প্রবন্ধধর্মশিক্ষা-সমস্যা | মমতাজউদ্দীন আহমদ এম.এ.

শিক্ষা-সমস্যা | মমতাজউদ্দীন আহমদ এম.এ.

বিবর্তন অত্যন্ত ধীরগতির বিষয়। বাঙালির বুদ্ধির বিবর্তন একটু বেশিই ধীরগতির। বাঙালি মুসলমানের বিবর্তন তারচেও ধীর গতির। হয়তো সেজন্যই প্রায় একশ বছর আগে লেখা প্রবন্ধে যেসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, বাঙালি মুসলমান এখনো সেসব সমস্যার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে।

শিক্ষা-সমস্যা | মমতাজউদ্দীন আহমদ এম.এ.

বিবর্তন অত্যন্ত ধীরগতির বিষয়। বাঙালির বুদ্ধির বিবর্তন একটু বেশিই ধীরগতির। বাঙালি মুসলমানের বিবর্তন তারচেও ধীর গতির। হয়তো সেজন্যই প্রায় একশ বছর আগে লেখা প্রবন্ধে যেসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, বাঙালি মুসলমান এখনো সেসব সমস্যার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে।

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এর মুখপত্র ‘শিখা’ পত্রিকায় এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। তখন লেখকের বয়স ২৪ বছর। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে তিনি তৎকালীন বাঙালি মুসলিম সমাজের শিক্ষা সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করেছেন। এটা খুব বেশি অবাক হওয়ার মতো তথ্য নয়, কারণ সে সময় আরো কম বয়সীরাও দেশ-সমাজ নিয়ে সুচিন্তিত লেখালেখি করতেন। কিন্তু অবাক হতেই হয়, যখন দেখি প্রায় শতবর্ষ আগে লেখা প্রবন্ধটি এখনো সমান প্রাসঙ্গিক, কারণ আমাদের অবস্থা খুব বেশি বদলায়নি।

প্রবন্ধটি ‘অবিশ্বাস’ এ প্রকাশের জন্য প্রস্তুত করেছেন মহিউদ্দিন শরীফ।


 

শিক্ষার দুইটি দিক আছে cultural এবং Practical-শারীরিক মানসিক বৃত্তিগুলির উৎকর্ষ সাধন এবং আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বর্জন। প্রথমতঃ শিক্ষার উদ্দেশ্য শারীরিক ও মানসিক বৃত্তিগুলির উৎকর্ষ সাধন-ইহা শারীরিক ও মানসিক ব্যায়াম:স্বরূপ। পুরাকালে অনেকের ধারণা ছিল যে, আত্মার উন্নতিসাধনে শরীর একটি অন্তরায় মাত্র; তাই কেহ কেহ আত্মার উন্নতির জন্য শরীরকে যথাসম্ভব নির্যাতন উৎপীড়ন করিয়াছেন। কিন্তু বর্ত্তমান সভ্য জগতে এরূপ সন্ন্যাস ধর্মের সমর্থন করা হয় না। বিজ্ঞান প্রত্যক্ষভাবে অকাট্য প্রমাণ দ্বারা দেখাইয়া দিতেছে যে, মন শরীরের সহিত অতি ঘনিষ্ট ভাবে সংশ্লিষ্ট। একের ভালমন্দ অন্যে পায়। তাই শরীরের সুস্থতা নষ্ট করিয়া আত্মার উদ্ধার করিতে গেলে আধ্যাত্মিক উন্নতি দূরের কথা, আধ্যাত্মিক অবনতি উন্মত্ততায় পর্যবসিত হয়। পক্ষান্তরে আমরা ক্রমবিকাশবাদ অনুসারে মানবেতর জীবের বংশধর হইলেও, বিবেক বুদ্ধির আবির্ভাবে আমরা নূতন জাতিতে পরিণত হইয়াছি। আমরা আর মানবেতর জীবদের মত জীবনযাপন করিতে পারি না। অধ্যাপক হাক্সলী সাহেব তাহাঁর Ethics and Evolution নামক Romans Lecture-এ ইহা সুস্পষ্টভাবে বুঝাইয়া দিয়াছেন। তাই জন স্টুয়ার্ট মিল বলেন, সুখী শূকরের চেয়ে অসুখী সক্রেটিস হওয়া ভাল—‘It is better to be a Socrates dissatisfied than a pig satisfied’ অতএব আমাদের পক্ষে আত্মা এবং শরীর দুইটিই সমোপযোগী এবং কোনোটারই পৃথকভাবে পূর্ণ বিকাশ বা পরিপুষ্টিসাধন সম্ভবপর নয়। তাই শরীর মন দুইটিরই যাহাতে যুগপৎ উৎকর্ষসাধন হয় সেইরূপ শিক্ষাই আদর্শ শিক্ষা।

দ্বিতীয়তঃ Practical বা কাজের দিক দিয়া দেখিলে শিক্ষার উদ্দেশ্য আমাদের সুখ সমৃদ্ধি বর্ধ্বন। শিক্ষা আমাদিগকে জ্ঞান দান করে। শিক্ষা দ্বারা আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে মানবজাতি অতীতযুগে এবং বর্ত্তমানের প্রকৃতির সম্বন্ধে, জড়জগৎ, জীবজগৎ, মনোজগৎ সম্বন্ধে যে জ্ঞান অর্জন করিয়াছেন এবং ঐ জ্ঞানের সাহায্যে ইহাদিগকে মানবজাতির কল্যাণার্থে কাজে লাগাইবার জন্য কল-কারখানা, সামাজিক আচার ব্যবহার, রীতিনীতি প্রভৃতি যে সকল উপায়, কৌশল-কৌশলাদি আমরা আয়ত্ব করিয়া প্রকৃতিকে আমাদেরও কাজে লাগাইতে পারি, এবং এই উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত ভিত্তির উপর দাড়াইয়া আমরা নূতন জ্ঞান অর্জন এবং তদ্বারা অভিনব উপায় উদ্ভাবন ও অবলম্বন করিয়াও ক্রমশঃ মানবজাতির সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বাড়াইয়া তুলিতে পারি। সক্রেটিস প্রমুখ প্রাচীন মনীষিগণের ধারণা ছিল যে জ্ঞানই ধর্ম। কিন্তু এই নব যুগের বার্তা হচ্ছে জ্ঞানই বল।

প্রকৃতিকে বিজ্ঞান বলে আমরা যতই ঘনিষ্টভাবে জানিতে পারিতেছি ততই দেখিতে পাইতেছি যে, প্রকৃতি অতি সুনিয়মে নিয়ন্ত্রিত। আমরা প্রকৃতির নিয়মাদি জানিয়া প্রকৃতিকে তাহারই নিয়মাদির সাহায্যে ক্রমশঃ আমাদের বশে আনিতে পারিতেছি এবং আমাদের কাজে লাগাইয়া আমাদের শারীরিক মানসিক বৃত্তিগুলির উৎকর্ষ সাধন করিতে পারি এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পরিবর্ধ্বিত করিতে পারি। অতএব শিক্ষা একদিকে আমাদিগকে উৎকৃষ্ট পরিপুষ্ট শারীরিক মানসিক বৃত্তিগুলি স্বরূপ ক্ষমতা দেয় এবং অন্যদিকে জ্ঞানরূপ অস্ত্র দান করে, য’দ্বারা আমরা প্রকৃতিকে জয় করিয়া সুখ স্বচ্ছন্দে জীবন যাপন করিতে পারি। যে জাতি প্রকৃত শিক্ষা লাভ করিয়া শারীরিক মানসিক বৃত্তিগুলির পরিপুষ্ট করিয়াছে, কার্লাইলের mens sana incorpore sano সুস্থ শরীরে সুস্থ মন লাভ করিয়াছেন এবং জ্ঞান অর্জন করতঃ প্রকৃতিকে বশে আনিয়া আর্থিক, নৈতিক, সামাজিক, আচার ব্যবহারাদি সেই জ্ঞানানুযায়ী গঠিত করিয়া মানব জাতির সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিধানে যত বেশী কৃতকার্য হইয়াছে, তাহারাই প্রকৃত প্রস্তাবে তত বেশী সভ্যতার দাবী করিতে পারেন। শারীরিক মানসিক উৎকর্ষসাধন এবং মানব জাতির সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধান ব্যতীত সভ্যতার আর কি মাপকাঠি হইতে পারে?

অতএব প্রকৃত শিক্ষা দ্বারাই আমরা বাঁচিয়া থাকিবার শক্তি এবং সভ্যতা লাভ করিতে পারি।

গত বৎসর বাংলায় শিক্ষা সম্বন্ধে সরকারী রিপোর্টে দেখা যায় যে, প্রাথমিক শিক্ষায় মুসলমান ছাত্র বেশ আছে কিন্তু স্কুল কলেজে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা শতকরা তের/ চৌদ্দ মাত্র, স্কুল কলেজে মুসলমান মেয়েদের সংখ্যা শতকরা একজনও হয় কিনা সন্দেহ। কিন্তু মাদ্রাসা গত বৎসর ৫০টি বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং ছাত্র সংখ্যাও সেই অনুপাতে বাড়িয়া চলিয়াছে।

প্রাথমিক শিক্ষায় মুসলমান ছেলেরা পাঠশালা মক্তব যেখানেই পড়ুক সাধারণতঃ দুই এক বৎসর তাহারা কোরান শরীফ পড়িয়াই কাটাইয়া দেয়। তারপর বাংলা এবং উর্দ্দু একসঙ্গে পড়িতে আরম্ভ করে। কেহ কেহবা সঙ্গে একটু পার্শী বয়েত পড়ে। বাংলা পড়াটা তাদের পক্ষে বাহুল্য বিলাসিতা মাত্র। বলা বাহুল্য আরবী, পার্শী, উর্দ্দু, কেতাব কোরান ছেলেমেয়েরা আদৌ না বুঝিয়াই পাঠ করে। সাধারণতঃ মুসলমানদের মধ্যে একটা কুসংস্কার প্রচলিত আছে যে, আরবী-কোরান শরীফ, এমন কি আরবী, ফার্সী, উর্দ্দু যে কোনো কেতাব না বুঝিয়া পড়িলেও পুণ্য হয়। শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যেও অনেকে উর্দ্দু ভাষায় কথাবার্ত্তা বলাটা বেশ সুশিক্ষার, পরিমার্জিত রুচির এমন কি আভিজাত্যের পরিচায়ক মনে করেন। ভাষা ভাব প্রকাশ করিবার অস্ত্রমাত্র। অবস্থাভেদে বিভিন্ন ভাষার উৎপত্তি হইয়াছে। কোনো ভাষা সম্বন্ধে বিশেষ মাহাত্ম্য বা ঐশ্বরিক অনুগ্রহাদি কিছুই নাই। অতএব অর্থগ্রহণ করিতে না পারিলে কোন ভাষায় লিখিত পুস্তকাদি ধৰ্ম্ম গ্রন্থই হউক আর যাই হউক, পাঠের কোনও সার্থকতা নাই। বরং এরূপ নিরানন্দ একঘেয়ে খাটুনীতে ছেলেদের বুদ্ধিশক্তির প্রখরতা নষ্ট হয়। আমরা মুসলমান অতি দরিদ্র, শতকরা নিরানব্বই জনই ছেলেকে আট/নয় বৎসর বয়সের বেশী পড়াশুনায় রাখিতে পারি না।

তাদের সাহায্য ব্যতীত জীবিকা উপার্জন অসম্ভব হইয়া দাঁড়ায়। কাজেই এই আট/নয় বৎসর বয়সেই তাদের শিক্ষা সমাপ্ত করিতে হয়। বর্ত্তমানে আরবী, ফার্সী, উর্দু, বাংলা পড়িয়া ছেলেরা কোনটাই এই অল্প সময়ে কার্যোপযোগী মত আয়ত্ত করিতে পারে না। কাজেই তাদের শিক্ষাটা বরং সময় ও শক্তির অপব্যয় মাত্র। ছাত্র জীবনের সঙ্গে তাদের লেখা পড়ার জীবনও শেষ হয়। মাত্র এইটুকু সার্থকতা হয় যে, কেহ কেহ মধ্যে মধ্যে কোরান শরীফখানা একটু একটু পড়ে এবং স্মরণ থাকিলে দুই একটি পার্সী বয়েত বা উর্দ্দু গজল আওড়ায়। মাতৃভাষাই ছেলেমেয়েরা সব চেয়ে সহজে আয়ত্ত করিতে পারে। অতএব আরবী ফার্সী না বুঝিয়া পড়িলেও পুণ্য সঞ্চয় হয় এই কুসংস্কার ত্যাগ করিয়া এই সকল বিজাতীয় ভাষা ছাড়িয়া দিয়া যদি ছেলে মেয়েদিগকে একমনে বাংলা ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয় তাহা হইলে তাহারা এই অল্প সময়েই ভাষা কার্যোপযোগী মত আয়ত্ত করিয়া ফেলিতে পারে এবং স্বাস্থ্য, কৃষি, সৰ্ব্ববিধ বিষয়ে পুস্তকাদি পড়িয়া এবং কোরান শরীফ ও অন্যান্য ধর্ম্ম ও নীতিশাস্ত্রগুলিও বাংলায় পাঠ করিয়া অর্থ গ্রহণ করতঃ কৰ্ম্ম-ধৰ্ম্ম-নীতি জ্ঞান লাভ করিতে পারে।

কুসংস্কারের বশীভূত হইয়া অনেকেই গান-বাজনা খেলাকে নিতান্তই ঘৃণার চক্ষে দেখেন। গীত সঙ্গীতের মত আর কিছুতেই এত বিশুদ্ধ আমোদ পাওয়া যায় না; এবং আমার মনে হয় গীত সঙ্গীত যেন আমাদের আত্মারও উন্নতি হয় ; নীচ ভাব দূর হইয়া যায়। ইহার পরশে যেন আমাদের হৃদয়ের গভীরতম তন্ত্রী বাজিয়া উঠে। খেলায় এরূপ অনেক শিক্ষা হয়, যাহা পাঠশালায় পুস্তকাদি পড়িয়া লাভ করা যায় না। খেলায় আমাদের শরীরে ব্যায়াম হয়, সাহস বাড়ে, একতা, সহযোগিতা, পরস্পর সহানুভূতি ও নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষা হয়। অতএব পাঠশালাগুলিতে গীতসঙ্গীত, খেলাদি প্রবর্তন করা অত্যাবশ্যক। মেয়েদের শিক্ষার আরও একটা বড় অন্তরায় পর্দা। একটু বয়স হইলেও মেয়েরা পর্দার খাতিরে পাঠশালায় যাওয়া বন্ধ করে। দরিদ্র মুসলমানগণ ত আর প্রত্যেক বাড়ীতে মাস্টার বা মিস্ট্রেস রাখিয়া পড়াইতে পারে না। তাই মেয়েদের পড়াটা ৭/৮ বৎসর বয়সেই শেষ হয়। পর্দা মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য অতএব ভবিষ্যৎ জাতির শিক্ষা, স্বাস্থ্যেরও সর্বনাশ করিতেছে। শারীরিক মানসিক উৎকর্ষ সাধন এবং সুখ স্বাচ্ছন্দ্য-বিধানই সভ্যতার সার্থকতা। এই মাপকাঠি দ্বারা বিচাৰ্য। অতএব সত্যের তাড়নায় বলিতে হইবেই যে, যদিও অনেকেই মনে করেন যে, তথাকথিত পর্দা যতই কড়াভাবে বজায় রাখা যায় ততই আভিজাত্যের পরিচায়ক, প্রকৃত প্রস্তাবে ইহা ততোধিক বর্বরতা ও অসভ্যতার নিদর্শন।

শিক্ষার দুইটি অঙ্গ (১) শিক্ষা প্রণালী এবং (২) শিক্ষার বিষয়— দুইটিই যে দিন দিন উন্নত হইতেছে ইহা এই যুগে সর্বাদিসম্মত। ক্রমবিকাশবাদ আমাদের মোহ ভাঙ্গাইয়া দিয়াছে। এখন সকলেই ভাবে কলিযুগ চলিয়া গিয়াছে, সত্যযুগ অতীতে নয়, ভবিষ্যতে আমরা ক্রমেই উহার দিকে অগ্রসর হইতেছি। মানবজাতি সভ্যতায় উত্তরোত্তর ক্রমোন্নতি অস্বীকার করা যায় না। তাও প্রত্যেক যুগের সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, ঐ যুগের উপযোগী থাকে। তার পরের যুগে আরও উন্নত বিজ্ঞান, দর্শন ইহাদের স্থান অধিকার করে। এইরূপে জগৎটি চলিয়াছে। যারা এই নিয়মের বিরুদ্ধাচারণ করে তারাই জীবন সংগ্রামে অকৃতকাৰ্য্য হইয়া সভ্যতায় পাছে পড়িয়া থাকে। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে শৈশবকালে যে জামা স্বাস্থ্যকর তাহাই যৌবনে বা প্রৌঢ়াবস্থায় ব্যবহার করিতে গেলে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হয় এবং শরীর বর্ধ্বনে বাঁধা জন্মায়। উহা রাখিতে হইলে শরীরের বর্ধ্বনানুযায়ী ইহার প্রসারণ দরকার অর্থাৎ জামা বদলাইতে হইবে। সেইরূপ আমাদের জাতীয় জীবনেও সামাজিক আচার-ব্যবহার, শিক্ষাদির ধারা সহস্রাধিক বৎসর পূর্ব্বের, তখনকার মনীষিগণ ঐ যুগের জন্য যাহা ব্যবস্থা করিয়াছিলেন তাহা সমাজের এই বর্ধ্বিত অবস্থায় পরিবর্তিত করিতে হইবে। অলৌকিক সলৌকিক যাই হউক, সনাতন বলিয়া গায়ের জোরে বজায় রাখিতে চাহিলে সমাজের স্বাভাবিক বর্ধ্বনে বাঁধা দিয়া সমাজকে অধঃপাতের দিকে টানিয়া লইয়া যাওয়া হইবে। সনাতন হইলেও অবস্থাভেদে বিভিন্ন ব্যবস্থার রূপ পরিগ্রহ করিতে হইবেই।

আমাদের মাদ্রাসার শিক্ষাপ্রণালী এবং শিক্ষার বিষয় পাঠ্যপুস্তকাদি দুই-ই শত শত বৎসর পূর্ব্বের। তাই এই যুগের উপযোগী নয়, অনেক পাছে পড়ে আছে। পাঠ্যপুস্তকাদি একরূপ environment স্বরূপ এবং ইহাদের অনুযায়ী চরিত্র গঠিত হয়। তাই এই বহুকাল অতীত যুগের পুস্তকাদি পাঠ করিয়া তাহাদের যে চরিত্র গঠিত হয়, তাহা এই যুগের উপযোগী হয় না। জ্ঞানার্জ্জন বিষয়েও তদ্রুপ। পূর্বেই বলিয়াছি যে, জ্ঞান প্রকৃতিকে বশে আনিয়া আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য বঞ্চিত করার একটি অস্ত্র। দিন দিন জ্ঞানের উন্নতিতে নূতন নূতন জ্ঞানরূপ অস্ত্র আবিষ্কৃত হইতেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে যেরূপ যাহারা সাবেকী অস্ত্রকৌশল ব্যতীত নূতন অস্ত্রকৌশল ব্যবহার করিতে পারেন তাহারাই জয়ী হন, সেইরূপ ব্যক্তিগত এবং জাতিগত জীবন সংগ্রামেও যাহারা নূতন জ্ঞানরূপ নূতন অস্ত্র ব্যবহার করিতে পারেন, তাহারাই জয়ী হইয়া শারীরিক মানসিক উৎকর্ষ সাধন এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বর্ধন করতঃ সভ্যতায় অগ্রগামী হয়। কিন্তু মাদ্রাসায় এই নূতন জ্ঞান দেয় না। অতএব মাদ্রাস-শিক্ষা শিক্ষার cultural এবং practical দুইদিকেই অসম্পূর্ণ, ক্ষতিজনক, অতএব সৰ্ব্বতোভাবে পরিহার্য্য। ওল্ড স্কীম মাদ্রাসার জায়গায় আজকাল নিউ স্কীম নামক মাদ্রাসার একটা নূতন edition বাহির। হইয়াছে। Old edition-এর দোষগুণ নূতন edition-এ পূর্ণ মাত্রায়ই বর্ত্তমান আছে। তদ্ব্যতীত ইহাইে ইংরাজী বাংলা যোগ করায় বরং আগের মত শাস্ত্রজ্ঞানটাও তাহাদের হয় না—তাহারা jack of all trades master of none. যদি ইহা লোককে ফাঁকি দিয়া ইংরাজী পড়ার দিকে ধাবিত করিবার জন্য অবলম্বন করা হইয়া থাকে, তবে ইহার দোষগুণ স্বতন্ত্রভাবে বিচার্য্য।

তদুপরি মাদ্রাসা শিক্ষায় ইসলামিক ইতিহাস, দর্শন, শাস্ত্র, সাহিত্যও শিক্ষা হয় না। ছাত্র জীবনে কেবল শারীরিক মানসিক উৎকর্ষ-সাধন এবং অধ্যয়নের রীতিনীতি শিক্ষা হয়। জ্ঞানার্জ্জনের ব্যবসায় শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু জ্ঞান অর্জ্জন করিতে হইলে ছাত্র জীবনের পরে বহু বৎসর অধ্যয়ন, গবেষণা করিতে হয়। কিন্তু মাদ্রাসার ছাত্রগণ ত ঐরূপ কিছুই করেন না। তাহারাও আমাদেরই মত চাকুরীর তালাসেই থাকেন। পদ খালি থাকিলে তাহারা মাদ্রাসার মৌলবী হন, নতুবা নূতন মাদ্রাসা স্থাপন করিয়া লন। কেহ কেহ বা পীর সাজিয়া বা ওয়ায়েজ সাজিয়া পুরোহিতের ব্যবসায় গ্রহণ করিয়া জীবিকা উপার্জ্জন করেন। নিজেরাও বর্ত্তমান যুগের কিছুই জানেন না। কিন্তু যাহা জানেন, তাহারাও ব্যবসায়ের খাতিরে অপলাপ করিয়া সমাজের কুসংস্কারগুলির সায় দিয়া সেইগুলি আরও দৃরীভূত করেন। কারণ কোনরূপ বিপ্লববাদ প্রচার করিলে তাহাদের ব্যবসায় মারা যায়। তদুপরি অশিক্ষিত লোক সাধারণতঃই একটু অত্যধিক ধৰ্ম্মপ্রাণ। তাহাদের এই দূর্ব্বলতা আরও বাড়াইয়া দিয়া তাহাদিগকে সংসারে উদাসীন করিয়া এই দরিদ্রদের কষ্টোপার্জিত অর্থ এই ব্যবসায়ী পুরোহিতগণ পীর ও ওয়ায়েজের বেশে লুটিয়া লয়। মাদ্রাসা শিক্ষা যতই বেশী চলিতে থাকিবে এইরূপে সমাজের বোঝা ততই বাড়িবে। এই সভ্য জগতে কেবল পুরোহিত্যের দল তৈয়ারী করিয়া কি কোনও জাতির উদ্ধার সন্তবপর? জাতি হিসাবে বঁচিয়া থাকিতে হইলে চাই বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক, দার্শনিক।

Islamic studies শিক্ষার জন্যও মাদ্রাসার পরিবর্তে তাহারা কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়িতে পারেন, এরূপ আট/দশটি মেধাবী ছাত্র যথেষ্ট বৃত্তি লইয়া Islamic studies অধ্যয়নে জীবনটি উৎসর্গ করিতে পারেন, এবং অন্যান্য ধর্ম্মের গ্রন্থাদি, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন পাঠ করিয়া ইসলামিক এবং অন্যান্য দেশে ভ্রমণ করিয়া আর্ধিক, নৈতিক, সামাজিক অবস্থাদি পৰ্যবেক্ষণ করিয়া নিজের ঐহিক ও পারত্রিক জ্ঞান অর্জন করতঃ ইসলামের ধৰ্ম্মোপদেশ, ইসলামের সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শনকে সেই জ্ঞানের আলোতে দেখাইতে পারেন। এইরূপে তাহারা ইসলামকে কেবল মুসলমানদের নিকট কেন, সমগ্র জগতের সম্মুখে উজ্জ্বল করিয়া তুলিতে পারেন। এরূপ না করিলে ধৰ্ম্মটিওে বজায় রাখা দিন দিন সুকঠিন হইয়া দাড়াইবে। আজকাল বিজ্ঞান দর্শনের যুগ। ধর্ম্ম প্রচারকগণও বিজ্ঞান দর্শন এড়াইয়া চলিতে পারিবেন না। আধুনিক বিজ্ঞান দর্শনাদির সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া ধৰ্ম্মগ্রন্থাদি বুঝাইতে হইবে, নতুবা ধৰ্ম্মটি অপার্থিব এবং অসম্ভব বলিয়া প্রতিপন্ন হইবে। অনেক স্থলে বা হাস্যম্পদও হওয়া বিচিত্র নহে। বাহুবলে ধৰ্ম্মপ্রচার বা রক্ষা সভ্যজগতে অসম্ভব। ধৰ্ম্মপ্রচার করিতে হইলে, ধর্ম্মের বাঁধন দৃঢ়ীভূত করিতে হইলে ইহাকে বিবেকের অনুমোদনাযায়ী সুমার্জিত করিতে হইবে। ধর্ম্ম জিনিষটা আমাদেরই হিতের জন্য। খোদাতালা All perfect, তাহার কোন কিছুতে প্রয়োজন নাই, কিন্তু যদি ধৰ্ম্মকে আমাদের দৈনন্দিন জীবন হইতে সরাইয়া রাখা হয়, তাহার সমস্যা সমাধানে অকেজো হয়, তাহা হইলে ধৰ্ম্মের উদ্দেশ্যও সাধিত হইবে না, ইহার বাঁধনও শিথিল হইয়া পড়িবে।

পূর্ব্বের আলোচনায় ইহা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হইবে যে, মাদ্রাসা শিক্ষায় Islamic studies অধ্যয়নের উদ্দেশ্য সাধিত হওয়া অসম্ভব। তাহারা বাস করেন অতীত যুগে এবং সর্বদাই আসমানের নামে মনের বাসনায় মশগুল। উল্লিখিত বিবরণের আট/দশ জন লোক দ্বারা ইসলামিক শিক্ষার কাৰ্য্য সম্পূর্ণ হইতে পারে এবং প্রাথমিক শিক্ষা প্রণালী উল্লিখিত আদর্শে সংশোধিত হইলে, বাংলার মধ্যে এই মুষ্টিমেয় পণ্ডিতগণের অধ্যয়ন ও গবেষণার ফল ঘরে ঘরে প্রচারিত হইতে পারে। অতএব এই দরিদ্র সমাজ বৎসর বৎসর হাজার হাজার মৌলভী তৈয়ারী করিয়া তাহাদের জীবন নাশ করিয়া এবং সমাজের আবর্জ্জনা বাড়াইয়া কি লাভ করিতেছে?

আমার শিক্ষার আদর্শ অনুযায়ী মুসলিম শিক্ষা-প্রণালীর সংশোধন করিতে হইলে প্রাথমিক শিক্ষার আরবী, ফার্সী, উর্দু বিজাতীয় ভাষা একেবারে উঠাইয়া দেওয়া এবং নূতন পুরাতন সকল মাদ্রাসা বন্ধ করিয়া স্কুল কলেজের শিক্ষা প্রণালী অবলম্বন করা উচিত। হিন্দুগণের ত বিশেষ সংস্কৃত বিদ্যালয় নাই, তাই বলিয়া কি তাহাদের সংস্কৃত শিক্ষা হইতেছে না? আমাদের মাদ্রাসা বন্ধ হইলে চলিবে না কেন? স্কুল কলেজের বর্ত্তমান শিক্ষা-প্রণালীতেও দোষ আছে বটে, কিন্তু এর চেয়ে ভাল শিক্ষা-প্রণালীর অভাবে, আমাদের ইহাই অবলম্বন করিতে হইবে। কেহ কেহ বলেন যে, আমরা মুসলমান দরিদ্র, স্কুল কলেজের খরচ চলে না, মাদ্রাসা শিক্ষা অপেক্ষাকৃত সুলভ। অতএব অশিক্ষিত থাকার চেয়ে মাদ্রা্সা শিক্ষাও ভাল। কিন্তু আমার মনে হয়, মাদ্রাসার কুশিক্ষার চেয়ে অশিক্ষাই ভাল। কারণ তাতে জাতীয় শক্তির অপব্যয় হয় না। যাহারা উচ্চ শিক্ষা লাভে অসমর্থ তাহারা প্রাথমিক শিক্ষা উত্তমরূপে পাইলেই যথেষ্ট। সকলের উচ্চ শিক্ষা লাভ না হইলেও বিশেষ আসে যায় না। বেকার সমস্যা ও অর্থ ব্যয় মাদ্রাসা শিক্ষা ও স্কুল শিক্ষা দুই বেলাই আছে। তবে মুসলমান সমাজ মনে করে যে, মাদ্রাসা শিক্ষায় অর্থোপার্জ্জন হইলে দীন দুনিয়া, দুইটিই হাসিল হয়। অর্থোপার্জ্জন না হইলেও অন্ততঃ আখেরাতের পথ পরিষ্কার হইবে কোনও সন্দেহ নাই। যদি আমাদের সমাজের এই সকল কুসংস্কার দূর করা যায় এবং মুসলিম জনমত মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি যেরূপ সুপ্রসন্ন ইংরাজী শিক্ষার প্রতিও এই সুনজর হয়, তাহা হইলে ইংরাজী শিক্ষাও নিশ্চয়ই অনেকটা সুলভ হইয়া পড়িবে।

আমি শিক্ষার যে আদর্শ অংকন করিতে চেষ্টা করিয়াছি এবং বর্ত্তমান বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের শিক্ষার যে চিত্র আপনাদের সম্মুখে ধরিয়া ঐ আদর্শানুযায়ী ইহার দোষগুণ বিচার করিয়া দোষ দূরীকরণার্থে যে পথ নির্দেশ করিতে চেষ্টা করিয়াছি, সে বিষয়ে আমার সঙ্গে মতভেদ হইলে, আমার বিশ্বাস, এইটুকু সত্য সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে যে, সুশিক্ষা ব্যতীত সমাজের কোনও রূপ সংস্কার বা উন্নতি সাধন অসম্ভব। অতএব শিক্ষার কিরূপ আদর্শ হওয়া উচিত এবং ঐ আদর্শ কি উপায় অবলম্বনে কাৰ্য্যে পরিণত করা যায় সেই বিষয়ে সমাজের শুভাকাঙ্ক্ষী সকলে পরস্পর আলোচনা সমালোচনা করিয়া কোনও স্থির সিদ্ধান্তে পৌছিয়া সমবেতভাবে কাৰ্য্য অবিলম্বে আরম্ভ না করিলে এই জটিল সমস্যার সমাধান ত হইবেই না, বরং আমাদের সমাজের অধঃপতন আরও ক্রমবর্ধিত হইবে ও দ্রুত গতিতে চলিবে।

অতএব শিক্ষা সমস্যার সমাধান কল্পে কিরূপে সমবেত চেষ্টা করা যাইতে পারে, সে বিষয়ে দুই একটি কথা বলিতে চাই। প্রথমে ছোট ভাবে আরম্ভ করাই শ্রেয়ঃ। ঢাকাকে কেন্দ্র করিয়া পূৰ্ব্ব বঙ্গের প্রত্যেক জেলার সদরে স্থানীয় শিক্ষিত মুসলমানগণকে লইয়া একটি করিয়া মুসলিম সাহিত্য সমিতি গঠন করিলে, তাঁহারাও আবার নিজ নিজ সমিতির অধীনে প্রত্যেক মহকুমায় একটি করিয়া সমিতি গঠন করিয়া লইতে পারেন। পরে সমগ্র বাংলাদেশে এরূপ Organisation করা যাইতে পারে। ফলে স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে ভাবে আদান প্রদানের সুবিধা হইবে এবং এই সকল ছোট বড় কেন্দ্রগুলির মধ্য দিয়া সমগ্র পূর্ব বাংলার কেন বাংলার শিক্ষিত লোকদের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান এবং শিক্ষার উন্নতিকল্পে সমবেত চেষ্টা সম্ভবপর হইবে। কালে এই ছোট বড় মহকুমা ও জেলা সমিতিগুলি শিক্ষা বিস্তারের কেন্দ্র হইয়া উঠিতে পারে। এরূপ দেশব্যাপী সমবেত চেষ্টা ব্যতীত শিক্ষা সমস্যার সমাধান সম্ভবপর নয়।।

 ‘খোদাতায়ালাকে জানতে হলে তাঁর সৃষ্ট বস্তুর সহিত সম্যক পরিচয় করা আবশ্যক। এই পরিচয়ের ভিতর দিয়ে ধর্ম্ম ও জীবন সামঞ্জস্য লাভ করে।’—আবুল হুসেন।

‘শাস্ত্র ফেলে ধর শাস্ত্রকার

শাস্ত্রের চেয়ে মানুষ বড়’—আবুল হুসেন

 

নতুন লেখার নোটিফিকেশন পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

কপিরাইট সংক্রান্ত

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।

মন্তব্য করুন