন, কিছু কায়েমি স্বার্থবাদী মানুষ কল্পনা করে আমাকে জন্ম দিয়েছে, মানুষের জন্ম আমি দিইনি। কারণ, আমার যখন কোন আকার নেই, তখন মানুষ আমাকে মানুষের মত ভাবলো কি করে? আর আমিই বা পুরুষ প্রকৃতি হলাম কেমন করে যখন আমার কোন প্রজনন ক্ষমতা নেই। আমি কোন নারীর স্বামী নই, সন্তানের টিতা নই বা পিতা-মাতার সন্তানও নই। আমি শুধু কল্পনা-মানুষের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তৈরি এক অদৃশ্য নামবাচক জীব। আমি যে মানুষের বানানো, আমি যে মানুষের কল্পনার সন্তান এটা আমার বদ্ধ ধারণায় এসে গেছে। যারা বলে এই বিশ্ব সৃষ্টি আমার, তারা মূর্ক, অজ্ঞ, গাঁজাখোর। দেকার্তে, কান্ট, বেকন ও ডারউইন যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে যে সৃষ্টিতত্ত্বে আমার কোন ভূমিকা নেই। মানুষের কল্পনাকে কেন্দ্র করে যে অস্তিত্বআমার গড়ে উঠেছিল, মানুষের মনোজত থেকে যুক্তির জোরে সে বিশ্বাসের যে অবলুপ্তি ঘটবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এখন পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ মানুষ আমাকে বিশ্বাস করে না। এই ক্রম-অগ্রসর শুরু হয়েছে অনেক আগেই। কারণ আমাকে সর্বশক্তিমান বলা হলেও আমার কানাকড়ি শক্তি নেই। আমি কারো কাথে পাথর, কারো কাছে মূর্তি, কারো কাছে শূন্য। এই নিথর ও শূন্যতার কাছে মানুষের পাওয়া ও চাওয়ার কিছুই নেই। কারণ আমার দেবার কিছুই নেই। যা ঘটে কাকতালীয় এবং কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী তাকেই ঈশ্বরের দান বলে বুজরুকি করে সরল মানুষদের ঠকায়।
প্রাচীন ভারতীয় চার্বাক দর্শন বা গ্রিক বন্তুবাদী দর্শনের পরে ভারতে যেমন এসেছে কনাদ দর্শন, ন্যায় ও সাংখ্য দর্শন,পুরাণ কাসব-এর নীতিশাস্ত্র বিরোধিতা (Anti nomianism) ইত্যাদি। তেমনি পাশ্চাত্যে সৃষ্টি হয়েছে অজ্ঞাবাদ (Agonsticism), মানববাদ (Humanism), সন্দেহবাদ (Skepticism), অভিজ্ঞতাবাদ (Empiricism), যুক্তিবাদ (Rationalism), দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism) ইত্যাদি। এই ধরনের নানান ভাবনার আন্তঃক্রিয়া ও বিবর্তন মানুষের সামনে আমার অসারতা ও শূন্যতাকে উন্মোচিত করেছে। একদিন আসবে, যেদিন আমি শুধু মানুষের মনোলোকে না থেকে, প্রাচীন ভাষাতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের গবেষণার বিষয় হয়ে উঠবো। মানুষ তখন আমার নামের সন্ধান করবে প্রাচীন পুঁথিপত্রে ডক্টরেট ডিগ্রির থিসিস লেখার জন্য। উৎসবের ক্ষেত্রে তখন বড়দিন, প্রাতিষ্ঠানিক পূজা-আচার থাকবে না, তার স্থানে এসে যাবে প্রকৃতি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি।
আমাকে এখন অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে মন্দিরের পুরোহিত, চার্চের পাদ্রী ও ব্যবসায়ী মোল্লারা শুধু তাদের পেশা ও কারবারী দরবার-এ। কিছু ম্যাজিক ও হাত সাফাই দেখিয়ে আগত ভক্তবৃন্দকে প্রতারিত করে মালপানি হাতিয়ে নিতে সে সুবিধা হতো, আমার অবর্তমানে তাদের সমূহ ক্ষতি ও সর্বনাশ হওয়ার সম্ভাবনায় তারা কোন প্রকারে আমায় বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
আমার নাম নিয়ে মানুষ কি-ই না করেছে। কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ খরচ করে মন্দির, চার্চ, মসজিদ গড়েছে। কেউ চার্চ ভেঙে মসজিদ করেছে, কেউ মন্দির ভেঙে মসজিদ গড়েছে। আমার নাম নিয়ে এখনো মানুষে মানুষে যুদ্ধ রক্তারক্তি কতো যে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এ সবকিছুই কিন্তু আমার কারণে হয়, আমার নিজের আখের গোছানোর জন্যে রাজ্য বিস্তার ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা। সম্রাট, খলিফা, রাজা, বাদশাহরা সবাই নাকি আমার প্রতিভূ। আমার নামে এরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে, অত্যাচার করে। নিরীহ ব্যক্তি শাস্তি পায়, অপরাধী মুক্তি পায়। আমার নামেই লিঙ্গভেদে অসম ব্যবহার হয়, আমি নাকি পুরুষ। তাই মেয়েদের উপর পুরুষদের এক ডিগ্রি বেশি করেছি। বহু বিবাহ প্রচলন করেছি। নারীদের উপর নির্যাতন, হত্যা ইত্যাদি আমার নামেই বেশি হয়েছে, হচ্ছে। আবার মানুষকে ভালোবাসার কথাও নাকি বলেছি- জীবে সেবা করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। আমার নামে আরো কত মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে মানুষ! অথচ আমি কেউ নই, আমার কোন অস্তিত্ব নেই। মানুষ আমাকে ব্যবহার করেছে শুধু তার নিজের প্রয়োজনে।
তাই আমার মনে হয় মানুষ যতদিন বেঁচে থাকবে, আমার মৃত্যু হবে না, হলে তারা আমাকে অন্যভাবে অন্য আকারে আবার সৃষ্টি করবে। কারণ মানুষের কল্পনা করার অসীম অসাধারণ ক্ষমতাতেই আমার জন্ম।
এই জন্য একজন নামকরা লেখিকা ঈশ্বরের ইতিহাস লিখতে গিয়ে শুরু করেছেন- “Human beings created a God who was the first cause of all things and rules of heaven and earth.” এবং শেষ করেছেন এই বলে যে, ঈশ্ব না থাকলে মানুষ শূন্যতা ও একাকীত্ব সহ্য করতে পারবে না। আগামী একবিং শতাব্দীতে – “We should perhaps, ponder the hostory of God for some lessons and warnings.” অন্য আর এক বিখ্যাত লেখক আমার জীবন চরিত লিখতে গিয়ে প্রথমে প্রশ্ন করেছেন- “Cam God’s life be written?” তার পুস্তকের নাম God – a Biography.
তাই আমি নিজেই আমার আত্মকথা অতি সংক্ষেপে লিখে দিলাম আমার এক ভক্তের পীড়াপীড়িতে। কারণ আমি জানি, মানুষ বেঁচে থেকে আমার শূন্যতা সহ্য করবে না। তারা তাদের প্রয়োজনে আমার পূজা করে; মানুষ আছে তাই আমিও আছি। মানুষ যেদিন থাকবে না, আমিও নেই। কারণ আমি মানুষেরই সৃষ্টি।