হারাম হালালের দোটানায় পড়ে আলেম সমাজ দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এড়িয়ে চলেছেন। কিন্তু বেশিদিন এড়িয়ে যেতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তারা ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারসহ অন্যান্য মাধ্যমে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে বাধ্য হন। কেবল সম্পৃক্ততা নয়, বরং তারা বেশ সক্রিয়ও বটে। এখন ইউটিউব ও ফেসবুকে ওয়াজ মাহফিলের হাজার হাজার ভিডিও। এসব ভিডিওতে চলে অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ, ধর্মহীনদের প্রতি সহিংসতার আহবান। আরো চলে আলেমদের বিভিন্ন গ্রুপের মাঝে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। মাঠ ঘাট থেকে কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনে উঠে আসা এসব ওয়াজ মাহফিল নিয়ে সব শ্রেণীর ব্লগার ও এক্টিভিস্টদের মাঝে চলে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, আলোচনা-সমালোচনা।
ব্লগারদের মধ্যে যিনি এ বিষয়ে সবচে বেশি আলোচনা সমালোচনা করেন, তার নাম সুষুপ্ত পাঠক। এটি তার ছদ্মনাম। সুষুপ্ত পাঠক বর্তমান সময়ের বেশ পরিচিত ও সক্রিয় একজন ব্লগার। এই সাক্ষাৎকারে তিনি তার ভাবনা-চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে মতামত প্রদান করেছেন। আমরাও চেষ্টা করেছি ওয়াজের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্ন করতে। আশাকরি সাক্ষাৎকারটি আপনাদের ভালো লাগবে এবং কাজে আসবে।
অবিশ্বাস: প্রথমে আমরা ওয়াজ মাহফিল প্রচলনের শুরুর সময়টা সম্পর্কে জানতে চাই। মুসলমানদের কোন শ্রেণীর হাত ধরে ওয়াজ মাহফিলের জন্ম? শুরুর দিকে ওয়াজের বিষয়বস্তু কেমন ছিলো?
সুষুপ্ত পাঠক: ওয়াজের ধারণা ইসলামের একদম শুরু থেকেই ছিলো। ওয়াজ অর্থ উপদেশ দেয়া। জুম্মার নামাজের খুতবাকে ‘ওয়াজ’ বলা হয়। মুহম্মদ ওয়াজ (খুতবা) করতেন মসজিদে একটা মোটা লাঠি বা ছড়ি হাতে নিয়ে। দেখবেন এখনকার মসজিদের ইমামরা সেই অনুকরণে হাতে লাঠি রেখে মসজিদে খুতবা বা ওয়াজ করছে মুসল্লিদের সামনে। কুরআনের একটি নামও ‘ওয়াজ’ বা উপদেশ। মুহাম্মদের বিদায় হজের ভাষণকে ‘ওয়াজ’ ধরে পরবর্তীকালে মুসলমানদের মধ্যে উপদেশ নির্দেশ দিতে ওয়াজ ‘মাহফিল’ অর্থ্যাৎ উপদেশ দেয়ার জমায়েত অনুষ্ঠান আয়োজন করা হতো।
হযরত মুহম্মদের মৃত্যুর ১৫০ বছরের মধ্যে মাহযাব গঠন করা হয়েছিলো। তখনো হাদিস সংকলন হয়নি। কুফার মুসলমান আর মদিনার মুসলমান ধর্মকর্মে এক রকম ছিলো না। তাদের কুরআনের ভাষা রীতিও ছিলো ভিন্ন। দেখা যেতো, কুফার আরবী যদি নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হয়ে থাকে বিপরীতে মদিনার কুরআন ছিলো বরিশালের ভাষায়। হাদিস যেহেতু মুহম্মদের মৃত্যুর ২৫০ বছর পর সংকলিত হয় কাজেই আজকের আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসুফের মত মুসলমান তখন সাহাবীরাও ছিলেন না! কারণ হাদিস তখন সাহাবীদের কাছে বিচ্ছিন্নভাবে রক্ষিত ছিলো। ইমাম বুখারী গোটা আরব চষে ফেলেছিলেন সেগুলো সংগ্রহ করতে। মক্কায় হাদিস পাওয়া গেলো নবী জয়তুনের ডাল দিয়ে দাঁত মাজতেন, এটা হয়ত বহুদূরের সিরিয়ার লোকজন জানতই না। বিষয়টা এরকম। হাদিস একত্রিত হবার পর একটা অভিন্ন মুহাম্মদের জীবন পাওয়া গিয়েছিলো। তার নির্দেশ, স্বভাব, অভ্যাস পাওয়া গিয়েছিলো। তার মানে মুহম্মদের সময়ই ‘সহি মুসলমান’ বলতে কিছু ছিলো না। তার মৃত্যুর ২৫০ বছর পর্যন্ত কেউ জানতই না কিভাবে ‘প্রকৃত ইসলামকে’ অনুসরণ করতে হবে! মাহযাব যেহেতু হাদিসের আগেই ইমামদের দ্বারা গঠিত হয়েছিলো তাই হাদিস আসার পরও ইমামদের অনুসারীদের রীতিতে বিশ্বাসে ভিন্নতা থেকেই গেলো। মানে ‘সহি মুসলমান’ হওয়া আর মুসলমানদের কপালে রইল না। এখান থেকে বুঝা যাচ্ছে মুহাম্মদের মৃত্যুর ২৫০ বছর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মটি পূর্ণগঠিত তখনো হয়ে উঠেনি। এই সময়টার অর্ধেকের বেশি ইসলামের গৃহযুদ্ধ চলছিলো। ক্ষমতা নিয়ে মুহম্মদের সরাসরি সাহাবী ও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালিয়ে গেছে তখন কুরআন হাদিস নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় ঘটেনি। যদিও তখনো আলীর অনুসারীরা অন্যদের কাফের মুরতাদ বলছে, অপর পক্ষও একই অভিযোগ তুলছে তাদের বিরুদ্ধে। কুরআন বিকৃত করার একটা অভিযোগও তখন উঠেছিলো। মুহম্মদের প্রিয় সাহাবী আবদুল্লাহ বিন মাসুদ ছিলেন আলীর একনিষ্ঠ অনুসারী। তার কাছে রক্ষিত কুরআন থেকে ভিন্ন ছিলো ওসমান যুগের কুরআন। এই টালমাটাল সময়েই ইসলাম প্রসারে একদল সাহাবী আরব সীমান্তে পৌঁছে যান, সেখান থেকে তারা জিহাদের নির্দেশ পাওয়ার আশায় বছরের পর বছর ঘরবাড়ি সংসার স্ত্রী সন্তান ফেলে পড়ে থাকেন। এই মানুষগুলি জিহাদ করার জন্য পাগল হয় উঠেছিলো। তখনো ইসলাম একটা মলাটে প্রস্তুত হয়ে উঠেনি। এইসব ঘরছাড়া ধর্মের রাস্তায় শহীদ হবার বাসনায় দূর বিদেশে মরুভূমিতে তাবু ফেলে বছরের পর বছর পরে ছিলো কেবল জিহাদের হুকুম আসার অপেক্ষায়। কয়েক প্রজন্ম ধরে জিহাদের আশায় দূর সীমান্ত দেশে গিয়ে গৃহহীন সংসারহীন কাফেলা যুবকদের প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে তুলে। এই সীমান্ত এলাকার সাহাবীদের উত্তরপুরুষরাই যে ইসলামের ফকির সন্ন্যাসী সেটা আজকে সবাই জানে। মূলত আরবের মূল ইসলাম থেকে ঘর পরিবার বিচ্ছিন্ন এইসব মানুষের হাতেই একদেড়শ বছরের মধ্যে প্রাথমিক ‘সুফিবাদ’ বা দরবেশ ধারা গড়ে উঠে যা আসলে আরবের মুহম্মদের মূল ইসলাম থেকে খানিকটা ভিন্ন। এদেরই পরবর্তী প্রজন্ম ভারতবর্ষে আসেন ধর্ম প্রচার করতে। এই ধর্মপ্রচার আসলে ভারতে ইসলাম কায়েমের অংশ। আফগান তুর্কি রাজবংশের অনুকুল্যে এরা ভারতে আসেন। এদের প্রায় সবাই অস্ত্র হাতে ভারতীয় রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জিহাদের অংশগ্রহণ করেন। তারা রাজআনুকূল্যে খানকা তৈরি করে সেখানে নৃত্যগীতের মাধ্যমে আল্লার জিকির করেন। ‘ওয়াজ’ করে মানুষদের ইসলামের দিকে আহ্বান করেন। তাদের গুরুদের যারা হয়ত আরবে গত হয়েছিলেন তাদের মৃত্যুবার্ষিকীতে যে ‘ওরস’ পালন হতো সেখানে সুফি ফকির আগত ভক্ত আশেকানদের উদ্দেশ্যে ‘ওয়াজ’ করতেন। গ্রামবাংলার ‘ওয়াজ’ এখান থেকেই ছড়িয়ে পড়েছিলো ফকিরদের শিষ্য মসজিদের মোল্লার হাত ধরে। যেহেতু কৃষি প্রধান ছিলো বাংলাদেশ, তাই অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধান উঠার পর কৃষকের হাতে পয়সা আসত। তাই কেবল শীতকালীন সময়ে গ্রামবাংলায় মেলা যাত্রা বাউল গানের মত ওয়াজও হতো একই সময়ে। মাছের পিঠে চড়ে নদী পার হওয়া ফকির বা কুমিরের পিঠে চড়ে সাগড় পারি দেয়া দরবেশকে নিয়ে গড়ে উঠা কিংবদন্তি তখন ওয়াজের বক্তারা ভক্তিভরে প্রচার করতেন। কিচ্ছাকাহিনী এভাবেই ওয়াজে তখন আসা শুরু করে। শুরুতে ফকিরদের ওয়াজে মূর্তি পূজার মত শিরকের ক্ষতিকর দিক নিয়ে বেশি আলোচিত হতো। কারণ চারপাশে হিন্দুরা বসবাস করত। আমরা যদি শাহজালাল শাহ পরাণের সময়কার কথা বলি তখন তাদের শিরকের বিরুদ্ধে প্রচন্ড রূদ্রমূর্তির কথা জানতে পারি। এতে বুঝা যায় তাদের খানকার ওয়াজে উনারা কি ধরণের ওয়াজ করতেন। এছাড়া তীতুমীর, শরীয়তউল্লাহ আর দুদুমিয়ারা ইংরেজ বিরোধী অবস্থান নিলেও মন্দিরে গরুর রক্ত ছিটিয়ে দেয়ার মত কাজ তাদের শিরকের বিরুদ্ধে অবস্থান স্পষ্ট হয়। হাজি শরীয়তউল্লাহ ভারতবর্ষকে ‘দারুল হার্ব’ বলে মনে করেতন তাই কাফের শাসিত দেশে মুসলমানদের জন্য ঈদের নামাজ আদায় করা হারাম বলে ফতোয়া দেন। চিন্তা করুন, কোন সময়কালে এই ফতোয়া দেয়া হয়েছিলো! কত গভীরভাবে ধর্মীয় শাস্ত্র চর্চা তখন হয়েছিলো। শোলাকিয়া ঈদের জামাতে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছিলো ইসলামের এই দিক থেকেই। যারা হামলা করেছিলো তারাও বাংলাদেশকে দারুল হার্ব মনে করে। তাই ঈদের নামাজ আদায় করা এখানে মুনাফেকির পর্যায়ে পড়ে। কাজেই এই সময়কালের ওয়াজ, ইসলামী আন্দোলন, জঙ্গি হামলা দেখে হঠাৎ গাছ থেকে ফল পড়ার মত ভাবার কোন কারণ নেই। তখনকার ওয়াজে কিংবদন্তি কিচ্ছা কাহিনীর পরিমাণ বেশি হলেও ইসলামের শিরক বিরোধী, কাফের মুশরিকদের প্রতি বিদ্বেষ একই পরিমাণ জারি ছিলো অনুমান করা যায়। তীতুমীর, শরীয়তউল্লাহ ইংরেজ বিরোধী লড়াই করেছিলেন, তারা ইংরেজ শাসন হটিয়ে ভারতকে ‘দারুল ইসলাম’ করতে চেয়েছিলেন। শরীয়তউল্লাহ’র ফতোয়া মেনে তখন মুসলমানরা ঈদের নামাজ পড়েনি। এই যে আমরা আবহমানকাল ধরে বাঙালীর অসাম্প্রদায়িকতার কিচ্ছা ইতিহাসের নামে চালিয়ে দিই, তার কোন ভিত্তি নেই। শরীয়তউল্লাহ যখন মুসলমানদের নেতা ছিলেন তখন হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা করেনি। কেউ কারোর মন্দির মসজিদ ভাঙ্গতে যায়নি। কেউ কারোর পূজাআর্চা ভাঙ্গতে যায়নি। তার প্রেক্ষিততো ভিন্ন। কারণ জিহাদটা তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। কোন দাঙ্গা লাগেনি তার ইতিহাস যেহেতু নেই তাই তখন অসাম্প্রদায়িক উদার এক ইসলাম বজায় ছিলো, এই মতামতে আসা অবিবেচনা প্রসূত। যারা দারুল হার্ব মনে করে ঈদের নামাজ পড়েনি তাদের কোন ধরণের মুসলমান কাতারে আমরা ফেলতে পারি? আমরা জানি লালন ফকিরের বিরুদ্ধেও মোল্লাদের ফতোয়া ছিলো। কাজেই আমরা বলতে পারি না এক-দেড়শো বছর আগে আজকের ওয়াজের মত তখনকার ওয়াজ ভায়োলেন্ট ছিলো না। তবে ধরণে চেহারায় ভিন্ন ছিলো। আজকের মত অর্থ উপার্জন করার জন্য পেশাদার ওয়াজকারীর জন্ম তখন হয়নি। যেটা এখন হয়েছে। আসছি সেকথায় পরে…।
অবিশ্বাস: ইসলাম ধর্ম যেমন আরব থেকে আসা, ওয়াজ মাহফিলের রীতিও কি তেমন? নাকি বাঙালি তথা উপমহাদেশীয় সংস্কৃতি বা ধর্মীয় রীতির অনুকরণ?
সুষুপ্ত পাঠক: শায়খ আবদুল্লাহ আযম যিনি ওসামা বিন লাদেনের গুরু হিসেবে বেশি পরিচিত তিনি আফগানিস্থানে মুজাহিদ হিসেবে যোগ দিতে জোহরের নামাজের পর মসজিদে আগতদের উদ্দেশ্যে ওয়াজ শুরু করতেন, আসর ওয়াক্তে গিয়ে একটা বিরতি দিয়ে আবার মাগরিব, তারপর এশার নামাজের আগ পর্যন্ত চলত তার টানা ওয়াজ। এসব ওয়াজ আরো ভয়ানক। বাংলাদেশে এখন যে ধরণের ওয়াজ করা সম্ভব সেটা হয়ত ভারতের সব জায়গা করা সম্ভব হবে না। চীনে তো ওয়াজই করতে পারবে না। বিষয়টা জিহাদের বিধানেই বলা আছে। শক্তি ও সামর্থ অনুযায়ী মুসলমান মুখ ও পেশি ব্যবহার করবে। অন্যান্য ইসলামিক দেশে যে ওয়াজ হয় সেটা আমাদের দেশের মত নয়। সেখানকার আদলটা ভিন্ন। প্যান্ডেল টানিয়ে, মঞ্চ তৈরি করে মাইক লাগিয়ে ওয়াজ কেবলই উপমহাদেশের স্টাইল। আরব দেশে বড় বড় অডিটরিয়ামে সুধি সমাবেশের মত ওয়াজ হয়। বক্তারা ঠান্ডাভাবে কুরআন ও হাদিস থেকে ওয়াজ করেন। আমাদের এখানে বক্তারা উপস্থিত জনগণকে উত্তেজিত করে তুলতে চান। এটাকে ওয়াজ জমানো বলে। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের ওয়াজ আদলের দিক থেকে একেবারেই আলাদা। টিপিক্যাল ‘ওয়াজ মাহফিল’ উপমহাদেশর চেহারা এখনকার নিজস্ব একটা চেহারা পেয়েছে। জসিমউদ্দিন রাহমানির একটা বয়ান নেটে পাওয়া যায়, খুব উত্তেজিতভাবে তিনি মুসলমানকে জিহাদ করতে বলছেন। মোল্লা ওমর একইভাবে জিহাদের উদ্দেশ্যে তালেবানদের কাছে একটা উত্তেজিত বক্তৃতা রেখেছিলো। হাদিসে আমরা পাই মুহম্মদ যখন সাহাবীদের ধর্মোপদেশ দিতো তখন তিনি গলা উঁচিয়ে কথা বলতেন আর তার চক্ষু রক্তবর্ণ হয়ে উঠত। একজন সেনাপতির মত তার সাহাবীদের দিকে রাগান্বিতভাবে সতর্কবাণী করতেন। ওয়াজে যে চিৎকার উত্তেজিতভাবে বক্তা ওয়াজ করেন তার উৎস সম্ভবত সচেতনভাবে এখান থেকেই এসেছে। এর মানে আমার মনে হয় ওয়াজের উপমহাদেশীয় যে চেহারা সেটা এখানকার হলেও সেটা ভারতীয় কোন ধর্মীয় জলসার মিশ্রণ বা প্রভাব নেই। হিন্দুদের ‘পাঠ’ মোটেই ওয়াজের মত কিছু নয়। ইসলামে সাম্রাজ্যবাদ একজন ইমামকে সেনানায়কের মত তার সামনে থাকা মুসলমানদের প্রতি আচরণ করতে শেখায়। শায়খ আবদুল্লাহ আযম বা মোল্লা ওমর জিহাদের রিক্রুটমেন্টে যে উত্তেজিত বক্তব্য রাখতেন সেটা ওয়াজ ধরা যাবে কিনা সেটা বিবেচনার বিষয়। আমরা আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মুফতিদের সেমিনারের মত করে যে ইসলামী সম্মেলন করতে দেখি সেটাও আমাদের এখানকার ওয়াজের কাতারে ফেলে বিবেচনা করবেন কিনা তাও বিবেচনার বিষয়। তবে আভিধানিক অর্থে এগুলো সবই ওয়াজ।
অবিশ্বাস: এই যে মারফতি অথবা মারিফতি বলে একটা বিষয় আছে, এর অনুসারীদেরকে খাজা মঈনউদ্দিন চিশতির গুনগান গাইতে দেখা যায়। ‘ইসলামে গান জায়েজ’ এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন তারা। এ বিষয়ে তথ্য ও যুক্তি উপস্থাপন করে একক কথাগান গাইতে দেখা যায়। এসব গানকে তারা ‘মেহফিল’ বলে পরিচিত করেন। এটাও কি ওয়াজ মাহফিলের অংশ?
সুষুপ্ত পাঠক: হ্যাঁ, এটা ওয়াজ মাহফিলের অংশ। এরকম মারফতি হুজুরদের ওয়াজ এখনো হয়। ইউটিউবে সেগুলো পাওয়া যায়। তবে তারা কোণঠাসা হয়ে গেছে। বিদাআত শিরকি অভিযোগে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান যেহেতু আগে থেকেই জানে ইসলামে বাদ্য গান হারাম তাই তারা তেমন প্রসার করতে পারেনি। তবে এই গ্রুপটা খানিকটা উদার। এদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি তারা অমুসলিমদের বিষয়ে অন্যদের মত ততখানি কট্টর নয়। সুফিদের ইতিহাস যাই থাকুক, মাজারপন্থিদের উদার না বলে উপায় নেই। মারফতিদের কুরআন হাদিসের সমর্থন খুবই সামান্য। তারা কয়েকটা হাদিস দেখিয়ে বাদ্যযন্ত্রকে হালাল বলেন। মাওলানা ফারুকী যিনি খুন হয়েছিলেন আনসারুল্লার হাতে, তিনি সুফি, মাজারপন্থি ছিলেন। ইহুদী-নাসারা ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে- এরকম ঢালাও অভিযোগের বিরুদ্ধে তিনি কথা বলতেন। তিনি খুন হবার পিছনে এগুলোই কারণ ছিলো। উপমহাদেশের ইসলামের প্রবেশ সুফিদের হাতে। যে কারণে এখানে প্রচুর খানকা, মাজার, দরগা দেখা যায়। ইসলামী জলসা বা মাহফিলের সূচনা তাদের হাতেই। ছোটবেলায় আমরা যে ওয়াজ দেখেছি সেখানে প্রথমে এই ‘মেহফিল’ গান চলত। হযরত মুহম্মদের দাসী ঈদের দিন সকালে একটা চামড়ার বাদ্য বাজিয়ে আল্লার রসূলের প্রশংসামূলক গান গাইছিলো। এমন সময় আবু বকর মুহাম্মদের ঘরে প্রবেশ করে গান শুনতে পেয়ে দাসীকে ধমক দিয়ে বলেন, গান হচ্ছে শয়তানি কারবার সে কোন সাহসে আল্লার নবীর সম্মুখে বসে এই কাজ করার সাহস করছে? তখন মুহম্মদ আবু বকরকে বলেন, থাক, আজকে তো ঈদের দিন, তাছাড়া সে তো আল্লার গুণগান গাইছে…। এই হাদিসটা দেখিয়ে গানকে জায়েজ করার একটা দুর্বল চেষ্টা চলে। হাদিসটা খেয়াল করলে দেখা যাবে আবু বকর গান বাদ্যকে শয়তানের কাজ বলছে, তার মানে আবু বকর জানত এটা শয়তানের কাজ যা আল্লার রসূল পছন্দ করেন না। এটা সে কিভাবে জেনেছে? অবশ্যই মুহম্মদ সেই শিক্ষাটা দিয়েছেন। তারপর মুহম্মদই বলছে ঈদের দিন বলে আজকে একটা ছাড় দিতে, সঙ্গে যোগ করেছেন গানটা ছিলো আল্লার রসূলের প্রশংসামূলক তাই দোষের কিছু হয়নি। এর অর্থ হচ্ছে ইসলামে গান হারাম, শয়তানের কাজ। তবে বিশেষ দিনে আল্লাহ নবীকে নিয়ে প্রশংসামূলক সংগীত গাওয়া যেতে পারে…। ‘মেহফিল’ বাদ্য বাজিয়ে গাওয়া এখান থেকেই প্রেরণা পেয়েছিলো হয়ত। সংগীত শিল্প সাহিত্য সমস্ত কিছু যা দুনিয়াবী বিষয় নিয়ে রচিত হয় তাকে কুরআনের সুরা লোকমানের ৬-৭ আয়াত দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সমস্ত তাফসিরকারক এই আয়াতকে গান বাজনার বিরুদ্ধে কথা বলা হয়েছে বলে মত দিয়েছেন। ইসলামে ‘দফ’ নামের একটা বাদ্যযন্ত্র বাজানোর অনুমতি আছে তাও কেবল ইসলামী গান গাওয়ার সময়। অন্যসব বাদ্যই ইসলামে হারাম। কাজেই মারফতিদের নিজেদের পক্ষে দলিল খুব দুর্বল হওয়াতে তাদের টিকে থাকা কঠিন হচ্ছে। তবে উপমহাদেশের ওয়াজ মাহফিলে মারফতিদের অনুষ্ঠানে এরকম সংগীত আগে থেকেই ছিলো। আবার এরকম ইসলামের বিরোধীতা বহু আগে থেকেই ছিলো। তীতুমীর হজ্ব করে আসার পর ভারতীয় মুসলমানদের হিন্দুদের মত নাম রাখার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেন। আমরা সব সময় বলার চেষ্টা করি ৯০ দশকের পর আরবী ইসলামের আমদানি ঘটে ভারতীয় উপমহাদেশের সহজীয়া ইসলামের অবসান ঘটেছে। এটা মোটা দাগে সঠিক নয়। শাহ আবদুল করিম-সহ অনেক বাউল সাধকই মোল্লাদের বাধার মুখে পড়ে নিজ গ্রাম ছেড়েছিলেন।
অবিশ্বাস: ওয়াজ মাহফিলে বক্তারা বিভিন্ন ধরনের গল্প বা কিচ্ছা ব্যবহার করেন। যার সাথে কোরআন বা হাদিসের সূত্রতা মেলে না। এ কারণে একটি প্রশ্ন বেশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। উপমহাদেশের মানুষ কি কোরআন হাদিসের বাংলা অনুবাদ পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, নাকি ওয়াজ মাহফিলের এসব গুল্প শুনে? ইসলাম গ্রহণের আরো অনেক কারণ থাকতে পারে, কিন্তু আমি কেবল ওয়াজ মাহফিলে বলা এসব গল্পের প্রভাব সম্পর্কে ধারণা পেতে চাইছি।
সুষুপ্ত পাঠক: উপমহাদেশের মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে দুটি উপায়ে। প্রথমত- রাজশক্তির দুঃশাসন-দুরাবস্থা থেকে মুক্তি পেতে, দ্বিতীয়ত- হিন্দুদের কঠিন জাতপাত থেকে মুক্তি পেতে। মুসলমান হলে বেশ কিছু সুবিধাও পাওয়া যেতো। আবার শাসকের কঠিন শর্ত থেকে মুক্তি পেতেও ধর্মত্যাগ করেছে মানুষ। হাদিস কুরআন পড়ে জেনে বুঝে দলে দলে সব হিন্দু মুসলমান হয়েছে ইতিহাসে এর কোন হদিস নেই। এভাবে পৃথিবীতে কোথাও ঢালাওভাবে ধর্মান্তরে নজির নেই। ইসলামের নানা রকম কিচ্ছা কাহিনী শুনে বিচ্ছিন্নভাবে কারোর ইসলাম গ্রহণ ভিন্ন বিষয়। জাকির নায়েকের লেকচারে হিন্দু থেকে মুসলিম হবার বানানো নাটক পরে ধরা পড়েছে। নওমুসলিম মাওলানার ওয়াজে সে কিভাবে হিন্দু ধর্ম ভুয়া এটা বুঝতে পেরে এবং ইসলামের আধ্যাত্মিক সত্য প্রমাণ পেয়ে মুসলমান হয়েছিলো- এরকম ওয়াজ শুনেও একজন হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করেনি। ওয়াজ মাহফিল কেবল মুসলমানদের মধ্যেই প্রভাব রাখতে পারে- এর বাইরে অন্য ধর্মের মানুষদের মধ্যে কোন প্রভাব রাখে না। ওয়াজ নিয়ে যদি আপনি হিন্দুদের সঙ্গে কথা বলেন, যদি তারা মনের সত্য কথাটা বলে তাহলে তারা ওয়াজ নিয়ে তাদের অসন্তুষ্ট হবার কথাই বলবে। তাদের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে উপহাস করায় তারা মন:ক্ষুণ্ন। উপমহাদেশের মানুষদের ইসলাম গ্রহণ করার কিছু কিচ্ছা কাহিনী প্রচলিত আছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্থানীয় হিন্দুরা দেখল মুসলমানরা তাদের চাকরবাকর সমেত এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে। এটা দেখে ব্রাহ্মণ সমাজের হাতে নিপীড়িত নিম্মবর্ণের হিন্দুরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলো দলে দলে…। এরকম কোন প্রমাণ ইতিহাসে নেই। বরং ইতিহাসে খান জাহান আলীর মত শাসকদের কথাই জানা যায় যারা প্রতারণা করে ইসলামের প্রসার করার চেষ্টা করেছিলেন। সুফি দরগা থেকে গরু জবাই করে তার নাড়িভূঁড়ি হিন্দু মন্দিরে ফেলার ঘটনা বরং তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়েছিলো। মধ্যযুগের কাব্য ‘মনসা মঙ্গল’ কিন্তু নিন্মবর্ণের হিন্দু দেবী মনসাকে নিয়ে লেখা। কাজেই এটা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের লেখা কোন সাহিত্য নয়। এই মনসা মঙ্গলে দেখা যাচ্ছে গরীব রাখাল বালকদের ঘট পূজা ভেঙ্গে তছনছ করে দিচ্ছে কাজির লোকজন। তখন সুফির দরবারে যে ‘ওয়াজ’ হতো সেখানে শিরনি বা তোবারক দেয়া হতো গরু জবাই করে। হিন্দুদের জন্য গরুর মাংস নিষিদ্ধ। সেই গোমাংস রন্ধনই তো স্থানীয়দের দরগা জলসা ওয়াজ থেকে বহুদূরে রাখবে। এটাই আমার মত।
অবিশ্বাস: অতীতের সাথে বর্তমান ওয়াজের পার্থক্য কী? আপনি কি ওয়াজ মাহফিলের বিবর্তনকে বিভিন্ন অধ্যায়ে ভাগ করতে চাইবেন?
সুষুপ্ত পাঠক: আগের ওয়াজ মাহফিল থেকে বর্তমানে ওয়াজ মাহফিলের একটা পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। আগের জনপ্রিয় বক্তারা কেঁদেকেটে বিভিন্ন নবী সাহাবীর করুণ কাহিনী বলে ওয়াজ করতেন। মানুষ আসলে গল্প শুনতে ভালোবাসে। এইসব বক্তারা একটা দীর্ঘ গল্প বলা শুরু করতেন। তারা একজন দক্ষ টিভি সিরিয়াল রাইটারদের মত কাহিনীকে টানটান উত্তেজনাপূর্ণভাবে গোটা ওয়াজের সময় পর্যন্ত ধরে রাখে। গল্পের নানা বাঁকে বয়ানকারী ইসলামে নারীর পর্দা, শিরক, হারাম হালাল এই বিষয়গুলিকে হাইলাইট করে শ্রোতাদের মনোযোগ দিয়ে বুঝতে বলত। এভাবেই একটি নির্দিষ্ট গল্প চলতে থাকত। আমি দেখেছি শীতের রাতে বাড়ির মহিলারা মাইকে সেই গল্পের সমাপ্তির আশায় কান পেতে শুনতে চাইতেন এরপর কী ঘটে…। এরকম ওয়াজের দিন শেষ বলতে গেলে। এখন ওয়াজ কয়েকভাগে বিভক্ত। কমেডিয়ান ওয়াজকারী হিসেবে বেশ কয়েকজন জনপ্রিয়। এরা মূলত নারীদের বেপর্দা চলাফেলা নিয়ে নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করে শ্রোতাদের হাসায়। তাদের ওয়াজের প্রধান অংশ হচ্ছে নারী শরীর। নারীর শরীর যে পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলছে এটাই তাদের প্রধান কথা। এর পাশাপাশি আল্লার আইনে দেশ পরিচালনা করা, কুরআনকে সংবিধান বানানো, হিন্দু-ইয়াহুদিদের ষড়যন্ত্র থেকে সতর্ক থাকার উপদেশ হচ্ছে তাদের ওয়াজের প্রধান দিক। এই ওয়াজকারীরা এখনো নানা রকম কিচ্ছাকাহিনী বানায় ওয়াজের স্বার্থে। তবে সেটা হাদিস জাল করার মত নয়। প্রত্যহ জীবনে হুজুরের অভিজ্ঞতার কথা। যেমন হুজুর এক বাড়িতে গিয়ে দেখে সেই বাড়ির মহিলা রাতদিন ভারতীয় টিভি সিরিয়াল দেখে আর স্বামীর কোন খোঁজখবর রাখে না ইত্যাদি। কিংবা হুজুর বাসে উঠেছে আর এক নারী তাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেছে… এইসব হচ্ছে কিয়ামতের যে ক’টা নতিজা, তার একটা… এরকম গল্প বলে শ্রোতাদের মজিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। দ্বিতীয় গ্রুপকে যদি এভাবে বলি ‘আবদুর রাজ্বাক বিন ইউসুফ ঘরানার’ ওয়াজ তাহলে বোধহয় ভুল হবে না। এখানে কোন কিচ্ছাকাহিনী ঠাট্টা তামাশা, অভিনয়, কৌতুকের স্থান নেই। সরাসরি হাদিস অনুবাদ করে শোনানো হবে। কুরআনের অর্থ করে বাংলা তাফসির করে শোনানো হবে। নির্দিষ্ট বিষয় ধরে বক্তা তার কথা শেষ করবে। গল্প থেকে গল্পে ছুটবে না। কুরআন হাদিসের বাইরে একটাও নিজের মতামত তারা দিবে না। বর্তমানে এই ওয়াজই অনলাইনে তুমুল জনপ্রিয়। মজাটা হচ্ছে মডারেট ইসলামের উত্থানের পর এই মোহাম্মদী ইসলামের উত্থান একটা গৃহযুদ্ধের মত! যেমন এই ঘরানার হুজুররা মডারেটদের সব রকম দাবীকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে দলিল সহকারে। এরা হাই প্রোফাইল মুফতি, আল আজহার থেকে পড়াশোনা করে এসেছে। এদের মডারেটরা ‘কাঠমোল্লা’ বলে রেহাই পায় না। আবদুর রাজ্বাক, মুফতি তারিক মুনায়ের মত বক্তারা গুলশান হামলার পর তাদের ওয়াজ জঙ্গিবাদের ভূমিকা রাখছে কাগজে নাম আসলে তারা দুজনের একজন দুবাই, অপরজন আমেরিকা ট্যুরে গিয়ে কিছুদিন চুপ করে থাকে। ইউটিউবে ৬০ ভাগ জিহাদী ওয়াজ এই দুজনের একার! এদের বাইরে আরো দুটি গ্রুপ আছে যাদের নিজেদের ব্যবসা ও পার্টির পলিটিক্যাল ইন্টারেস্টের উপর ওয়াজ করে থাকে। যেমন চরমোনাই পীর, মাইজভান্ডারী, জামাতের দেলোয়ার হোসেন সাঈদী। এগুলোকে রাজনৈতিক ওয়াজ বলাই শ্রেয়। এই ওয়াজকেই রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়। জামাত বা চরমোনাই পীরের ওয়াজে ঘটমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করা হয়। তাই অনেক সময়ই আওয়ামী লীগ বিএনপির মত মূলধারার পার্টির সমর্থকদের এইসব ওয়াজের বিরুদ্ধে কথা বলতে দেখা যায়।
(দ্বিতীয় অংশ)
অবিশ্বাস: এক সময় ওয়াজ মাহফিলের অডিও ক্যাসেট বের হতে শুরু করে। এরপর সম্ভবত মাওলানা যুক্তিবাদী নামক এক ব্যক্তির ওয়াজের ক্যাসেট সবচেয়ে বেশি বিক্রি হতো। নব্বইয়ের দশকে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী এসে যুক্তিবাদীর জনপ্রিয়তায় ভাগ বসান। এই দু’জনের ওয়াজের মাঝে কি কোন পার্থক্য আছে? থাকলে তা কেমন?
সুষুপ্ত পাঠক: আহমদ ছফা সাঈদীর ওয়াজ সম্পর্কে বলেছিলেন, “সাঈদী যদি ওয়াজ না করে গান গাইতেন, তাহলেও খুব জনপ্রিয় গায়ক হতেন। দ্বিতীয়ত তাঁর বলার মধ্যে তিনি একধরনের ড্রামাটিক সাসপেন্স তৈরি করেন। তিনি একজন ভাল অভিনেতা এবং শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখার ক্ষমতা রাখেন। তৃতীয়ত নাটক বা গান শুনতে পয়সা লাগে, ওয়াজ শুনতে পয়সা লাগে না। চতুর্থত যৌন আবেদনমূলক ছায়াছবি মানুষ যে কারণে এনজয় করে, সাঈদীর বক্তৃতায় তাও রয়েছে। ওর বক্তৃতায় আধুনিক ব্লু-ফিল্মের উপাদান রয়েছে। তিনি যদি একঘণ্টা বক্তৃতা করেন তার মধ্যে অন্তত দশ মিনিট থাকবে যৌনতা। পঞ্চমত ব্লু-ফিল্ম দেখার পর দর্শকের মনে এক ধরনের পাপবোধ জাগে, অন্যদিকে ওয়াজ শোনার পর মনে পূণ্যের সঞ্চার হয়। সুতরাং আমি দেখলাম যে সাঈদীর জনপ্রিয়তা অস্বাভাবিক কিছু নয়”। ছফা সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলে উপস্থিত থেকে কোনদিন শুনেননি। তিনি গ্রামে গিয়ে দেখেন তার ভাবী ক্যাসেটে এই ওয়াজ শুনছেন। ওয়াজের ক্যাসেট বিক্রিতে যুক্তিবাদী, সাঈদী, তোফাজ্জল হোসেনদের রেকর্ড কেউ ভাঙ্গতে পারেনি। ছফার সময়ের সেই ওয়াজের বাজার আর নেই। আবদুর রাজ্জ্বাক বিন ইউসুফদের ওয়াজের ধরণ এখন অনুকরণীয়। সাঈদী ও যুক্তিবাদীর (হাবিবুর রহমান) ওয়াজে মোটা দাগে কোন তফাৎ আমার চোখে নেই। ছফা সাঈদী সম্পর্কে যা বলেছিলেন যেমন তিনি সুকন্ঠি, এটা তার নিজস্বতা। ভালো অভিনেতা, যুক্তিবাদীর হয়ত এই দিকগুলো নেই। তবে একই ক্যাটাগরির ওয়াজই তারা করতেন। অন্তত আমি যতটুকু দেখেছি।
অবিশ্বাস: নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করে ওয়াজ নিয়ে মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকেই বলাবলি করতেন “এখনকার ওয়াজে রাজনৈতিক বক্তব্য বেশি, তাই শুনি না।” এ বিষয়টা আপনি কিভাবে দেখেন? এক শ্রেণীর মুসলমান যে ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করে দেখেন, তার ভিত্তি কী? ইসলাম কি আদৌ কোন ধর্ম নাকি অলীক বিশ্বাসাশ্রিত তীব্র রাজনৈতিক মতবাদ?
সুষুপ্ত পাঠক: …যেমন ধরেন জামাত যখন বলে নৌকায় ভোট দিলে বউ তালাক হয়ে যাবে তখন বক্তা এর সপক্ষে কোন হাদিস কুরআন হাজির করতে পারে না। কাজেই বক্তাকে সহজেই রাজনৈতিক বক্তব্য রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায়। কিন্তু রাজ্জ্বাক বিন ইউসুফ যখন বলেন ভোট দেয়াই হারাম, গণতন্ত্রই হারাম তখন তিনি নির্দিষ্ট কোন মার্কাকে নিয়ে বলেন না। আর তার কথার পিছনে কুরআন হাদিসের দলিলও থাকে। এক শ্রেণীর মানুষ ধর্ম আর রাজনীতিকে আলাদা করে দেখেন যখন চরমোনাই পীর বলেন হাতপাখায় ভোট দিলে বেহেস্তে যাওয়া যাবে তখন। কারণ আক্ষরিক অর্থে কুরআন হাদিসের কোথাও তো বলা নেই হাতপাখা মার্কায় ভোট দিলে বেহেস্তে যাওয়া যাবে। মানুষ তখন বলে, আরে ধর্মে তো ভোটের কথাই নেই যেখানে সেখানে হাত পাখায় ভোট দিলে বেহেস্তে যাবার কথা পীরের নিজের বানানো কথা… ইত্যাদি। এই হচ্ছে এক শ্রেণীর মুসলমানের ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করার ভিত্তি। এরপরও আহমদ ছফার ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ যে ভন্ডামী দেখানো হয়েছে সেটা আসলে ধর্ম বিশ্বাস করা সব আধুনিক মুসলমানের মধ্যেই দেখা যায়। এরা জানে ইসলাম গণতন্ত্রের কথা বলে না। থাকলে ইসলামী খিলাফতে ইহুদী খ্রিস্টানরাও খলিফার পদের দাবীদার হত। তবু তারা মুখে বলবে- ইসলামে গণতন্ত্র আছে। কুরআন হাদিস সীরাত কোথাও গণতন্ত্র নুন্যতম সহিষ্ণুতার চিহৃ আমরা দেখতে পাই না। ইসলাম যে পৃথিবীর বাকী ধর্মগুলোর মত জপতপ করে ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিকতাবাদী কোন ধর্ম নয় তা কুরআন নিজেই বলছে। নামাজ রোজা হজ্ব পালন করে ইসলামের হালাল হারাম মান্য করে সাচ্চা মুসলমান হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়ার জন্য পৃথিবীতে ইসলামের আগমন হয়নি। সুরা আলে ইমরানের ১৪২ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা কি ভেবেছো এমনিতেই জান্নাতে চলে যাবে, অথচ আল্লাহ এখনো দেখেননি তোমাদের মধ্য থেকে কারা জিহাদ করে এবং কারা সবর অবলম্বনকারী? হযরত ইবন উমার আবু দাউদে একটা হাদিস বর্ণনা করেছেন এভাবে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, তোমরা যদি নিজেদের মধ্যে ব্যবসা করতে থাক,আর ষাঁড়ের লেজের পেছনে চলতে থাক, এবং কৃষক হিসাবেই সন্তুষ্ট হয়ে যাও আর জিহাদ ছেড়ে দাও, আল্লাহ তখন তোমাদের ওপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেবেন যতক্ষন তোমরা তোমাদের দ্বীনে ফিরে না যাও।“ দেখা যাচ্ছে কোন মতেই ইসলামকে আপনি আর দশটা আধ্যাত্মিকবাদী ধর্মের মধ্যে ফেলতে পারছেন না। যত রকমের ইসলামি সোর্স আছে, সেখানে হাজার হাজার দলিল পাওয়া যাবে যেখানে ইসলামের মূল উদ্দেশ্য বলা হয়েছে, ইসলামী শাসন অমুসলিম রাজ্যগুলো জিহাদের মাধ্যমে দখল করে কায়েম করতে হবে। ইসলাম তাই একটি সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক দর্শন ছাড়া অন্য কিছু না।
অবিশ্বাস: ওয়াজ মাহফিলে কি শুরু থেকেই সহিংস বক্তব্যের প্রচার হতো নাকি তা নিকট অতীতে শুরু হয়েছে? সহিংস বক্তব্য প্রচারের নেপথ্যে কী কাজ করে? এটা কি তারা বিরুদ্ধ পক্ষকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে করে নাকি নিজেদের অস্তিত্বের সংকট বিষয়ক শংকা থেকে করে?
সুষুপ্ত পাঠক: আমি কিছু ওয়াজ বেশ বয়স্ক ব্যক্তিদের শুনিয়েছি যারা বাল্যকালে কৈশোরে যৌবনে গ্রামে প্রচুর ওয়াজ মাহফিলে যেতেন। তারা কেউ ইহুদী কবি কাফ ইবনে আশরাফকে হত্যা করতে গুপ্তচর পাঠানোর ঘটনা জানে না! মুহম্মদকে সমালোচনা করা কবিতা লেখার অভিযোগে তাকে খুন করতে মুহম্মদ তার সাহাবীকে পাঠিয়ে ছিলেন এরকম কোন কাহিনী তারা জানে না! তার মানে কি ৪০ বছর আগে ওয়াজে এই কাহিনীগুলো ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাওয়া হতো। নাকি তখনকার হুজুরদের প্রপার শিক্ষা ছিলো না? না, শিক্ষা ঠিকই ছিলো তবে তারা মনে করত সাধারণ মানুষ এসবে ভুল বুঝতে পারে। বাংলা কুরআন ও হাদিস অনুবাদকদের আমরা যেমন দাসীকে সেক্স করা ইসলামে হালাল এই সম্পর্কিত আয়াত ঘুরিয়ে পেচিয়ে অনুবাদ করতে দেখি যাতে সহসা বিষয়টা ধরা না যায়। ইংরেজি অনুবাদেও এরকম লুকোছাপার ব্যাপার নানা বিষয়ে দেখা গেছে। এমনটা করা হয় এই ভাবনায় যে, মানুষ পুরোপুরি ইসলামে নিবেদিত না হলে এই বিষয়গুলোকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হবে। তারা তাগুদি চিন্তা ও বিবেকবোধে যেভাবে নিমজ্জিত তাতে আল্লার বিধানকেই অবিশ্বাস করে বসবে। আমার মনে হয় ৪০-৫০ বছর আগের ওয়াজে হয়ত নানা কারণে ইসলামে খুনোখুনির ওয়াজ কম করা হত। তখন ইউটিউব ছিলো না বিধায় তখনকার রেকর্ড সংগ্রহের ব্যবস্থা ছিলো না। তবে এই বিষয়ে মিশ্র অভিজ্ঞতার কথা নানা জনের কাছ থেকে শুনেছি। সিলেটের একজনের কাছে শুনেছি ৪০ বছর আগে তিনি যখন বালক তখন তিনি রসূলের বিরুদ্ধকারীকে হত্যা করা জায়েজ এমন ওয়াজ শুনেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে এখন কেন সহিংস বিষয়গুলো ওয়াজে বেশি আসছে। এর দুটি কারণ বলে আমার কাছে মনে হয়, একটা হচ্ছে অনলাইনের কারণে নাস্তিকদের লেখালেখি, ভিডিও তৈরির মাধ্যমে ধর্মের যে নির্মোহ বিশ্লেষণ চলছে তাতে তারা নিজের অস্তিত্বহীনতাকে দেখতে পেয়েছে। রসূলের সমালোচনাকারী নাস্তিকদের হত্যা করা ওয়াজিব এটা ওয়াজে বেশি আসছে। নাস্তিকদের ফেইসবুক ইউটিউব ভিজিট করলে সাধারণ মুসলমান হয়ত ঈমান ধরে রাখতে পারবে না এই ভয়টা তো তাদের কাজ করেই। দ্বিতীয়ত, ইসলামকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রসালো করে উপস্থাপন করার কোন দরকার নেই। দ্বীন যেমন তেমন করেই মানুষকে জানাতে হবে। ইসলাম প্রচার করতে গিযে মুনাফেকি করা যাবে না। এই চরমপন্থা অবস্থানও ওয়াজে সহিংসতা আসার আরেকটা কারণ হতে পারে।
অবিশ্বাস: ব্লগার হত্যা শুরুর পর জানা গেলো জঙ্গিদের অনেকেই মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানি নামক এক ব্যক্তির খুৎবার বক্তব্য ও তার রচিত বই পড়ে জঙ্গিরা ব্লগার হত্যায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু ওয়াজ মাহফিলের বক্তা হিসেবে যারা অধিক পরিচিত, তাদের কারো নাম আসেনি। সেক্ষেত্রে জঙ্গিবাদের বিস্তারে ওয়াজ মাহফিলের কী ভূমিকা? ওয়াজ মাহফিল কি আসলে ধর্মের রক্ষণভাগের দায়িত্ব পালন করে? অর্থাৎ এমন একটা শ্রেণী তৈরি করে যারা জঙ্গিবাদের প্রশ্নে চুপ থাকবে, কিন্তু ধর্ম বিষয়ক যেকোন বিরুদ্ধমতকে তীব্রভাবে প্রতিহত করবে?
সুষুপ্ত পাঠক: গুলশান হামলার পর আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ ও তারিক মনোয়ারের নাম কাগজে এসেছিলো। আমি যতদূর জানি তরুণদের জঙ্গি হয়ে উঠার পিছনে তাদের ওয়াজকে দায়ী করা হলে এই দুজন যথাক্রমে দুবাই ও আমেরিকা অবস্থান করেন। সবচেয়ে বেশি যার নাম এসেছে তিনি জাকির নায়েক। তার টিভি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কয়েকটা দেশে। বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। তার পিস স্কুল বাংলাদেশে বন্ধ করা হয়েছে শুনেছি। জসিম উদ্দীন রাহমানি সংগঠক। তিনি যে মসজিদের খতিব ছিলেন সেটা ছিলো ধনী এলাকার মসজিদ। এলাকার ইমামকে সবাই খাতির করে। বিকেলবেলা অল্পবয়েসী ছেলেদের ডেকে মসজিদে নেয়ার বিষয়টা তো বাংলাদেশে ছিলোই। লজ্জ্বায় পরে বা অনুশোচনায় পড়েই হুজুরের ডাকে মসজিদে যেতে হয়। বৈকালিক বয়ানের মাধ্যমে জসিমউদ্দীন ছেলেদের প্রাথমিক দীক্ষা দিতে সক্ষম হন। আপনি ক্রিকেট শিখতে মাঠে যাবেন কোচের মাধ্যমে টেকনিক শিখতে। আর বড় ক্রিকেটার হবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ইউটিউবে বড় বড় ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং দেখবেন তারা কিভাবে ব্যাট চালায়। আবার টিভিতে খেলা দেখে মাঠে প্রক্টিসে গিয়ে খেলোয়ার হবার ইচ্ছা জাগতে পারে। যেমন ইন্টারনেটে সিরিয়াতে যোগাযোগ তৈরি হয়ে পরে স্থানীয় আইএসের এজেন্টের মাধ্যমে সিরিয়া যাবার ঘটনার কথা আমরা জানি। ওয়াজকে আমি প্রেরণা হিসেবে দেখি যে কিনা আগ্রহ তৈরি করে দিবে। ওয়াজ মাহফিল তো সদস্য সংগ্রহ করে না। ওয়াজ তা আপনি ময়দানে বসে শুনেন বা কম্পিউটারে- শুনে শুনে জিহাদে কতলে আগ্রহী হলে আপনি একজন জসিমউদ্দীন রাহমানির সন্ধান করবেন কারণ আপনাকে সংগঠিত হতে হবে। জাকির নায়েক সেই দায়িত্ব নিবে না। রাজ্জাক বিন ইউসুফকে তো আপনি হাতের কাছে পাবেন না। জঙ্গিবাদে চুপ আর ইসলামের বিরুদ্ধাচরণে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানো গোষ্ঠি আসলে আলোচিত ‘মডারেট মুসলমান’। ওয়াজ মাহফিল আয়োজনে হঠাৎ প্রশাসনে বাধা দিলে এরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। আবার ওয়াজে চিত্র তাদের দেখালে বলে, আরে এইসব কাঠমোল্লারা নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা দেয় যা ইসলাম সমর্থন করে না। তাহলে এইসব মনগড়া ব্যাখ্যা দাতাদের ওয়াজ তো পন্ড করে দেয়া উচিত তাই না? তখনই এদের ল্যাঞ্জা (ব্লগের ভাষায়) বের হয়ে যাবে। ওয়াজ এই মডারেট প্রজন্ম তৈরি করেনি। এটা তৈরি করেছে আধুনিকতা ও ধর্মীয় নির্যাসের অসামঞ্জস্যতার মিশ্রনে। ই্ংরেজ আমলে ধুতির উপর কোট চাপিয়ে যে কেরানীবাবু তৈরি হয়েছিলো, এ-ও তেমনি একটা জিনিস।
অবিশ্বাস: ইদানিং ওয়াজ মাহফিলগুলোতে মানুষের অংশগ্রহণ একেবারেই কমে এসেছে। দেখা যায় মঞ্চের সামনে গোটা পঞ্চাশেক মানুষ বসে আছে, কিন্তু চারপাশে এক দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত মাইক লাগিয়ে রেখেছে। এভাবে মাইক ব্যবহারের কারণে মানুষজনকে মাহফিল স্থলে আসার দরকার হচ্ছে না, নাকি মানুষ আসে না দেখে মাইকের এমন ব্যবহার হচ্ছে, আপনার কী মনে হয়?
সুষুপ্ত পাঠক: দর্শক একেবারে কমে গেছে কথাটা ঠিক না। ওয়াজ এখন বারোমাসী বিজনেস। একসময় কেবল শীতকালীন ছিলো। এখন হয় কি গ্রাম গুলোতে ১৪-১৫ বছরের উপরের কোন কিশোরকেই খুব বেশি একটা দেখবেন না। হয়ত বিদেশ নয়ত ঢাকা এসেছে জীবিকার প্রয়োজনে। যে কারণে গ্রামে বুড়ো আর অপ্রাপ্ত বয়স্ক জনগণের সংখ্যাই বেশি। দেশের যে পরিমাণ ধর্মান্ধতার চাষ হয়েছে তাতে ওয়াজের শ্রোতার সংখ্যা কমার কোন কারণ দেখি না। আমাদের মিডলইস্ট শ্রমজীবীদের মধ্যে ফেইসবুকে ওয়াজের পেইজগুলো ভীষণ জনপ্রিয়। এরকম পেইজ আছে শত শত। তারা দূর প্রবাসের কারণে অনলাইনে আশ্রয় নিয়েছে। দেশে থাকলে ঠিক মাহফিলে উপস্থিত থাকত। শহরে রিকশাঅলাদের একটা বড় অংশ বছরে একবার গ্রামে যায়। এদের মুখে শুনেছি বাড়ি গিয়ে এরা ফজরের ওয়াক্তে আর ঘুমাতে পারে না। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে একদল মুসল্লী লাঠি হাতে টিনের দেয়ালে শব্দ করে নাম ধরে নামাজের জন্য ডাকাডাকি করে মসজিদে নিয়ে গিয়ে নামাজ পড়ায়। মুখে দাড়ি না রাখার জন্য তিরস্কার করে। মানে বুঝা যাচ্ছে গ্রামে কি রকম করে একটা ইসলামিক পরিবেশ জেঁকে বসেছে। সেই প্রেক্ষিতে ওয়াজে লোক কম থাকার কোন কারণ নেই। কোন কোন ওয়াজে সেরকম চিত্র যদিও দেখা যায়। সেটা মনে হয় নানা রকম যৌক্তিক পরিস্থিতে ঘটে থাকে। একই সঙ্গে বলা জরুরী, ওয়াজ এখন সাতদিন ব্যাপী হচ্ছে। হুজুর হেলিকপ্টার দিয়ে মাহফিলে আসছেন। ওয়াজকারীদের সবাই নিজস্ব গাড়িতে চলাফেলা করেন। মসজিদে ইমামতি করে এরকম ইনকাম সম্ভব ছিলো না। ওয়াজের বাজার ভালো থাকার কারণেই ঘটছে। তবে এই ওয়াজই তাদের বারোটা বাজাবে। অনলাইনের ওয়াজের ভিডিওগুলো আমাদের হাতে পড়ে আমাদের এঙ্গেল থেকে যখন বিশ্লেষণ করে সেগুলো শেয়ার করি মানুষ তখন ভিন্ন একটা দৃষ্টিকোণ থেকে তা উপলব্ধি করতে পারে। আমরা যখন বলেছি নবী দুইজন দাসী ছিলো যাদের তিনি বিয়ে করেননি। লোকজন বিশ্বাস করবে কিনা দ্বিধা করেছে। কিন্তু ওয়াজের হুজুর যখন একই কথা বলছে তখন তাদের অবিশ্বাস করার কিছু নেই। আমরা সেই ভিডিও শেয়ার করে মানুষের কাছে তুলে ধরছি।
অবিশ্বাস: যারা ওয়াজ মাহফিল করেন, তাদের মাঝে কয়েকটা শ্রেণী আছে, আমরা জানি। এরমধ্যে বর্তমানে দু’টি শ্রেণীকে খুব সহজে শনাক্ত করা যায়। একপক্ষ বলে ইসলাম মানুষ হত্যার কথা বলেনি, আরেকপক্ষ বলে নাস্তিক বা মুরতাদ হত্যা করা মুসলমানদের কর্তব্য। এই দুই শ্রেণীর মাঝে এই ব্যবধানটা কি কৌশলগত পার্থক্য নাকি মতপার্থক্য? এমন পার্থক্যের কারণ কী?
সুষুপ্ত পাঠক: কৌশলগত পার্থক্য। এই কৌশলগত পার্থক্য গড়ে উঠেছে মতপার্থক্য থেকে। মানে হচ্ছে, সশস্ত্র জিহাদী দলগুলো যেমন মনে করে জিহাদের মাধ্যমে ইসলাম কায়েম করার সময় এসে গেছে কিন্তু ভোটের মাধ্যমে যে সব ইসলামিক দলগুলো এখনো খিলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, তারা মনে করেন এখনো সেই পরিস্থিতি আসে নাই যখন শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতা বদল করে ইসলামিক হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা যাবে। তবে কোন পক্ষই কিন্তু বলে না ইসলামে জিহাদ নেই বা ইসলাম কায়েম করতে চেষ্টা করা যাবে না। খেয়াল করুন ‘মানুষ হত্যা’ এটা কি কেউ সমর্থন করতে পারে? দাঙ্গাবাজ যুদ্ধাবাজ- এসব কি শুনতে ভালো লাগে? না ভাল অর্থে এসব ব্যবহার হয়? জঙ্গিবাদ ইসলামে আছে- এটা কি ওহাবীরাও স্বীকার করে? কেন করবে কারণ ইসলাম কখনই মনে করে না সে সন্ত্রাস করছে! ইসলাম আল্লার শাসনতন্ত্র দুনিয়ার জমিনে প্রতিষ্ঠা করতে জিহাদ করতে বলে, এটা করতে গিয়ে যে তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বাধা দিবে সেই হাতকে ভেঙ্গে দিতে হবে যদি শক্তি থাকে। এটাকে বলে আল্লার রাস্তায় জিহাদ করা। এটাকে আপনি বলছেন জঙ্গিবাদ, বলছেন মানুষ হত্যা, তারা কেন এই দাবী মেনে নিবে? জাকির নায়েকের পিস টিভিতে সব বক্তাই ইসলামে মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলত। খুনোখুনি ঝগড়া ফ্যাসাদ ইসলাম কতটা খারাপ চোখে দেখে সেটা বলত। কিন্তু এসব দুনিয়াবী ব্যাপারের সঙ্গে তারা তো জিহাদ কতলকে এক করে দেখে না। কিন্তু নবীর কটুক্তিকারীকে হত্যা করা ওয়াজিব- এই বিষয়টি নিয়ে ছোট্ট একটা গ্রুপ- যেমন ধরেন মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ তাকিয়াবাজী করেন। তিনি আবদুল্লাহ বিন সা’দ মুরতাদ হয়ে যাবার পরও মক্কা বিজয়ের দিন তাকে মুহম্মদ সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন দেখিয়ে দাবী করেন মুরতাদ হত্যা যদি বিধান থাকত তাহলে নবী সা’দকে কেন ক্ষমা করলেন। মাসুদ সাহেবের কথাতে দুর্বলতা আছে। সা’দ মুরতাদ হয়ে গিয়েছিলো বলেই মুহম্মদ তাকে ‘ক্ষমা’ করেছিলেন মানে সে অপরাধ করেছিলো। বুঝা যাচ্ছে ধর্মত্যাগ করা ছিলো তার জন্য একটা অপরাধ। আমরা জানি সা’দের জন্য প্রাণ ভিক্ষা করেছিলো তারই দুধভাই হযরত ওসমান। তার অনুরোধে মুহম্মদ শেষ পর্যন্ত তার প্রাণ ভিক্ষা দেয় নতুবা সা’দের নাম হত্যা তালিকার শীর্ষে ছিলো। মাসুদ সাহেবরা এটা করেন ইসলাম সম্পর্কে যাতে মানুষ খারাপ ধারণা না করে। উনারা মনে করেন ইসলামের খিলাফতের রাজনীতির ছিলছিলা সাধারণ মানুষ তাদের সীমিত জ্ঞান দিয়ে অনুধাবন করতে পারবে না। নানা রকম প্রবোধ দিয়ে ইসলামের সব রকম অন্ধকারকে তারা ঢেকে রাখেন। এই কাজটা বা কৌশলটা বেশ জনপ্রিয়। ইসলামের স্বার্থে এরকমটা করা জায়েজ। পাশ্চত্যের বেশ কিছু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে পরে ছেড়ে দিয়েছিলো। ইসলাম সম্পর্কে হুজুরদের থেকে যে কথা শুনে পরে তারা ইসলাম গ্রহণ করে ইসলাম স্টাডি করতে গিয়ে দেখে তা সম্পূর্ণ বিপরীত! তারা ইসলাম ত্যাগ করে বলেছিলো তাদের ভুল বুঝানো হয়েছিলো।
অবিশ্বাস: ব্লগার রাজীব হত্যার রায়ে মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানিকে হত্যার সাথে জড়িত হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়নি। যদিও হত্যাকারীরা বলেছে তারা রাহমানির বক্তব্য থেকেই হত্যায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে। আদালত বলেছে তদন্তকারী দল যেসব প্রমাণ উপস্থাপন করেছে, তাতে রাহমানির প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়নি। অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী ‘উদ্বুদ্ধকারী’ ‘প্ররোচনাকারী’দের অপরাধী হিসেবে দেখছে না। প্রকাশ্যে মানুষ হত্যার আহবানকারীদেরও অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করছে না। এর কারণ কী?
সুষুপ্ত পাঠক: বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের আদালত কি ভারতের আদালতের মত রায় দিতে সক্ষম? আদালত দেশকাল দেশের মানুষকে একেবারে মাথায় না রেখে রায় দিতে পারে তা আমি বিশ্বাস করি না। সমকামিদের পক্ষে ভারতীয় আদালত রায় দিয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সেখানে বাস করে। হিন্দু ধর্মও সমকামিদের বিরুদ্ধে নানা রকম শাস্তির বিধান দিয়ে রেখেছে। তবু এরকম রায় ভারতীয় আদালত দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি। সমকামি বিষয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের আদালত কি সমকামিদের পক্ষে রায় দিতে পারবে? বা এই বিষয় আদালত কি কার্যতালিকায় রাখবে নাকি ফেলে দিবে? বাংলাদেশের আদালত হুজুরদের ফতোয়া দেয়াকে বৈধ বলেছেন। একটা দেশে আইন আদালত থাকার পরও হুজুররা মুসলমানদের সামাজিক জীবনের উপর ফতোয়া কিভাবে দিবে? তাহলে হুজুরের ফতোয়া আর রাষ্ট্রীয় আইন সংঘর্ষিক হয়ে গেলো না? ভারতীয় আদালত কিন্তু সেখানকার মুসলিম নারীদের তিন তালাকের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে যা সরাসরি ইসলামী শরীয়া আইনের বিরুদ্ধে গেছে। তাই দেখা যাচ্ছে আদালত আসলে দেশকাল দেখেই রায় দেয়। জসিমউদ্দিন রাহমানি বক্তব্য থেকে যদি গুলশান ম্যাসাকারে অংশ নেয়া তরুণরা উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে কান টানলে মাথা আসার মত সামনে চলে আসবে জসিমউদ্দিন রাহমানি কার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন? তখন দেখা যাবে তিনি কুরআন হাদিস দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তারপর কী করবেন? জসিমউদ্দিন রাহমানিকে সাজা দিলে বাকী থাকল তার ধর্ম বিশ্বাস যা তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। দেখেন আদালতে এই বিষয়গুলি কিন্তু আসবেই যে জসিমউদ্দিন রাহমানিকে দোষী করা হয়েছে উশকানির জন্য। তখন প্রশ্ন উঠবে এই লোক কাদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিলেন? তদন্তকারী দল ঠিকই দেখেছে এই মুফতি সাহেব ইসলাম সম্পর্কে একজন বড় পন্ডিত ব্যক্তি। তিনি বই লিখেছেন। সেই বইয়ে তার কথার পক্ষে সহি ইসলামিক রেফারেন্স দেয়া আছে। তারা জানেন তাকে দায়ী করে বা তার সংম্পৃক্ত করে চার্জশীট দিলে আদালতে তাকে প্রশ্ন করা হবে তিনি কীসের ভিত্তিতে এ ধরণের কথা বলেছেন বা লিখেছেন। বেশ জটিল ব্যাপার।
অবিশ্বাস: বর্তমানে ওয়াজগুলোতে একটা প্রতিপক্ষ ধরে পরিকল্পিত ভাবে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়। আওয়ামীলীগ এই পরিকল্পিত বিদ্বেষের পুরোনো শিকার। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে ওয়াজের মঞ্চে দেখা যায়, এমনকি শামীম ওসমান, কামরুলরা মাহফিলে ওয়াজ করে। লীগ নেতাদের এমন আচরণ কৌশলগত, নাকি এরা সত্যিই ধর্মান্ধ হয়ে গেছে?
সুষুপ্ত পাঠক: ৯১ সালে নির্বাচনে হারার পর আওয়ামী লীগ থেকে রব উঠেছিলো ধর্মনিরপেক্ষতাকে আওয়ামী লীগের শত্রুরা সেটাকে ইসলাম বিরোধী হিসেবে প্রচার করে। পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আগে থেকেই উপমহাদেশের ওলামারা ক্ষিপ্ত ছিলো। তারা শেখ মুজিব ও তাজউদ্দিনকে কাফের মনে করত। সৌদির একজন প্রতিনিধি যখন ৭৪-৭৫ সালে ঢাকায় এলো তিনি বাইতুল মোকাররম পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখেন এত মানুষ এখানে নামাজ পড়ছে! সঙ্গে ছিলেন ডক্টর কামাল হোসেন, তাকে সেই সৌদি প্রতিনিধি বলেছেন, এত মানুষ নামাজ পড়ছে এখানে, শুনেছিলাম আপনারা মুসলমানদের নামাজ পড়তে দেন না…। এটা কামাল হোসেন এটিএন নিউজে নিজের মুখে বলেছিলেন। এরপর ৯১ সালের নির্বাচনে হারার পর কাগজে এসেছিলো, আওয়ামী লীগ নেতাদের বলা হয়েছে নিজ নিজ এলাকার মসজিদে সাপ্তাহে একদিন শুক্রবার নিয়মিত নামাজ পড়তে যাবে। নেতাদের মাথায় টুপি ধর্মকর্ম করার বিষয়ে তাগিদ দেয়া হয়েছিলো। আবদুস সামাদ আজাদ তারপর থেকে সব সময় মাথায় টুপি পড়ে থাকতেন। ঘটা করে তখন শেখ হাসিনার নামাজ পড়ার পোস্টার বের হলো। কারণ এর আগে বিএনপি এডিটিং করে শেখ হাসির হাতে শাখা ও মাথায় সিদুর পরিয়ে ভারতের একটা মন্দিরে ঘন্টা বাজাচ্ছে পোস্টার বানিয়েছিলো। সেই পোস্টার আমি দেখেছি। আমাকে দেখিয়েছিলো এলাকার বিএনপি করে যারা তারাই। হাসিনা যে হিন্দু সেটাই তারা প্রমাণ দেখাচ্ছিল আমাকে…। এটা আসলে খুব ট্র্যাজেডি আওয়ামী লীগের জন্য। আওয়ামী লীগ আসলে কখনই ধর্মহীন পার্টি ছিলো না। সাত মার্চের ভাষণ তারা শুরু করেছিলো কুরআন তেলাওয়াত করে। দেশ স্বাধীন হবার পর তারাই প্রথম দেশকে ইসলামিকরণে অনেকগুলো প্রজেক্ট হাতে নেয়। এখন শুনছি তারা রেডিও টেলিভিশনে আজান প্রচারের নির্দেশ দিয়েছিলো। যাই হোক, তবু আওয়ামী লীগ হিন্দুদের দল এই ‘অপবাদ’ থেকে বাঁচতেই লীগকে ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করতে হচ্ছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে নেতারা যে উপমহাদেশের ট্র্যাডিশন অনুযায়ী বুড়োকালে ধর্মীয় গোড়ামীতে আক্রান্ত হন নাই তা হলপ করে বলা যাবে না। যেমন ধরেন একটা বাচ্চার নাম রাখতে গিয়ে একজন রাখল ‘রামাদান’। এখান থেকেই তার বর্তমান রুচি ও ধর্মীয় পরিচয়টা আমরা পেয়ে যাই। সেই ব্যক্তি যদি রাজনীতিবিদ হন তাহলে তার ব্যক্তি রুচিটা অবশ্যই রাজনীতিতে আপনা আপনি চলে আসবে। সেটা যে এখন ঘটছে না তা নয়। তার মানে আমি মনে করি দুটো কারণই এখানে ঘটছে। তবে নিজেদের সেক্যুলার হিন্দুদের দল এই তকমা থেকে বেরিয়ে আসতেই রাজনীতিটা বেশি করছে বলেই মনে হয়।
(তৃতীয় ও শেষ অংশ)
অবিশ্বাস: বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম নির্বাচনের পূর্বে ওয়াজ মাহফিল নিষিদ্ধ করেছে নির্বাচন কমিশন। আগে সাধারণত মাদ্রাসা ভিত্তিক ওয়াজ বা ইসলামিক জলসা অনুষ্ঠিত হতো। এখন নানানভাবে, এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ওয়াজের আয়োজন করা হয়। এ বিষয়ে আপনি কী ভাবছেন? ওয়াজ কি তথাকথিত সেকুলার রাজনীতির নতুন অস্ত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে?
সুষুপ্ত পাঠক: এটা একটা বাস্তবতা বাংলাদেশ দেখিয়ে দিলো যে, ওয়াজ নির্বাচনের পূর্বে নিষিদ্ধ করেও নির্বাচন কমিশন নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়েছে হাটহাজারীর এক মোল্লার হুমকিতে! এদেশের কাঠামো কতখানি নতজানু মাদ্রাসার হুজুরদের কাছে, ইসলাম এখানে কতখানি জেঁকে বসেছে, রাষ্ট্র এখানে ধর্মের হাতে গ্রাস হয়েছে সেটা দেখিয়ে দিলো। আমার এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের প্রত্যেক বছর ওয়াজ আয়োজন করতে দেখতাম। নির্বাচন করবে ঢাকার কোন শিল্পপতি নিজ গ্রামে, তিনি চার পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে গ্রামে ওয়াজ করে নিজে প্রধান অতিথি হন। জনগণ এসব পছন্দ করে। কে নামাজ পড়ে, কে ইসলামি অনুষ্ঠানে টাকা খরচ করে এটাই তাদের কাছে বড়। যে কারণে ধনীদের এখন স্কুলের চাইতে মাদ্রাসা আর মসজিদ নির্মাণে বেশি আগ্রহী দেখা যায়। আগে স্কুল লাইব্রেরি করতে দেখা যেতো। স্কুল লাইব্রেরি কিছুই যেহেতু পরকালে যাবে না মসজিদ মাদ্রাসা ছাড়া তাই পাবলিক মসজিদ মাদ্রাসা হতে দেখলে খুশি হয়। রাজনীতি করতে গেলে ধর্মান্ধ জনগণ ও তাদের ধর্মীয় নেতাদের খুশি রাখতে হবে। এ কারণেই লীগের নেতাদের এখন ওয়াজের মাহফিলে চেয়ার নিয়ে বসে থাকতে হয়। শামীম ওসমান এখন সব সময় বলেন তিনি আল্লাহকে খুশি করতে রাজনীতি করেন। তিনি জনগণের কাছে ভোট চাইবেন না। যদি আল্লাহ চায় তিনি আবার এমপি হবেন তাহলে কেউ ঠেকায় রাখতে পারবে না। মজা হচ্ছে জনগণ তার এই কথার সঙ্গে দ্বিমত করতে পারে না! এভাবে চলতে থাকলে বামপন্থিরাও ওয়াজের ময়দানে যাওয়া শুরু করবে।
অবিশ্বাস: বর্তমানে ওয়াজ মাহফিল মূলত ফেসবুক ও ইউটিউব কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। ছোট ছোট ঘরোয়া মাহফিল রেকর্ড করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাড়া হচ্ছে। আবার অনেক সময় দেখা যায় কোন শ্রোতা নেই, বক্তা একা একা চিৎকার চেঁচামেচি করে যাচ্ছে। আপনার কি মনে হয়, তারা ফেসবুককে প্রচারের টুল হিসেবে ব্যবহার করছে, নাকি ফেসবুক ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছে?
সুষুপ্ত পাঠক: আমরা যখন ব্লগে লিখতাম, তখনো ফেইসবুক এতোখানি জনপ্রিয় হয়নি, তখন দেখতাম আমাদের সঙ্গে লাগতে আসা ইসলামিস্টদের সবাই শিবির করত। এরা শিক্ষিত ও আইটিতে বেশ দক্ষ ছিলো। তখনো কওমি গ্রুপ অনলাইনে কেউ আসেনি। একজনকে চিনতাম যে কওমি হুজুর আমাদের সঙ্গে আমার ব্লগে ব্লগিং করত। তবে আশ্চর্য যে এই কয়েক বছরে কওমি হুজুরদের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে ফেইসবুক কেন্দ্রিক। তাদের নতুন প্রজন্ম দেখেছে যুগের এই শক্তিশালী মাধ্যমে বাদ দিয়ে পড়ে থাকলে পিছিয়ে পড়তে হবে। মানুষ এখন ফেইসবুকে দেখে। টিভিও দেখে না। খবরের কাগজও পড়ে না। নিউজ যতটুকু পড়ে সবটাই ফেইসবুকের মাধ্যমে। তাই কওমি নিউজ পোর্টাল তারা খুলেছে অনেকগুলো। ওয়াজের পেইজ, হুজুরদের নিজেদের নামে পেইজ। এগুলো রীতিমত একটা টিম হিসেবে কাজ করে। তারা ফেইসবুককে প্রচারের একটা মাধ্যম হিসেবেই ব্যবহার করছে। আবার বাধ্য হয়েছে বলাও শ্রেয়। কারণ যুগকে তারা অস্বীকার করতে পারেনি। যে কারণে শুক্রবারে জুম্মার নামাজের খুৎবার বক্তব্য ইমাম তার পেইজের টিমকে দিয়ে ভিডিও করিয়ে আপলোড করাচ্ছে। এগুলো দেখে ওয়াজ আয়োজনকারী হুজুরের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। ভিডিওতে হুজুরের সঙ্গে যোগাযোগ করার ফোন নাম্বার থাকে। ফেইসবুক ছাড়া বিজনেসের এমন সহজ বিজ্ঞাপন আর কোথায় পাবে?
অবিশ্বাস: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ওয়াজের ভিডিওতে বেশ সহিংস, ঘৃণাশ্রয়ী ও অশ্লীল বক্তব্যের ব্যবহার দেখা যায়। ইসলামী বক্তাদের এমন উগ্র থেকে উগ্রতর হয়ে ওঠাকে আপনি কিভাবে দেখেন? উত্থান নাকি পতন?
সুষুপ্ত পাঠক: ওয়াজের প্রধান একটি বিষয় হচ্ছে নারী। সব ধর্মের টার্গেটই হচ্ছে নারীরা। ইসলামে পর্দার নাম করে তাকে প্রথমে ঘরে বন্দী করেছে। দ্বিতীয় পুরুষকে চার বিয়ে ও দাসী গমনের অনুমতি দিয়ে তাকে চরমভাবে অপমানিত করেছে। কিন্তু এটি যখন সে অনুধাবন করতে শুরু করবে তখন বিদ্রোহ করা ছাড়া পথ থাকবে না। যে কারণে হাদিসে নারীদের নবী সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, জাহান্নামে শুধু নারী আর নারী কিছু পুরুষ…। তার কারণ হচ্ছে তারা তাদের স্বামীদের অবাধ্য হয়েছে, পর্দা করেনি ইত্যাদি। ওয়াজে এগুলোই আসে। আপনি অনলাইনে নারীর পর্দা বিষয়ক যত ওয়াজ পাবেন তার মধ্যে চটির ফ্লেবার থাকবেই। নারী শরীর নিয়ে আদি রসাত্মক বর্ণনা দিয়ে বক্তা আজকের বেপর্দা নারীদের চলাফেরার উপর শ্রোতাদের পর্ণগ্রাফির বিনোদন দেন। ওয়াজে নারীকে নিয়ে অশ্লিল ইঙ্গিত ইদানিং বেড়েছে আগে ছিলো না- এরকম মতামতে আমি একমত নই। তবে রাজনৈতিক ইসলাম, অর্থ্যাৎ খিলাফত কায়েম করার জন্য মুসলমানদের জন্য জিহাদ ফরজ, সেক্যুলার রাষ্ট্র ধারণা কুফরি, গণতন্ত্র হারাম এরকম ওয়াজ এখন বেড়েছে। তার কারণ হচ্ছে ইসলামিক দল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হবার পর নিজেদের গুছিয়ে নেয়ার পরই তাদের প্রত্যেকের রাজনৈতিক লক্ষ নিশ্চিত করতেই ইসলামে মূল দর্শন খিলাফতকে যে যার পার্টির জন্য ব্যবহার করছে। দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পূর্বে উপমহাদেশের ওলামারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো এখন জিহাদ করার সময় নয় কারণ মুসলমান এখন বিধ্বস্ত, খর্বশক্তির। তাদের এখন নিজেদের গুছিয়ে নিতে, নিজেদের ঘেরাটোপে সুস্থির হবার পর মুসলমানদের উচিত হবে সশস্ত্র খিলাফত আন্দোলন শুরু করা। তখনই দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন থেকেই ওলামাদের ওয়াজ জলসা মাহফিলে ইসলামী শিক্ষা, মুসলিম আত্মপরিচয় ইত্যাদি বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছিলো বেশি। জিহাদ কতল করার মত পরিস্থিতি ছিলো না। কারণ আধুনিক যন্ত্র প্রযুক্তি হাতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা বোকামীর নামান্তর। যে কারণে একটা বড় সময় পর্যন্ত ওলামারা কেবল ইসলামী শিক্ষা আদব হারাম হালালের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলেন। আপনি দেখবেন এ কারণে আজকের ওলামারা মনে করেন দেওবন্দ, আলীয়া মাদ্রাসা ছিলো ইংরেজদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র। মুসলমানদের জিহাদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য তখনকার ওলামাদের দিয়ে এ দুটো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছিলো। আজকের দেওবন্দ ওলামাদের মুখের কথা এগুলোই। তাই এটাকে উত্থান বা পতন কিছুই বলছি না। ইসলাম ১৪০০ বছর ধরে তার হাদিস, তাফসির, সীরাত, কুরআন নিয়ে চলছে। জিহাদের কৌশল হিসেবে কখনো কখনো কোনটায় জোর বেশি দেয়া হয় কোনটায় জোর বেশি দেয়া হয় না। এখন ওয়াজে ভায়োলেন্স বেড়ে গেছে কারণ দেশে তাদের শক্তিমত্তা ও জনগণের সমর্থন দুটোই বেড়েছে।
অবিশ্বাস: ওয়াজের সংস্কৃতি আমাদের আবহমানকাল ধরে গড়ে ওঠা বাঙালি ও আদিবাসী সংস্কৃতিকে গ্রাস করেছে কিনা? আমাদের জারী-সারী-বাউল গানের আসর, নাটক, যাত্রা প্রভৃতির জায়গা দখল করে নিচ্ছে কিনা? উত্তরযদি হ্যাঁ হয়, তবে আমাদের সংস্কৃতির স্বরূপ রক্ষায় কার কেমন ভূমিকা রাখা উচিত?
সুষুপ্ত পাঠক: সোজা কথা বললে, কোন রাখঢাক রেখে কথা না বললে, বাঙালী সংস্কৃতি বলতে অতীতে যা ছিলো, এখন যা পরিবর্তিত রূপে আছে তার সঙ্গে ইসলামের সরাসরি সাংঘর্ষিক। দেখেন আদিবাসীদের বড় একটা অংশ খ্রিস্টান হয়েছে মিশনারীদের কাছ থেকে, তাদের কেউ তাদের সংস্কৃতিকে ত্যাগ করেনি। নামটা পর্যন্ত পরিবর্তন ঘটেনি। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করলে তার সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস, ইতিহাস ঐতিহ্য এমনকি পৈতৃক নামটা পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হতো। ভিএস নাইপাল এসব প্রত্যক্ষ করেছিলেন। মন্তব্য করেছিলেন, ইসলাম ভাষা ও সংস্কৃতির উপনিবেশ চালায়। আমি এ কথার প্রয়োগ দেখতে পাই। বাঙালী মুসলমানের দ্বিধা, স্ববিরোধীতার মূলেই এই উপনিবেশিকতা। সে তার জাতির অতীত ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে উত্তরাধিকার স্বীকার করতে পারে না। মধ্যযুগের যত মুসলমান কবি পাবেন তারা সবাই মক্কা মদিনার কাহিনী নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন। মুসলিম হিসেব হয়ত ইসলাম ধর্ম নিয়ে কাব্য করতেই পারে যেহেতু সেটা ছিলো ধর্মীয় মিথ নিয়ে মহাকাব্য রচনার যুগ। কিন্তু স্পেনে মুসলিম বিজয়ে পূর্বপুরুষের গৌরববোধকে আমি কি বলব? আমাদের বাউলদের মোল্লাদের হাতে নাজেহাল হবার ইতিহাস অনেক পুরোনো। তিন-চারশো বছর আগেও তাদের হাতে বাউলদের নাজেহাল হবার ইতিহাস গ্রামের লোকগানে পাওয়া যায়। বাউলদের ধরে চুল কেটে দেয়া, তাদের আশ্রমে আগুন ধরিয়ে দেয়া। কারণ তারা আল্লাহ রসূল নিয়ে মনগড়া বক্তব্য দেয় ইত্যাদি। তবু গ্রামের যাত্রা, পালাগান, বাউল গানের আসরে উপচে পড়ত মানুষ। হুজুরদের একটা অস্তিত্ব সংকট এরকম দৃশ্যে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় বলে মনে করি। বিগত ৫০ বছর ধরে ক্রমাগত যাত্রা, নাটক, গান, সার্কাস, বাউল, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদির বিরুদ্ধে ওয়াজ করে তারা গ্রামের মানুষদের মাঝে এগুলো জাহান্নামে যাবার রাস্তা এটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। তারপর নিজেরা প্রশাসনের উপর প্রভাব সৃষ্টি করার পর আইন দিয়ে মেলা, যাত্রা, গানের আসর বন্ধ করিয়েছে। বৈশাখী মেলা ছিলো গ্রামবাংলার সবচেয়ে বড় উৎসব মানুষের কাছে। এটা এখন বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে বিগত কয়েক বছর সরকার থেকে অনুমতি না দেয়ার কারণে। নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে শতবছরের পুরোনো বৈশাখী মেলাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। যাত্রাপালা, লালন উৎসব, বাউল উৎসব এরকম অনুষ্ঠান করতে দেয়া হচ্ছে না। তার জায়গায় ওয়াজ মাহফিল খালি মাঠে গোল দিচ্ছে। আমি এখনো মনে করি, ওয়াজ আর গানের আসর একসময় অনুষ্ঠিত হলে মানুষ গানের অনুষ্ঠানেই বেশি যাবে। এ কারণেই বারবার সরকারের কথা বলি। সরকার যদি এধরণের সংস্কৃতি ও প্রগতিশীলতাকে পৃষ্ঠপোষকতা করত তাহলে মানুষ হয়ত এতখানি মৌলবাদী চরিত্র পেতো না। আমাদের সংস্কৃতি মৌলবাদীরা সবাই ঢাকায় থাকে। মহিলা সমিতিতে নাটক করে একটা শ্রেণীকে শিক্ষিত করে তুললে কোন লাভ হবে না। ব্যান্ডের গান নিয়ে এক সময় বুদ্ধিজীবীরা নাক সিটকাতো। বাঙালী সংস্কৃতি বিরোধী একটা ব্যাপার তারা মনে করত। এই সংস্কৃতি মৌলবাদীরা কি করেছে তরুণদের জন্য বলেন? ৯০ দশকে তুঙ্গে থাকা ব্যান্ড সংগীত কনসার্ট করতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। যে প্রজন্ম আইয়ু্ব বাচ্চু মারা যাবার পর তার জান্নাত জাহান্নাম নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল বা একটা পাপীষ্ঠ মরেছে বলে উল্লাস করেছে তারা এই মাঝখানের ফাকা সময়টাতে বেড়ে উঠেছে যখন একতরফা ইসলামিক প্রচারেই দেখেছে। এটা আরো বাড়বে। কারণ আমাদের রাষ্ট্র গানবাজনা সংস্কৃতি নাটক এরকম বিষয়গুলো সারাদেশে পৃষ্ঠপোষকতা করছে না। ৫৬০টি মসজিদ করা হবে। এর ফল যা হবে নিশ্চয় ৫৬০টি শিল্পকলা একাডেমি গড়ে তুললে এক রকম হবে না? সোজা হিসাব। কাজেই আগামী ৩০ বছরের বাংলাদেশের কথা চিন্তা করলেই তো ভীত হতে হয়!
অবিশ্বাস: এবার জানতে চাইবো বাংলাদেশে ওয়াজ মাহফিলের ভবিষ্যত কী? নিকট ভবিষ্যতে ওয়াজ মাহফিলে কী কী পরিবর্তন আসতে পারে?
সুষুপ্ত পাঠক: আমাদের কেন, পুরো পৃথিবীই অনলাইন নির্ভর হয়ে গেছে। তাই আমার নিজের মনে হয় ওয়াজ মাহফিল ময়দানের চেয়ে মসজিদে বা হুজুরের ঘরের মধ্যে ধারণ করে ইউটিউব চ্যানেল আর ফেইসবুকে আপলোড কেন্দ্রিক হয়ে পড়বে। অনলাইনে ফতোয়া দিবে ওলামারা। তবে শুক্রবার যেহেতু আমাদের দেশের ছুটি উঠাবে না কেউ তাই এইদিন মসজিদেই ‘ওয়াজ মাহফিল’ সম্পন্ন হতে থাকবে। তারমানে এই না ওয়াজ মাহফিল এখনকার মত করে হবে না। প্রত্যেকটা মাদ্রাসায় এরকম ওয়াজ মাহফিল হয় সেটা তো তাদের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে থাকতেই। যদি বলেন ওয়াজের ধরণের কোন পরিবর্তন ঘটবে কিনা। সে ব্যাপারে বলতে পারি, ওয়াজ থেকে এখনই দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম ধরে বিষেদাগার করা হয়। দিনকে দিন দেখা যাবে এখান থেকেই মুরতাদ, বিদাতী, শিরকি হিসেবে ট্যাগ মেরে দিবে আর মানুষ ভিকটিমে পরিণত হবে। কারণ তাদের প্রভাব বাড়বে বই কমবে না। এককভাবে ওয়াজ মাহফিল তো কোন অপশন নয়, এমন তো নয় ওয়াজ বন্ধ করে দিলেই কোন ফল আসবে। আছে জুম্মার খুতবা। সেটা বন্ধ করে দিলো ফেইসবুক ইউটিউব আছে। মানে এর শেষ কোথায়? আপনাকে গোড়ায় হাত দিতে হবে। কোথা থেকে ওয়াজের মাল মশলা আসে? শেষ পর্যন্ত আমাদের কথা কি থাকে, উৎসে হাত দিন। কোন আইডিওলজিতে এরকম ওয়াজকারীর জন্ম হয় সেখানে হাত দিন। তাই ওয়াজ মাহফিল আদলে যেমনই পরিবর্তন ঘটুক- যদি রাষ্ট্র ধর্মকে এভাবেই পৃষ্ঠপোষকতা করে চলে তাহলে ওয়াজের ভয়াবহ জঙ্গি চেহারা আরো বাড়বে।
অবিশ্বাস: সর্বশেষ প্রশ্ন। দীর্ঘদিন ধরে ওয়াজ মাহফিলে বক্তাদের মূল নিশানা মুক্তচিন্তার মানুষজন। ওয়াজকারীদের সমস্ত আক্রোশ মুক্তচিন্তকদের প্রতি। এই আক্রোশ, এই আক্রমণ প্রতিহত করার প্রয়োজন আছে কিনা, থাকলে তা কিভাবে?
সুষুপ্ত পাঠক: এটাকে মুক্তিচিন্তুকদের ইনজয় করা শিখতে হবে। এটা আশান্বিত হবার মত ব্যাপার। প্রতিহত করার জন্যই আমরা লিখি বা ভিডিও বানাই বা লাইফ প্রোগাম করি। তবে সেটা ওয়াজ বন্ধ করে নয়, দমন কখনই ভালো ফল আনে না। তাদের প্রতিহত করা হবে আমাদের বেশি করে অনলাইনে ভূমিকা রাখা। ওয়াজগুলোকে কাউন্টার করা। কারণ সাধারণ যে ধর্মীয় বলয়ে থাকে সেখান থেকে জীবনেও ধর্মের বিষ চোখে দেখবে না। আমরা কি পৃথিবীতে থেকে বুঝতে পারি পৃথিবী ঘুরছে? পারি না কারণ পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ঘুরছি। তেমনি আজন্ম বিশ্বাস করা ঈশ্বর ধারণা আর নবী, অবতার ইত্যাদি জিনিসগুলো অসাড়তা তারা মুক্তভাবে চিন্তা করতে পারে না। তখনই পারে যখন আপনি তা ধরিয়ে দিবেন। আমাদের সেই কাজটা করতে হয় এবং অবিরাম করে যেতে হবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মুক্তচিন্তার প্রসারের জন্য লড়তে হয়। আমাদের প্রতি মোল্লা পুরোহিতদের ক্ষোভ থাকাটাই স্বাভাবিক। এটা তো তাদের রুটিরুজির বিষয়। আপনি সেই জিনিস হাটে হাড়ি ভাঙ্গছেন তারা কি বসে থাকবে?
অবিশ্বাস: আপনার যদি বিশেষ কিছু বলার থাকে।
সুষুপ্ত পাঠক: আপাতত বিশেষ কিছু বলার নেই।
অবিশ্বাস: এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে আলোচনা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ব্যস্ত জীবনের মূল্যবান সময় থেকে কিছু সময় আমাদেরকে দিয়েছেন, আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। ভালো থাকবেন। শুভকামনা।
সুষুপ্ত পাঠক: আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ।