Site icon অবিশ্বাস

অভিজিৎ রায় | আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী

অন্তঃস্বত্তা স্ত্রীকে ভারতের আসামে নিরাপদে রেখে দেশকে মুক্ত করতে যুদ্ধে গেলেন স্বামী। এর আগে কখনো অস্ত্র ধরেননি, কলম ধরেছেন অনেক, তিনি কলমের মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু দেশের প্রয়োজনে ঘরে বসে থাকেননি, রণাঙ্গনে চলে গেলেন। তখন সেপ্টেম্বর মাস। গণহত্যার পরিকল্পনায় হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসা পাকিস্তান সেনাবাহিনী মরণকামড় বসাতে সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ শানাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারাও বীর বিক্রমে লড়ে যাচ্ছে। চুড়ান্ত প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির মুখে বাংলার মানুষ। ঠিক এসময় ১৯৭১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর খবর পেলেন তাঁর প্রথম সন্তান জন্ম নিয়েছে। খবর পেয়ে আসামের শিবনগরে নাজিরা ম্যাটারনিটি সেন্টারে ছুটে গেলেন স্ত্রী ও সন্তানকে দেখতে। যিনি ছুটে গেলেন তার নাম অজয় রায়, যাদের কাছে ছুটে গেলেন তারা স্ত্রী শেফালী রায় ও নবজাতক অভিজিৎ রায়।

ছোট ভাই অনুজিৎ রায়ের সাথে অভিজিৎ রায়

যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে স্ত্রী সন্তানকে সাথে নিয়ে ফুলার রোডের বাসায় উঠেন অজয় রায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ব-পদে যোগ দিলেন। যুদ্ধোত্তর দেশ, সমস্যার শেষ নেই। কিন্তু সেসব সমস্যা সদ্যজাত শিশুকে স্পর্শ করেনি। অভিজিৎ বেড়ে ওঠেছেন মুক্ত বাংলাদেশে নিরিবিলি ঢাকা শহরে বুক ভরা নিঃশ্বাস আর অবাধ ছুটোছুটির মাঝে। শিক্ষার হাতেখড়ি বাবা মায়ের কাছে। বাসার খানিক দূরে উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। অভিজিৎ রায়ের শিক্ষা জীবন শুরু হয় এই বিদ্যালয়ে। উদয়ন স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন।

অভিজিৎ রায়রা দুই ভাই। ছোট ভাইয়ের নাম অনুজিৎ রায়। শিক্ষিত, আদর্শ ও ন্যায়পরায়ন বাবা মা’র নিবিড় পর্যবেক্ষণে বড় হন তারা। সততা, নৈতিক শিক্ষা ও শিল্প সাহিত্য সাংস্কৃতিক বলয়ে তাদের মন ও মনন গড়ে ওঠে। ছোটবেলা থেকে নতুন নতুন বিষয়ের প্রতি আগ্রহী ছিলেন অভিজিৎ রায়। বিজ্ঞানের ছাত্র বলে নয়, প্রতিটি বিষয়ে চুলচেরা ব্যাখ্যা বিশ্লেষন ও এর পক্ষে বিপক্ষে প্রচুর তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করার অভ্যাস তার স্বভাবজাত। তিনি মনে করেন তার এভাবে বেড়ে ওঠার পেছনে বাবা মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি।

বাবা আমাকে ‘রাজপুত্রে’র মত বড় করতে পারেননি বটে, কিন্তু বাবাই আমাকে যত রাজ্যের বইয়ের জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের শেলফে হাজারো বইয়ের পাশাপাশি ছিলো মুক্তধারার কিশোর–বিজ্ঞানের মজার মজার সমস্ত বই। জাফর ইকবালের ‘মহাকাশে মহাত্রাস’ কিংবা স্বপন কুমার গায়েনের ‘স্বাতীর কীর্তি’ কিংবা ‘বার্ণাডের তারা’ এগুলো তার কল্যানেই পড়া। বাবাই আমাকে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন সুকুমার রায়ের রচনা সমগ্র। হযবরল-এর বিড়াল, পাগলা দাশু আর হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রীর কথা জেনেছি তার কাছ থেকেই। বাবাই আমার মনে বপন করেছিলেন মুক্তবুদ্ধি আর সংশয়ের প্রথম বীজ। বাবাই আমাকে আবৃত্তি করতে শিখিয়েছিলেন রবিঠাকুরের প্রশ্ন কবিতা।

 

শুধু পাঠ্যপুস্তক আর মোটা মোটা জ্ঞানের বই পড়ে দিন যায়নি অভিজিতের। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেন, মাঠে গিয়ে ফুটবল ক্রিকেট খেলতেন, ফুলার রোড চষে বেড়াতেন। তিনি মানুষের সাথে মিশতে পছন্দ করতেন। একই সাথে মনযোগী শ্রোতা ও বক্তা ছিলেন। সে অর্থে দুরন্ত না হলেও তিনি গম্ভীর ছিলেন না। তবে যাই করুন না কেন, মাথায় সবসময় নতুন নতুন চিন্তা আসা যাওয়ার দরজা ঠিকই খোলা রাখতেন।

উদয়ন স্কুলের সহপাঠীদের সাথে অভিজিৎ রায়

স্কুলের পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ঢাকা কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে প্রকৌশল শিক্ষা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখান থেকে জৈব চিকিৎসা প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে অধিকতর শিক্ষাগ্রহণের উদ্দেশ্যে সিঙ্গাপুর যান। সেখানে সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জৈব চিকিৎসা প্রকৌশলে স্নাতকোত্তর ও ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে একজন প্রকৌশলী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

গল্পের পরের অংশটা অন্যরকম হতে পারতো। হতে পারতো অভিজিৎ রায় শুধুমাত্র একজন প্রকৌশলী হয়েই জীবন পার করে দিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের কারো সাথে জীবন বাঁধলেন। বাবা, মা এবং ছোট ভাইকেও সেখানে নিয়ে গেলেন। আর বাংলাদেশে আসলেন না, অথবা বাকি জীবনে দুই কি তিনবার আসলেন। এভাবে অপর আট দশজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত মার্কিন হয়ে জীবন শেষ করলেন। – অথচ গল্পটা এরকম হয়নি। অন্যরকম হয়েছে।

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা ধর্মান্ধতা এবং ধর্ম ব্যবসার সাথে সরাসরি রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা। সাধারণ মানুষ রাজনীতি সচেতন নয়, সামনে ধর্ম ঝুলিয়ে তাদেরকে যেকোন কিছু গেলানো যায়। বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের আগ্রহ কম। প্রযুক্তির ব্যবহারেও আছে সংকীর্ণতা। মুসলিম অধ্যুষিত দেশের কারণে যেকোন প্রযুক্তিতে প্রথমে অনীহা দেখায়, অনেক পরে ধীরে ধীরে সম্পৃক্ত হয়। এই কারণে একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে আমাদের দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুব বেশি ছিলো না। বাংলা ভাষায় ওয়েবসাইটের সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। অভিজিৎ রায় ও কয়েকজন সমমনা তখন নিজেদের ইয়াহু গ্রুপে লিখতেন ও আলোচনা করতেন। সে সময় তারা বাংলা ভাষায় একটি তথ্যসমৃদ্ধ ওয়েবসাইট নির্মানের কথা ভাবলেন। ড. এ এইচ জাফর উল্যা, আবুল কাশেম, ফতেমোল্লা, জাহেদ হোসেন ও বাবা অজয় রায়কে সাথে নিয়ে তৈরি করলেন মুক্তমনা ওয়েবসাইট। ২০০১ সালের ২৬ মে মুক্তমনার আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা আন্দোলনে নতুন যুগের সূচনা হয়। মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ক প্রবন্ধ নিবন্ধে সমৃদ্ধ হতে থাকে সাইটটি। নতুন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য মুক্তমনা ছিলো হঠাৎ খুঁজে পাওয়া রত্নভান্ডারের মত। তখন কেউ ইন্টারনেট দুনিয়ায় বাংলা ভাষায় এমন সাইট কল্পনাও করতেন না। পরবর্তীতে এই ওয়েবসাইট বিজ্ঞান ভয় পাওয়া রাজনীতি অচেতন ব্যক্তিদের আত্মোন্নয়নে যে ভূমিকা রেখেছে, অভিজিৎ রায় হয়তো শুরুতে এতটা প্রত্যাশা করেননি।

অভিজিৎ ও বন্যার প্রথম দেখার দিন।

মুক্তমনা অভিজিতের ব্যক্তিজীবনে নিয়ে আসে বিশেষ পরিবর্তন। রাফিদা আহমেদ বন্যা নামের এক জ্ঞানান্বেষী নারী মুক্তমনার খোঁজ পান। দেখলেন অভিজিৎ নামের একটি ছেলে সেখানে প্রচুর তথ্য উপাত্ত ব্যবহার করে বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি করছে। তিনি আগ্রহবোধ করেন। কারণ অভিজিতের আগ্রহের সাথে তার আগ্রহের মিল আছে। এরপর লেখালেখির সূত্রে অভিজিত ও বন্যার পরিচয়, আলাপ। অল্প সময়ে তাদের মাঝে ভালো বোঝাপড়া হয়ে যায়। দু’জনে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০২ সালে একজন সিঙ্গাপুর থেকে আরেকজন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্যারিসে গেলেন। সেখানে অভিজিৎ রায় ও বন্যা আহমেদের প্রথম দেখা, তাদের মাঝে সৃষ্টি হওয়া প্রেমে উভয়ের সম্মতি আদান প্রদান। বন্যা আহমেদ পূর্ব বিবাহিতা ছিলেন, অভিজিৎও। বন্যার প্রথম দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে বিবাহ বিচ্ছেদের মাধ্যমে। ওই সময় বন্যা আহমেদের মেয়ে তৃষার বয়স চার বছর। অভিজিতের প্রথম দাম্পত্য জীবন শেষ হয় তার স্ত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুর মাধ্যমে। বন্যা ও অভিজিতের মাঝে যখন প্রেম হয়, তৃষা তখন অনেক ছোট। তৃষার সাথে অভিজিতের দেখা হয় ২০০৩ সালে। প্রথম দেখায় ফুটফুটে শিশুটির সাথে দারুণ ভাব জমিয়ে ফেলেন।

বন্যা ও অভিজিতের প্রথম দেখার ঠিক পাঁচ বছর পর ২০০৭ সালে তারা বিয়ে করেন। বিয়ের পর মুক্তমনার সাথে বন্যার সম্পৃক্ততা আরো বাড়ে। দু’জনেরই লেখালেখি সমৃদ্ধ হতে থাকে। দু’জনের লেখালেখির বিষয়ে মিল থাকার কারণে লেখাপড়া ও গবেষণার কাজে একে অপরকে সাহায্য করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ফ্লোরিডায় নিরিবিলি, প্রকৃতির কাছাকাছি দ্বি-তলা বাড়ি। বাড়ির সামনে ঘাস বিছানো আঙিনা, পেছনে বড় বড় গাছের বাগান। বাগানে চেয়ার টেবিল পেতে রাখা, এখানে দু’জনের ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত লেখালেখি আর আলোচনা করে। পাশে বারবিকিউ সরঞ্জামাদি। সুযোগ পেলেই বারবিকিউর আয়োজন করতেন অভিজিৎ। অভিজিৎ রান্না করতে পছন্দ করতেন। অনেক কিছুই রান্নার চেষ্টা করতেন, কিন্তু খিচুড়িটা খুব ভালো রাঁধতেন। প্রেমে, জ্ঞানে, অনুসন্ধানে তাদের দাম্পত্য জীবন খুব চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠে।

২০০১ সালে নির্মিত মুক্তমনার সাইট ২০০৪ সালে পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর বছর দুয়েক পর অর্থাৎ ২০০৬ সালে সাইটে কমিউনিটি ব্লগ নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে ২০০৭ সালে শেষ হয়। আত্মপ্রকাশের কিছুদিনের মধ্যে পরিচিত অপরিচিত লেখকদের লেখালেখিতে জমে উঠে মুক্তমনা ব্লগ। মুক্তবুদ্ধি চর্চার পালে নতুন হাওয়া লাগে। একই সময়ে সামহোয়ার ইন ব্লগ ও সচলায়তন নামে আরো দু’টি জনপ্রিয় কমিউনিটি ব্লগ থাকলেও বিশেষায়িত মুক্তমনা ব্লগের প্রতি মানুষের বিশেষ আগ্রহ ছিলো। বিজ্ঞান, ধর্ম, ইতিহাস নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ লেখা পড়ার জন্য অসংখ্য মানুষ ঢুঁ মারতেন মুক্তমনায়।

ব্লগ চালুর এক বছর আগে ২০০৬ সালে অভিজিৎ রায়ের প্রথম বই ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ প্রকাশিত হয়। এরপরের বছর ফরিদ আহমেদ এর সাথে যৌথ লেখা ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ প্রকাশিত হয়। এরপর একে একে লিখে যান বিশ্বাসের ভাইরাস (২০০৮), সমকামিতা (২০১০), অবিশ্বাসের দর্শন (২০১১), ভালোবাসা কারে কয় (২০১২), ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি বিদেশিনীর খোঁজে (২০১৫), শূন্য থেকে মহাবিশ্ব (২০১৫)। সম্পাদনা করেন স্বতন্ত্র ভাবনা: মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি (২০০৮) এবং বিশ্বাস ও বিজ্ঞান (২০১২)। এর মধ্যে ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইয়ের সহ-লেখক রায়হান আবীর এবং ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’র সহ-লেখক মীজান রহমান। ‘বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’র অপর সম্পাদকরা ছিলেন শহিদুল ইসলাম ও ফরিদ আহমেদ, সভাপতি ছিলেন অজয় রায়।

অভিজিৎ রায় পত্রিকা প্রকাশের সাথেও জড়িত ছিলেন। ‘মুক্তান্বেষা’ নামের একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ’ এবং ‘মুক্তমনার’ যৌথ প্রয়াসে প্রকাশিত হতো। ঢাকার সেগুনবাগিচা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাটির লক্ষ্য ছিলো সমাজে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং মানবকল্যানবোধ প্রতিষ্ঠা। অজয় রায় ছিলেন সম্পাদনা পর্ষদের সভাপতি। শহিদুল ইসলাম, হাসান আজিজুল হক, অনন্ত বিজয় দাশ ছিলেন সদস্য এবং সহযোগী সম্পাদক ছিলেন সাইফুর রহমান তপন।

মুক্তমনা বাংলা ব্লগে অভিজিৎ রায় লিখেছেন একশ’র কাছাকাছি পোস্ট, সচলায়তনে লিখেছেন অর্ধ-শতাধিক। ইংরেজি ব্লগে লিখেছেন তেরটি পোস্ট। এছাড়াও দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন নিউজপেপারে লেখালেখি করতেন। তার লেখার বিষয়বস্তু ছিলো বিজ্ঞান, ধর্ম, ইতিহাস ও রাজনীতি। প্রতিটি লেখার উদ্দেশ্য একই। সত্য প্রকাশ করা। কিন্তু সত্য যে খুব ভয়ংকর। কারণ সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সাহস অনেকেরই থাকে না। তেমনই কিছু ভীতু মানুষ সত্য সইতে না পেরে অভিজিৎকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন। অনলাইনে প্রাণনাশের কত হুমকি যে অভিজিৎ রায় পেয়েছেন, তা গুনে শেষ করা যাবে না। শুধু অভিজিৎ রায় নয়, মুক্তচিন্তার চর্চা করে এমন কোন ব্লগার নেই যিনি প্রাণনাশের হুমকী পাননি।

এই লেখার শুরুতে আমরা অভিজিতের বাবা অজয় রায়ের যুদ্ধে যাওয়ার গল্প শুনেছি। স্বাধীন দেশে অভিজিৎ রায়রা যা করেছেন, তা যুদ্ধের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। অভিজিৎসহ আরো কিছু সাহসী মানুষ এই রক্তমাখা সময়ে স্রেফ যুদ্ধই করেছেন। এই চিরচেনা সমাজ, আটকে থাকা সময়, নির্মম পরিণতির কথা ভেবেও বিশাল কর্মযজ্ঞে মেতে উঠেছিলেন অভিজিৎ রায়। সমূহ বিপদ সম্পর্কে তিনি সম্যক অবগত ছিলেন, জানতেন মৃত্যু তার সবচে নিকটতম প্রতিবেশী। অস্ত্রে শান দেয়ার শব্দাতঙ্ক আর চোখভরা স্বপ্ন পাশাপাশি রেখেই কাঁটা বিছানো পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন-

যারা ভাবেন বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হয়ে যাবে, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের মত জিনিস নিয়ে যখন আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালেখি করছি।

 

অভিজিৎ রায়ের ব্লগ এবং বইগুলো উপযুক্ত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ধর্মের অসারতা প্রমাণ করে দেয় অতি সহজে। তিনি শুধু নিজ ধ্যান ধারণা প্রকাশ করে ক্ষান্ত হতেন না, এর সাথে ইতিহাসকে সম্পৃক্ত করে বৈজ্ঞানিক চিন্তার সুতোয় গেঁথে যুক্তি দিয়ে বেঁধে পাঠকের সামনে তুলে ধরতেন। ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইয়ে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন ‘কেউ একজন চাইলো আর মহাবিশ্ব সৃষ্টি হলো’ কথাটি সত্য নয়। আকাশ থেকে টুপ করে দুইজন মানুষ পড়লো, তারপর তাদের মাধ্যমে বাড়তে বাড়তে আজ পৃথিবীতে কয়েকশ কোটি মানুষ- এ কথাটিও সত্য নয়। তথ্য প্রমাণ এক করে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। ‘ভালোবাসা কারে কয়’ বইয়ে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই বিষয়ে বাংলা ভাষায় এর আগে কেউ বই লিখেছেন কিনা, সন্দেহ আছে। বইটি এত সহজ ও প্রাঞ্জল, যে কেউ বিবর্তন সম্পর্কে কোন ধারণা না নিয়েই বইটি পড়ে খুব ভালোভাবে বুঝতে পারবে। ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইয়ে নাস্তিকতা বা অবিশ্বাস নিয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ঈশ্বরে বিশ্বাস হারানো -তিন শব্দের ঘটনাটি যে কত বড় এবং বিশাল হতে পারে, পুরো বই পড়ার পর একজন মানুষ তা খুব সহজে অনুধাবন করতে পারবেন।

অভিজিৎ রচিত ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ ও ‘সমকামিতা’ নামের দু’টি বই ধর্ম সেবকদের আঁতে সবচে গভীর ঘা সৃষ্টি করেছে। বিশ্বাসের ভাইরাস গ্রন্থে লেখক দেখিয়েছেন সহজ সরল বিশ্বাস একজন মানুষের মাঝে প্রবেশের পর তা কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, যদি সে বিশ্বাস হয় অলীক ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত অনেক উদাহরণ এনে তিনি বুঝিয়েছেন অদৃশ্য, অলীক, কল্পিত কাউকে বিশ্বাস করে একজন মানুষ কিভাবে মানুষ হত্যা করতে পারে। শুধুমাত্র ধর্মবিশ্বাসের কারণে এই পৃথিবীতে হাজার হাজার খুনোখুনি হয়েছে। তিনি বলার চেষ্টা করেছেন, তাহলে এই বিশ্বাসের কী প্রয়োজন?

সমকামিতা যে একটি প্রাকৃতিক বিষয়, এটি যে মনোবিকৃতি নয় তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন ‘সমকামিতা’ বইয়ে। আধুনিক জীববিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানের সর্বাধুনিক তথ্যের ভিত্তিতে স্পর্শকাতর এ বিষয়টির উদ্ভব এবং অস্তিত্বকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এ বইয়ে। বৈজ্ঞানিক আলোচনার পাশাপাশি উঠে এসেছে আর্থ-সামাজিক, সমাজ-সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং মনোস্তাত্ত্বিক বিভিন্ন দিক। বই লেখার বাইরেও তিনি সমকামীদের অধিকার আদায়ে তাদের পক্ষে ছিলেন। বাংলাদেশে সমকামীদের মুখপত্র ‘রূপবান’ ম্যাগাজিনে ‘সমকামিতা’ বই নিয়ে সাক্ষাৎকার দেন এবং এই বিষয়ে আলোচনা করেন।

একজন আলোকিত মানুষের কাছে সন্দেহ, প্রমাণ, প্রশ্ন, অনুসন্ধান হচ্ছে সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন ধার্মিকের কাছে এই বিষয়গুলো বিবর্জিত। আর যে ব্যক্তি ধর্মকে ব্যবহার করে সমাজে প্রভাব বিস্তার করে থাকেন, তার কাছে সন্দেহ, প্রমাণ, প্রশ্ন, অনুসন্ধান হচ্ছে সবচেয়ে বিধ্বংসী অস্ত্রের নাম। যেন এই অস্ত্রগুলো তাকে ধ্বংস করার জন্য তাড়া করে ফিরছে। ‘বিশ্বাস’, ধর্মজীবীদের প্রধান মূলধন। আবার এই বিশ্বাসই তাদের প্রধান দুর্বলতা। একজন বিশ্বাসীর সামনে যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন করা হলে তার বিশ্বাসে চিড় ধরে। তাই ধর্মজীবীদের যত ভয় সত্য প্রকাশে।

অভিজিৎ রায়ের রচনায় তার সংগৃহীত প্রমাণ ও প্রদর্শিত যুক্তিতে শত শত মানুষের ধর্ম বিশ্বাস নড়বড়ে হতে থাকে। বাংলা অনলাইন মাধ্যমে ধর্মহীন ব্যক্তির সংখ্যা প্রত্যাশাতীতভাবে বাড়তে থাকে। প্রগতিশীল মানুষরা না বুঝলেও ধর্ম বেচে খাওয়া লোকজন ঠিকই অভিজিতের শক্তি ও ক্ষমতা টের পায়। অনেকেই জঙ্গিদেরকে ‘অবুঝ’ বলেন, বলেন তারা না বুঝে মুক্তচিন্তার মানুষদেরকে মেনে নিতে পারে না। কথাটি মোটেও ঠিক নয়। যারা অভিজিৎ রায়কে চিনতে পেরেছে, তারা মোটেও অবুঝ কেউ নন। কথিত অবুঝ ব্যক্তিরা তাদের সুবিধা অসুবিধা ও ঝুঁকি নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। তাইতো অভিজিৎ রায়কে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে তারা। তাদের পরিকল্পনা প্রকাশ্য রূপ নেয় যখন ফারাবী শফিউর রহমান নামের এক উগ্র ধর্মান্ধ যুবক অভিজিৎ রায়কে হত্যার হুমকী দেয়।

অভিজিৎ রায়কে হত্যার হুমকী দেয় ফারাবী

সেসময় অনেকেই ফারাবীকে ‘পাগল’ বলে বিষয়টি হালকা করে দেখে। কারণ ফারাবী ফেসবুকে যাকে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতো, মোবাইল ফোনে টাকা চাইতো, অবাঞ্ছিত কথা বলতো। অথচ এই ফারাবী সবসময় কোন নাস্তিককে হত্যার আগে অনলাইনে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে জনমত গঠনের কাজটি করেছে। হয়তো ব্যক্তিগতভাবে এই কাজ করেছে, অথবা ফারাবি যা করেছে তা হত্যা পরিকল্পনারই অংশ।

এসব হুমকি ধমকি সত্ত্বেও ২০১৫ সালে বাংলাদেশে আসেন অভিজিৎ রায়। সাথে আসেন স্ত্রী বন্যা আহমেদও। তৃষা আসেনি, সে তখন লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের অমর একুশে গ্রন্থ মেলা ছিলো অভিজিৎ রায়ের প্রিয় উৎসব। তার ছেলেবেলা কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, তার বাবা একজন শিক্ষাবিদ। শিক্ষা, বই এবং বই মেলার সাথে তাদের আত্মার যোগাযোগ। তাছাড়া সেবার অভিজিৎ রায় ও মীজান রহমান রচিত ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হবে। নিজের বই প্রকাশের সময় উপস্থিত থাকার প্রবল ইচ্ছেও ছিলো। তাই বাবা অজয় রায়ের পরামর্শ না মেনে তিনি বাংলাদেশে এলেন। বইমেলায় নিয়মিত যেতেন, ভক্ত ও পাঠকদের সাথে কথা বলতেন, অটোগ্রাফ দিতেন। আর জঙ্গিদেরও ধারণা ছিলো যেহেতু নিজের বই প্রকাশিত হবে সেহেতু অভিজিৎ রায় এবার দেশে আসবেন।

আক্রমণের আধা ঘণ্টা আগে বইমেলায় অভিজিৎ গিয়ে সিঙ্গারা কিনে এনেছিলেন।

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সাল। বুয়েটে কিছু পরিচিত মানুষের সাথে পূর্ব নির্ধারিত আড্ডা। সেখান থেকে মেলায় যাবেন। কী মনে করে যেন বন্যা আহমেদ বারবার বলছিলেন আজ বের না হতে। বন্যা কোনভাবেই বাসা থেকে বের হতে চাননি। কিন্তু বুঝিয়ে শুনিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বের হলেন অভিজিৎ রায়। বিকেলে আড্ডা হলো, মেলায় যাওয়া হলো। কিছুক্ষণ পর বাসায় ফিরে যাবেন, তার আগে সিঙ্গারা কিনলেন। বন্যাকে নিয়ে খেলেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে রাজু ভাস্কর্য সংলগ্ন রাস্তা ধরে বাসায় ফিরছেন। কখন যে পেছনে চাপাতিধারীরা সঙ্গ নিয়েছে টেরও পাননি। তারা হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে অভিজিৎ রায়ের উপর। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অভিজিৎ ও বন্যার শরীর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হলো। অভিজিতের মগজ, বন্যার ছিন্ন বৃদ্ধাঙ্গুল পড়ে রইলো বাংলাদেশের সবচে বড় সাংস্কৃতিক বলয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটপাতে। অনেক মানুষ ছিলেন, প্রচুর মানুষ। নিকটেই পুলিশ ছিলো। কিন্তু এত মানুষের মাঝে খুনীরা খুন করে বীরদর্পে পায়ে হেঁটে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।

এত এত মানুষের ভিড়ে একজন মানুষ ছিলেন যিনি মানবিক মূল্যবোধ ধারণ করার পাশাপাশি বুক ভরা সাহস রাখেন। তিনি চিত্র সাংবাদিক জীবন আহমেদ। অভিজিৎ রায় ও বন্যা আহমেদকে একটি অটোরিক্সায় তুলে নিকটবর্তী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতাল নেয়ার পথে অভিজিৎ রায় সম্পূর্ণ অচেতন ছিলেন। বন্যা আহমেদের চেতনা থাকলেও কিছুক্ষণ পর তিনিও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। একসময় যখন বন্যা আহমেদের সংজ্ঞা ফিরে আসে, তখন তার প্রথম প্রশ্ন ‘অভিজিৎ বেঁচে আছে?’ এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার শক্তি কারোরই ছিলো না। কারণ অভিজিৎ বেঁচে নেই।

অভিজিৎ রায় মারা গেলেন। তিনি মারা গেলেন তার যুদ্ধজয়ী বাবার আগে। স্বেচ্ছায় মারা যাননি, মারা যাননি অসুখে কিংবা দুর্ঘটনায় অথবা বার্ধক্যে; তিনি খুন হলেন। খুন হলেন বিশ্বাসের ভাইরাস আক্রান্ত কিছু যুবকের চাপাতির আঘাতে যারা তাদের ধর্মের আগে ‘শান্তির’ শব্দটি রক্ষা করতে নিঃসংকোচে মানুষ হত্যা করে।

বাবার যুদ্ধে হাতে অস্ত্র ছিলো, ছেলের যুদ্ধে ছিলো কলম। বাবা বেঁচে রইলেন, ছেলে মরে গেলেন। একবিংশ শতকের শুরুটা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ এক সময়। এতটাই ভয়াবহ যে, ‘অস্ত্রের চেয়ে কলম শক্তিশালী’ কথাটি বারবার পরাজিত হচ্ছে। কারণ লেখনীর শক্তি অস্বীকার করছে সারি সারি মানুষ। কলম হাতে কেউ খুন হলে কোটি কোটি আঙ্গুল লাশের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, “তার মৃত্যুর জন্য সে নিজেই দায়ী।” কেউ খুন হওয়ার দেরি আর প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অতি সাধারণ মানুষটি পর্যন্ত সবার মাঝে হুলস্থুল বাড়াবাড়ি লেগে যায় কার আগে কে গিয়ে খুনীর পেছনে দাঁড়াবে, খুনীর গা থেকে অপরাধ মুছে দিবে।

অভিজিতের পিতা অজয় রায়কে স্বান্তনা দিতে ফোন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এই ফোন করার কথা গোপন রাখতে বলা হয়। একই প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ সালে নিহত নাস্তিক ব্লগার রাজীব হায়দারের বাসায় যান তার পরিবারকে স্বান্তনা দিতে। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে সময় কতটা পাল্টে যায়। দেশের অন্যতম বিজ্ঞান লেখক খুন হলেন যিনি কীনা একজন মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদের সন্তান। স্বান্তনা দিতে বাসায় আসার দরকার নেই, ফোন করারও দরকার নেই। বাংলাদেশে প্রতিদিন ডজন মানুষ খুন হয়, একজন প্রধানমন্ত্রী কয়টি লাশের বাবা মাকে ফোন করবেন? যাহোক, তিনি ফোন করলেন, কিন্তু ফোন করার খবর লোকজনকে না জানানোর অনুরোধ করলেন। কারণ ইতিমধ্যে রাষ্ট্রের সবচে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিগোষ্ঠীর কাছে আত্মসমর্পন করেছেন। তিনি ঘোষণা দিয়ে তার কিবলা পরিষ্কার করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর রহস্যময় আচরণে সবাই বুঝে যায় এই খুনের বিচারের কোন ভবিষ্যত নেই। অন্তত নিকট ভবিষ্যতেতো নয়ই!

২০১৩ সালে আসিফ মহিউদ্দিনের উপর আক্রমণের মধ্য দিয়ে ব্লগারদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনার সূচনা হয়। আসিফ প্রাণে বেঁচে যান। জঙ্গিগোষ্ঠী ব্যর্থ হয়। কিন্তু একই বছর দ্বিতীয় চেষ্টায় আর ব্যর্থ হয়নি। আহমেদ রাজীব হায়দারকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা। অর্থাৎ অভিজিৎ রায়ের আগেও ব্লগারদের প্রতি আক্রমণ হয়েছে, ব্লগার খুন হয়েছে। কিন্তু অভিজিৎ রায়ের হত্যা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কারণ অভিজিৎ খুন হওয়ার পর ব্লগার হত্যার ইস্যুতে সরকারের নেয়া অবস্থানে জমাট বাধা কুয়াশা পুরোপুরি সরে যায়। মৌলবাদী গোষ্ঠীর কাছে আত্মসমর্পনের বিষয়টিতে আর কোন লুকোচুরি থাকেনি। বরং নগ্ন থেকে নগ্নতর হয়ে যায় পুরো দৃশ্যপট।

অভিজিৎ খুনের পর মামলা হয়। কিন্তু এই মামলার তদন্ত বা বিচারে সরকারের বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও দেখা যায়নি। পুলিশ প্রায় এক বছর কাটিয়েছে ডিএনএ নাটক করে। তারা ক্রাইম সিনে পাওয়া ডিএনএ যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায় পরীক্ষার জন্য, কিন্তু সন্দেহভাজন কারো ডিএনএ স্যাম্পল পাঠাতে পারেনি। কিন্তু সাংবাদিকদের সামনে এসে কিছু বলার মত ছু’তা ঠিকই পায় পুলিশ। বছর খানেক কাটিয়ে দেয় ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্টের অপেক্ষার কথা বলে। ভাবখানা এমন যে, ক্রাইম সিনে পাওয়া ডিএনএ করলেই খুনীদের বংশলতিকা সহ স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির হিসাবও পাওয়া যাবে। কিছুদিন পরপর তারা অভিজিৎ হত্যার ‘মূল হোতা’ গ্রেফতার করে। যাকে গ্রেফতার করে, সেই নাকি মূল হোতা। কেউ কেউ আবার ক্রসফায়ারে মারাও যায়। এভাবে চলছে। তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়, খুব চেষ্টা হয়, নতুন তথ্য পাওয়া হয়, প্রেস ব্রিফিং হয়, কিন্তু অভিজিৎ রায় হত্যার বিচার হয় না।

অভিজিৎ হত্যার ঘটনাস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করছে গণজাগরণ মঞ্চ।

প্রতি বছর অভিজিৎ রায়ের জন্ম ও মৃত্যু দিবসে অনলাইনে অফলাইনে তাঁকে স্মরণ করা হয়, তার জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা হয়। এসব আলোচনায় উঠে আসে অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুতে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হলো আর কারা লাভবান হলো। কিন্তু আসলে কি কেউ লাভবান হয়েছে? অভিজিৎ রায়ের সৃষ্টি করা প্রতিষ্ঠানগুলো সচল আছে, নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হচ্ছে, নতুন নতুন কণ্ঠে নতুন নতুন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পূর্বসুরীদের ধারাবাহিকতায় অভিজিৎ রায় যে গতিধারা সৃষ্টি করেছিলেন, উত্তরসূরীরা তা বয়ে বেড়াবে। সময় এভাবেই এগিয়ে যায়। হাজার বছর আগেও ধর্মের নামে মানুষ খুন হয়েছে, এখনো হয়। তখন যারা পিছিয়ে ছিলো তারা আরো পিছিয়েছে, যারা এগিয়েছিলো তারা আরো এগিয়েছে।

এ অঞ্চলে যখনই কেউ সমাজের পচন ঠেকাতে এগিয়ে এসেছে, তাকেই ধর্মাস্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ঊনিশ শতকে রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার মত ভয়ঙ্কর অপরাধ থেকে ভারতবর্ষের হিন্দুদের মুক্তি দিতে গেলেন, যাদের মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন তারাই তাকে হত্যা করতে চেয়েছে। বিশ শতকে বাংলার মুসলমানদের বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী আবুল হুসেনকে পিস্তলের মুখে পড়তে হয়েছে, ছাড়তে হয়েছে কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ছাড়তে হয়েছে ঢাকা শহর। শহর ছাড়তে হয়েছে সৈয়দ মুজতবা আলীকে। দেশ ছাড়তে হয়েছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে কথা বলা তসলিমা নাসরিনকে, রক্তাক্ত হতে হয়েছে অসুস্থ সমাজটাকে সুস্থ করার চেষ্টাকারী হুমায়ুন আজাদকে। এমনকি টাঙ্গাইলের সেই অচেনা কবি মনির হোসেন সাগর, ২০০০ সালে তাকে মরতে হয়েছে বই লেখার অপরাধে। অস্ত্র, রক্ত, মৃত্যু সমাজ সংস্কারকদের জন্য নতুন কিছু নয়। অন্ধকার পথে আলো হাতে যাত্রীদের কেউ রেহাই পায়নি এসবের হাত থেকে।

অথচ এরা প্রত্যেকেই মানবতার কথা বলতেন, সত্য ও সুন্দরের কথা বলতেন। মানুষের মুক্তি ও সমৃদ্ধিই ছিলো তাদের চাওয়া পাওয়ার কেন্দ্রবিন্দু। অভিজিৎ রায়ও ঠিক তেমনি মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন একজন মানুষ ছিলেন। মানুষের প্রতি তার কোন ঘৃণা, বিদ্বেষ ছিলো না। তিনি সবসময় মানবকল্যাণ ও মানবমুক্তির জন্য কাজ করেছেন। এ বিষয়ে তার বক্তব্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট-

আমি নাস্তিক। কিন্তু আমার আশপাশের বহু কাছের মানুষজন বন্ধু বান্ধবই মুসলিম। তাদের উপর আমার কোন রাগ নেই, নেই কোন ঘৃণা। তাদের আনন্দের দিনে আমিও আনন্দিত হই। তাদের উপর নিপীড়ন হলে আমিও বেদনার্ত হই। প্যালেস্টাইনে বা কাশ্মীরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে কার্পণ্য বোধ করি না। অতীতেও দাঁড়িয়েছি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবো। এটাই আমার মানবতার শিক্ষা।

 

এ মানুষটিকে বাঁচতে দেয়নি হাজার বছরের অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষেরা। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে বর্ণাঢ্য জীবন থেকে বিদায় নিতে হয়েছে অভিজিৎ রায়কে যখন তিনি কর্ম চঞ্চলতার সেরা সময় পার করছেন। অভিজিতের মৃত্যুর পর অাহত স্ত্রী বন্যা আহমেদ কিছুদিন হাসপাতালে থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। এই ২০১৮ সালে এসেও তিনি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। ২৬ ফেব্রুয়ারির সেই বিভীষিকাময় রাতের স্মৃতি ভুলতে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার কিছুদিন পর প্রিয় বাড়িটা বিক্রি করে নতুন জায়গায় চলে যান। কিন্তু পারলেন কই! দুই হাতে নয়টি আঙ্গুল নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই দুঃসহ স্মৃতি।


২০১৮ সালে মুক্তমনার উদ্যোগে অভিজিৎ রায়ের জন্মদিনে তার জীবন ও কর্ম নিয়ে ওয়েবসাইট প্রকাশিত হয়।
এই ওয়েবসাইটে তার সকল রচনা এবং তার স্মরণে রচিত সকল লেখার সংকলন করা হয়েছে।

অভিজিৎ রায়ের জীবন ও কর্ম

ছবিসূত্রঃ
ছবিতে অভিজিৎ

Exit mobile version