Site icon অবিশ্বাস

ওয়াশিকুর বাবু | মৃত্যুও যাকে থামাতে পারেনি

কেউ বলে ওয়াশিকুর বাবু জমিয়ে আড্ডা দিতেন, কেউ বলে চুপচাপ থাকতেন। কেউ বলে তিনি ছিলেন মিষ্টভাষী, বিনয়ের উৎকৃষ্ট উদাহরণ, আবার কেউ বলে তার মত ঠোঁটকাটা লোক একটাও দেখিনি। আসলে তিনি কেমন ছিলেন? রহস্যময় কেউ? না। তিনি সবচেয়ে কঠিন ইস্পাতকাঠির চেয়েও সরল ছিলেন, ছিলেন পরিচ্ছন্ন ও মসৃণ। তার চেহারায় তাকালে সবার আগে চোখ দুটি নজর কাড়ে, যেন একজোড়া কপোতাক্ষ নদ। সারি সারি চিন্তা জলরাশির মত বয়ে চলছে আপন গতিতে। তিনি দেখতে ভালোবাসতেন, মানুষ; মানুষের ভেতর, বাহির এবং তার উপরও যদি কোন বাহির থাকে। সম্ভবত তেইশ ঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন দেখতেন, বুঝতেন, চিনতেন, জানতেন এবং বাকি এক ঘন্টা বিরতিহীন লিখতেন। লেখা শেষ হয়ে যখন পাঠকের সামনে নিয়ে আসতেন, মনে হতো সমাজের কোন এক চিরচেনা প্রাচীন ক্ষত কেটেকুটে গভীরের বিষটুকু বের এনে চোখের সামনে ধরে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলতেন -দেখো, এই ভয়ঙ্কর বিষের সাথে তোমাদের বসবাস।

ওয়াশিকুর বাবু আপসহীন চোখে সবকিছু দেখতেন, তাই তার বুঝার শক্তি ও প্রতিক্রিয়া জানানোর ভাষাও ছিলো নির্ভয়, নিষ্কণ্টক। যা বুঝার বুঝে নিলাম, দরকার কী সবকিছু সোজা ভাষায় বলে দেয়ার, লোকজন কী মনে করবে! -তিনি এরকম ছিলেন না। এরকম ছিলেন না কেন, এটাই তার অপরাধ। বাংলাদেশের সকল আত্মপ্রতারকের কাছে তিনি অপরাধী, যারা দেখে একরকম, বুঝে আরেকরকম, বলে অন্যরকম।

নষ্টদের মিছিলে ওয়াশিকুর বাবুকে মানুষের চেয়ে অধিক কিছু মনে হচ্ছে? দেখি নিজের সম্পর্কে তিনি কী বলেন-

মানুষ হিসেবে আমি খুব ভাল বা মহৎ কেউ নই; কখনো দাবীও করিনি। স্বল্পভাষী এবং অন্তর্মুখীতার কারনে পরিচিতরা সেরকম কিছু ভাবে। আমার অন্তর্মুখীতা ভাল সাজার জন্য না বরং নিজের প্রকাশ করার অপারগতা। আমার ভেতরে স্বার্থপরতা, মোহ, লোভ, প্রেম, কাম, ঘৃণা সব কিছুই বিরাজ করে।

– ওয়াশিকুর বাবু

হ্যাঁ, তিনিও রক্ত মাংসে গড়া একজন মানুষ। বঙ্গের চিরচেনা শ্যাম বর্ণের মধ্যমাকৃতির একজন সাধারণ মানুষ। তিনিও অপর আট দশ জনের মতই দেখে দেখে শিখে বড় হয়েছেন, বড় হচ্ছিলেন। অপরাপরের সাথে তার পার্থক্য চিন্তায় এবং চিন্তাপ্রসূত ভাব প্রকাশে। ওয়াশিকুর বাবু সহজ কথাটি সহজভাবে বলতে জানতেন।

যে গ্রন্থের ‘ভুল ব্যাখ্যায়’ মানুষ মরে কিন্তু ‘সঠিক ব্যাখ্যার’ কোন প্রয়োগ বা উপযোগীতা থাকে না, সেই গ্রন্থ নিষিদ্ধ হোক।

– ওয়াশিকুর বাবু

– তিনি এভাবে বলতেন। ধর্মগ্রন্থপূজারীদের হাতে তার দুই সহ-ব্লগার খুন হওয়ার পর যখন আত্মপ্রতারকের দল কথিত পবিত্র গ্রন্থের ভুল ব্যাখ্যায় বিপথগামী যুবকেরা খুন করছে বলে হাউ কাউ করছে, তখন ওয়াশিকুর বাবু এ কথা বলেছেন। আমরা দেখে আসছি, এখনো দেখছি, কিভাবে সাধারণ কাগজে মুদ্রিত বিদেশি ভাষার একটি গ্রন্থের সম্মান রক্ষার জন্য কাতারে কাতারে মানুষ খুন হওয়া ব্যক্তির কথা ভুলে একটি বিশেষ ধর্মকে শান্তির ধর্ম বলে বলে চেয়াল ব্যাথা করে ফেলে। এই কাজটি তারা তখন বেশি করে, যখন সেই ধর্মের নামে কাউকে খুন করা হয়। ভন্ডের দল মানুষ খুনে শান্তি খুঁজে পায়। অথচ এই শান্তির ধর্ম তার পূর্ব ধর্মগুলোর মতোই পৃথিবীর কোথাও কোন প্রকার শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বরং যুগে যুগে বিভক্তি, বিবাদ এবং রক্তপাত সৃষ্টির কাজটি ঠিকঠাক করে যাচ্ছে।

এসব মিথ্যা, কপটতা ও বিশ্বাসরোগের বিরুদ্ধে তীরতীব্রতায় কথা বলে যাওয়া মানুষটির জন্ম ১৯৮৮ সালে লক্ষীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর গ্রামে। ২০০০ সালে যখন তার বয়স ১২ বছর, তখন বাবা মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর অনেকদিন বড় বোনের সাথে বসবাস করেন। ২০০৪ সালে স্থানীয় চণ্ডীপুর চরমনসা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেনী পাশ করে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা আসেন। ২০০৬ সালে এস.এস.সি. এবং ২০০৮ সালে এইচ.এস.সি. পাশ করেন এবং ২০১৩ সালে রাজধানীর তেজগাঁও কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। স্নাতক শেষ করে লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজধানীর ঢাকার মতিঝিলে ফারইস্ট অ্যাভিয়েশন এজেন্সিতে প্রশিক্ষকের কাজ নেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এটাই ছিলো তার একমাত্র চাকরি।

অনলাইনে ওয়াশিকুর বাবু লেখালেখি শুরু করেন সামহোয়ারইন ব্লগে। তিনি ‘কুচ্ছিত হাসের ছানা’ ও ‘বোকা মানব’ ছদ্মনামে লিখতেন। পরে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য কয়েকটি কমিউনিটি ব্লগে লিখতে শুরু করেন। কাছের মানুষরা তার আরো একটি ছদ্মনামের কথা জানতেন, ‘গন্ডমূর্খ’। যদিও ফেসবুকে তিনি স্ব-নামে ছিলেন। লেখালেখির শুরু থেকেই ওয়াশিকুর বাবু ছিলেন তীক্ষ্ণ। তাই দ্রুত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ওয়াশিকুর বাবুর লেখালেখির সত্যিকারের ধার টের পাওয়া যায় যখন তিনি ‘ধর্মকারী’ ব্লগে লিখতে শুরু করেন। ধর্মকারীতে তার লেখা পোস্টের সংখ্যা শতাধিক। এই ব্লগে তিনি দুই নামে লিখতেন, ‘অ-বিষ-শ্বাসী’ ও ‘ধর্মবিদ-দেশী’।

কী লিখতেন ওয়াশিকুর বাবু?
খুব বেশি বড় কিছু লিখতেন না। ঠিক যতটুকু লিখলে পেটে ধর্ম ঝুলিয়ে চলা লোকরা দমকা হাওয়ায় টালমাটাল হয়ে যায় ততটুকু লিখতেন। এত এত চিন্তা করতেন যেন, একটি চিন্তা নিয়ে পুরো এক পৃষ্ঠাও লেখার সময় ছিলো না। তাছাড়া লেখাপড়া আছে, চাকরি আছে। তাই তিনি আসল কথাটি বলে ছেড়ে দিতেন, আর সেই কথাটিই অন্য অনেক কথার চেয়ে অধিকমাত্রায় সঠিক বলে ধরা দিতো।

মোল্লা স্বাধীন, জঙ্গি স্বাধীন, ছাগু[১] স্বাধীন, মুমিন স্বাধীন, দুর্নীতিবাজ স্বাধীন, রাজনৈতিক নেতা স্বাধীন, পাতি নেতা স্বাধীন, ধর্ষক স্বাধীন, সামরিক বাহিনী স্বাধীন, সুশীল সমাজ স্বাধীন, পিনাকী[২] স্বাধীন, শফি হুজুর স্বাধীন, দলদাস স্বাধীন, গার্মেন্টস মালিক স্বাধীন, লঞ্চ মালিক স্বাধীন-

স্বাধীন নয় কৃষক-শ্রমিক,
স্বাধীন নয় কথিত সংখ্যালঘু-আদিবাসী,
স্বাধীন নয় মুক্তচিন্তার মানুষ,
স্বাধীন নয় মানুষ হতে চাওয়া মানুষগুলো।

– ওয়াশিকুর বাবু

ওয়াশিকুর বাবু মানুষকে ভালোবাসতেন। তাই মানুষের ভালো থাকা নিয়ে, অধিকার নিয়ে, স্বাধীনতা নিয়ে তার যত ভাবনা। তিনি তার সাধারণ, স্বাভাবিক গঠনের দুটি চোখ দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেয়েছেন স্বাধীনতার সুফল কারা ভোগ করছে আর সেসব সুফলভোগীদের দ্বারা কারা আক্রান্ত হচ্ছে এবং এই আক্রান্ত হওয়াকে কারা বিনাবাক্যে মেনে নিচ্ছেন। যখন অধিকাংশ মানুষ বিনাবাক্যে মেনে নেয়াদের দলে, তখন ওয়াশিকুর বাবুর মত মানুষদেরকে একটু অচেনা, অস্বাভাবিক কিংবা অসাধারণ বলে মনে হবে। অথচ পৃথিবীর অনেক দেশেই ওয়াশিকুর বাবুর চোখে সমাজ দেখা মানুষরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা সকলের জন্য নিরাপদ। কিন্তু ধর্মের কাছে আপনাকে বিক্রি করে দেয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা অমাবশ্যা রাতে বিশাল চাঁদ দেখার মত দুরাশা এবং বিস্ময়। ওয়াশিকুর বাবু এসব অনাচারের প্রতিবাদ করতেন তার সরল ভাষায়।

আদিবাসীদের নিপীড়নের বেলায় বাঙালি ধর্ম ও দল নিরপেক্ষ।
সব ধর্ম ও দলের বাঙালি মিলেমিশে এই কাজ করে।

– ওয়াশিকুর বাবু

বর্তমান বাংলাদেশে যে ক’টি অকাট্য সত্য আছে উপরের কথাটি তার অন্যতম। মনে করুন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি আদিবাসীদের প্রতি নিপীড়নে জড়িত নন, ওই ব্যক্তি শুধুমাত্র নিজ ধর্ম বা দলের সম্ভ্রম রক্ষার্থে এই সত্যটি অস্বীকার করবেন, বিরক্ত হবেন, ক্ষেপে যাবেন। এদের বিরুদ্ধে ওয়াশিকুর বাবুর রাগের শেষ নেই। যেসব মানুষ নিজের চিন্তা চিবিয়ে মতামত বের করে আনতে পারে না, যারা মস্তিষ্কের চিন্তাক্ষেত্র ধর্ম বা দলের কাছে বন্ধক রেখে অন্য পক্ষ বা জাতির উপর চলা নিপীড়নে চুপ থেকে নিজেকে বেহেশত অর্জনের উপযুক্ত অথবা এই সমাজের একজন ভালো মানুষ হিসেবে ভাবেন, ওয়াশিকুর বাবু তাদেরকে ছেড়ে কথা বলতেন না।

আমরা যদি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বড় বড় বুলি ঝেড়ে আদিবাসী দমন-নিপীড়নে সমর্থন দেই বা নিশ্চুপ থাকি তাহলে বুঝতে হবে আমরা একেকজন অসাম্প্রদায়িক বজ্জাত।

– ওয়াশিকুর বাবু

আসুন পাহাড়িদের কেটে সাফ করি, তারপর পাহাড় কেটে সমান করি,
তারপর জমি দখল নিয়ে বাঙালিরা কাটাকাটি করি।

– ওয়াশিকুর বাবু

বাবুর ছোঁড়া এই তীরে কেবল সেসব ব্যক্তি বিদ্ধ হননি যারা কয়েকযুগ ধরে পাহাড়ে চলে আসা নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। সত্যের সাথে আছেন, তাহলে ওয়াশিকুর বাবুর সত্যোন্মচনে ভয় পাবার কারণ নেই। অবশ্য এখন আর ভয় পাবার কোন কারণই নেই। কারণ না থাকার একমাত্র কারণ ওয়াশিকুর বাবুর বেঁচে না থাকা। হ্যাঁ, তার পুরোনো লেখা হয়তো আমাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াবে, কিন্তু নতুন কোন লেখা হঠাৎ আপনার সামনে এসে বিব্রত করবে না। আপনার জন্য এই স্বস্তি ‘ধর্মগ্রন্থের ভুল ব্যাখ্যা কিংবা ইহুদী মার্কিন ষড়যন্ত্রের’ কারণে জ্ঙ্গী হয়ে ওঠা যুবকদের পক্ষ থেকে বিশেষ উপহার।

১৯৮৮ সালে জন্ম নেয়া এই সাহসী মানুষটি মাত্র সাতাশ বছর বয়সে ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ ধর্মীয় সন্ত্রাসীসের হাতে নিহত হন। রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার দক্ষিণ বেগুনবাড়ির বিসমিল্লাহ মঞ্জিল নামে একটি আবাসিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় সাবলেট থাকতেন ওয়াশিকুর বাবু ও তার বাবা। বাবার নাম টিপু সুলতান। তিনি দৈনিক বাংলা মোড়ে মোটর যন্ত্রাংশের ক্ষুদ্র বিক্রেতা। বাবা ছেলে দু’জনেরই রুটিন মাপা জীবনযাপন। সকাল সাড়ে ৯টায় যে যার কাজে বেরিয়ে যেতেন, ওয়াশিকুর বাবু ফিরতেন সন্ধ্যার কিছু পর।

টার্গেট যদি এমন নিয়মতান্ত্রিক হন, তবে আততায়ী খুব খুশি, তার কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। ৩০ মার্চ ভোরে ওয়াশিকুরের বাবা টিপু সুলতান গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বাবাকে বিদায় দিয়ে প্রাতঃপ্রস্তুতি সেরে অফিসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন। প্রতিদিনের মত আজও শহরের যানজট ও লোকালবাসের ধকল মাথার এক পাশে রেখে অন্যপাশে সমাজ-সংস্কার বিষয়ক দুনিয়ার যত চিন্তা এনে জড়ো করেছেন। ওদিকে তাকে খুন করে বেহেশত নিশ্চিত করার জন্যও কয়েকজন ধর্ম সেবক পবিত্র সময়ের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে আছে। বাসা থেকে বেরিয়ে গলির মুখে যেতে না যেতে তার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে চাপাতি হাতে তিনজন যুবক ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুহূর্তে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বাবুর ঘাড়, মাথা ও বিনয় মাখানো চেহারা। বরাবরের মত এবারও আশেপাশে অনেক মানুষ ছিলেন, কিন্তু এগিয়ে আসলেন এসব মানুষের চোখে অর্ধেক মানুষ অথবা সিকি মানুষ কিংবা বেমানুষ দু’জন বৃহন্নলা। ঝাঁপিয়ে পড়ে লড়াই করে খুনীদের দুইজনকে আটকে রাখতে সক্ষম হন। এরপর সাধারণ মানুষও এগিয়ে আসে। আটককৃত দুই ধর্মসন্ত্রাসীকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়।

গ্রেপ্তার হওয়া দুই হামলাকারীর মধ্যে একজনের নাম জিকরুল্লাহ। সে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র। আরিফুল নামের অন্যজন মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র। উল্লেখ্য যে দুটো মাদ্রাসাই হেফাজতে ইসলামের আমীর আহমেদ শফীর নিয়ন্ত্রণাধীন। এবং আহমেদ শফী ২০১৩ সালে প্রকাশ্যে ‘ব্লগার হত্যা ওয়াজিব হয়ে গেছে’ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।

পরবর্তীতে পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদে খুনী জিকরুল্লাহ জানান-

ব্লগ কী বুঝি না। আর তার (বাবু) লেখাও আমরা দেখিনি। হুজুরেরা বলেছেন, সে (বাবু) ইসলামবিরোধী। তাকে হত্যা করা ইমানি দায়িত্ব। ইমানি দায়িত্ব পালন করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে। সেই ইমানি দায়িত্ব পালন করতেই ওয়াশিকুরকে হত্যা করেছি।

নেপথ্যের সেই হুজুররা কারা, আমরা তা আজও জানতে পারিনি। তবে তাদের এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় এই খুনের কারণ ও প্ররোচনা যুগিয়েছে খুনীদের ধর্ম। উৎসমূলে। ধর্মীয় কারণেই তারা বাবুকে খুন করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। ঘাড়ের উপরে আঘাত করে হত্যার নির্দেশনা কোরানেই রয়েছে। (৮:১২)। ওয়াশিকুর বাবু সহ প্রত্যেক মুক্তমনা ব্লগার হত্যার সময়েই আমরা কোরানের সে আয়াতের বাস্তবায়ন দেখেছি।

আজ ওয়াশিকুর বাবু নেই, ফেসবুক বন্ধুদের নিউজ ফিডে আর তার ‘ফাল দিয়ে ওঠা কথা’রা আসে না। স্মৃতি থেকে উঠে আসা কোন পোস্ট বা কোন কমেন্টে বাবুর নাম দেখে এখনো মানুষের দীর্ঘশ্বাস আসে, আসবে। আমরা এরকম বেশকিছু দীর্ঘশ্বাস কিনে নিয়েছি সত্য ও সাহসের বিনিময়ে। ওয়াশিকুর বাবুর জীবনের দৈর্ঘ্য কম ছিলো, কিন্তু প্রস্থে বিশাল। স্বল্পদৈর্ঘ্যের এই জীবনে তিনি যা লিখে গেলেন, যুগ যুগ ধরে সত্যের ছদ্মনাম হিসেবে আমাদের কাছে ধরা দিবে।

ওয়াশিকুর বাবু রচিত কয়েকটি ‘ফাল দিয়ে ওঠা কথা’-

এক সময় সবাই মানুষ ছিল। তারপর ঈশ্বরের আবির্ভাব হল; মানুষ হয়ে গেল হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ।
যে ধর্ম মানুষকে ঘৃণা করতে শেখায়, সে ধর্মকে আমি ঘৃণা করি।
এমন কোন ভালো কাজ নাই, যার জন্যে ধর্ম আবশ্যক। কিন্তু এমন অনেক অপরাধ আছে, যা ধর্ম ছাড়া সম্ভব হতো না।
কোন ধর্মই নারীকে কথিত সম্মানটুকুও দেয়নি। তারা সম্মান দিয়েছে মাকে, বোনকে, স্ত্রীকে, কন্যাকে। যারা নিজেদেরকে এইসব পরিচয়ে সীমাবদ্ধ রেখেছে- তারা সতী আর যারা মানুষ হতে চেয়েছে, তাদেরকে বেশ্যা উপাধি দিয়েছে ধর্মীয় সমাজ।
ধর্মানুভূতি দিয়ে চাষাবাদ হয় না, উৎপাদন হয় না, শিক্ষা হয় না, গবেষণা হয় না, শিল্প-সাহিত্য হয় না। ধর্মানুভূতি দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা হয়, দাঙ্গা হয়, লুটপাট হয়, ধর্ষণ হয়, নোংরা রাজনীতি হয়।
মানব রচিত সবচেয়ে আগ্রাসী কল্পনা হচ্ছে ধর্ম; যা মানুষের কল্পনা শক্তিকে গ্রাস করে। নিজের মত করে একটি স্বর্গ কল্পনা করতেও ধার্মিকেরা অক্ষম।
যে পুস্তক পাঠ করিলে বুদ্ধি, বিবেক, বাস্তবতাবোধ বিলুপ্ত হয় তাহাকে ধর্মগ্রন্থ বলে।

 


টীকা:
[১] ছাগু শব্দটি বাংলাদেশে প্রচলিত কথ্য বিদ্রুপ হিসেবে ব্যবহৃত শব্দ ‘ছাগল’ এর অপভ্রংশ। এর সাথে জাতীয়তাবাদী চিন্তার সূত্র আছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি জনগণের উপর গণহত্যার মত নিকৃষ্ট অপরাধ করে। অথচ আজও বাংলাদেশে নিজ স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অস্বীকারকারী কিছু পাকিস্তানপন্থী আছে, বাংলা ব্লগসমূহে যাদেরকে বিদ্রুপ করে ‘ছাগু’ বলা হয়। পাকিস্তানের জাতীয় পশু মারখোর নামের এক প্রজাতির ছাগল। সম্ভবত ছাগু শব্দের সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে।

[২] তিনি একজন ব্যক্তি। একসময় ছাত্র ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারে কাজ করেন। বিভিন্ন কারণে তিনি বিতর্কিত, যার মধ্যে ড. জাফর ইকবালের উপর হামলার উস্কানি দেয়ার অভিযোগ অন্যতম।

Exit mobile version