১৯৭২ সালের ১৯, ২০ ও ২১ আগস্ট তারিখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য সংসদের উদ্যোগে শেরে বাংলা ফজলুল হক হল মিলনায়তনে ধর্মনিরপেক্ষতার উপর তিন দিনব্যাপী এক আলোচনা চক্রের আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাংলাদেশ’ শিরোনামে আলোচ্য প্রবন্ধটি পাঠ করেন। ১৯৭৩ সালে আলী আনোয়ার সম্পাদিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বইয়ে প্রবন্ধটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিচার করে এই প্রবন্ধের বক্তব্য আজও প্রাসঙ্গিক এবং সেটা বিবেচনা করেই আমরা আমাদের সাইটে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাংলাদেশ’র অনলাইন ভার্সন প্রকাশ করলাম। অসাধারণ এই প্রবন্ধের জন্য আমরা লেখকের কাছে কৃতজ্ঞ।
ভূমিকাঃ
আমার প্রবন্ধের দু’টি ভাগ আছে। প্রথম ভাগে আমি আলোচনা করেছি কিভাবে গত পঁচিশ বছর ধরে বাংলাদেশে ধীরে ধীরে একটি ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারা জন্ম নিলো এবং বিকাশ লাভ করলো এবং দ্বিতীয় ভাগে আলোচনা করছি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ধর্মনিপেক্ষতা কিভাবে কতটুকু পালিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ভবিষ্যৎ কী ।
১৯৭১ এর মার্চ মাসে পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমাদের যখন লড়াই লাগলো তখন থেকে, এমনকি বোধ হয় লড়াই শুরু হওয়ার অব্যবহিত পূর্ব থেকে, আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা বলতে আরম্ভ করেছেন যে, তাঁরা অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী এবং পাকিস্তানের ভিত্তি যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর সেটা ছিলো ঘোর মিথ্যা। অতিশয়োক্তি বাঙালিদের চরিত্রের প্রধান দুর্বলতা। সে জন্যেই আমরা হঠাৎ অতো বড়ো একটা অমূলক দাবি করে ফেলি যে, আমরা একান্তভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। এমনকি আতিশয্যবশত একথাও ভুলে যাই যে, আমরাই পঁচিশ বছর আগে বিপুল উৎসাহের সঙ্গে মুসলিম লীগকে ভোট দিয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিলাম। সেদিন এদেশের আপামর প্রায় সব মানুষই বিশ্বাস করতেন, ভারতবর্ষে মুসলমানরা একটা স্বতন্ত্রজাতি আর একটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের তাদের আছে জন্মগত অধিকার। ধরে বেঁধে আমাদের কেউ মধ্যপ্রাচ্যের একটি জাতির -যাদের পোশাক, পরিচ্ছদ, রুচি, রুজি, ভাষা, সংস্কৃতি সব ভিন্ন রকমের -তাদের সঙ্গে একই জোয়ালে জুড়ে দেয়নি। আমরা স্বেচ্ছায়ই তাদের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম –ভাই বলে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে তাঁদের মিল ছিলো কেবল ধর্মের, তারা আমাদের ধর্মের ভাই।
সেদিনের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে একথাটা ছিলো সম্পূর্ণ সত্য। কিন্তু ইতিহাস সৌভাগ্যক্রমে একঠাঁই দাড়িয়ে থাকে না। সে নিয়ত চলছে সামনের দিকে। কখনো কখনো কেউ কেউ চেষ্টা করেন ইতিহাসের চাকাকে আটকে দিতে, অথবা উজান পথে চালাতে। কোনো কোনো আত্মতুষ্ট ব্যক্তি কখনো কখনো ভাবেনও যে, তাঁরা বোধ হয় ইতিহাসের গতিকে রুদ্ধ কিংবা বিচলিত করতে পেরেছেন। কিন্তু ইতিহাস তখন, প্রকৃতপক্ষে, অশ্রুত অট্টহাস্যের সঙ্গে এগিয়ে চলে। পরিণতিতে একদিন আইয়ুব খান-মোনেম খান-ইয়াহিয়া খান-ভুট্টো সাহেবরা আবিষ্কার করেন যে, ইতিহাসের গতি তাঁরা রোধ করতে পারেননি, বরঞ্চ তারা গুঁড়িয়ে গেছেন তার চাকার তলায়। জনাব জিন্নাহ কদিন আগেও এদেশের জাতির জনক ছিলেন। তার দ্বিজাতি-তত্ত্বকে পরবর্তী নেতারা বাঁচিয়ে রাখতে প্রাণপণ কোশিশ করেছেন—আখেরে লাভ হবে বলে। কিন্তু পারেননি। মহাকালের তুলনায় অত্যল্প কালের মধ্যে দ্বিজাতি-তত্ত্ব ব্যর্থ হয়ে গেছে।
এই ব্যর্থতার একটি ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। খুঁজতে গেলে সে ধারার একটি উন্মেষ যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি তার বিকাশের পথটাও অনাবিষ্কৃত থাকে না। শুরুতেই বলেছি, আমাদের জাতীয়তার ভিত্তি ছিলো ধর্ম। নানা ঐতিহাসিক কারণে তখন সমাজ-অর্থনৈতিক জীবনে হিন্দু মুসলমানের সমকক্ষতা ছিলো না। ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় একজন ছিলো মহাজন, অন্যজন খাতক; একজন জমিদার, অন্যজন রায়ত, একজন শিক্ষিত, অন্যজন নিরক্ষর। সমাজের এই উচু নীচু পথে মহাকালের রথ বেশি দিন চলতে পারে না। সে জন্যেই ১৯৪৭ সালে ভেঙে পড়েছিলো কংগ্রেসের তথাকথিত সেকুলার স্টেটের পরিকল্পনা। জন্ম নিয়েছিলো সমাজের নীচু তলার মানুষদের এক ঐক্যজোট। এই মানুষগুলো সেদিন কিন্তু ঠিক শ্রেণী সচেতনতা থেকে ঐক্যবদ্ধ হননি, কেন না সে শিক্ষা ও সচেতনতা তাদের ছিলো না; তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন সাম্প্রদায়িক সচেতনতা থেকে। অবশ্য এর পেছনে কাজ করেছে সমাজ-অর্থনৈতিক বৈষম্যই। তবে সেদিন তাদের যারা ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, তারা তা করে ছিলেন ধর্মেরই নামে।
ধর্মের নামে মিলিত হয়ে পূর্ববাংলার মানুষেরা ভেবেছিলেন এবারে তাদের অবস্থার উন্নতি হবে। ইসলামের সাম্য মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শ অনুসারে এবারে সুবিচার পাবেন তারা। কিন্তু পাকিস্তান লাভের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই তাদের প্রত্যাশায় ঘা লাগলো। কি? না, দেশের অধিকাংশ মানুষ যে-ভাষায় কথা বলেন, গণতান্ত্রিক দেশ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সে ভাষা স্বীকৃতি পাবে না, রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। কিন্তু এটাকে ঠিক ইসলামি ন্যায়বিচার বলে চালানো গেলো না। সুতরাং পাকিস্তানের জন্মের সাত মাসের মধ্যে বাংলা ভাষার আন্দোলনে ঢাকা এবং প্রদেশের অন্যান্য স্থান বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। মুহম্মদ আলি জিন্নাহ সে সময়ে এসেছিলেন ঢাকা সফরে, পিতার চোখ রাঙানিও সে বিক্ষোভকে অবদমন করতে পারলো না। আরো সাত মাস পরে এলেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলি খান। তিনিও শুনলেন, ছাত্ররা অখুশি।
কিন্তু, তবু, আরো চার বছরের আগে এ আন্দোলনটা রীতিমতো দানা বাঁধতে পারেনি। তারপর এক ফেব্রুয়ারি মাসে অগ্ন্যুৎপাতের মতো ছড়িয়ে পড়লো ভাষা-আন্দোলন। তার লাভাস্রোতে চাপা পড়লে দ্বি-জাতিতত্ত্ব, জন্ম নিলো ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা; স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থায় চিড় ধরলো, সূচিত হলো গণতান্ত্রিক সংগ্রাম; সংস্কৃতিক্ষেত্রে মোল্লাপুরুতের দাড়ি-টীকি ঢাকা পড়লো, এক সেকুলার সংস্কৃতির বীজ রোপিত হলো।
আসলে ভাষা-আন্দোলন আলাদা-আলাদাভাবে রাজনৈতিক স্বাধিকার তথা গণতান্ত্রিক আন্দোলন, বাঙালি জাতীয়তার আন্দোলন এবং অসাম্প্রদায়িকতার আন্দোলন। আর একত্রিতভাবে ভাষা-আন্দোলন গণতান্ত্রিক আন্দোলন—কেন না, যথার্থ গণতন্ত্রে সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মের কোনো আলাদা আসন নেই; কেন না, গণতন্ত্রের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের কোনো বিরোধ নেই; কেন না, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। বস্তুত পক্ষে, ভাষা আন্দোলন যেদিন শুরু হলো সেদিনই বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে এবং পাকিস্তানের পতন আরম্ভ হয়েছে। তারপর ভাষা-আন্দোলনই ১৯৫৭, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১-এর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিণতিতে পৌছেছে।
একটা দিন ছিলো যখন বাঙালি মুসলমানরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গর্ব করা দূরে থাক, বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকার করতে পর্যন্ত কুণ্ঠিত হতেন। বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা উর্দু না বাংলা এ নিয়ে বর্তমান শতাব্দীর প্রথম পঁচিশ-তিরিশ বছর পর্যন্ত যথেষ্ট বিতর্ক চলেছে। মুসলমানদের সে সময়কার সাময়িকপত্রসমূহে তার অভ্রান্ত স্বাক্ষর আছে। কিন্তু ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু হবার পর মুসলমানরা বাংলাকে কেবল যে তাদের মাতৃভাষা বলেই স্বীকার করলেন তা-ই নয়, উপরন্তু বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য নিয়ে তারা রীতিমতো গর্ব প্রকাশ করেন। এবং এ ভাষার অধিকার কেড়ে আনার জন্যে তারা জান পর্যন্ত কবুল করলেন।
এইভাবে বাংলা ও বাঙালিত্ব নিয়ে আন্দোলন শুরু করার পরেই তাঁরা দেখলেন, তাঁদের পশ্চিম পাকিস্তানি ভাই -এরা যদিও মুসলমান, কিন্তু তাদের ভাষাটা আলাদা। দেখলেন, পূর্ব ও পশ্চিমের সংস্কৃতিচিন্তায় মিল সামান্যই। প্রকৃত পক্ষে, অনেক অমিল সম্পর্কেই তাঁরা সচেতন হলেন। মিল খুঁজে পেলেন কেবল ধর্মের ক্ষেত্রে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও তাঁরা লক্ষ্য করলেন -ধর্মীয় ঐক্য সত্ত্বেও, পশ্চিম পাকিস্তানিরা ইসলাম ধর্মীয় সাম্য মৈত্রীর আদর্শের দ্বারা চালিত হয়ে বাঙালিদের ন্যায় অধিকারকে স্বীকার করছে না। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবিচারের মুখে কদিন টিকে থাকে ধর্মের এই ঠুনকো ঐক্য? সুতরাং, একদিন, আমরা যাদের পরম আত্মীয় বলে মেনে নিয়েছিলাম, তাদের প্রতি আমাদের বাঁধন ধীরে ধীরে আলগা হলো।
কিন্তু বিশ্বপ্রকৃতির নিয়ম এই যে, নদীর এক তীর ভাঙলে অন্য তীর গড়ে উঠে। এই স্বাভাবিক নিয়ম মেনে অতঃপর অন্য দিকের ছিন্ন সম্পর্কে আবার জোড়া লেগেছে, ফলে নতুন মৈত্রী এবং সমঝোতা বেড়ে উঠেছে নতুন উপলব্ধির পলিতে-গড়া সত্যের মাটিতে।
একদিন অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক অবদমন এবং সামাজিক বৈষম্যের মুখে আমরা হিন্দুদের প্রতি বিরূপ ছিলাম। প্রবল বিদ্বেষের সেই ক্ষণে, এ কথাটা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিলাম যে, ধর্মের অমিল এবং সামাজিক অসাম্য সত্ত্বেও, হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতিতে ঐক্য ছিলো যথেষ্ট। সে ঐক্য প্রতিফলিত হয়েছে এ দেশের ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, জ্যোতিষ এবং ইতিহাস চর্চায়। সে সময় প্রতিবিম্বিত হয়েছে শ্রীচৈতন্যের প্রবর্তিত বৈষ্ণব আন্দোলনে, কবীর-দাদু-লালন শাহ-মদন-হাসান রাজার বাউল সাধনায় এবং অসংখ্য সহজিয়ার দর্শনে। এই ঐক্যসূত্র ধরেই পূর্ব বাংলার মুসলমানরা আবিষ্কার করেন, ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও, আবহমান বঙ্গীয় সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের মিল অনেকখানি।
এই নতুন পাওয়া যুক্তিবাদী এবং উদার দৃষ্টি দিয়ে, বাঙালি মুসলমানরা নিজেদের দেখতে পেলেন যথার্থস্বরূপে। তাদের দৃষ্টি আরব-ইরানের খেজুরতলা থেকে ঘরমুখো হলো; বদরুদ্দীন উমরের ভাষায়, তাঁরা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন। ধর্মের দ্বারা নিজেদের জাতীয়তাবাদকে শনাক্ত করার প্রবণতা তাঁদের হ্রাস পেলো। তার পরিবর্তে, তাঁরা নিজেদের চিহ্নিত করলেন বাঙালি বলে।
একবার ধর্মের আচ্ছন্ন দৃষ্টি কাটিয়ে ওঠাই শক্ত। কিন্তু উঠতে পারলে তখন মানুষ আর কথায় কথায় সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতিতে ধর্মকে টেনে আনে না। ধর্ম থাকে তাঁর ব্যক্তিজীবনে, এবং পালপাৰ্বণরূপে সমাজজীবনে। এজন্যেই দেখতে পাই, ভাষা-আন্দোলনের পর থেকে ধীরে ধীরে এদেশের মুসলমানরা গাইতে শুরু করেছেন রবীন্দ্রনাথের গান -আমার সোনার বাংলা, ডি. এল. রায়ের গান-ধন-ধান্যে-পুষ্পে ভরা, অতুলপ্রসাদের গান-মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা। রবীন্দ্রনাথ, ডি.এল. রায় এবং অতুলপ্রসাদের ধর্মীয় বিশ্বাস তাঁদের সাহিত্যিক গুণাগুণ বিচারে আর প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠেনি।
বস্তুত পক্ষে, বাঙালি হতে গিয়ে আমরা অসাম্প্রদায়িক হয়েছি; অসাম্প্রদায়িক হওয়ার ফলে বাঙালি হতে পেরেছি এবং সর্বোপরি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হতে গিয়ে, সব-ধর্মে-বিশ্বাসী মানুষদের সমান মর্যাদা দেওয়ার শিক্ষা পেয়েছি।
অসাম্প্রদায়িক হতে পারার আরো কারণ ছিলো-সেগুলো প্রধানত শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক। এদিকে শিক্ষা এবং অর্থনীতিও পরস্পর অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত—সুতরাং বলা যেতে পারে, জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিক আদর্শ ছাড়া, অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের অন্য প্রধান কারণ হলো অর্থনৈতিক।
আগেই উল্লেখ করেছি, দেশবিভাগের পূর্বে এ অঞ্চলের মধ্য-ও উচ্চবিত্তের অধিকারীরা প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু, মুসলমানরা ছিলেন নিম্ন বিত্তের অধিকারী। সুতরাং, সম্প্রদায়হিশেবে মুসলমানরা হিন্দুদের দ্বারা শোষিত ছিলেন। তা ছাড়া, হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা এতো নগণ্য ছিলো যে, তাঁরা একটা প্রবল হীনমন্যতায় সর্বদা কাতর থাকতেন।
দেশবিভাগের পরে অবস্থা গেলো পাল্টে। সমর্থ ও প্রচুর সংখ্যক হিন্দুদের অনুপস্থিতিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা কমে গেলো এবং বাড়লো প্রচুর সুযোগ। শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানরা দ্রুত এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। একটা দৃষ্টান্ত দিলে এই অগ্রগতির পরিমাণটা বোঝা যাবে। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৪ সাল এই পাঁচ বছর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ও আসামের গড়পড়তা ৭ হাজার করে মুসলমান ছাত্র-ছাত্রী ম্যাটিক পরীক্ষা দিয়েছেন। তুলনায় ১৯৭২ সালে গৃহীত ১৯৭১ সালের প্রবেশিকা পরীক্ষায় একমাত্র পুর্ব বাংলা থেকেই মোট ৩ লক্ষ মুসলমান ছাত্র-ছাত্রী অংশগ্রহণ করেন। তার মানে ৩০ বছরের মধ্যে মুসলমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় পঞ্চাশ গুণ। এই মুসলমানরা শিক্ষিত হয়ে স্বাভাবিক নিয়মেই অথনৈতিক দিক দিয়েও কিঞ্চিৎ অগ্রসর হয়েছেন। প্রকৃত পক্ষে, ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকুরির ক্ষেত্রে বর্ধিত সুযোগ-সুবিধের মুখে ধীরে ধীরে একটি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠেছে। হিন্দুরা আর তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে গণ্য হলেন না; কিংবা হিন্দুদের তুলনায় অথনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়েও তারা পিছিয়ে থাকলেন না। ফলে, উভয় সম্প্রদায়ের ভেতরকার বিদ্বেষ স্বভাবতই হ্রাস পেলো। তা ছাড়া, শিক্ষা বিস্তারের ফলস্বরূপ মুসলমান-সমাজ মনের ঔদার্যও স্বীকরণ করলেন। হোক না মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক পাঠক্রম আর পাঠ্যপুস্তক, তবু এই শিক্ষার পথ ধরেই দৃষ্টির প্রসারতা এসেছে।
অবশ্য বলা যায়, শুধুমাত্র শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নতির দ্বারাই মুসলমানরা হয়তো এতো শীঘ্র অসাম্প্রদায়িক এবং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তায় বিশ্বাসী হতে পারতেন না। পরিবর্তনটাকে আসলে দ্রুত করেছে পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শোষণ। সেই শোষণের অনিবার্য ফলস্বরূপ আমরা জোট বেঁধেছি,—কিন্তু কী বলে? মুসলমান বলে? তা হলে তো ওদের থেকে পার্থক্য দেখানো চলে না অথবা উদবুদ্ধ হওয়া যায় না প্রবল এক জাতীয়তাবাদী ঐক্যবোধের দ্বারা। সুতরাং, আমরা বলেছি, আমরা বাঙালি, সেই আমাদের প্রথম এবং সব চেয়ে বড়ো পরিচয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের কালে, পশ্চিমী কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এক লাখ নরপশু লেলিয়ে দিয়ে যেভাবে ধর্মের নামে চরম অধর্ম করেছে, সে-ও একটা কারণ, যা আমাদের আস্থাহীন করেছে ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রতি।
এই হচ্ছে বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনা তথা ধর্মনিরপেক্ষতার উন্মেষ ও বিকাশের গোড়ার কথা। এই পথেই ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের জন্ম ।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতিহিশেবে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণ করার পরে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে মাত্র ন মাস, এরই মধ্যে আমাদের সামাজিক জীবনে এমন সব লক্ষণ ফুটে উঠেছে যাকে সুস্থ মানসিকতার প্রকাশ বলে মনে করতে পারিনে। আইয়ুব-ইয়াহিয়ার আমলে আমরা যেমন অনেকে ধর্মনিরপেক্ষতার কথায় সোচ্চার হয়েছি, ধর্মনিরপেক্ষতার এ কালে তেমনি অনেকেই সাম্প্রদায়িক আচরণ করছি। অবশ্য সেটা কিছু অস্বাভাবিক নয়। এ দেশের সব মানুষ লড়াই-এর আগে যেমন অসাম্প্রদায়িক হতে পারেননি, তেমনি লড়াই-এর পরে পরিবর্তিত পটভূমিতে অনেকেই আবার নতুন করে সাম্প্রদায়িক হয়েছেন, অথবা বিশেষ পরিবেশে তাদের মধ্যকার যে সাম্প্রদায়িক চেতনা ঘুমিয়ে পড়েছিলো, তা-ই আবার নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলেন শতকরা ৮২ জন। এরা তাই বলে সবাই অসাম্প্রদায়িক নন, এমন কি সবাই বোধ হয় বাংলাদেশও চাননি চেয়েছিলেন স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তান। শতকরা চারজন ভোট দিয়ে ছিলেন ন্যাপকে। আর বাকি শতকরা চোদ্দ জন ভোট দিয়েছিলেন ইসলাম-পসন্দ, দলগুলিকে। তার অর্থ দাড়ায় এই যে, এ দেশের শতকরা ১৪ জন মানুষ রীতিমতো ধর্মীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী। আপন ধর্মীয় স্বাতন্ত্র ও শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী লোকের সংখ্যা নিশ্চয় আরো বেশি। এদের সংখ্যা যদি শতকরা আরো মাত্র ১৪ জন হয়—তা হলেও দেশের কমপক্ষে শতকরা ২৮ জন ধর্মান্ধ। তার মানে দাঁড়ায় এই যে, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ দেশের ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ এখনো ধর্মীয় গোঁড়ামি ছাড়তে প্রস্তুত নন।
ভারতের সঙ্গে অর্থাৎ হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশের সঙ্গে রাজনৈতিক মৈত্রী স্থাপন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা স্বীকার করার পরে পূর্বোক্ত ২ কোটি ১০ লাখ এবং আরো অনেকে একটা নিরাপত্তাহীনতার মানসিকতার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁরা আশঙ্কা করছেন, বাংলাদেশ হয়তো ধীরে ধীরে রাজনৈতিক দিক দিয়ে ভারতের কুক্ষিগত হবে এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়েও ভারতের বাজারে পরিণত হবে। এবং তার ফলস্বরূপ বিভাগ-পূর্ব দিনগুলির মতো হিন্দুরা পুনরায় প্রাধান্য পেয়ে বসবেন এবং মুসলমানরা শোষিত হবেন। এই আশঙ্কা থেকে দেশের অর্ধেক লোকই হয়তো এক নয়া-সাম্প্রদায়িকতার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছেন। বর্তমান সময়ের ক্রমবর্ধমান ভারত বিরোধী মনোভাব আসলে এই সাম্প্রদায়িকতারই ঘোমটা-পরা আর এক রূপ।
প্রকৃত পক্ষে, বাংলাদেশ সরকার যখনি ঘোষণা করেছেন যে, এ দেশের নাম ইসলামিক রিপাবলিক -রিপাবলিক হলে নানা ধর্মের মানুষের যে-দেশে বাস তা তত্ত্বত কখনোই ইসলামিক হতে পারে না -ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ হবে না—উপরন্তু তা হবে ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমাজতান্ত্রিক, সেই মুহুর্তেই এ দেশের জনগণের একটা বিরাট অংশ আঁতকে উঠে ভেবেছেন, ইসলাম বোধ হয় বিপন্ন হলো। অতঃএব জেহাদ শুরু করে। সেই জেহাদই শুরু হয়েছে নানা পথে। দু-একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে ।
ভাসানী সাহেব দীর্ঘকাল আগে থেকে বামপন্থী রাজনীতিক মতবাদ প্রচার করে আসছেন, এমন কি এ-ও বলা যায়, কখনো-কখনো তিনিই বামপন্থী রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়েছেন। আজ হঠাৎ তিনি তার তাঁর রাতারাতি বদল করতে পারেন না। সুতরাং, জেহাদের কথা মনে রেখেই তিনি তাঁর নীতির কিঞ্চিৎ সংশোধন করে বলেছেন, আমরা ইসলামি সমাজ তন্ত্র চাই। সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা যারা জানেন, তাঁরা জানেন, এরকমের সোনার পাথরের বাটি কোথাও নেই, থাকতে পারে না। আসলে তিনি সমাজতন্ত্রের নামে সাম্প্রদায়িকতার প্রচার করেই ক্ষমতা দখলের শট কাট পথ খুজছেন। তার এই মানসিকতা অভ্রান্তভাবে প্রকাশ পায়, যখন তিনি বলেন, যেহেতু এদেশের ৮৬ জন মানুষ মুসলমান (কথাটা ঠিক নয়), সুতরাং শাসনতন্ত্র হবে ইসলামি।
বাংলাদেশ সরকার যে সাম্প্রদায়িক দলগুলিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন, তার সদস্যরা হঠাৎ রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন, এমন মনে করলে ভুল হবে। এরাই কেউ ভাসানী সাহেবের পতাকার নীচে, কেউ মুজাফফর সাহেবের পতাকার ছায়ায়, কেউ-বা আওয়ামী লীগের নামে – আপনার সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প সমাজে ছড়াচ্ছেন। ছাত্রদের মধ্যেও ঘটেছে এ ব্যাপারটা-ইসলামি নীতিতে বিশ্বাসী ছেলেরা আজ অন্য দলের সঙ্গে মিশে কেবল সে দলকে জয়ী করাননি, সঙ্গে সঙ্গে তাদের চির দিনের প্রগতিশীল চরিত্রকে পর্যন্ত বিচলিত এবং বিভ্রান্ত করেছেন। আমাদের সমাজের জন্যে এর থেকে বড়ো দুর্ভাবনার ও দুর্ভাগ্যের বিষয় আর নেই। যে প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে পূর্ব বাংলার সকল আন্দোলন পরিচালনা করেছেন—এক কথায় জন্ম দিয়েছেন বাংলা দেশের, তাঁরা যদি ক্ষমতার লোভে কমপ্রোমাইস করেন প্রতিক্রিয়াশীলতার সঙ্গে, তার চেয়ে নৈরাশ্য ও বেদনার আর কিছু থাকতে পারে না। অতঃপর আমরা অন্য কারো ওপর ভরসা কিংবা আশা করতে পারবো না।
ভাবলে অবাক হতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ছাত্ররা মাদ্রাসা শিক্ষার জন্যে দাবি করছেন। তাঁরা কি ভেবে দেখেছেন, এর যথার্থ ফলটা কী? একদিকে টোল এবং মাদ্রাসা থেকে বছরে বছরে যে ধর্মান্ধ কিছু তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ আমরা তৈরি করবে, তারা ক্রমশ খর্ব করবেন আমাদের দেশের উদারতা ও মুক্তিবুদ্ধির সাধনাকে। অপর পক্ষে, সরকারের কী অধিকার আছে জনগণের অর্থ ব্যয় করে একদল দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক তৈরি করার? যারা পাস করে বেরোবেন টোল অথবা মাদ্রাসা থেকে, যুগের অনুপযোগী শিক্ষা নিয়ে তারা কি বর্তমান জগতের জীবিকার কঠিন সংগ্রামে টিকে থাকতে পারবেন? ইতিহাস কী প্রমাণ করে আমাদের কাছে? আসলে, ১৭৮১ সালে যেদিন কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষার পরিবর্তে ধর্মীয় শিক্ষা দেবার জন্যে কলকাতা মাদ্রাসা স্থাপিত হলো মুসলমানদের জন্যে, সেদিনই মুসলমানরা হিন্দুদের তুলনায় অন্তত এক শতাব্দী পিছিয়ে পড়লেন। পুরো ইংরেজ রাজত্বে সেই পশ্চাৎপদতা মুসলমানরা সম্পূর্ণরূপে কাটিয়ে উঠতে পারেননি। সম্ভবত আজও পারেননি। তা হলে এখন বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আমরা কেন ইতিহাসের শিক্ষা ভুলে গিয়ে মধ্যযুগীয় শিক্ষায় একদল অযোগ্য অর্ধশিক্ষিত মানুষ গড়ে তুলি? সেটাতো শুধু সেই মানুষের পক্ষেই নোকশানের নয়, সেটা সামগ্রিকভাবে আমাদের সমাজের পক্ষেই নোকশানের। মানুষের শক্তির এমন করুণ অপচয় কেন করবো আমরা, যখন ইতিহাস আমাদের ভিন্নরূপ শিক্ষা দিচ্ছে। নিরেট অপরিণামদর্শী ও আত্মহননে উন্মুখ ব্যক্তি ব্যতীত আর কেউ-তে ইতিহাসের শিক্ষাকে অমান্য করে না।
আমাদের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে, প্রকৃত পক্ষে, এক নয়া সাম্প্রদায়িকতা কেবল ইসলামি সমাজতন্ত্র আর মাদ্রাসা শিক্ষার নামেই আত্মপ্রকাশ করেনি-সে রীতিমতো প্রকাণ্ড বেড়াজাল মেলে আমাদের মুক্ত বুদ্ধিকে বেড়া দিতে এগিয়ে আসছে।
আমার কাছে সব চেয়ে অসঙ্গত ঠেকছে, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ সরকারের বহুতর নির্ভুল সাম্প্রদায়িক আচরণ। ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের সকল ধর্মীয় ব্যাপারে নির্লিপ্ত ও নিরপেক্ষ থাকার কথা। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন এবং খ্রীস্টান সব ধর্মের লোকই আছে আমাদের দেশে। সরকার এর কোনো ধর্মের যেমন পৃষ্ঠপোষকতা করবেন না, তেমনি কোনো ধর্মের প্রতি বিরূপ হবেন না—এই পক্ষপাতহীনতাই ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের কাছ থেকে মানুষ আশা করে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বিশেষ ধর্মের প্রতি এবং সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত দেখাচ্ছেন। এই পক্ষপাতপূর্ণ আচরণ প্রকাশ পাচ্ছে রাষ্ট্রীয় কর্ম ও আনুষ্ঠানিকতায়। এ জন্যেই ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশের ক্যাডেটদের শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠান প্রায় ইসলাম ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। অথচ অন্য কোনো দেশে —মায় আরব দেশগুলিতে সৈন্যদের অনুষ্ঠান বোধ হয় কোরান পাঠ দিয়ে শুরু হয় না। অসঙ্গতি অন্যত্রও দেখতে পাই। সরকার সাম্প্রদায়িক দলগুলি নিষিদ্ধ করেন বটে, কিন্তু আওয়ামী ওলেমা পাটি বহাল তবিয়তে থাকেন। আরো দৃষ্টান্ত আছে। ধর্মনিরপেক্ষ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তি জীবনে যে ধর্মেই বিশ্বাস করুণ না কেন, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার সময়ে তিনি যদি বারংবার বিশেষ ধর্মীয় শপথ বাক্য উচ্চারণ করেন (যেমন ইনশা আল্লাহ, তা হলে ধর্মনিরপেক্ষতার স্পিরিট ক্ষুন্ন হয় কিনা, সেটাও ভেবে দেখার মতো বিষয়। আল্লাহ, গড, বা ভগবানের নামে বারবার শপথ করলে তখন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা স্বস্তি কিংবা আত্মবিশ্বাস ফিরে পান কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ করার অবকাশ আছে। এ ছাড়া, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ দেশের জাতীয় প্রচারযন্ত্র —রেডিও এবং টেলিভিশন, অনুষ্ঠান শুরু করে কোরান পাঠ দিয়ে, শেষ করে ‘খোদা হাফেজ’ বলে। এটা কোন ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা? প্রশ্নটা আরো প্রবল হয়ে দেখা দেয় এ জন্যে যে, বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে এ প্রচার যন্ত্র থেকে মাসাধিক কাল অনুষ্ঠানের শেষে ‘খোদা হাফেজ’ বলা হতো না, বলা হতো কেবল ‘জয় বাংলা’। কোরান পাঠ এবং খোদা হাফেজের সঙ্গে খানিকটা গীতা, ত্রিপিটক আর বাইবেলের ভেজাল মিশিয়ে দিলেও, আমাদের ধারণা, তা দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া যায় না, বরং তাতে করে দেশের ধর্মীয় চরিত্রটাই বিশেষভাবে প্রবল হয়ে ওঠে।
আমাদের রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দের আচরণেও এই অসঙ্গতি দুর্লক্ষ নয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এদেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রধান নেতা। কিন্তু, তবু, প্রধানমন্ত্রী হিশেবে তিনি যখন মুসলিম ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদান করে বক্তৃতায় বলেন, “আমাদের ধর্মের উন্নতি বিধান করতে হবে এবং এর পৃষ্ঠপোষকতা করবেন সরকার” -তখন তিনি অজ্ঞাতেই একটি ধর্মের প্রতি পক্ষপাত দেখান। এমন কি, তিনি যখন গণভবনে মিলাদের মহফিল ডাকেন তখনো একই রকমের পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ পায়।
অন্যাপ্ত মন্ত্রীদের আচরণেও এরূপ অসঙ্গতি চোখে পড়ে। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁরা যে কোনো ধর্মে বিশ্বাসী হতে পারেন এবং সে ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারেন। এমন কি, বিশেষ কোনো মন্ত্রী যদি ধর্মে বিশ্বাসী না-হন, সেটাও তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার।
কিন্তু তাদের পাবলিক লাইফে, তাঁদের বক্তৃতায় বিশেষ ধর্মীয় প্রতি প্রকাশ পাওয়া উচিত নয়। ধরা যাক, একটি দৃষ্টান্ত। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর রোগমুক্তি নিয়ে মন্ত্রীরা যেভাবে প্রকাশ্যে মোনাজাত করেছেন এবং তার ছবি ও খবর যে-ভাবে দিনের পর দিন সরকারি প্রেসে ছাপা হয়েছে; তাতে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে কেউ কেউ হয়তো কটাক্ষ করতে পারেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা কি প্রিয় নেতার জন্যে প্রার্থনা করবে না? উত্তরে বলতে হয়, নিশ্চয় করবে, বহুবার করব; তবে মন্ত্রী হিশেবে প্রকাশ্যে প্রার্থনা করলে সকল ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে মিলিত ভাবে প্রার্থনা করবো -তার মধ্যে বিশেষ কোনো ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার আমদানি করবো না। আর আমি যখন আমার ধর্মসভায় যোগ দেবো কিংবা ব্যক্তিজীবনে প্রার্থনা করবে, তখন বিশেষ ধর্মীয় রীতিতে প্রার্থনা করবো। দিনের পর দিন পত্রিকায় মন্ত্রীদের মোনাজাতের ছবি ফলাও করে ছাপা হলে, সন্দেহ হয়, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আন্তরিকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা উভয়ই বোধ হয় খর্বিত হয়। আর যদি ইসলাম ধর্মের কথা ওঠে, তা হলে তো সরাসরি বলতে হয়, মোনাজাতের ছবি তো জায়েজ নেই (কোনো ছবি তোলাই জায়েজ নেই)। আসলে মন্ত্রী অথবা নেতা এবং সাধারণ মানুষে পার্থক্য অনেক; এদের মধ্যে তুলনা চলতে পারে না। এ জন্যেই সাধারণ মানুষ যত্রতত্র যৌনসম্পর্কে রাখলে তা দূষণীয় হয় না, কিন্তু অনুরূপ কাজের জন্যে প্রফুমোর মতো মন্ত্রীদের সরে দাঁড়াতে হয় পাবলিক-লাইফ থেকে।
মোনাজাতের ঘটনাটা যদি-বা যুক্তিতে টিকে যায়, একজন মন্ত্রীর এক অদ্ভুত ও মারাত্মক ঘোষণা কিছুতেই টেকে না। তিনি সম্ভবত ইসলাম প্রীতি প্রকাশের জন্যে এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে, এ দেশের সংবিধান কোরান-হাদিস ও ইসলামি আইনের পরিপন্থী হবে না। এরূপ ঘোষণা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে একটা রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। কারণ, একদিকে এ উক্তি নির্ভেজাল রূপে সাম্প্রদায়িক। অন্যদিকে অবাস্তব। অবাস্তব, কারণ ইসলামি আইন-যা ১৭৯২ সাল অবধি এ দেশে প্রচলিত ছিলো তাতে বলে, একজন মুসলমানের বিরুদ্ধে একজন বিধর্মী সাক্ষ্য দিলে তা গ্রাহ্য হবে না। এই কি তবে বাংলাদেশের ভাবী ধর্মনিরপেক্ষ শাসনতন্ত্রের নমুনা? ইসলামি আইন সত্যি সত্যি চালু হলে আধুনিক বিশ্বে এ দেশ কী করে চলবে, তা ভেবে দেখার বস্তু। ব্যাঙ্ক-বীমা বিনিয়োগ-ঋণবর্জিত অথনীতি ইসলামি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের পক্ষে কি এ যুগে খুব একটা মঙ্গলজনক ব্যাপার হবে?
আসলে, বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেছেন বটে, দেশের অন্যতম নীতি হবে ধর্মনিরপেক্ষতা, কিন্তু আমাদের কাজে-কর্মে প্রতিনিয়ত আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা ও সংস্কার বেরিয়ে পড়ছে। উচ্চকণ্ঠে ধর্মনিরপেক্ষতার ডাক ছেড়েও আমাদের আচারের সেই অসঙ্গতিকে আমরা চাপা দিতে পারছিনে। প্রকৃতপক্ষে, ধর্মনিরপেক্ষতা এক কঠিন সাধনার বস্তু। রীতি মতো উচ্চ শিক্ষা আর সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়েই সেই উদারতাকে আত্মসাৎ করা সম্ভব। সেটা যেমন সাধনাসাপেক্ষ, তেমনি সময়সাপেক্ষ। ভারতের শাসনতন্ত্র প্রথম থেকেই ধর্মনিরপেক্ষ, তাই বলে সে দেশের সব মানুষ কিংবা সরকারের সকল স্তর এখনো অসাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠেনি। হয়তো হতে পারে কিন্তু তার জন্যে তন্তত পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকতে হবে। দ্বিজাতিতত্ত্বের কবরের ওপর বাংলাদেশ সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার নিশান উড়িয়েছেন, এটা যেমন সৎসাহসের দৃষ্টান্ত, তেমনি আশা ও আনন্দের কথা। কিন্তু দীর্ঘদিনের প্রযত্ন ও সাধনার মাধ্যমে জনগণ এবং জনগণের সরকারকে ধর্মনিরপেক্ষতা অর্জন করতে হবে। তবেই এ দেশ সার্থক সেকুলার স্টেট বলে পরিচিত ও প্রশংসিত হতে পারবে।