Site icon অবিশ্বাস

শেফালী রায়ের মৃত্যু ও মরণোত্তর দেহ দান

কিছু কিছু মানুষ আছেন যাদের জীবনে সংগ্রাম, আনন্দ ও বেদনা সমানে সমান হয়। একটুও কম-বেশি হয় না। তেমনই একজন মানুষ হলেন শেফালী রায়। একুশে পদক প্রাপ্ত শিক্ষাবিদ অজয় রায় তার জীবনঙ্গী এবং জঙ্গীদের হাতে প্রাণ হারানো বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় তার সন্তান।

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। রণাঙ্গনে দেশের জন্য অস্ত্র হাতে লড়াই করছেন স্বামী। প্রথম সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে ভারতের আসামে নিরাপদে অবস্থান করছেন স্ত্রী। কিন্তু কতটা নিরাপদ? জীবনে প্রথমবার মা হতে চলেছেন, বাড়তি ভয়, বাড়তি চ্যালেঞ্জ। আবার প্রথম সন্তান জন্ম দেয়ার সময় স্বামীকে পাশে পাবেন না। উল্টো স্বামীর নিরাপত্তা নিয়ে চাপা আতঙ্ক। তার চেয়েও বহুগুণ অসহায় লাখো নারী রয়ে গেছেন যুদ্ধরত দেশের মাটিতে। অনেকেই ভারতের শরনার্থী শিবিরে অমানবিক জীবনযুদ্ধে লিপ্ত। বুকের ভেতর বয়ে চলা এক তীব্র ঝড়ের মাঝে ১৯৭১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জন্ম দিলেন তার প্রথম সন্তান অভিজিৎ রায়কে।

মুক্তিযোদ্ধা স্বামী অজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সাধারণ আট দশ জন শিক্ষকের মত নন। দেশের জন্য তার অগাধ ভাবনা ও কর্মচেষ্টা। তাই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে সন্তান লালন পালনের পুরো ভার পড়ে শেফালী রায়ের উপর। তার সংগ্রাম তখনো শেষ হয়নি।

তিনি সফল। তার দুই সন্তান। অভিজিৎ রায় ও অনুজিৎ রায়। দুই ছেলেকে শিক্ষিত ও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন শেফালী রায়। কিন্তু খুব বেশি ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন বলে একটি চাপা আতঙ্ক, দমবন্ধ ভয় সারা জীবন তাকে তাড়া করে ফিরেছে। কারণ এই অভাগা দেশে ‘খুব ভালো মানুষরা’ কখনোই নিরাপদ ছিলেন না, থাকেন না।

শেফালী রায়ের সন্তানরা মাকে যেমন ভালোবাসেন, মায়ের ভাষাকেও ভালোবাসেন। মাতৃভূমির প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কেউ গণ্ডি বেঁধে দিতে পারেনি। তাইতো শেফালী রায়ের বড় ছেলে বাংলার বন্ধ্যাচিন্তার মানুষদের ভাবনার জড়তা কাটাতে ২০০১ সালে নির্মাণ করলেন ‘মুক্তমনা’ নামে একটি ওয়েবসাইট। যে ওয়েবসাইট আজো বাংলার মানুষের চিন্তার অন্ধকার অলিগলিতে আলো ফেরি করে বেড়াচ্ছে।

শেফালী রায়ের ছেলে অভিজিৎ রায় একজন প্রকৌশলী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। মায়ের টানে, মাতৃভাষার টানে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশে আসেন। প্রবাসী ছেলে দেশে আসলে মায়ের চেয়ে বেশি খুশি কে হয়? কিন্তু শেফালী রায় খুশি হতে পারেননি। তার বুকের ভেতর তখন ভয়নৃত্য কেঁপে ওঠে। কারণ অভিজিৎকে হত্যা করার জন্য ওঁৎ পেতে আছে বরাহ শাবকের দল।

মা বাবার বারণ সত্ত্বেও প্রাণের বইমেলায় অংশ নিতে দেশে আসেন তাদের সন্তান। তারপর খুন হলেন। কয়েক দশক ধরে বয়ে বেড়ানো আতঙ্ক শেফালী রায়কে জানান দেয় যে সে আতঙ্ক মিথ্যে ছিলো না। শেফালী রায় যেন আবার ফিরে গেলেন আসামের সেই নাজিরা ম্যাটারনিটি সেন্টারে। যে ভয় ও আতঙ্কের মাঝে অভিজিতের জন্ম হয়েছিলো, সেই ভয় আর আতঙ্কের মাঝেই তার প্রয়াণ হলো।

আমার মা খুব সাধাসিধে আটপৌরে জীবন যাপনে অভ্যস্ত। যত ঝুট-ঝামেলা এড়িয়ে সবার সাথে মানিয়ে শুনিয়ে থাকতে পারাতেই তার শান্তি। তার জীবনের উদ্দেশ্য সংসারটাকে ঠিক রাখা আর আমাদের দু-ভাইয়ের মঙ্গলেই সীমাবদ্ধ। ওই যে ছোটবেলায় কিছু প্রবচণ পড়েছিলাম না – ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ – আমার মা ছিলেন এই প্রবচণ বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টার সার্থক প্রতিভূ। ছোটবেলা থেকে তাইই দেখে এসেছি। তা না হয়ে উপায়ও ছিল না। আমার বাবাকে ছোটবেলা থেকেই দেখেছি বহির্মুখী স্বভাবের। পেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সারা দিন ল্যাব রিসার্চ, ছাত্র-ছাত্রীদের সমস্যা নিয়েই কাটাতেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্স আর ইলেক্ট্রম্যাগনেটিজমের সমস্যাগুলো তার ছাত্র-ছাত্রীদের এক নিমেষে বুঝিয়ে দিতে পারলেও সংসারের দৈনন্দিন জীবনের চাল ডালের হিসেবগুলো তার মাথায় কখনোই ঢুকতো না। হয়ত ঢুকানোর চেষ্টাও করতেন না। আমার মা তার নিপুন হাতে আমাদের অগোছালো সংসার গুছিয়ে রাখতেন।

– শেফালী রায়কে নিয়ে তার প্রয়াত সন্তান অভিজিৎ রায়ের স্মৃতিচারণ

সূত্র: তিনি বৃদ্ধ হলেন

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বসে শেফালী রায় দেখলেন অবিকল মানুষের মত দেখতে কয়েকটি জীব এসে তার সন্তান ও সন্তানের ভালোবাসার মানুষকে কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করলো। তিনি দেখলেন পাশেই পুলিশ দাঁড়ানো ছিলো। তিনি আরো দেখলেন খুনীরা বীরদর্পে পায়ে হেঁটে চলে গেলো। শত শত মানুষের মাঝে কেউ ছিলো না খুনির পথ আগলে দাঁড়ায়।

ছেলেকে হারালেন। কিন্তু সবকিছু হারালেন না। হারানোর আরো অনেক কিছু বাকি রইলো। পুলিশ কর্তৃক অভিজিৎ রায়ের লেখালেখি খতিয়ে দেখা বাকি, প্রধানমন্ত্রীর ফোন পাওয়া বাকি, সেই ফোন কলের কথা কাউকে না বলার অনুরোধ শোনা বাকি, নাস্তিকের বাবা মাকে ফোন করেছেন প্রধানমন্ত্রী- এটা জানলে ক্ষমতার ক্ষতি হয়ে যাবে – এটা শোনা বাকি। একে একে এসবও দেখলেন, শুনলেন।

জানি না এত কিছু দেখে-শুনে শেফালী রায়ের মনে কী প্রশ্ন এসেছিলো, কী আক্ষেপ এসেছিলো। আমরা জানি না তিনি তার ঘেন্নার মেজাজ কিভাবে সামলেছেন, আদৌ সামলে রেখেছেন কীনা। সেই পুরোনো সংগ্রাম, সমসাময়িক বেদনা আর রগরগে বাস্তবতা বেশিদিন সহ্য করতে পারেননি শেফালী রায়।

নতুন বছরের ৩ জানুয়ারি জীবনের সব সংগ্রাম, সব অপ্রাপ্তি, সব আনন্দ, সব অর্জন আর সন্তানের মৃত্যুস্মৃতি সাথে নিয়ে শেফালী রায় চলে গেলেন। গতকাল ভোর ছয়টায় শেফালী রায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু তিনি তার দেহ ত্যাগ করেননি। নিজের দেহ দান করেছেন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের গবেষণা কাজে ব্যবহার করার জন্য। ঢাকার আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এর আগে কেউ কখনো স্বেচ্ছায় মরণোত্তর দেহ দান করেনি। এই হাসপাতালের জন্য এক নতুন ইতিহাসের জন্ম দিলেন প্রয়াত শেফালী রায়।

শেফালী রায়ের পরিবারই সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র পরিবার, যে পরিবারে এখন পর্যন্ত দু’জন সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন, দু’জনই আর্তমানবতার সেবায় নিজ দেহাবশেষ দান করে গেলেন।

মানবতাবাদী শেফালী রায়ের প্রতি অফুরান শ্রদ্ধা। তিনি আমাদের কাছে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।

Exit mobile version