স্রষ্টা বিষয়ক ভাবনাটা আসলে আমাদের কেমন? যদি চিন্তা করা হয়, কিভাবে এই স্রষ্টা বিষয়ক ধারণাটা বা অনুভূতিটা মানুষের মাথায় আসে? মানে সবাই তো নিজে থেকেই আপনা-আপনি অনুভব করতে শুরু করে না যে স্রষ্টা আছেন কিনা, দেখতে কেমন? বা তাঁর দয়া কেমন? রাগ কেমন? ব্যাপারটাতো বায়োলজিক্যাল নীড নয়। মানুষের মাথায় এই স্রষ্টার ধারণাটা প্রোথিত করা হয়। বাইরে থেকে ঢোকানো হয়। ধর্মবাণী, ধর্মাচার, ধর্মানুরাগ থেকে মানুষের মাথায় স্রষ্টা বিষয়ক ধারণা স্পষ্ট হতে থাকে। এই যে বাণী, আচার আর অনুরাগের কথা বললাম, এটার কিন্তু কোনো নিরেট মাত্রা নাই। এদের কঠোরতা যখন কম বেশি হয়, তখন স্রষ্টা বিষয়ক ধারণার ক্ষেত্রেও সেই পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে। কঠোর ধার্মিকের মনে স্রষ্টা বিষয়ক ভাবনা যতটা স্পষ্ট, দুর্বল ধার্মিকের মনে কিন্তু তেমন স্পষ্ট না। কঠোর ধার্মিক নিজের বিশ্বাসে, স্রষ্টার দয়া, কঠোরতা, বিবেচনার ধারণা পোষণ করেন। কিন্তু কম বিশ্বাসী ধার্মিক হয়ত আবছা ধারনা রাখেন, নিশ্চিত হতে পারেন না স্রষ্টা কতটা দয়ালু বা কঠোর ইত্যাদি।
স্রষ্টা বিষয়ক একক ধারণার যে ধর্মীয় মতবাদ আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে আছে, সেগুলোর দিক থেকে দেখলে স্রষ্টা একক, অক্ষয় অজর বিচারক। কিন্তু এই গুণাগুণ গুলোর বিস্তারিত যতটা জানা না যাচ্ছে, ধারণা কিন্তু প্রাথমিক স্তরেই থেকে যাচ্ছে। ধর্ম বিষয়ে অধিক জানা থাকার ফলে স্রষ্টার ইমেজ (ছবি নয়, চারিত্রিক প্রতিচ্ছবি বুঝিয়েছি) স্পষ্ট হতে থাকে। যেমন একজন ধার্মিক ধর্মজ্ঞানের সুবাদে জানেন যে চুরি করার কারণে স্রষ্টা কতটা শাস্তি দিতে পারেন, আর সেই শাস্তির কঠোরতা আর কষ্টের পরিমাপটাও আন্দাজ থাকে তার। তাই ধার্মিক পাপ কে ভয় পায়। পাপ বলতে সে বোঝে তার ধর্মের স্রষ্টার নিষেধ করা কাজ। অপর দিকে যে চোর, সে মনেই করে, চুরি কাজটাকে লোকে পাপ বললেও কাজটা তার প্রয়োজনীয়। তার মনে পাপবোধের কমতিই তাকে স্রষ্টার কঠোর শাস্তির ভয় থেকে দুরে রাখে। এমনও হতে পারে, তার মনে স্রষ্টার ইমেজে কঠোরতার পরিমাণ কম। তার মনে যে স্রষ্টার ইমেজ, সেটা অন্যদের মাত্রায় অনেক বেশি দয়ালু বা ক্ষমাশীল। হয়তো চোরটার মনে স্রষ্টার যে ধারণা, সেই ধারণায় বিচারকের ভুমিকায় থাকা স্রষ্টাকে অনুনয় বিনয় করলে তিনি ক্ষমা-টমা করে দিবেন, একটা আশা থাকে। তার স্রষ্টা কঠোর হবার প্রয়োজনই বোধ করেন না। যেমন চুরি করে ধরা পড়ার পর কারও পা ধরে মাফ টাফ চাইলে অনেকসময় ক্ষমা পাওয়াও যায়।
স্রষ্টা বিষয়ক এই যে ব্যক্তিগত ধারণার তারতম্যতা, এটা তাহলে স্রষ্টার সামগ্রিক ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কি? স্রষ্টাকে তো একক বলা হচ্ছে। তার সম্পর্কে পরিমিতিমূলক সংখ্যাও কোথাও দেয়া হয় নাই। স্রষ্টাকে অসীম দয়ালু আবার চুড়ান্ত কঠোর বিচারক বলা হয়েছে। এই অসীম আর চুড়ান্ত এর কি কোন মাপ ঝোকের বিজ্ঞান আছে? নাই তো। তাহলে এই অসীম আর চুড়ান্ত এর পরিমাপ হচ্ছে যিনি ভাবছেন তিনি কতটুকু ভাবছেন। একজন কয়েদীর চোখে একটা দেয়াল বিহীন খোলা হ্রদকে অসীম লাগে, আবার নাবিকের কাছে মহাসুদ্রকেও কখনো অসীম মনে হয় না। তার মানে এই ধারণার পরিমিতি কমেছে বাড়ছে মানুষ ভেদে। তাই এই দুই বিশেষণের ধারণা অভিজ্ঞতা ভেদে ভিন্নতা এনে দিচ্ছে।
তাহলে মনে মনে ধর্মবাণীর প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল হবার পরেও, অভিজ্ঞতার ভিন্নতা দুজনের মনে স্রষ্টার ক্ষমতা বিষয়ক ধারণায় ভিন্নতা এনে দিচ্ছে। সেদিক থেকে চিন্তা করলে, পৃথিবীতে যতজন আস্তিক আছে, ঠিক ততটাই ভিন্ন ভিন্ন স্রষ্টার ইমেজ আছে ততজন আস্তিকের বিশ্বাসে। এই সংখ্যাটা কাউন্টেবল। এই কাউন্টেবল নাম্বার থেকে ধর্মের ভিন্নতায় ক্যাটাগোরাইজ করলে পরে অল্প কিছু নাম্বারে নেমে আসবে। সে নাম্বারটা হচ্ছে যতগুলা ধর্ম ততগুলা ক্লাস্টার হবে। সেই ক্লাস্টারে বড় বড় অনুসারী গোষ্ঠির ধর্মগুলোর অধীনে বিলিয়ন বিলিয়ন স্রষ্টার ইমেজ পাওয়া যাবে। একটা ধর্মের একক স্রষ্টারই ইমেজ প্রতিটা মনে কিন্তু সমান মাপে নাই, সমান ইনটেনসিটিতে নাই। এখন ভেবে দেখা যাক নাস্তিক মনে তাহলে কি আছে? নাস্তিক বিশ্বাস করে স্রষ্টা নাই, তাই ইমেজও শূন্য। স্রষ্টার ইমেজ যেহেতু শূন্য তাই স্রষ্টা বিষয়ক কর্মবাচক ধারণাও তার নাই। তাই নাস্তিক পরকাল, বিচার, স্বর্গ, নরক কিছুই বিশ্বাস করে না।
তাহলে প্রশ্ন আসে, নাস্তিকের মনে কি তাহলে পাপবোধ নাই? সেটা তো আছে, সেটা কোথা থেকে আসলো? স্রষ্টাই যেহেতু নাই ভাবা হচ্ছে, তাহলে তো স্রষ্টার বিধি নিষেধ বলেও কিছু নাই। তাহলে নাস্তিক মনে পাপ বিষয়ক ধারণা আসে কোথা থেকে? আসলে স্রষ্টা ভাবনা নাই বলে, নাস্তিক মনের এই ধারনার জায়গাটার কোনো অটোমেটেড কমান্ড সিস্টেম তৈরী হয় না। নাস্তিক নিজেই এই ধারণার চালক হবার সুযোগ পান। তখন সেই নাস্তিক নিজ চিন্তা থেকে নিশ্চিত করেন তিনি কোন ধরনের সেটস্কিল ফলো করবেন। রাষ্ট্রের আইন আছে, সামাজিক আচার আছে, ব্যক্তিগত জ্ঞান অভিজ্ঞতা, চিন্তা আছে। নিজের মত করেই নাস্তিক ঠিক করেন তিনি কী করবেন, কী বর্জন করবেন। এক্ষেত্রে নাস্তিক মন সীমাবদ্ধতা বিহীন। মদে আসক্তি, মাংসে নিরাসক্তি, পরচর্চা বর্জন, পরপ্রেম হরণ সে করবে কি করবে না, এটা সম্পূর্ণ তার নিজ বিবেচনা। তার মনে দ্বিধা নাই। যদি পরকাল বলে কিছু থাকার ভয়ই না থাকে, তখন চিন্তা ভাবনা তো নগদ।
এদিকে যে কোন পরিমানে ধর্মবিশ্বাস ধারণকারী মানুষ নিজের প্রতিটা কাজেই নিজের ইচ্ছা-ক্ষমতা-অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করছে, কিন্তু ভেতরে স্রষ্টার ধারণার ভিন্নতার জন্য সমান সতর্কতা দেখা যাচ্ছে না। প্রভুত্বের ধারণা মানুষের মাথায় স্পষ্ট গেঁথে দেয়ার নজীর আছে মিলিটারীতে। প্রতিটা সোলজারের মাথায় স্পষ্ট ইমেজ তৈরী করে দেয়া হয় কমান্ডারের ইমেজ। কমান্ডারের প্রতিটি কথার আনুগত্য নিশ্চিত করার জন্য সবার মনে সমান ইন্টেন্সড ইমেজ তৈরী করা হয়। আর সে কাজ করার জন্য সব সোলজারকে সাম্যতা নিশ্চিত করা হয় সব রকমভাবে। সবার সাম্যতার ধারণা স্পষ্ট না হলে, সবার মনে কমান্ডার বিষয়ক ধারণাও তো সমান স্পষ্ট, সমান ক্ষমতার ইমেজ তৈরী হবে না। প্রতিটা সোলজার ট্রেনিং এর মাধ্যমে বিশ্বাস করতে শুরু করে, সে আর তার ব্যাচমেট সমান। সবভাবে, সবদিক থেকে সমান। এই সাম্যতার ধারণাই তার কামান্ডার বিষয়ক আনুগত্যের ধারণাকেও প্রভাবিত করে। তাই মিলিটারীতে কমান্ড এর প্রতি আনুগত্যের স্পষ্ট উদাহরণ দেখা যায়। আর সে কারণেই সবচেয়ে সফলভাবে অর্ডার পালন করে মিলিটারিরা।
আস্তিকদের ঝামেলা হচ্ছে স্রষ্টা বিষয়ক ধারণার ভিন্নতা আসলে তাদের যার যার ধর্মবিশ্বাসের কমান্ড সিস্টেমকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। ভিন্ন ধারণা পোষণ করার কারনেই একই কমান্ড সিস্টেমের নীচে থেকেও একই ধর্মের দুইজনের আচরণের, কর্মের, আনুগত্যের ভিন্নতা। স্রষ্টা বিষয়ক ধারণা ধারণ করার সফলতা আসতো, যদি একই ধর্মের কমান্ডের নীচে সবাই সাম্যতার ধারণাটা আগে ধারণ করতে পারতো। সাম্যতার ধারণাই স্রষ্টা বা প্রভুর ধারণাকে এক স্পষ্ট ইমেজে দাড় করাতে পারে, সবার মনে, সমান ভাবে। কিন্তু কনফ্লিক্টটা হচ্ছে সাম্যতার ধারণা তৈরী হবার ক্ষেত্রে আবার ধর্মীয় বাধা আছে। ধর্মপালন আর পাপাচার এর তালিকা সামনে নাড়ানোর কারনে, আগে থেকেই আত্ম-মূল্যায়নের এর একটা প্রেশার তৈরী হয়ে যায়। সেই প্রিবিল্ডেড প্রেশারের গ্রাউন্ডে স্রষ্টার ইমেজের ফাউন্ডেশানেও তারতম্যতা আসে। তাই সাম্যতা আসেনা, কখনো আসবেও না।
সবাইকে সমান ভাবতে পারলে, নিজের মনের খোদাকেও সবার খোদার সমান ভাবা যেত। যেহেতু সবাইকে নিজের সমান ভাবা যাচ্ছে না, তাই সবার মনে খোদা হয়ে আছে, তার তার মনের সাইজের। মুখে যদিও সবাই এক সমান খোদার কথাই বলতে চাচ্ছে। পৃথিবীর সব আস্তিকরা গোষ্ঠিবদ্ধ হয়ে নিজের নিজের স্রষ্টার একক যে ইমেজ বানানোর সংজ্ঞা খুজতে ব্যস্ত তা আসলে সারাজীবনেও শেষ হবে না। কারণ আস্তিকদের মনে সাম্যতার ধারণাই কখনো ঠিকভাবে তৈরী হয় না। যদি চিন্তায় সাম্যতা আসতো, যদি আসলেই মানুষ সার্বিকভাবে সাম্যতার ধারণা ধারণ করতে পারতো, তাহলে ধর্ম এবং স্রষ্টার এত রকম ধারণাই তৈরী হতো না। এমনকি আব্রাহামিক ধর্মের স্রষ্টার ধারণার ক্রমবিকাশেরও হয়ত প্রয়োজন হতো না। এই ধারণাটা একটা সার্কুলেটেড চিন্তা। মানুষের মনে স্রষ্টার ধারণা দেয়ার জন্য ধর্ম নামক সাম্যতা ভঙ্গকারী ধারণা জন্ম নিয়েছে। ধর্ম সামগ্রিক সাম্যতাকে ধংস করে, স্রষ্টার ধারণা দিয়ে নতুন সাম্যতার তত্ব নির্মাণ করে। সাম্যতার ধারণাকে অস্বীকার করলে ধর্ম টিকে, স্রষ্টা টিকে না। আবার স্রষ্টাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হইলে লাগে সাম্যতা, তাইলে আবার ধর্ম টিকে না। এই টানাটানিতে মানুষ একটা মাত্র প্রজাতি হয়েও শত শত রকমের স্রষ্টার বিলিয়ন বিলিয়ন আলাদা ইমেজ নিয়ে বেদিশা।