প্রবন্ধবাংলাদেশ, বাঙালি ও বাংলাদেশী । আনিসুজ্জামান

বাংলাদেশ, বাঙালি ও বাংলাদেশী । আনিসুজ্জামান

এই জাতিগত সত্তাকে দূরে সরিয়ে রেখে যারা কেবল রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে নিজেদের চিহ্নিত করতে চান, তারা বাংলাদেশকে দেখেন একটু ভিন্নভাবে। ১৯৭১ সালের সমস্ত সংগ্রামকে তাঁরা ভুলে যেতে চান, তার পূর্ববর্তী চব্বিশ বছরের ইতিহাসকে তাঁরা গুরুত্বহীন মনে করেন। জাতিসত্তার প্রশ্নটি ঠেলে ফেলে দেওয়া যায় না, এ কথা বুঝে কেউ কেউ আবার বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন।

বাংলাদেশ, বাঙালি ও বাংলাদেশী । আনিসুজ্জামান

এই জাতিগত সত্তাকে দূরে সরিয়ে রেখে যারা কেবল রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে নিজেদের চিহ্নিত করতে চান, তারা বাংলাদেশকে দেখেন একটু ভিন্নভাবে। ১৯৭১ সালের সমস্ত সংগ্রামকে তাঁরা ভুলে যেতে চান, তার পূর্ববর্তী চব্বিশ বছরের ইতিহাসকে তাঁরা গুরুত্বহীন মনে করেন। জাতিসত্তার প্রশ্নটি ঠেলে ফেলে দেওয়া যায় না, এ কথা বুঝে কেউ কেউ আবার বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন।

আমাদের জাতিগত পরিচয় কী—এ নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। কী হবে আমাদের পরিচয় বাঙালি, না বাংলাদেশী। এই তর্কের মীমাংসা আজ অবধি হয়নি। বিতর্কটি কেবলমাত্র জাতিসত্তার অন্তর অনুসন্ধানে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর মধ্য দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের দীর্ঘ ধারাবাহিক সংগ্রাম ও সেই সংগ্রামের মর্ম-চৈতন্যকে। অসাম্প্রদায়িক ও উদার রাষ্ট্রেরে যে আকাঙ্ক্ষা প্রোথিত ছিল বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে, তা মুছে দিতেই যেন এই বিতর্কের অবতারণা। ড. আনিসুজ্জামান তার এই প্রবন্ধে সেই বিষয়টিই আলোকপাত করেছেন।— অবিশ্বাস টিম।


আমরা বাঙালি না বাংলাদেশী— এ নিয়ে দেশজুড়ে একটা বিতর্ক চলছে। ১৯৭৫ সালের আগে এই বিতর্কের কোনো সম্ভাবনা কিন্তু দেখা যায়নি। বরঞ্চ আমরা খুব নিশ্চিত মনে নিজেদের বাঙালি বলে জেনে এসেছি।

১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময়ে আমাদের চারপাশ থেকে গগনবিদারী ধ্বনি শোনা যেতো— ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’। তখন তো কেউ জিজ্ঞাসা করেনি, কোন বাঙালিকে জাগতে বলছে। সবাই জানতো যে, এই বাঙালির ঠিকানা পদ্মা মেঘনা-যমুনা। সেদিন দেশের মানুষ যাকে নেতা বলে জেনেছিল ও মেনেছিল, তাঁকে উপাধি দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু। ওই উপাধির মধ্যেও জনতার নবলব্ধ আত্মপরিচয়ের প্রতিফলন ঘটেছিল। সেবারের একুশে ফেব্রুয়ারিতে মানুষের বুকে শোভা পেয়েছিল নতুন অভিজ্ঞান বড় করে একটি বাংলা বর্ণ লিখে তার ওপরে-নিচে লেখা হয়েছিল। ‘একটি বাংলা অক্ষর/একটি বাঙালির জীবন’।

সেই ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান যখন ঘোষণা করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট ভেঙে দিয়ে সাবেক প্রদেশগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হবে, তখন অনেকেই বলেছিলেন যে, আমাদের প্রদেশের পূর্ব বাংলা নাম ফিরিয়ে আনতে হবে। কেউ কেউ বললেন, পশ্চিম পাঞ্জাবকে পাঞ্জাব বলা হবে, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলা বলা হোক। ১৯৭০-এর জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমরা দাবি করছি, এ প্রদেশের নাম হবে বাংলাদেশ’। বছরের শেষে ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মারাত্মক পরিণামের খবর দিয়ে সংবাদপত্রে ব্যানার হেডিংয়ে লেখা হয়েছিল: ‘বাংলার মানুষ কাঁদো’। এ কোন বাংলা, তা কাউকে বলে দিতে হয়নি।

তারপর এলো ১৯৭১। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে আকাশবাতাস বিদীর্ণ করে ধ্বনি উঠলো: ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। তখন কেউ প্রশ্ন করেনি, বাঙালি বলতে কাদের বোঝায়, বাংলাদেশের সীমা-সরহদ কোথায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যখন আমরা ‘জয় বাংলা’ বলেছি, তখন আমরা নিশ্চিতভাবে জানতাম, কোন বাংলার জয়ধ্বনি করছি আমরা। তখন পশ্চিম বাংলারও কেউ মনে করেনি যে, তারা এই বাংলার মধ্যে আছে। বরঞ্চ আমাদের দেখিয়ে তারা বলতো, ‘এরা জয় বাংলার লোক’ কিংবা জানতে চাইতো, আপনারা জয় বাংলা থেকে এসেছেন?

আমাদের এই বাঙালি পরিচয় ও এই বাঙালি সত্তা ইতিহাসের একটা ধারার মধ্যে দিয়ে বয়ে এসেছে। বাঙালির ইতিহাস সুদীর্ঘকালের ইতিহাস। সে-ইতিহাসের ধারাবাহিক যে উত্তরাধিকার, তা আমরা নিজের বলে দাবি করি। সে-ইতিহাসে অনেক ভাঙাগড়া আছে, অনেক ধারার মিলন আছে। সে-ইতিহাসের মধ্যে এমন ব্যক্তিত্ব পেয়েছি বাঙালি-পরিচয়ে যিনি বিশেষভাবে ভূষিত করেছেন নিজেকে। যেমন, পনেরো শতকে বাংলার দরবেশদের অগ্রগণ্য শেখ নূর কুতুব আলম— যেখান থেকেই তিনি এসে থাকুন না কেন— পরিচিত হয়েছিলেন শেখ নূর বাঙালি হিসেবে। যেমন, আঠারো শতকের সঙ্গীতজ্ঞ লালা বাঙালি— সম্রাট মুহম্মদ শাহের দরবারে তিনি সাদরে বৃত হয়েছিলেন। সৈয়দ আহমদ বেরিলভির খলিফা উনিশ শতকের নোয়াখালির সন্তান পরিচিত ছিলেন মওলানা ইনামউদ্দীন বাঙালি বলে। বাঙালির ইতিহাস একটা বিশেষ রূপ নিয়েছে আমাদের এই ভূখণ্ডে — ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে। ইতিহাসের সে বিশেষ রূপই ধরা পড়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে। এই নতুন জাতিসত্তার সূচনা ১৯৫২-তে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভাষাপ্রীতি, আত্মত্যাগ, জাতিগত ঐক্যবোধের মধ্য দিয়ে। ১৯৫২-তে যার সূচনা, ১৯৭১-এ তার প্রতিষ্ঠা। আমাদের নতুন রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে আছে আমাদের জাতিগত পরিচয়।

দুই

এই জাতিগত সত্তাকে দূরে সরিয়ে রেখে যারা কেবল রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে নিজেদের চিহ্নিত করতে চান, তারা বাংলাদেশকে দেখেন একটু ভিন্নভাবে। ১৯৭১ সালের সমস্ত সংগ্রামকে তাঁরা ভুলে যেতে চান, তার পূর্ববর্তী চব্বিশ বছরের ইতিহাসকে তাঁরা গুরুত্বহীন মনে করেন। জাতিসত্তার প্রশ্নটি ঠেলে ফেলে দেওয়া যায় না, এ কথা বুঝে কেউ কেউ আবার বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন। যেমন, আবুল মনসুর আহমদ। তাঁর মতে, বাংলাদেশের সৃষ্টি হচ্ছে লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন। তাঁর ভাষায়,

১. শেরে-বাংলা ফজলুল হক যা শুরু করিয়াছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা সমাপ্ত করিয়াছেন। (শেরে-বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু, ঢাকা, ১৯৭৩, পৃ ১)।
২. … লাহোর প্রস্তাব স্বাধীন ভারতবর্ষকে কল্পনা করিয়াছিল দুইটি নয়, তিনটি নেশন-স্টেট হিসাবে। মুসলিম লীগ নেতারা ‘থ্রি নেশন থিওরির’ জায়গায় টু নেশন থিওরি প্রয়োগ করার পরিণামে তাদের মতবাদ ভুল প্রমাণিত হইয়াছে। এই ‘থ্রি নেশন স্টেটস’-এর ভিত্তিতেই আজ ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক সুস্থতা ও স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠিত হইতে যাইতেছে। (ঐ, পৃ ১২)।
৩. স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ভুট্টোসহ পাকিস্তানের অনেক নেতা ও খবরের কাগজের সম্পাদকরা মাত্র কিছুদিন আগে হইতে বলা শুরু করিয়াছেন: বাংলাদেশের অভ্যুদয় ‘পাকিস্তান কনসেপ্টে’র বিরোধী নয় বরং লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণ রূপায়ণ।’ এই সহজ কথাটাও তাঁদের অনেক আগেই উপলব্ধি করা দরকার ছিল। ৭১ সালে যা ঘটিয়াছিল, তা ছিল সেই ‘সিভিল ওয়ার’।
(বেশী দামে কেনা কম দামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা, ঢাকা, ১৯৮২, পৃ ১০২-৩)।
৪. … পাকিস্তানের নেতারা পঁচিশ বছরে যা পারেন নাই, ভারত সরকার তাই করিয়া দিলেন: ‘পাকিস্তান’কে লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক করিয়া দিলেন। এতে পাকিস্তানেরও লাভ হইল ভারতেরও লাভ হইল। ‘পাকিস্তান’ লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে দুইটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হওয়ায় সেখানে সামরিক শাসনের আবশ্যকতা দূর হইল এবং সেকুলার ডেমোক্র্যাসির সম্ভাবনা নিশ্চিত হইল। (ঐ, পৃ. ১০৩)
৫. … প্রকৃত অবস্থাটা এই যে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় পাকিস্তানও ভাঙ্গে নাই, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ও মিথ্যা হয় নাই। এক পাকিস্তানের জায়গায় লাহোর প্রস্তাব-মত দুই পাকিস্তান হইয়াছে। ভারত সরকার লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নে আমাদের সাহায্য করিয়াছেন। তারা আমাদের কৃতজ্ঞতার পাত্র। দুই রাষ্ট্রের নাম পাকিস্তান হয় নাই, তাতেও বিভ্রান্তির কারণ নাই। লাহোর প্রস্তাবে ‘পাকিস্তান’ শব্দটার উল্লেখ নাই, শুধু মুসলিম মেজরিটি রাষ্ট্রের উল্লেখ আছে। তার মানে রাষ্ট্র-নাম পরে জনগণের দ্বারাই নির্ধারিত হওয়ার কথা। পশ্চিমা জনগণ তাদের রাষ্ট্র-নাম রাখিয়াছে ‘পাকিস্তান’। আমরা পূরবীরা রাখিয়াছি ‘বাংলাদেশ’। এতে বিভ্রান্তির কোনও কারণ নাই।’ (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ঢাকা, ১৯৭৫, পৃ ৮০৮)।

উদ্ধৃতির আর দরকার নেই। একাধিক বইতে একাধিক ভাষায় একাধিক ভাবে আবুল মনসুর আহমদ আমাদেরকে বোঝাতে চেয়েছেন যে, ১৯৭১ সালে ভারত ও কংগ্রেস তো পাকিস্তান ভাঙেনি, বরঞ্চ লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়নে সাহায্য করেছেন। আমরাও পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসিনি, পাকিস্তানেই রয়ে গেছি। দ্বিজাতিতত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি, মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে শুধু ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র।

কিন্তু লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হবার একত্রিশ বছর পরে এবং ইংরেজ-শাসনের অবসান ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার চব্বিশ বছর পরে ভারত সরকার এবং সেদেশের কংগ্রেস দল কেন লাহোর প্রস্তাব-বাস্তবায়নের জন্যে এত ব্যগ্র হয়ে উঠলো, আবুল মনসুর আহমদ তার কোনো ব্যাখ্যা দেননি। তাছাড়াও আবুল মনসুর আহমদ যে-কথা বলেননি, তা এই যে, লাহোর প্রস্তাবে যে-পূর্ব পাকিস্তানের কল্পনা করা হয়েছিল, তার মানচিত্র আর ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মানচিত্র এক নয়; ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এ দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের যে- ধারাবাহিকতা, সে-ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ; আর মুক্তিযুদ্ধের বীজ উপ্ত হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে, ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাবে নয়। এতো মানুষ প্রাণ দিয়েছে, এতে নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে— কেবল লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়নের জন্যে এ কথা বড় নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের মতো শোনায়।

তিন

আবুল মনসুর আহমদ তবু নিজেকে বাঙালি বলতে দ্বিধা করেননি, সে বাঙালি যেমন ধরনেরই হোক না কেন। তিনি বলেছেন: আমরা বাঙালীরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র ও ভাষা-কৃষ্টিতে ইউনিফর্ম বাঙালী নেশন প্রতিষ্ঠা করিয়াছি। ফলে বাঙালী জাতীয়তাবাদ বাংলা রাষ্ট্রের চতুঃসীমার মধ্যেই পরিবৃত। রেস, ভাষা ও কৃষ্টিতে অবাঙালী হইয়াও বাংলা রাষ্ট্রের নাগরিকরা জাতিত্বে ও নাগরিকত্বে বাঙালী। আর রেস, ভাষা ও কৃষ্টিতে বাঙালী হইয়াও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরা ভারতীয়। রাজনৈতিক জাতীয়তা পলিটিক্যাল নেশনহুড রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের সহিত সমায়ত বলিয়াই এটা ঘটিয়াছে। (শেরে-বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু, পৃ ২৪)।

আবুল মনসুর আহমদের ভাবশিষ্য খোন্দকার আবদুল হামিদ ভার নিয়েছিলেন এই বাঙালিত্বকে নস্যাৎ করার। ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের যে নতুন তত্ত্ব উপস্থাপিত করেন তাতে পরিত্যক্ত দ্বিজাতিতত্ত্বের পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টাই আমরা লক্ষ করি:

বাঙালী জাতীয়তা বললে মাল্টি-স্টেট ন্যাশনালিজম-এর কথা এসে পড়ে। কারণ, বাংলাদেশের বাইরেও কয়েক কোটি বাঙালী আছেন। আমরা কি সেসব বাঙালীকে বাংলাদেশের জাতির শামিল করতে পারি? জটিল আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রশ্নের ঝুঁকি না নিয়ে অমন [প্যানবেঙ্গলিজম বা সুপ্রা-ন্যাশনালিজমের] কথা আমরা কি ভাবতেও পারি? পারি না। আর তাই আমাদের জাতীয়তাকে ‘বাঙালী জাতীয়তা’ বলে অভিহিত করতে পারি না। করলে টেকনিক্যালি ভুল হবে, পলিটিক্যালি তা বিপজ্জনক হতে পারে।

আরও কথা আছে। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের ও অন্যান্য বাংলাভাষী অঞ্চলের মানুষ একই ‘স্টক’ থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকতে পারে। উভয়ে বঙ্গভাষাভাষী হতে পারে, উভয়ে অন্নভোজী হতে পারে, উভয়ের মধ্যে আচার-আচরণেও খানিকটা মিল থাকতে পারে। কিন্তু সংস্কৃতিতে, জাতীয় সত্তায়, জাতীয় ভাবাদর্শে তারা কি এক, অভিন্ন? নিশ্চয়ই তা নয়। বরং অনেক দিক দিয়ে ভিন্ন এবং কতক ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী।…

… এপার বাংলা ওপার বাংলার মধ্যে তেমনি চিরন্তন তফাৎ। সে প্রভেদ রগের, রক্তের, মনের, মানসের, আবেগের, অনুভূতির, ধর্মের, কর্মের, এবাদৎ-বন্দেগির, নামের, নিশানের, ঐতিহ্যের, উত্তরাধিকারের, খোরাকের, পোশাকের, আদবের, লেহাজের, কায়দা-কানুনের, জীবনবোধের, জীবনধারার, জীবন-দর্শনের এবং জীবন-সাধনার । হৃদয়ানুভূতির নিবিড় বন্ধন দু’য়ের মধ্যে চিরকাল অবর্তমান। এমন কি উভয় বাংলার ভাষা মূলত একটা হলেও বড়লোকদের বৈঠকখানা, বিদগ্ধদের সাহিত্য-অঙ্গনের বাইরে জনগণের যে ভাষা তা যবানে-লিসানে, মুখরেজে-তালাফফুজে পর্যন্ত আলাদা। …
কাজেই ‘বাঙালী জাতীয়তা’ কথাটা শুধু রাজনৈতিক দিক থেকে ভ্রান্ত নয়, ঐতিহাসিক দিক থেকেও অবাস্তব। এমনকি রাজনৈতিক দর্শন হিসাবেও এর অসারতা স্বপ্রমাণিত। ‘বাঙালি জাতীয়তা’ তাই মিসনোমার। আমাদের জাতীয়তাকে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তা’ বলাই এ্যাপ্রোপ্রিয়েট বা সঙ্গত।…
এই জাতির রয়েছে গৌরবময় আত্মপরিচয়, নাম-নিশানা-ওয়ারিসী উত্তরাধিকার, ঐতিহ্য-ইতিহাস, ঈমান-আমান, যবান-লিসান, শিল্প-সাহিত্য, স্থাপত্য-সঙ্গীত সবকিছু।

…এদের জীবনে ও মনোজগতে রয়েছে এমন অসংখ্য বৈশিষ্ট্য, যা সারা পৃথিবী থেকে এদের স্বাতন্ত্রদান করেছে— এমনকি অন্যান্য দেশের বা অঞ্চলের বাংলাভাষী ও ইসলাম-অনুসারীদের থেকেও। ইসলামের কথা বললাম, এ জন্যে যে এ দেশের ৮৫ শতাংশ লোকই মুসলিম। এই বৈশিষ্ট্যগুলোই ‘বাংলাদেশী জাতীয়তার’ উপাদান। এগুলি বাকল নয়, আসল সারাংশ। আর এই সারাংশই আমাদের বাংলাদেশী জাতীয়তার আসল শক্তি, ভিত্তি ও বুনিয়াদ।
(খোন্দকার আবদুল হামিদ, স্পষ্টভাষী স্মরণে, ঢাকা, ১৯৮৪, পৃ ২১-২৩)।

এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এই বক্তব্যের মূলে কাজ করেছে দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা। বাংলাদেশের যেসব অধিবাসী বাংলাভাষী নন, আমাদের জাতীয়তাবাদের মধ্যে তাদের টেনে আনার কোনো প্রয়োজনীয়তা এতে ব্যক্ত হয়নি। যা এখানে বড় হয়ে উঠেছে, তা হলো অনুক্ত হিন্দু ও অকথিত মুসলমানের স্বাতন্ত্র্য। ১৯৭১ সালের ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক এই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ উপস্থাপিত হয়েছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের কোনো প্রসঙ্গ এতে স্থান পায়নি, পাওয়ার কথা নয়। একই কারণে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রচার ও প্রসারে মুক্তিযুদ্ধের কথাটা গৌণ করে তোলার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় হয়তো খোন্দকার আবদুল হামিদের এই মনোভাব কার্যকর হতে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমাদের বুঝতে হবে যে, নিজেদের বাঙালী সত্তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম পাকিস্তানি দুঃশাসনের অবসানের পরেও শেষ হয়নি।

চার

আবুল মনসুর আহমদ ও খোন্দকার আবদুল হামিদের কথা যদিও ওপরে আলোচিত হলো, তবু এ কথা বলা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে অনেকেই উল্লেখযোগ্য বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। যেমন, অ্যান্থনী মাসকারেনহাস মনে করেন যে, বাংলাদেশের অধিবাসীদের বাঙালি বলে অভিহিত করে শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের বিরক্তি উৎপাদন করেছিলেন, কেননা এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবাঞ্ছিত সংশ্লেষ পশ্চিমবঙ্গে দেখা যেতে পারে ভবিষ্যতে, এমন আশঙ্কা ছিল, আর তাই জিয়াউর রহমান যখন নাগরিকদের পরিচয় স্থির করলেন বাংলাদেশী বলে, ভারত তা স্বাগত জানাল (Anthony Mascarenhas, Bangladesh : A Legacy of Blood, London, 1986, p 125)।

নিজের বক্তব্যের সমর্থনে মাসকারেনহাস কোনো প্রমাণ দেননি; দিলেও তাতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যৌক্তিকতা ভ্রান্তি প্রতিপন্ন হতো না। তবে এটা বোঝা যায় যে, বাংলাভাষী ভারতীয়দের কথা চিন্তা করে অথবা ভারতের শাসকদের প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে যারা বাংলাদেশের নাগরিকদের বাঙালি বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন, তিনি তাদের একজন।

বদরুদ্দীন উমরের কাছে এই বিতর্ক বাহুল্যমাত্র। বাংলাদেশের অধিবাসীদের একটি জাতি বলে তিনি স্বীকার করেন না, অবিভক্ত বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিতে তেমন স্বীকৃতিদান তিনি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি-সঞ্জাত বলে মনে করেন এবং সেই কারণে বাংলাদেশকে একটি জাতীয় রাষ্ট্ররূপে মেনে নিতে তার আপত্তি রয়েছে (‘বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি’, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর-সম্পাদিত জাতীয়তাবাদ-বিতর্ক, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃ ৯২-৯৫)।

এ-প্রসঙ্গে মাত্র দুটি কথা বলার আছে। প্রথমত, বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে নিজস্ব রাষ্ট্রগঠনের আকাঙ্ক্ষা— একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্বতন্ত্র পরিচয়ে একত্র বসবাসের ইচ্ছা তুচ্ছ করার মতো বিষয় নয়। দুই জার্মানির পুনরেকত্রীকরণে যেমন, তেমনি বাংলাভাষী এলাকার দুই অংশের মানুষের পৃথক হয়ে থাকার মূলে একটিই সাদৃশ্য আছে, তা হলো জনগণের ইচ্ছাশক্তি। জাতিগঠনের ক্ষেত্রে সেটা বড় উপাদান এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সে-ইচ্ছা একটা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে রূপায়িত হয়েছে বলে তার গুরুত্ব আরো বেশি। দ্বিতীয়ত, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ ও পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে পার্থক্য ছিল নিশ্চয়। সে পার্থক্য অগ্রাহ্য করার মতো নয়। একটা পুরো প্রজন্মই পৃথক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়ে গেল ইতিহাসের ধারায়, বাংলার পূর্ব ও পশ্চিম অংশ পরস্পরকে ভালো করে জানতেও পারলো না এ-সময়ে— এ অভিজ্ঞতা মুছে ফেলার নয় ।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করেও তার স্বাধীনতাকে স্বীকার করতে কুণ্ঠিত আহমদ শরীফ। তিনি বলেন: … বাঙালীরা ১৯৪৭ সালের চৌদ্দই আগস্ট থেকেই স্বাধীন ও রাষ্ট্রের সার্বভৌম মালিক। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে ভাইরা যখন পৃথক হয় তখন তাকে স্বাধীনতা বলে না, …। স্বাধীন বাংলাদেশও তার অপর শরিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে ১৯৭১ সনে শোষণমুক্তির লক্ষ্যে। একে অধীনতা থেকে মুক্তি বলে আখ্যাত করলে জাতির ও ইতিহাসের অবমাননা হয় মাত্র। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাদেশ ও বাঙালী পরাধীন ছিল ভাবলে বলতে হবে, ১৯৪৭ সনে বাঙালী মুসলমানরা স্বেচ্ছায় ভিন্ন জাতির দাসত্ব বরণ করেছিল। অতএব ১৯৭১ সনে বাঙালীরা বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭১ সনের সংগ্রাম ছিল প্রবল দলের বা শরিকের শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তিলক্ষ্যে সংগ্রাম। কোন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জনগণ যদি স্বদেশী ও স্বধর্মী স্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জনগণের অধিকার আদায় করে বা জনগণের প্রতিনিধি রূপে কৃষাণ মজুর সরকার গঠন করে তাকে স্বাধীনতা অর্জন বলা যাবে না।- – – সুতরাং ১৯৭১ সনের যুদ্ধ ছিল পৃথক বা বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্যে যুদ্ধ । এ সংগ্রামের তাত্ত্বিক ও তাথ্যিক তাৎপর্য ও ফল এক কথায় দেশকালহীন মুসলিম ভ্রাতৃত্ব ঐক্য বা জাতীয়তা থেকে অধিকাংশ বাঙালী মুসলমানের দৈশিক জাতীয়তা চেতনায় তথা বাঙালীত্বে উত্তরণ। এ-ও সত্য যে, দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক পাকিস্তান না হলে বাঙালী জাতীয়তা ভিত্তিক বাংলাদেশও সম্ভব হত না। অতএব ২৬শে মার্চ কিংবা ১৬ই ডিসেম্বর নাজাত দিবস হতে পারে, কোন সংজ্ঞাতেই আজাদী হিসেবে স্মরণ্য নয়। (কালের দর্পণে স্বদেশ, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ ২২ -২৩)।

আহমদ শরীফকে বোঝা খুব সহজ নয়। উপরের উদ্ধৃতি থেকে মনে হয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তিনি বড়জোর বিচ্ছিন্নতাবাদ বলতে রাজি— তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। বিচ্ছিন্নতাবাদ আর স্বাধীনতা-সংগ্রামের সীমানা কোথায়, তা নিয়ে বড় বড় পণ্ডিতের মতানৈক্য আছে। এ নিয়ে তর্ক করা চলে, কিন্তু কাউকে দোষ দেওয়া চলে না। আরো কেউ কেউ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রয়াস হিসেবে দেখেছেন। তবে আহমদ শরীফ আবার এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরকে পূর্বতন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মালিক বলেও অভিহিত করেন। সার্বভৌম রাষ্ট্রের মালিকেরা আবার স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে কেন, এই প্রশ্নের সদুত্তর তাঁর লেখায় পাওয়া যায় না। ১৯৭১-এর পাকিস্তানকে তিনি শুধু স্বাধীন ও স্বদেশী বলে বিবেচনা করেননি, তার স্বধর্মী বলে পরিচয়টা বেশ বড় করে তুলেছেন। আবার তারপরই তিনি বলেছেন যে, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে মুসলিম জাতীয়তাবাদী ভাবধারা থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদে। তবে সে উত্তরণের দিনটিকে তিনি গণ্য করেন নাজাত দিবস হিসাবে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে নাজাতের সম্পর্ক নিয়ে ভাবিত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তার চেয়েও ভাবিত হই আহমদ শরীফের সাম্প্রতিক বক্তব্যে। তিনি ঘোষণা করেছেন যে, ‘১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টে এদেশের মুসলমানেরা স্বাধীন হয়েছে আর ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে স্বাধীন হয়েছে এদেশের হিন্দুরা।’ (সংবাদ, ২৩ এপ্রিল ১৯৯১)। এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে তিনি যা বলেছেন, তার যৌক্তিকতা আমাদের বোধগম্য নয়, এ কথা স্বীকার করতে বাধা নেই।

পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশ হতো না, এ কথা আমরা এতবার শুনেছি যে, এ সম্পর্কে এক-আধটা কথা না বলে থাকা যাচ্ছে না। পি. জি. ওডহাউজের Big Money উপন্যাসে একটি চরিত্র ছিল, সে সবকিছুর মূল খুঁজতো। মুখ-দেখা আয়নায় লিপস্টিকের দাগ মুছতে মুছতে সে চিন্তা করছিল এভাবে— লিপস্টিক আবিষ্কৃত না হলে তাকে এটা মুছতে হতো না; যুদ্ধের সময়ে লিপস্টিকের চল হয় তাই যুদ্ধ না হলে লিপস্টিক বের হতো না ; সারায়েভোয় রাজকুমার নিহত না হলে যুদ্ধ লাগতো না; ওই রাজকুমারের হত্যাকারী না জন্মালে কুমার নিহত হতেন না ; হত্যাকারীর পিতামাতার পরস্পর সাক্ষাৎ না ঘটলে তার জন্ম হতো না। পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশ হতো না, এ কথা সত্য। তেমনি ইরেজরা এ দেশে না এলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হতো না ; মুঘলদের কাছ থেকে ইংরেজ কোম্পানি ব্যবসা ও লুঠ করার সনদ পেয়েছিল, তাই মুঘলরা না এলে ইংরেজ আসতো না। এভাবে ক্রমান্বয়ে পেছন দিকে গিয়ে ইতিহাসের কতকগুলো সত্যের কার্য-কারণ নির্দেশ করা যায়, কিন্তু তাতে সেসব সত্যের তাৎপর্য নির্ণীত হয় না। পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশ হতো না— তা সত্য, কিন্তু এ ক্ষেত্রে যা তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার, তা এই যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ও দার্শনিক তত্ত্ব অস্বীকার করতে পেরেছিলেন বলেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্ভবপর হয়েছিল। সুতরাং কেবল পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার মধ্যে বাংলাদেশের উন্মেষের সম্ভাবনা না দেখে পাকিস্তানের বিলয়ের মধ্যেই বাংলাদেশের আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করা অনেক বেশি সমীচীন। সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে আমার ভাবনার যেমন মিল আছে, তেমনি তার মধ্যে অন্যদের উত্থাপিত কিছু কিছু প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া যাবে। তিনি বলেন :

ইতিহাসের নানান যোগ-বিয়োগ শেষে বাঙালী জাতির ভবিষ্যৎ আজ বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর বর্তেছে। মুক্তি-আন্দোলনের সময় ‘জাগো জাগো বাঙালী জাগো’ বলে যে শ্লোগান দেওয়া হয় তা বাঙালীর ইতিহাসে পূর্বে কোনোদিন ধ্বনিত হয়নি। বাংলাদেশের এই চেতনা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের চেতনা থেকে স্বতন্ত্র, ১৯৪৬-৪৭-এর মৃতবৎস অখণ্ড সার্বভৌম বঙ্গের চেতনা হতেও স্বতন্ত্র। এর জন্মের সূত্রপাত হয়েছে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, যার মধ্যে অবশ্য পুরানো দিনের নানা রেশ ওতপ্রোতভাবে মিশে রয়েছে।
(গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ, দ্বি-স; ঢাকা, ১৯৮৯, পৃ ১৬৭)।

পাকিস্তানি ইকরাম সেহগল সম্প্রতি যে-প্রবন্ধ লিখেছেন তার শিরোনাম ‘Pakistan and Bangladesh—Two countries, one nation’ (The Nation, 26 March 1991)। স্বভাবতই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, এ কোন ‘ওয়ান নেশন’? পাকিস্তানিরা কি বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হতে সম্মত হয়েছে, না আমরা পাকিস্তানি জাতিসত্তার মধ্যে আত্মবিলোপ করতে চলেছি? আজ যারা এই একজাতির কথা বলতে সাহস পেয়েছেন, ১৯৭৫ সালে তাঁরাই —মাহমুদ আলীর মতো— পাকিস্তানের পুনরেকত্রীকরণের স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। আমাদের দেশে যেসব নেতা সব সময়ে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কথা বলেন, তাঁরা আমাদের বোঝাতে চান যে, ভারতের থেকে আমাদের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন এবং সেই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হবে। পাকিস্তান থেকে যে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আমরা বহু মূল্যে ছিনিয়ে এনেছিলাম, তা পাকিস্তানের কাছ থেকেও রক্ষা করা প্রয়োজন। কিন্তু সেকথা তারা বলেন না এবং এই না বলার যে কারণ আছে, তা বুঝতে আমাদের বেগ পেতে হয় না। তেমনি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে যারা ভাইয়ে-ভাইয়ে বিবাদ হিসেবে দেখেন, তারা ভুলে যান যে, সেদিন ভাই কেবল ভাইকে হত্যা করেনি, বোনকেও ধর্ষণ করেছিল। সেকথা যদি আমরা ভুলে যাই, সেই বেদনার ভার যদি আমরা বহন করতে না পারি, তবে স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের বিকাশ ব্যাহত হবে। ইতিহাসের কী কষ্টকর পথ বেয়ে আজ আমরা এখানে এসে পৌঁছেছি, তা স্মরণে রাখতে হবে। সেই স্মৃতি আমাদের জাতীয়তাবাদ, ঐক্যচেতনা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে ভিত্তি দেবে।

নতুন লেখার নোটিফিকেশন পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

কপিরাইট সংক্রান্ত

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।

মন্তব্য করুন