প্রবন্ধধর্মভিত্তিক বনাম ধর্ম-নিরপেক্ষ শিক্ষা-প্রসঙ্গে: আবুল ফজল

ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্ম-নিরপেক্ষ শিক্ষা-প্রসঙ্গে: আবুল ফজল

ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে শ্লোগান দেওয়া সোজা, কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষার ফল প্রত্যাখ্যান করা কারো পক্ষেই আজ সম্ভব নয়। এ কারণে দেখা যায়, জন-মানসকে বিভ্রান্ত করার জন্য সুখে যারা অহরহ ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার জিকির করে থাকেন ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োজনের সময় তারাও ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষা-জাত ফল-গ্রহণে এতটুকু অরুচির পরিচয় দেন না।

ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্ম-নিরপেক্ষ শিক্ষা-প্রসঙ্গে: আবুল ফজল

ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে শ্লোগান দেওয়া সোজা, কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষার ফল প্রত্যাখ্যান করা কারো পক্ষেই আজ সম্ভব নয়। এ কারণে দেখা যায়, জন-মানসকে বিভ্রান্ত করার জন্য সুখে যারা অহরহ ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার জিকির করে থাকেন ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োজনের সময় তারাও ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষা-জাত ফল-গ্রহণে এতটুকু অরুচির পরিচয় দেন না।

‘ধর্ম-ভিত্তিক বনাম ধর্ম-নিরপেক্ষ শিক্ষা-প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধটি আবুল ফজলের ‘সমকালীন চিন্তা’ বই থেকে নেয়া হয়েছে। প্রগতিশীল আন্দোলন ‘শিখাগোষ্ঠীর’ অন্যতম সদস্য আবুল ফজল ১৯৬৯ সালে কলকাতা থেকে বইটি প্রকাশ করেন। প্রবন্ধটিতে ধর্ম-নিরপেক্ষ শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা চমৎকার ভাবে আলোচিত হয়েছে। একই সাথে আবুল ফজল দেখিয়েছেন ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার অসারতা। সেই সঙ্গে যা ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষা জিকির তোলেন, তাদের ভণ্ডামির দিকও তুলে ধরেছেন তিনি। লেখাটি পাকিস্তান আমলের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও এর মূল বক্তব্য আজও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। সেই বিবেচনায় মূল প্রবন্ধটি অবিশ্বাস পাঠকদের জন্য হুবহু প্রকাশ করা হল—অবিশ্বাস টিম।


এক

ধর্ম কথাটার মধ্যে একটা অসম্ভব মোহ রয়েছে। ফলে যে-কোন কিছুর সঙ্গে ধর্মকে তথা ধর্ম শব্দটাকে যখন জুড়ে দেওয়া হয় তখন তা হয়ে পড়ে স্রেফ আবেগের বিষয়। কোন রকম যুক্তি-বিবেচনা তাতে আর ঠাঁই পায় না। এমনকি বুদ্ধি কিংবা যুক্তি দিয়ে বিচার করে দেখার সাহসটুকুও যেন মানুষ তখন হারিয়ে বসে। কেউ কেউ তা করাকে মনে করে রীতিমতো বড় রকমের এক গুনাহ! যারা আরো এক ডিগ্রি বেশী গোঁড়া তারা মনে করে, স্রেফ নাস্তিকতা। বলা বাহুল্য তারাই গোঁড়া, যারা বিচার-বিমুখ আর পরিচালিত হয় অন্ধ আবেগে। সামাজিক জীবনে এসব মানুষ অত্যন্ত বিপজ্জনক, কারণ স্বভাবে এরা হয়ে থাকে চরম অসহিষ্ণু। ধর্মে পরমত-সহিষ্ণুতার সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা-সত্ত্বেও এরা ধর্মের নামেই অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে থাকে সবচেয়ে বেশী। পরমত-সহিষ্ণুতা শুধু-যে সত্যিকারের ধর্ম-জীবনের লক্ষণ তা নয়, সভ্য জীবনের এক প্রধান শর্ত, সমাজ-জীবনেরও বুনিয়াদ। এছাড়া সমাজ-জীবন দু’দিনেই মগের মুল্লুক না হয়ে যায় না।

আমাদের মতো অনুন্নত দেশে ধর্মের বুলি, ধর্মের ভেক আর বাহ্যিক ধার্মিকতার একটা জনপ্রিয়, লোক-ভুলানো আবেদন রয়েছে। তাই মানুষ সহজে এর খপ্পরে না পড়ে পারে না, এ কারণে কোন কোন রাজনৈতিক দলের এ হয়ে পড়েছে এক মোক্ষম অস্ত্র। ফলে ধর্ম এখন এদের হাতে সব রকম আধ্যাত্মিক আবেদন হারিয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতি তথা রাজনৈতিক হাতিয়ার।

সম্প্রতি আমাদের দেশে ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্ম-নিরপেক্ষ শিক্ষা-সম্বন্ধে একচোট উত্তেজক আলোচনা হয়ে গেছে। এ আলোচনা ভবিষ্যতে আরো-যে অধিকতর উত্তেজক হয়ে উঠবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কারণ, আমরা নাকি অতি বেশী ধর্মপ্রাণ জাতি! খাঁটি অর্থে আমরা কতখানি ধর্মপ্রাণ তা সঠিকভাবে বলার উপায় নেই, তবে ধর্মের নামে আমরা-যে প্রাণ দিতে আর নিতে জানি তার দেদার নজির আমাদের ইতিহাসে রয়েছে। আজো সমাপ্তি ঘটে নি সে ইতিহাসের।

কিন্তু যদি জিজ্ঞেসা করা যায় ধর্মের নামে এই যে আমরা প্রাণ দেওয়া-নেওয়া করেছি, সে কার সঙ্গে? কোন বিধর্মীর সঙ্গে কি? ইতিহাস বলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের সঙ্গেই। একদল মুসলমানের সঙ্গেই। উপরে শিক্ষা নিয়ে যে-উত্তেজক আলোচনার কথা বলেছি তাতেও সীমিতভাবে প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঘটেছে এবং ঘটেছে নিজেদের মধ্যেই। যে-ধর্মের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ভ্রাতৃত্ব-প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষীদের হাতে সে ধর্ম হয়ে পড়েছে এখন ভাতৃহননের হাতিয়ার! আশ্চর্য, আমাদের তথাকথিত ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা কিন্তু একবারও ভেবে কিংবা বিচার করে দেখে না যে, এতে কার কতটুকু ফায়দা হয়েছে। নিজের ধর্মের, নিজের দেশের, নিজের সমাজের, এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়েও কোন লাভ হয়েছে কি কারো?

বলেছি তথাকথিত ধর্মপ্রাণরা স্বভাবতই বিচার-বিমুখ হয়ে থাকে। এসব সে বিচারমুখীনতারই শোচনীয় পরিণতি। না হয় সেই খোলাফা-এ রাশেদীনের আমল থেকে ধর্মের নামে যে-ভ্রাতৃ-হনন শুরু হয়েছে ইতিহাসের বিচিত্র-পর্বে যা খারেজি-শিয়া-সুন্নী-ওহাবী-কাদিয়ানী-ফরায়েজী-লা-মজহাবী ইত্যাদি নানা নামে চিহ্নিত হয়ে বর্তমানে আমাদের দেশে ধর্ম-ভিত্তিক বনাম ধর্ম-নিরপেক্ষতার বাহাছে এসে ঠেকেছে, তাতে একবিন্দু ফায়দাও আমি লক্ষ করি নি কোথাও! বরং লক্ষ করেছি এতে ইসলামের নাম হয়েছে কলঙ্কিত, মুসলমান হয়েছে দুর্বল, দ্বিধা-বিভক্ত আর খণ্ডিত আর ধর্মের আসল উদ্দেশ্য হয়েছে পদে পদে ব্যর্থ।

আমার ধারণা, ধর্ম এক অতি সহজ, সরল ব্যাপার, তাতে কোন রকম হেঁয়ালি কিংবা জটিলতার স্থান নেই। কতকগুলি অতি সোজা, অতি সুস্পষ্ট ও সহজে বোধগম্য বিশ্বাস পোষণ আর তার আনুষঙ্গিক ধর্মীয় নির্দেশ, যেমন নামাজ, রোজা, হজ, জকাত ইত্যাদি পালনের মধ্যেই ধর্ম-জীবন সীমিত। এসব কোন অর্থেই জটিল কিংবা দুর্বোধ্য নয়। এসবে মতভেদের তেমন অবসর আছে বলেও আমার মনে হয় না। ছেলেমেয়ে আর পোষ্যদের এসব শিক্ষা দেওয়া মুসলমান পরিবারের এক চিরকেলে রেওয়াজ। এখন সে রেওয়াজ যদি অধিকাংশ ক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হয়ে থাকে তার জন্য আধুনিক জীবন-সমস্যাই দায়ী—যে জীবনকে অস্বীকার করা এখন কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। বলা বাহুল্য, এ জীবন তথা আধুনিক জীবনের বেশীর ভাগই জুড়ে আছে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে শ্লোগান দেওয়া সোজা, কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষার ফল প্রত্যাখ্যান করা কারো পক্ষেই আজ সম্ভব নয়। এ কারণে দেখা যায়, জন-মানসকে বিভ্রান্ত করার জন্য সুখে যারা অহরহ ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার জিকির করে থাকেন ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োজনের সময় তারাও ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষা-জাত ফল-গ্রহণে এতটুকু অরুচির পরিচয় দেন না। অত্যন্ত সাহোৎসাহে বৈদ্যুতিক পাখার হাওয়া এমন ধর্মপ্রাণরাও ভোগ করে থাকেন। অথচ তারা খুব ভালো করেই জানেন ঐ বস্তুটা মোটেও ধর্মভিত্তিক শিক্ষার ফল নয়। ওর সবটাই সম্পূর্ণভাবে ধর্ম-নিরপেক্ষ শিক্ষারই ফলশ্রুতি। বাস্তব জীবনে ধর্ম-নিরপেক্ষ শিক্ষার নানা ফল ভোগ করা আর স্রেফ লোক ভুলানোর জন্য মুখে ঐ শিক্ষার বিরোধিতা করাকে ঠিক সাধু আচরণ বলা যায় না। এর নাম মানসিক সততা নয়।

আমাদের যে-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি ধর্মভিত্তিক শিক্ষার দাবীতে অতিমাত্রায় সোচ্চার, কিছুদিন আগে সে প্রতিষ্ঠানের আমীরে আজম চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন ধর্ম-নিরপেক্ষ শিক্ষার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র লন্ডনে। লন্ডনে তার অপারেশন করেছেন ধর্ম-নিরপেক্ষ শিক্ষায় শিক্ষিত ডাক্তারেরাই, সেবা করেছেন ঐ শিক্ষায় শিক্ষিতা নার্সরাই। অধিকন্তু ঐ নার্সরা-যে বেপর্দায় চলে তাও সকলের জানা কথা। ঐ সব ডাক্তার আর নার্সরা-যে নিষিদ্ধ তথা হারাম খাদ্য আর পানীয়ও খেয়ে থাকে তাতেও বোধ করি সন্দেহ নেই। তবুও ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষার এমন জেহাদী দাবীদারেরাও চিকিৎসার জন্য সেখানে গেলেন কেন? যান এ কারণে যে, তাঁরাও মনে মনে জানেন—রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মুখে যাই বলা হোক না কেন, ধর্ম-নিরপেক্ষ শিক্ষা তথা সে শিক্ষাজাত ফল গ্রহণ না করে তাঁদেরও নিস্তার নেই। এসব রাজনৈতিক আলেমরা যদি ‘জান বাঁচানো ফরজ’ এ ফতোয়ার দোহাই দিয়ে সেক্যুলারিজমের ফল গ্রহণকে জায়েজ মনে করেন, তা হলে তাদের ‘জেহাদী’ সংকল্পের চেহারাটাই তো অত্যন্ত করুণ হয়ে ওঠে। জেহাদী সঙ্কল্পের অর্থ তো ‘প্রাণ যায় যাক’। প্রাণের মায়ায় যদি সেক্যুলারিজমের তথা ধর্ম-নিরপেক্ষ বিদ্যার আশ্রয় নিতেই হয় তা হলে ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার চেয়ে সেক্যুলার তথা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা-যে উৎকৃষ্টতর তা কি স্বীকার করে নেওয়া হয় না? ধর্ম-নিরপেক্ষ শিক্ষার দাবী যাঁরা করেন তাঁদেরও তো এ দাবী। আসলে ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার দাবীদারেরা ধর্ম নিরপেক্ষতার বাসন থেকে গ্রাসটা তুলে হাতটাকে মাথার চারদিকে লন্ডন-প্যারিস ঘুরিয়ে এনে মুখে পুরছেন মাত্র, আর ধর্মনিরপেক্ষবাদীয়া গ্রাসটা বাসন থেকে তুলে সরাসরি দিচ্ছেন মুখে। তফাতটা শুধু এখানে। না হয় এ রকম বহু নজির দিয়ে দেখানো যেতে পারে যে, ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার দাবীদারেরা ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষাকে বাদ দিয়ে এ-জীবনে এক পা-ও অগ্রসর হতে পারবেন না এবং পারছেনও না। ধর্ম-নিরপেক্ষতা মানে ইহলোকে বেঁচে থাকা, জীবনের বিকাশ সাধন করা, যে-যুগে, যে-দেশে জন্মগ্রহণ করা গেছে-সে-যুগ আর সে-দেশের চাহিদা, প্রয়োজন আর সমস্যার মোকাবেলা করে বেঁচে থাকা। স্রেফ ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষার দ্বারা এ হওয়ার নয়। হলে নেজামে ইসলামের সম্পাদক নিজের ছেলেকে ক্যাডেট কলেজে না পাঠিয়ে পাঠাতেন মাদ্রাসা আলিয়ায়। অক্সফোর্ড কেমব্রিজের পরিবেশ আর অধ্যয়ন-অধ্যাপনা সর্বতোভাবেই সেক্যুলার তবুও ঐখানে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেলে আমাদের মৌলবী মওলানাদের ছেলে-জামাইও দেখেছি কৃতার্থ বোধ করেন, এমনকি ঐসব ছেলে-জামাইয়ের বাপ শ্বশুররাও মনে করেন যেন হাতে চাঁদ পাওয়া গেল। এমনতর উৎসাহ নিয়ে এরা কখনো নিজের ছেলে কি জামাইকে শিক্ষার জন্য মক্কা-মদিনা কিংবা বাগদাদ-দামেস্ক বা মিসরে পাঠান? দেশের উচ্চ মাদ্রাসাগুলিতেও কি পাঠান? ধর্মভিত্তিক শিক্ষা যদি ভালো হয় তা ষোল আনাই ভালো একথা না মেনে উপায় নেই। সে ষোল আনা ভালো শিক্ষা আমাদের মত মাদ্রাসাগুলিতে আবহমানকাল ধরেই চলছে। কিন্তু সে শিক্ষায় শিক্ষিতদের আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের কোথাও কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় কি? দেশের প্রশাসন-ক্ষেত্রে কোথাও তো তাদের স্থান নেই, দেশ রক্ষায় তারা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, আজাদী আন্দোলনেও তাদের ভূমিকা ছিল অকিঞ্চিৎকর। মোটকথা, আধুনিক রাষ্ট্রীয় দাবী আর জীবনের মোকাবেলায় তাঁরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ প্রমাণিত। বৃহত্তর সমাজেরও-যে এ সত্য জানা নেই তা নয়, জানা আছে বলেই দেশের সেক্যুলার শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে যেমন ভর্তির ভিড় দেখা যায় ঐসব অ-সেক্যুলার শিক্ষালয়ে তার সিকি পরিমাণ ভিড়ও দেখা যায় না। আজ শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা সেক্যুলার বিদ্যালয় আর সেক্যুলার বিষয়ে ভর্তির সমস্যাই। প্রতি বছর হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ঐসব বিদ্যাকেন্দ্রে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে লেখাপড়াই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। চিকিৎসা আর প্রকৌশল ক্ষেত্রে অবস্থা আরো জটিল। অন্য দিকে ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষা-কেন্দ্র মাদ্রাসাগুলিতে অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সেখানে কোন ছাত্র ভর্তির সুযোগ পায় না তেমন কথা আজো শোনা যায় নি।

দুই

আমাদের দেশে ধর্ম বা ধর্মভিত্তিক শিক্ষার সুযোগের কোন অভাব আছে বলেও মনে হয় না। মক্তব মাদ্রাসার কথা বাদ দিলেও নিউ স্কিম মাদ্রাসাগুলি রয়েছে, যেখানে ইংরেজি, বাংলা, অঙ্কের সাথে সাথে প্রচুর ধর্মশিক্ষারও ব্যবস্থা আছে। তবুও শোনা যায় সে-সব মাদ্রাসায়ও এখন ছাত্রসংখ্যা দিন দিনই কমে এসেছে। যে-কোন ধরনের মাদ্রাসা আর সেক্যুলার হাই স্কুলের আর ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের সঙ্গে সেক্যুলার ইন্টারমিডিয়েট কলেজের তুলনা করে দেখলে এ সত্যটাই প্রকট হয় যে, দেশে ধর্মভিত্তিক শিক্ষার তেমন কোন চাহিদা নেই। আমাদের প্রায় সব কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম তথা ধর্মভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। তার জন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য সেক্যুলার বিভাগের সঙ্গে তুলনা করে দেখলেও দেখা যায়, ঐসব বিভাগে ছাত্র সংখ্যা অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে কম। সম্প্রতি ছাত্র ভর্তির প্রবল চাহিদা আর চাপ এড়াতে না পেরে বাধ্য হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন বিভাগে সিটের সংখ্যা কিছু কিছু বাড়িয়েছে। এ সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তিতে যে পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে তা নিম্নরূপ:

বিষয়                                 সিটের সংখ্যা                               এখন বাড়িয়ে যা করা হয়েছে
ইংরেজী                              ৭৫                                            ৯০
বাংলা                                 ১০০                                           ১৬০
অর্থনীতি                             ১৫০                                           ১৬০
ইতিহাস                              ৭৫                                            ৮৫
সমাজ বিজ্ঞান                      ৭৫                                            ৯০
দর্শন                                 ৬০                                            ৮০
রাষ্ট্র বিজ্ঞান                         ১৫০                                           ১৮০
বাণিজ্য                              ১৫০                                           ১৭০
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক               ২৫                                            ৪০
মনস্তত্ত্ব                              ৪০                                            ৪৫
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি     ৪০                                           ৬০
আরবি                              ১৫                                             ২০
ইসলামিক স্টাডিজ               ২৫                                             ৩০

এসব বিষয়ে সিটের মোট সংখ্যা ছিল আগে ৮১৫, এখন বেড়ে তা হয়েছে ১১৭০। ‘ইসলামের ইতিহাস আর সংস্কৃতি’কে ঠিক ধর্ম-ভিত্তিক বিষয় বলা যায় না, বরং সার্বিক ইতিহাসের অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য শাখা এটি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বিষয়ের অধ্যাপক একজন হিন্দু। কাজেই আরবী আর ইসলামিক স্টাডিসকেই শুধু ধর্ম-ভিত্তিক বিদ্যা বলা চলে। এ দুই বিষয়ে সিটের সংখ্যাল্পতা কি প্রমাণ করে না যে, দেশে ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার তেমন চাহিদা নেই? থাকলে এ দুই বিষয়ের এমন শোচনীয় দশা ঘটতো না। শোনা যায়, এসব সিটের জন্যও তেমন কোন প্রতিযোগিতা হয় না। অন্যদিকে ধর্ম নিরপেক্ষ বিষয়গুলিতে ভর্তির জন্য কিরকম প্রতিযোগিতা ঘটে, তা কারো অজানা নয়। স্থান আর প্রয়োজনীয় সংখ্যক অধ্যাপকের অভাবে প্রবল দাবী থাকা-সত্ত্বেও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে সিট বাড়ানো সম্ভব হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে। বিজ্ঞান শুধু-যে ধর্ম-নিরপেক্ষ তা নয়, বিজ্ঞানের বহু থিওরি আর মতবাদের সঙ্গেও ধর্মের রীতিমতো বিরোধ রয়েছে। তবুও ধর্ম বা ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার চেয়ে বিজ্ঞান-শিক্ষার চাহিদা দেশে অনেক বেশী। প্রতি বছর বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে বহু ছাত্র যে স্রেফ সিটের অভাবে ভর্তির সুযোগ পায় না, এ এক সার্বজনীন সত্য। দেশের ক্ষেত্রে এই তো বাস্তব অবস্থা। এ অবস্থায় ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষার ধুয়ো তুলে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত আর পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়ার কোন মানে হয় কি? আশ্চর্য, চোখের সামনে সারা মধ্যপ্রাচ্যের শোচনীয় আর করুণ দশা দেখেও আমাদের একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতাদের চোখ খোলে না। একবারও এরা তাকিয়ে দেখেন না বাস্তবের কঠিন মাটির দিকে, যে-মাটিতে তারা পা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথ-যে একবার শিক্ষা-প্রসঙ্গে বলেছিলেন: ‘ধর্ম-মোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভাল’, মনে হয় কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়। ধর্মান্ধতার চেয়ে বড় অন্ধতা আর নেই। চোখের অন্ধতা শুধুমাত্র দৃষ্টিশক্তিই হরণ করে, কিন্তু ধর্মান্ধতা হরণ করে বুদ্ধি-যুক্তি বিচার বিবেক আর সব রকম মূল্যবোধ।

আরবদের মাতৃভাষা আরবী-কোরান-হাদিস, ফেকাউসুল-তফসীর ইত্যাদি যা কিছুকে এক কথায় ইসলামী ধর্ম-বিদ্যা বলা হয় তা সবই আরবীতে। শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই আরবেরা এসবের সঙ্গে পরিচিত (এ সবকে বাদ দিয়ে ধর্মভিত্তিক শিক্ষা আর কাকে বলা হয় আমার জানা নেই), তবুও শ্রেষ্ঠ ধার্মিকের আদর্শ কি এ যুগের আরবেরা? তা যদি হতো আমার বিশ্বাস তাদের অবস্থা কখনো এমন শোচনীয় হতো না। ক্ষুদ্র এক শক্তির হাতে তারা-যে শুধু পদে পদে পরাজিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে তা নয় তাদের জীবন-মানও এখন সর্বনিম্নস্তরে। এত নিম্নে যে, ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার দাবীদারেরাও দৈহিক আরোগ্যের জন্য যেমন তাদের কাছে যায় না, তেমনি পাঠায় না নিজেদের ছেলেমেয়েকে মানসিক সম্পদ তথা জ্ঞান আহরণের জন্যও ঐসব দেশে। ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার অভাবেই কি এ পরিণতি? মনে হয় না। বরং আধুনিক শিক্ষা আর সেই শিক্ষাজাত দৃষ্টিভঙ্গির অভাবেরই এ ফল। কোন ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষাই এ অধঃপতিত অবস্থা থেকে ওদের উদ্ধার করতে পারবে না। উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র উপায় মনেপ্রাণে আধুনিক শিক্ষাকে গ্রহণ করে সর্বতোভাবে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান আর যন্ত্রবিদ্যাকে আয়ত্ত করা, পরমুখাপেক্ষিত ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করা। এ করা হলে আমার বিশ্বাস, দশ কোটি মানুষ পৃথিবীতে আবারও অসাধ্য সাধন করতে পারে। তাদের চোখের সামনে ক্ষুদ্র ইসরাইল তার এক জ্বলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। জ্ঞানী শত্রুর কাছ থেকেও সব নিয়ে থাকে। আরবদেরও তা নেওয়া উচিত। ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার কোন অভাব আরব দেশে নেই, ছিলও না ইসলামের আবির্ভাবের কাল থেকে। জামে আজহার নাকি প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় আর ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষাই-যে ওখানে দেওয়া হয়, তাতেও বোধ করি সন্দেহ নেই। তবুও সে-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তেমন কোন কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পারেন না। আরবদের এখন একমাত্র অভাব ধর্মনিরপেক্ষ তথা সেক্যুলার শিক্ষার। আমাদের দেশেও ধর্ম বা ধর্মভিত্তিক শিক্ষার সুযোগের কিছুমাত্র অভাব নেই। অসংখ্য মক্তব-মাদ্রাসা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে, যাতে ধর্মীয় শিক্ষার দরাজ ব্যবস্থা রয়েছে। তদুপরি আমাদের প্রায় সব কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতম স্তর পর্যন্ত ধর্ম-ভিত্তিক তথা সব রকম ধর্মীয় বিদ্যা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা আছে। যারা ধর্মভিত্তিক শিক্ষার দাবীর সমর্থনে জান দেওয়া-নেওয়ার হুমকি দিয়ে থাকেন, তারাও কি এসব সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে থাকেন? করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সিট তথা ছাত্র পরিসংখ্যান এমন বিপরীত তথ্য পরিবেশন করতো না।

তিন

ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষা যাঁরা চান তাঁদের কথা আর কাজে স্ববিরোধিতা দেখেই সবচেয়ে বেশী অবাক হতে হয়। আমার এক অধ্যাপক বন্ধুকে—যিনি নিজে ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষা পেয়েছেন এবং ধর্মীয় বিষয়েই সারাজীবন অধ্যাপনা করেছেন, একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম: একজন বেনামাজী, ধর্মকর্মে সম্পূর্ণ উদাসীন এমন সি.এস.পি. যদি তোমার মেয়ের পাণিপ্রার্থী হয় তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবে, না একজন নামাজী-কালামী পরহেজগার আলেম প্রার্থীর সঙ্গে দেবে? বন্ধুবর ধর্মভিত্তিক শিক্ষার দাবীদার, তাই তাঁকে এমনতরো প্রশ্ন করা। শুনে অবাক হলাম তিনি বিনা দ্বিধায় মুহূর্তে বলে ফেল্লেন, ‘সি.এস.পি’র সঙ্গেই দেব।’ তিনি তাঁর এক ছেলেকে পড়িয়েছেন অর্থনীতি, অন্য ছেলেকে বাণিজ্য, এক মেয়েকে বাংলা, অন্য মেয়েকে ইংরেজী। কোন ছেলেমেয়েকেই ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষা দেন নি, তেমন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে পাঠান নি। মনে হয় এঁরা যে-ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষা চান সে শুধু পরের ছেলের জন্যই, নিজের ছেলেমেয়ের জন্য নয়। যে -শিক্ষাপদ্ধতি এরা নিজের ছেলেমেয়ের জন্য অকেজো আর অনাবশ্যক মনে করেন সে শিক্ষা-পদ্ধতি এঁরা দাবী করেছেন পরের ছেলেমেয়ের জন্য। আমার আপত্তি আর প্রতিবাদ এদের এ-বিরোধিতার প্রতিই, না হয় বিলাতে নাসারাদের মুলুকে অপারেশনের জন্য যাওয়া বা ক্যাডেট কলেজে ছেলেকে ভর্তি করানো কিংবা অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতির মতো ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় অধ্যয়নে আমার কোন আপত্তি তো নেইই বরং আন্তরিক সমর্থন আছে। এমনকি আমার স্পষ্টবাদী অধ্যাপক বন্ধুটির সিদ্ধান্তকেও আমি স্বাগত জানাই।

(বিশেষতঃ এ-কারণে যে, গলার সব জোর দিয়ে ধর্মভিত্তিক শিক্ষার দাবী করলেও তিনিও এ-বাস্তব সত্যটুকু ভালো করেই জানেন যে, পরহেজগার আলেমের সাথে মেয়ের বিয়ে হলে মেয়েটি সারা জীবন একটিবার সিনেমা দেখার সুযোগও পাবে না। আর সি.এস.পি.’র সঙ্গে বিয়ে হলে ইচ্ছা করলে বক্সে বসে বিনা পয়সায় রোজই তা দেখতে পারবে।) মোটকথা, মেয়ে-জামাইয়ের পরকাল-সম্বন্ধে তাঁর কোন দুশ্চিন্তা নেই, তাঁর চিন্তা ওদের ইহজীবনের সুখ সুবিধা নিয়েই। বলা বাহুল্য ইহজীবনের সুখ-সুবিধারই তো এক নাম ধর্ম নিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজম।

এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে স্মরণীয়, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা মানে ধর্মহীন শিক্ষা নয়। তা হলে সেক্যুলার দেশগুলিতে এত সব মহাপ্রাণ ধার্মিকের আবির্ভাব ঘটতো না। মানবকল্যাণে উৎসর্গিত-প্রাণ যত মানুষ ঐসব দেশে দেখা যায় আমাদের মতো ধর্মপ্রাণ জাতিতে তার সিকি পরিমাণও তত দেখা যায় না। সেক্যুলার দেশেও ধর্ম আছে, ধর্ম-শিক্ষা দেওয়া হয়। ধর্ম ও ধর্মানুষ্ঠান পালিত হয়। ধর্ম-নিরপেক্ষ শিক্ষার যারা পক্ষপাতী তাদের একমাত্র দাবী তো ধর্ম-শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বাধীনে না আনার। ধর্ম-শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি চালু থাক, তার সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম স্তর পর্যন্ত অধ্যয়নের সুযোগ যেমন আছে তা অব্যাহত থাক তাতে ধর্ম-নিরপেক্ষ শিক্ষার পক্ষপাতীদের কিছুমাত্র আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতায়। ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাই ধর্ম-শিক্ষাকে সব উন্নত দেশেই পারিবারিক আর বে-সরকারী আয়ত্তে রাখা হয়। কারণ, ধর্ম আর রাষ্ট্রের ভূমিকায় যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্য স্বীকার না করলে ধর্মই ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবচেয়ে বেশী। ধর্মের প্রধান কাজ মানুষকে পরলোকের অনন্ত জীবনের জন্য তৈরি করা। সে-পথের হদিস বাৎলানো। বলা বাহুল্য, পরলোকে বিশ্বাস না থাকলে ধর্মের আবেদন মুহূর্তে নিঃশেষিত। রাষ্ট্র সর্বতভাবে ইহলৌকিক ব্যাপার। ইহলোকে মানুষের যে-সীমিত জীবন, সে-জীবনের প্রয়োজন মেটানো আর তার দায়িত্ব গ্রহণ আর পালনই রাষ্ট্রের প্রথম আর প্রধান কর্তব্য। মানুষের পারলৌকিক জীবনের ভার গ্রহণ কিংবা মানুষকে ধার্মিক বানানো কোন অর্থেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়, বরং তা করতে গেলে ধর্মের সমূহ ক্ষতি না হয়ে যায় না। ধর্মীয় ব্যাপারে (ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষাও এর অন্তর্গত) রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ মানে রাজনীতিবিদদের হস্তক্ষেপ। আমার বিশ্বাস, কোন প্রকৃত ধার্মিকই তা কাম্য মনে করতে পারে না। রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র পরিচালকরা সব সময় রাষ্ট্রের এবং নিজেদের ইহলৌকিক স্বার্থের দিকে নজর রেখেই রাষ্ট্রীয় সব কিছু, শিক্ষা তো বটেই, পরিচালনা আর নিয়ন্ত্রণ যে করবে এবং করতে চাইবে এ প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। সব দেশেই এ ঘটে, ঘটে চলেছে। এ কারণে অনেক সময় খাঁটি ধার্মিক আর শাস্ত্র পণ্ডিতেরা রাষ্ট্রপ্রধান বা রাষ্ট্র পরিচালক হতে চান না— এমন কি কেউ কেউ প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতেও-যে অস্বীকার করেছেন তেমন নজির ইসলামের ইতিহাসেও বিরল নয়।

রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে-শিক্ষা-ব্যবস্থা তার প্রধান লক্ষ্যই থাকে উপযুক্ত নাগরিক তৈরি করা, যে-নাগরিক পারবে যথাযথ যোগ্যতার সাথে রাষ্ট্রের সব রকম দায়িত্ব গ্রহণ আর পালন করতে। ধর্মীয় ব্যাপার সে দায়িত্বের আওতায় পড়ে না সে দায়িত্ব পরিবার আর বে-সরকারী প্রতিষ্ঠান আর সংস্থার। ধর্ম মানুষের সর্বাপেক্ষা পবিত্রতম আর সর্বাপেক্ষা স্বাধীন এলাকা। রাষ্ট্রের বিশেষ করে আধুনিক রাষ্ট্রের প্রবণতাই হলো সব ব্যাপারে নাক গলানো, মানুষের সব কিছুতেই হস্তক্ষেপ করা। ধর্মীয় ব্যাপারেও যদি রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ঘটে তা হলে ধর্মের পবিত্রতা আর স্বাধীনতা দুই-ই খর্বিত আর লঙ্ঘিত হবে। পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রই ধার্মিক তৈরির উদ্দেশ্যে শিক্ষাপদ্ধতি প্রণয়ন করে না— করতে চাইলেও ফল সম্পূর্ণ বিপরীতই হবে। কারণ, রাষ্ট্র নিজের স্বার্থেই তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, চালাবে, প্রয়োজনমতো দোমড়াবে চোমড়াবে। ধর্মের ঋজু-সারল্য তখন আর থাকবে না, হয়ে পড়বে তা রাজনৈতিক দাবা খেলার গুঁটি।

তখন পরলোকমুখীনতা ছেড়ে ধর্মও হয়ে উঠবে ইহলোকমুখী আর ইহলোক মুখীনতা মানে সেক্যুলারিজম। এখন আমাদের ধর্ম-ভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির যে দশা হয়েছে তখন ধর্ম-শিক্ষারও সে একই দশা হবে। জমাআতে ইসলাম বা নেজামে ইসলাম এখন ধর্মের কথা যত না বলে তার চেয়ে অন্তত শতগুণ বেশী বলে নির্বাচনের কথা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতালাভের কথা। ওদের সর্বশক্তি এখন সেদিকেই নিয়োজিত। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের হাতে ধর্মের এ দুর্দশা না হয়ে যায় না। এ অবস্থায় ধর্মের যে-আসল উদ্দেশ্য মানুষকে আল্লায় নিবেদিত-প্রাণ করে তোলা, সে ভূমিকা তখন আর থাকবে না। ধর্মকে তখন ইচ্ছামতো রাজনৈতিক তথা দুনিয়াভী উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হবে। তাই ধর্মের নামে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান করার আমি ঘোর বিরোধী—এমনকি মসজিদে, মিলাদে, ঈদের জামাআতে আর যে-কোন ধর্মসভায়ও রাজনৈতিক আলোচনা কিংবা রাজনীতি নিয়ে আসারও আমি পক্ষপাতী নই।

ধর্মের একটা শাশ্বত ভূমিকা আছে। পারলৌকিক জীবনের প্রস্তুতি ছাড়াও মানুষের আত্মার বিকাশসাধনও ধর্মের উদ্দেশ্য আর ভূমিকা। রাষ্ট্রের এলাকা এসবের বাইরে। পরলোক আর আত্মা নিয়ে রাষ্ট্র মাথা ঘামায় না। ঘামাতে গেলেই রাষ্ট্র আর ধর্ম দুই-ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অধিকন্তু তখন ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরোধ নির্ঘাত আর একটা কারবালা ঘটাবে। ঐতিহাসিকদের অজানা নয় আগের কারবালাটাও ঘটেছিল ধর্ম আর রাষ্ট্রশক্তির বিরোধের ফলেই। ধর্ম সনাতন, চিরন্তন আর অচল, রাষ্ট্র সচল, ক্রম-পরিবর্তনশীল তাবৎ বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয় রাষ্ট্রকে। এছাড়া আজকের দিনে রাষ্ট্রের পক্ষে অস্তিত্ব রক্ষা অসম্ভব। এ কারণেই ‘ইসলামী’ নাম শিরে বহন করেও পাকিস্তানকে একদিকে কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য দিকে কাট্টা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সাথে দোস্তি করে চলতে হচ্ছে।

ধর্ম আর রাষ্ট্রের ভূমিকা-যে সম্পূর্ণ আলাদা একথা উপরেও একবার উল্লেখ করেছি। এ সত্যটা অনেক সময় ভুলে থাকা হয় বলে এ দুইকে মিলিয়ে এক বিভ্রান্তিকর অবস্থা ডেকে আনা হয় আমাদের দেশে। ধর্ম-ভিত্তিক বনাম ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষা নিয়ে যে-বিতর্ক, তাও এ বিভ্রান্তিরই নতিজা। ধর্ম যদি মানুষের মনে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার আর পারলৌকিক জীবনের নির্দেশকের ভূমিকা ছেড়ে রাষ্ট্রের মতো এক স্থূল জাগতিক তথা সেক্যুলার বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে আর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নেয় তা হলে ধর্ম স্বধর্মচ্যুত না হয়ে পারে না। সে সঙ্গে রাষ্ট্রও হবে ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ, রাষ্ট্র তখন তার চলিষ্ণুতা হারাতে বাধ্য হবে। সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নীতি নির্ধারণ তখন অসম্ভব হয়ে পড়বে রাষ্ট্রের পক্ষে। রাষ্ট্রের স্বার্থে ধর্মীয় নির্দেশ যুগের প্রয়োজন মেনে চলবে না কোনদিন। অন্যদিকে রাষ্ট্রকে হতে হয় যুগোপযোগী। ফলে ছোট ছোট ব্যাপারেও তখন দেখা দেবে বহু তর্কযুদ্ধ—অহিংসায় যার সমাপ্তি ঘটবে না কোন দিনই। পাক-সৈন্যদের প্যান্ট, হাফ হবে কি ফুল হবে, য়ুরোপীয় হ্যাটের অনুকরণে তৈরী হেলমেট পরা আমাদের পুলিশদের পক্ষে জায়েজ কিনা ইত্যাদি হাজারো বহছের দরজা তখন খুলে দেওয়া হবে, যা প্যান্ডোরার বাক্সকেও হার মানাবে!

ধর্ম এক নয়, বহু। আবার প্রতি ধর্মের রয়েছে হাজারো ফেরকা। ইসলামও তার ব্যতিক্রম নয়। এক এক ধর্ম এক এক বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য। রাষ্ট্র কিন্তু তা নয়, দেশের ভৌগোলিক সীমার অন্তর্গত সব সম্প্রদায় আর সব মানুষের জন্যই রাষ্ট্র। এমনকি ধর্মহীন অবিশ্বাসীর জন্যও। ধার্মিকরা যাদের ‘কাফের’ বলেন তাদের জন্যও। নাস্তিককে রাষ্ট্র অস্বীকার করতে কিংবা কুফরী কি নাস্তিকতার অভিযোগে পারে না দণ্ড দিতে। ধর্ম কিন্তু পারে, দিয়েও থাকে দণ্ড। ধর্ম অবিশ্বাসীকে ইহলোকে একঘরে করতে পারে আর পরকালের জন্য পারে নরকবাসের ব্যবস্থা দিতে। রাষ্ট্র এ ধরনের কিছুই পারে না করতে, করলে ঐ দেশ রাষ্ট্র নামের যোগ্যতাই হারাবে। আমার বিশ্বাস ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্রের আর রাষ্ট্র দিয়ে ধর্মের কাজ কখন পুরোপুরি চলতে পারে না। চালাতে গেলেই বিরোধ আর সংঘর্ষ অনিবার্য। স্রেফ মুসলিম রাষ্ট্রেও এ সম্ভব নয়। কারণ, মুসলমানদের মধ্যেও ফেরকার অন্ত নেই। শিয়া, সুন্নি, আহমদি, কাদিয়ানী, ওহাবী-মজহাবী-লামজহাবী ইত্যাদি ফেরকার কোন সীমা নেই। ধর্মীয় ব্যাপারে সব ফেরকারই ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস আলাদা। ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার নামে প্যান্ডোরার বাক্সেও মুখ খুলে দেওয়া হলে প্রথম সমস্যাই দেখা দেবে কোন্ ফেরকার বিশ্বাস আর আকিদা-অনুসারে পাঠ্যসূচী তৈরি করা হবে? রাষ্ট্র স্রেফ সংখ্যার দাবীতে কারো ধর্মীয় দাবী অস্বীকার করতে পারে না। শুধু কোরান-হাদিসের দোহাই দিয়েও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কারণ, কোরান-হাদিসের ভাষ্য আর ব্যাখ্যা নিয়েই তো এসব ফেরকার উৎপত্তি। মোটকথা, ধর্মভিত্তিক শিক্ষাকে সব দেশের মতো আমাদের দেশেও বে-সরকারী পর্যায়ে বে-সরকারী নিয়ন্ত্রণেই রাখতে হবে। ধর্ম-শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারী হস্তক্ষেপ আমার মতে কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়। তাতে সমস্যা আরো জটিল হয়ে দাঁড়াবে। এ বিতর্কের সূচনায় যে-বিরোধ আর সংঘর্ষ দেখা গেছে তা আবো বৃদ্ধি পাবে। আর এ বিরোধ আর সংঘর্ষ ঘটবে মুসলমানে মুসলমানে, পাকিস্তানী পাকিস্তানীতে।

নতুন লেখার নোটিফিকেশন পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

কপিরাইট সংক্রান্ত

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।

মন্তব্য করুন