তিনি এলেন, এসেই জয় করলেন, তারপর চলে গেলেন। দেখার খুব একটা সময় পাননি। অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন, ছিলো চলে যাবার তাড়া। চলে যাওয়ার পর গত দুইশ বছর ধরে আমরা তার রচিত ইতিহাস মুগ্ধতার সাথে শুনে যাচ্ছি। ভোগ করছি তার নতুন চিন্তা-চেতনার ফসল। তিনি বাংলা তথা ভারতবর্ষের প্রগতিশীল সংগঠন চর্চার সূচনাকারী, প্রথা বিরোধিতার অপ্রতিরোধ্য রূপকার। বাংলায় সর্বকনিষ্ঠ কলেজ শিক্ষক আবার একইসাথে বরখাস্ত হওয়া প্রথম শিক্ষকও। তিনি একাধারে নেতা, কবি, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, শিক্ষক, সম্পাদক ও সংগঠক।
বলছি হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর কথা। ১৮০৯ সালের ১৮ এপ্রিলে সালে কলকাতা শহরের ১৫৫, লোয়ার সার্কুলার রোডে পৈত্রিক বাড়িতে জন্ম নেয়া ডিরোজিওর মৃত্যু হয় ১৮৩১ সালে। বেঁচে ছিলেন মাত্র বাইশ বছর। বাইশ বছরের ছোট্ট জীবনে আমাদের অঞ্চলে তার হাত ধরে জন্ম নেয় এক অভূতপূর্ব নবজাগরণ। সমকালীন প্রবীণদের ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রজন্মের বাতিঘর। ডিরোজিও দেখিয়েছেন হাজার বছরের চেনা প্রাচীন পথে না হেঁটেও পথ চলা যায়, সামনে এগোনো যায়। তার কিশোর পা বেয়ে বেড়ে ওঠা নতুন পথ ধরে আমাদের পূর্বরা এগিয়েছে অনেক দূর। তাদের এগিয়ে যাওয়া এতটা সুষম ও গৌরবমাখা ছিলো যে, এ অঞ্চলে ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন প্রতিকূল বাতাসে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে।
পিতা ফ্রান্সিস ডিরোজিও বিখ্যাত জে. স্কট অ্যান্ড কোং নামে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করতেন। মায়ের পারিবারিক নাম সোফিয়া। তিনি ছিলেন গৃহিণী। ডিরোজিওর পূর্বপুরুষরা সুদূর পর্তুগাল থেকে ভারতবর্ষে এসে আর ফিরে যাননি। এরকম আরো অনেকে ইউরোপ বংশদ্ভুত মানুষ ভারতবর্ষে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। আমরা তাদেরকে ফিরিঙ্গি বলি। হেনরি ডিরোজিওর বাবা ছিলেন ফিরিঙ্গি সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তার তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলে ফ্রাঙ্ক, মেজ ছেলে হেনরি, ছোট ছেলে ক্লাডিয়স। প্রথম মেয়ে সোফিয়া (মায়ের নাম থেকে নেয়া পদবী বিশেষ) মাত্র ১৭ বছর বয়সে মারা যায়। ছোট মেয়ে অ্যামিলিয়া। ডিরোজিওর বয়ষ যখন ছয়, তখন তার মায়ের মৃত্যু ঘটে। এরপর মিস্টার ফ্রান্সিস আনা রিভার্স নামে এক নারীকে বিয়ে করেন।
ডিরোজিওর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় ডেভিড ড্রমণ্ড নামে এক স্কটিশ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্কুলে। ড্রমন্ড ছিলেন তার বলয়ের সুপরিচিত কবি। নিজ দেশীয় সাহিত্যে তার সুখ্যাতির কমতি ছিলো না। কিন্তু ওসব খ্যাতি পেছনে ফেলে বাড়ি ছেড়ে ভারত চলে আসেন। কারণ তিনি ছিলেন নাস্তিক, যা পরিবার ও আত্মীয়স্বজনরা মেনে নেয়নি। ভারতে এসে শিক্ষার প্রসারে কাজ শুরু করেন। প্রথমে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। বিদ্যালয় স্থাপন করলেও তার স্কুলে ছাত্রের সংখ্যা ছিলো অত্যন্ত কম। ভারতীয়রা দূরে থাক, ভারতবাসী ইংরেজরাও ড্রমণ্ডের স্কুলে তাদের বাচ্চাদের পাঠাতো না; বাচ্চারা যদি নাস্তিক হয়ে যায়! —এই ভয়ে।
হেনরি ডিরোজিওর বাবা যখন তার ছেলেকে ড্রমণ্ডের স্কুলে ভর্তি করান, তখন তাকেও এসব কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু তিনি চেয়েছেন তার ছেলে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। পিতার কাছ থেকে পাওয়া চিন্তার স্বাধীনতার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করে ডিরোজিও হয়ে উঠেছিলেন ইতিহাসের সেরা কিশোর সমাজ সংস্কারক।
ড্রমণ্ড কেবল গৃহত্যাগী কবি ও শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন একজন দার্শনিক। ধর্ম ছাড়াও অন্য অনেক বিষয়ে তার ভাবনার সাথে অন্যদের ভাবনার বৈপরীত্য ছিলো উল্লেখ করার মত। তিনি সমসাময়িক প্রগতিশীলদের চেয়েও বেশি প্রগতিশীল ছিলেন। ডিরোজিও তার শিক্ষক ড্রমণ্ডের অগ্রচিন্তার সান্নিধ্যে এসে বালক বয়সেই সুচিন্তক হওয়ার উৎসাহ ও প্রেরণা লাভ করেন। এসময় দর্শনজ্ঞানের পাশাপাশি তার কাব্যপ্রতিভারও বিকাশ ঘটতে শুরু করে।
ড্রমন্ডের স্কুলে যখন লেখাপড়া শেষ করেন, ডিরোজিওর বয়স তখন চৌদ্দ বছর। এসময় তার বাবা মারা যান। ফলে লেখাপড়া আর এগোয়নি। এই বয়সে পিতার অফিসে কেরাণীর চাকরি নেন। কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে ভাগলপুরে মাসীর বাড়ি চলে যান। মাসীর স্বামী আর্থার জনসন ছিলেন ভাগলপুরে নীলকুঠির মালিক। মেসোর ব্যবসায় টুকটাক দেখাশোনা করা ছাড়া সেখানে কোন কাজ ছিলো না। সারাদিন ঘুরে বেড়ানো, খাওয়া, ঘুম —কাব্যপ্রতিভা সম্পন্ন এক বালকের জন্য এ যে অতি লোভনীয় জীবনযাপন। মাসীর বাড়ির কাছেই গঙ্গা নদী। নদী তীরের সবুজাঞ্চলে মাতাল হাওয়ায় বসে কবিতা লিখতেন, কখনো ঘাসের শরীরে গা এলিয়ে বই পড়তেন। নানান ধরণের বই। এর মধ্যে দর্শনের বইয়ে ডিরোজিওর আগ্রহ ছিলো সবচেয়ে বেশি।
সে সময় ইন্ডিয়া গেজেট নামে একটি খবরের কাগজে কবিতা পাঠাতে শুরু করেন তিনি। কবিতা প্রকাশিতও হচ্ছে নিয়মিত। ফিরিঙ্গি সমাজ ও ইংরেজরা ডিরোজিওর কবিতা পড়ে কিঞ্চিত অবাক হয়, ভাবে বালকের প্রতিভা আছে বটে! কিন্তু বিস্ময়ের সীমা থাকে না যখন এই বালক বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের Lectures on Philosophical Theology গ্রন্থের জমজমাট সমালোচনা লিখে ফেলেন। প্রতিভাগুণে অল্পদিনে ভারতবাসী ইংরেজদের নজর কাড়েন ফিরিঙ্গি ডিরোজিও।
১৮২৬ সালে কবিতার বই ছাপানোর কাজে কলকাতা আসেন। তার শহর আগমনের খবর পৌঁছে যায় সর্বত্র, সুবিখ্যাত হিন্দু কলেজেও (বর্তমান প্রেসিডেন্সি কলেজ)। তখন হিন্দু কলেজে চতুর্থ শ্রেণীর জন্য সাহিত্য ও ইতিহাসের একজন শিক্ষক প্রয়োজন ছিলো। কলেজ কর্তৃপক্ষ ডিরোজিওকে প্রস্তাব দিলে তিনি হ্যাঁ বলেন। আর এই ‘হ্যাঁ’ বলার ফল যে কত উজ্জ্বল ও গৌরবের হতে পারে, তিনি নিজেও হয়তো জানতেন না।
১৮২৭ সালে তার প্রথম কবিতার বই ‘দ্যা পোয়েমস’ প্রকাশিত হয়। ১৮২৮ সালে প্রকাশিত হয় তার মাস্টারপিস ‘দ্যা ফকির অব ঝঙ্গীরা অ্যান্ড আদার পোয়েমস’। ভাগলপুরের নদীতীরে ঝঙ্গীরা নামক আশ্রমে এক ফকির বাস করতেন। দূর হতে ফকিরের আশ্রম ও তার জীবনযাপন মনযোগের সাথে খেয়াল করতেন ডিরোজিও। এমন জীবনযাপন তার কাছে কৌতুহল উদ্দীপক মনে হয়। এই কৌতুহল অথবা ভালোলাগার সাথে একটি গল্প নিদারুণ অথবা দারুণ গল্প জুড়িয়ে লিখে ফেলেন তার সেরা কবিতা।
জুড়ে দেয়া গল্পটি সতীদাহ থেকে উদ্ধার হওয়া একজন বিধবা নারীকে নিয়ে।
একজন সদ্য বিধবা, যাকে স্বামীর সাথে চিতায় পুড়ে মরতে হবে। চিতায় অগ্নিসংযোগ পূর্ববর্তী সব আচার অনুষ্ঠান শেষে বিধবা নারীটি যখন চিতায় উঠে সূর্যকে প্রণাম করছেন, ঠিক তখন দলবল নিয়ে এক দস্যু এসে ওই নারীকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
উল্লেখ্য তখন রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বিলোপে হিন্দুদের কট্টরপন্থার সাথে প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছেন। ফকির অব ঝঙ্গিরা কবিতা লেখার পরের বছর ১৮২৯ সালে ব্রিটিশ সরকার সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধে আইন করে। গভীর জীবনবোধ সম্পন্ন এই কবিতা ডিরোজিওকে আরো পরিচিত করে তোলে। ভারতবাসী ইংরেজ সাহিত্য সমঝদারগণ ডিরোজিওকে একজন পরিণত কবি হিসেবে গণ্য করতে থাকেন।
এর আগে ১৮২৬ সালের মার্চ মাসে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েই নিজের প্রতিভা চেনাতে শুরু করেন। পাঠদান পদ্ধতির ভিন্নতার কারণে শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি কেবল শিক্ষক রইলেন না, হলেন তার চেয়েও বেশি কিছু। শুধু নিজ শ্রেণীর ছাত্র নয়, অন্যান্য শ্রেণীর ছাত্ররাও ডিরোজিওর ডানে বামে জায়গা নিতে শুরু করে। ছাত্রদের কেউ কেউ বয়সে তার সমবয়সী, কেউবা দুই এক বছরের বড়। অথচ ডিরোজিওর যোগ্যতা ও দক্ষতার কারণে সেসব ছাত্ররা শিষ্য হিসেবে ধরা দেয়।
ডিরোজিও কেবল শ্রেণীকক্ষের শিক্ষক ছিলেন না। কলেজ আঙিনা, নিজের বাসা কিংবা কোন এক ছাত্রের বাসায়ও ক্লাস জমিয়ে তুলতেন। আসলে ক্লাস-তো না; তিনি লেকচার দিতেন, ছাত্ররা শুনতেন। তার লেকচারে উঠে আসতো সংস্কারের কথা, নতুন চিন্তা, সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা। আলোচনার মূল বিষয় ছিলো সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, সমাজ, বিজ্ঞান ও ধর্ম। তিনি বলতেন ভারতবাসীর ধর্ম বিশ্বাসে ঘাপলা আছে, এই ধর্ম বিশ্বাসের মূলে রয়েছে অজ্ঞতা ও মূর্খতা। এমনকি তাদের ধর্ম অমানবিকও বটে। বলতেন এসব কিছু আমুল পাল্টে দিতে হবে। মন্দিরে আর গঙ্গায় দৌড়াদৌড়ি না করে জ্ঞানঘরে যেতে হবে, পড়তে হবে, বিশ্বকে জানতে হবে। ইতিহাসের শিক্ষক হওয়ার কারণে বিষয়টা তার জন্য প্রাসঙ্গিক ছিলো। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইতিহাস তুলে ধরে বুঝানোর চেষ্টা করতেন ভারত কোথায় আছে, অথচ কোথায় থাকার কথা।
এভাবে অল্প ক’দিনে তিনি হয়ে উঠলেন নবচিন্তার বাঁশিওয়ালা। বুদ্ধিদীপ্ত এক ঝাঁক ছাত্র তার গুণমুগ্ধ অনুসারী। যাদের মধ্যে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, মাধবচন্দ্র মল্লিক, রামতনু লাহিড়ী, প্যারীচাঁদ মিত্র, মহেশচন্দ্র ঘোষ, শিবচন্দ্র দেব, হরচন্দ্র ঘোষ, রাধানাথ শিকদার, গোবিন্দচন্দ্র বসাক, অমৃতলাল মিত্র অন্যতম। যারা প্রত্যেকে পরবর্তীতে বাংলায় চিন্তার মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
ডিরোজিও তার ছাত্রদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন কুসংস্কার ও চিন্তার সংকীর্ণতা থেকে বাঙালি জাতিকে বের করে আনতে হবে। সেজন্য প্রচলিত ধর্মভিত্তিক সমাজের সাথে লড়াই করতে হবে। ঢাল তলোয়ার কিংবা তীর ধনুকের লড়াই নয়, এ লড়াই চিন্তার লড়াই। ধর্ম ও সমাজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তিনি তার ছাত্রদেরকে নাস্তিক হতে বলতেন না, আবার আস্তিক হতেও বলতেন না। তিনি বলতেন না ধর্ম ছাড়তে, বলতেন না ধর্মকে আঁকড়ে ধরতে। একইসাথে হিউম এর নাস্তিকতা বিষয়ক রচনা পড়াতেন, আবার রীড এ আস্তিকতা বিষয়ক রচনাও পড়াতেন। এভাবে তিনি তার ছাত্রদেরকে স্বচিন্তায় উদ্বুদ্ধ করতেন। এমন জলের মত স্বচ্ছ ও বাতাসের মত মুক্ত চিন্তার গুরু পেয়ে ছাত্ররা দলে দলে তার শিষ্য হতে শুরু করে।
একঝাঁক শিষ্য পেয়ে সাহস করে গড়ে তুললেন ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ নামে এক সাংঘাতিক সংগঠন। প্রথম দিকে ডিরোজিওর বাসভবনে এই সংগঠনের সভা বসতো। পরে শহরের মানিকতলার একটি বাড়িতে। সভার সভাপতি থাকতেন স্বয়ং ডিরোজিও। উমাচরণ বসু নামে তার এক ছাত্র ছিলেন প্রথম সম্পাদক। শুরুতে এ সংগঠনে তারা ভলতেয়ার, হিউম, লক, টমাস পেইনের মত সুবিখ্যাত লেখকদের লেখা নিয়ে পাঠসভার আয়োজন করতেন। কিছুদিনের মধ্যে বিখ্যাতদের রচনা পড়ার পাশাপাশি নিজেদের রচিত বক্তব্য পাঠ করা শুরু হয়। একজন সত্যিকারের আলোকিত মানুষ যদি কোন একটা দলের দিক নির্দেশক হন, তবে তার ফলাফল কেমন হতে পারে, এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ ডিরোজিও। তার সংস্পর্শে এসে ভোলাভালা ছাত্ররা অল্পদিনে হয়ে উঠলেন নতুন নতুন চিন্তার সৃষ্টিকর্তা।
অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের মুখপত্র হিসেবে নিয়ে আসেন ‘পার্থিনন’ নামে একটি সায়মিকী। কিন্তু তৎকালীন হিন্দু সমাজ এই পত্রিকার মাত্র একটি সংখ্যা হজম করতে সক্ষম হন। দ্বিতীয় সংখ্যা ছাপানো হলেও বিতরণ করতে দেয়নি হিন্দু সমাজনেতারা। পত্রিকাটিকে তারা হিন্দু ধর্মের প্রতি হুমকী হিসেবে বিবেচনা করেন। পার্থিনন বন্ধ হওয়ার পর ‘হেসপেরাস’ নামে একটি বার্ষিক সংকলন প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই পত্রিকাটিও মাত্র এক সংখ্যা পর বন্ধ করে দিতে হয়। এরপর ডিরোজিওর সম্পাদনায় ‘ক্যালিডোস্কোপ’ পত্রিকাও সমভাগ্য বরণ করে। পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ ঠেকিয়ে রাখলেও তাদের আলোচনা সভা বন্ধ করা যায়নি।
অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের সভায় ডিরোজিয়ানরা এমন সব বিষয় নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কের আয়োজন করতেন, যা শুনে তৎকালীন হিন্দু সমাজনেতারা কানে হাত দিতে বাধ্য হতেন। যেন শুনলেই ক্ষমার অযোগ্য পাপ হয়ে যাবে। হিন্দু ধর্মের মৌলিক রীতি, আচার ও বিশ্বাসে আঘাত করতে শুরু করে ডিরোজিওর শিষ্যরা। ডিরোজিও দর্শনের মূলে ছিলো স্বদেশপ্রেম, বিশ্বমান দৃষ্টিভঙ্গি, ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রশ্নে যুক্তিনির্ভরতা এবং সমাজে অন্ধ ও পশ্চাৎমুখী চিন্তা চেতনার বিরুদ্ধে লড়াই। প্রথমটি বাদে এর প্রতিটি বিষয় হিন্দু ধর্মের পুরাতনবাদী ধ্যান ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। ফলে খুব অল্প সময়ে প্রত্যাশাতীত শত্রু সঞ্চয় করলেন। শত্রুর সংখ্যা দেখে ডিরোজিও স্বস্তি পান, শান্তি পান। তিনি বুঝতে পারেন তার শিষ্যরা সঠিক জায়গায় সঠিক মাত্রায় আঘাত করছে।
অনেক শত্রু থাকার সুবিধা পেতে শুরু করেন ডিরোজিও ও তার দল। শত্রুদের কেউ কেউ অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের বিতর্কে শ্রোতার আসনে শোভা পেতে শুরু করেন। বিতর্ক শুনে অবাক হন, শত দ্বিধা জাগে, সহস্র প্রশ্ন জাগে। শেষে নতুন কিছু চিন্তা নিয়ে ঘরে ফিরে যায় প্রতিপক্ষের পন্ডিতরা। এসব সভায় গড়ে চার শতাধিক ছাত্র-শিক্ষক-সাধারণ মানুষ উপস্থিত থাকতেন। ততদিনে সমাজের প্রভাবশালী হিন্দুদের টনক নড়ে। তারা বুঝতে পারেন এ তো স্রেফ ছোকরা না, ধারালো ছোরা। একের পর এক ঘা’য়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হচ্ছে তাদের অন্ধকারের দোকানদারি। ফলে সমাজপতিরা পাল্টা আঘাত করতে শুরু করলেন। প্রথমে বাঙালি সংস্কৃতির দোহাই এলো। বলা হলো এক বিদেশি ছোকরা বাঙালি সংস্কৃতিকে গিলে খাচ্ছে। ইংরেজি আধুনিকতার নামে এ অঞ্চলের হাজার বছরের ঐতিহ্যকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে।
কিন্তু এসব ধোপে টিকেনি। ডিরোজিও’র শিষ্যরা আসলে সংস্কৃতির সাথে কোন বিরোধ করেননি। অথবা যৎকিঞ্চিৎ করেছেনও। কিন্ত তারা মূলত সংস্কৃতির শরীরে লেপ্টে থাকা পুরোনো ক্ষতগুলোর সাথে বিরোধ করেছেন। তারা অযথা অদরকারি অলৌকিক অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বলেছেন, প্রচলিত অকার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা পদ্ধতির জন্য আন্দোলন করেছেন। শহরজুড়ে গণপাঠাগার নির্মাণের কথা বলেছেন, এসব পাঠাগারে বিশ্ব ইতিহাস ও দর্শনের বই রাখতে বলেছেন, জ্ঞানার্জনের জন্য ইংরেজি শিক্ষার কথা বলেছেন। আরো বলেছেন কলেরা হলে শীতলা পূজা দিয়ে লাভ নেই, গঙ্গার সাথে পবিত্রতার কোন সম্পর্ক নেই, বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে হবে, জাত নিয়ে বৈষম্য করা অমানবিক। বলেছেন, শাস্ত্রবচন মাত্রই মান্য করা উচিত -এটি খুবই বাজে কথা। —এসব কথার মাঝে সব কথা কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে, কয়েকটা আবার ‘আধা উদারবাদী’ খেতাব পাওয়া ব্রাহ্ম সমাজের বিরুদ্ধেও গিয়েছে। তাই ব্রাহ্ম বুড়োদের অনেকে কিশোর ডিরোজিওর বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন।
এরই মধ্যে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের মত আরো বেশ কিছু সংগঠনের জন্ম হয়। প্রায় সব সংগঠনে সদস্য হিসেবে নিজের নাম লিখিয়েছিলেন ডিরোজিও। সংগঠন বেড়ে যাওয়ায় আলোচনাও বেড়ে যায়। আলোচনার সাথে পাল্লা দিয়ে সমালোচনা। শহরের আনাচে কানাছে ডিরোজিও এবং তার দলের সুনাম ও বদনাম। এদিকে লোকজন তাদের দলের একটা নামও দিয়েছে। ‘ইয়ং বেঙ্গল’ অথবা ‘নব্য বঙ্গ আন্দোলন’। কেউ কেউ ‘ইয়ং ক্যালকাটা’ও বলতো।
ইয়ং বেঙ্গলের আমদানি করা ডেভিড হিউম, জেরেমি বেনথাম, টমাস পেইন, ভলতেয়ারের মত প্রগতি ও যুক্তিবাদী চিন্তাবিদের প্রভাবে কলেজ ছাত্ররা সবকিছুকে যুক্তি দিয়ে বিচার করতে শুরু করলে সমাজে চিন্তার সংঘাত দেখা দেয়। লোকজন বলাবলি করতো – ‘যুক্তি ভালো, যুক্তি দেখাও। কিন্তু ধর্মকে যুক্তির বাইরে রাখো।’ আসলেই, ধর্ম আর যুক্তিকে এক করা যায় না। আর করা গেলেও হিন্দু নেতারা তা করতে দেবে কেন? হিন্দু ধর্মের খোলাখুলি নিন্দা ধর্মব্যবসায়ীরা সইবে কেন? কমবয়সী কতগুলো ছেলেপেলে, বলে “তামা পিতল মানি না, গঙ্গা মানি না!” এও কি সহ্য হয়!?
এখনকার ছেলেপেলেরা কোথাও দ্রুতগতির ওয়াইফাই সিগন্যালে প্রবেশের সুযোগ পেলে দরকারি উপাত্ত ডাউনলোড ও আপডেট করার জন্য যেরূপ চঞ্চল হয়ে উঠে, তখনকার সময়ে ইয়ং বেঙ্গলের ইয়ংম্যানরা এরচেয়ে অধিক চঞ্চল ছিলেন। তাদেরকে সন্ধ্যা বেলায় জোর করে ঠাকুর ঘরে নিয়ে গেলে সেখানে বসে ধর্মগ্রন্থ পড়ার পরিবর্তে হোমার, ইলিয়ডের বই থেকে উদ্ধৃতি পাঠ করতেন। দেবদেবীকে প্রণাম করার পরিবর্তে বলতো ‘গুড মর্নিং, ম্যাডাম!’ দিনের বেলা লোকজনকে দেখিয়ে গরুর মাংস ও মুসলমানের রুটি খেয়ে হিন্দুদের খাদ্যবিধিতে আঘাত করতেন। হাতের কাছে ব্রাহ্মণ পেলে ‘আমরা গরু খাইগো’ বলে উত্যক্ত করতেন। এভাবে করে হিন্দুদের জাত্যাভিমানে আঘাত হানার জন্য যত ধরনের বুদ্ধি মাথায় আসতো, তার সবটুকুর প্রয়োগ করতেন।
কিন্তু তা নির্বিঘ্ন হবে কেন! গ্রামে যেমন একজন বিশেষ বার্তাবাহক থাকেন যিনি এ বাড়ির খবর ওবাড়ি সেবাড়ি করে বেড়ান, তখন কলকাতা শহরে সেরকম একজন ছিলেন। ধর্মের পবিত্র দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে শহরজুড়ে ইয়ং বেঙ্গলের তরুণদের নামে নিন্দা প্রচার শুরু করেন। ধর্ম ও ঈশ্বর বিষয়ক সত্য নিন্দার পাশাপাশি মিথ্যা ও বানোয়াট নিন্দাও প্রচার হতো। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো ডিরোজিও তার শিষ্যদের বলেন ‘ভাই ও বোনের মাঝে বিয়ে’ হওয়ায় দোষ নেই। নিন্দা যেহেতু ধর্ম বিষয়ক, ভাই বোনের মাঝে বিয়ের মতো চাঞ্চল্যকর, সেহেতু ডিরোজিও আর যায় কোথায়! হিন্দু ধর্মের আভিজাত্যে হস্তক্ষেপের ফল পেতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি।
শুধু কানেমুখে নিন্দা ছড়িয়ে ক্ষান্ত হয়নি গোঁড়া হিন্দুরা। ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ নামে দু’টি হিন্দুত্ববাদী পত্রিকা ডিরোজিওর বিরুদ্ধে টানা বিষেদগার করেছে। যার মূল বাক্য ছিলো ‘দুর্বৃত্ত ফিরিঙ্গিদের নকল করে চলেছে যে নাস্তিক পশুরা, তাদের জন্য বিপন্ন হয়ে উঠেছে আমাদের ধর্ম।’ পাশাপাশি হিন্দু কলেজ কর্তৃপক্ষকে আহ্বান করা হতো ডিরোজিওকে বহিষ্কারের জন্য। কিন্তু ডিরোজিও বা কলেজ কর্তৃপক্ষ, কারোরই কোন কর্ণপাত হয়নি এসব অভিযোগ ও বিবৃতির দিকে। ফলে ১৮৩১ সালের এপ্রিল মাসে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় হিন্দু কলেজ শিক্ষকদের চরিত্র হনন করে এক চিঠি প্রকাশিত হয়। এই চিঠি প্রকাশের পর ডিরোজিও ও তার শিষ্যরা কলেজ কর্তৃপক্ষকে চাপ দেয় হিন্দু নেতাদের চিঠির প্রতিবাদ জানাতে। কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হয়। একই সাথে ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ পত্রিকায় হিন্দু নেতাদের সমালোচনা করে একটি কড়া উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। অনেকের ধারণা এই উপসম্পাদকীয় ডিরোজিও নিজেই লিখেছেন।
এর আগে কলেজ কমিটির পক্ষ থেকে হেডমাস্টার (অধ্যক্ষ) ডি আন্সলেমকে নির্দেশনা দেয়া হয় শিক্ষকরা যেন শ্রেণীকক্ষে বা এর বাইরে ছাত্রদের সাথে ধর্ম বিষয়ে আলোচনা সমালোচনা না করেন। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ডিরোজিওকে মৌখিক শোকজ করেন প্রধান শিক্ষক। দৈনিক কার্যবিবরণীতে একটু খুঁত পেয়ে উত্তেজিত হয়ে ডিরোজিওর গায়ে হাত তোলার জন্য তেড়ে যান। আত্মরক্ষা করে সেখান থেকে সরে আসেন তিনি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলায় শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ডেভিড হেয়ার। মিস্টার হেয়ারের প্রতিও ক্ষিপ্ত হন প্রধান শিক্ষক। হেয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ডিরোজিওকে আস্কারা দেন। আসলে ডেভিড হেয়ার ছিলেন ডিরোজিওর পাঠদান পদ্ধতির ভক্ত ও অন্যতম উৎসাহদাতা।
হেড মাস্টারের তোপের মুখ হতে বেঁচে আসলেও ডিরোজিওর শেষ রক্ষা হয়নি। ১৮৩১ সালের ২৩ এপ্রিল রামকমল সেন নামের এক প্রবীন হিন্দু নেতার আহবানে ডিরোজিওর বিরুদ্ধে বিচার সভার আয়োজন করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। সেখানে গোঁড়া হিন্দু পরিবার থেকে আসা ছাত্ররা এক জোট হয়ে ডিরোজিওর বিরুদ্ধে ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ আনে। রাধাকান্ত দেব এর মত রক্ষণশীল হিন্দু সমাজনেতার নেতৃত্বাধীন কলেজ ব্যবস্থাপনা পরিষদে অভিযোগ দাখিল করা হয়। ডিরোজিওর অনুপস্থিতিতে দীর্ঘ তর্ক বিতর্ক শেষে ‘ডিরোজিও তরুণদের শিক্ষাদানের পক্ষে অযোগ্য’ প্রস্তাবনার পক্ষে-বিপক্ষে শিক্ষকদের মাঝে ভোটাভুটি হয়। ৬-৩ ভোটে ডিরোজিওর জয় হয়।
কিন্তু বাদী হলেন কট্টর হিন্দু, বিচারক রক্ষণশীলদের নেতা, আর বিবাদী হলেন সংস্কারবাদী। সুতরাং যা হবার তাই হলো। বিচারে ডাক্তার উইলসন ও ডেভিড হেয়ার ডিরোজিওর পক্ষ নিয়েও লাভ হয়নি। কারণ জোটবদ্ধ হিন্দুর আকার আয়তন বেশ বড় ছিলো। রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন, রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসন্নকুমার, রসময় দত্ত এবং চন্দ্রকুমার ঠাকুরের মত সমাজনেতারা ডিরোজিওকে বরখাস্ত করা ‘একান্ত প্রয়োজনীয়’ ‘সুবিধাজনক’ বলে উল্লেখ করেন। তারা বলেন, ‘ডিরোজিওর অত্যাচারে হিন্দু ছাত্রদের মানসিক অবস্থা বিপর্যস্থ, নিজ ধর্মের অপমান দেখে ছাত্ররা সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।’ এমনকি ডিরোজিওর কারণে নাকি হিন্দু ছাত্ররা দলে দলে কলেজ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এসব দিক বিবেচনা করে ডিরোজিওকে কলেজ থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু বরখাস্ত নোটিশ জারির সাহস তাদের হয়নি।
তাই ডিরোজিও সম্মান করেন, এমন কাউকে খুঁজে বের করা হয়। তিনি ডক্টর উইলসন। কলেজের পরিদর্শক। ডক্টর উইলসন তিনটি গুরুতর প্রশ্নসহ পদত্যাগের সবিনয় অনুরোধ জানিয়ে ডিরোজিওকে অফিসিয়াল মোড়কে একটি আবেগমাখানো ব্যক্তিগত চিঠি লিখেন। প্রশ্ন তিনটি হলো ১. ডিরোজিও তার ছাত্রদের নাস্তিকতার দীক্ষা দেন কিনা? ২. ছাত্রদেরকে পিতামাতার অবাধ্য হওয়ার প্ররোচনা দেন কিনা? এবং ৩. ভাই-বোনের মাঝে বিয়ে সমর্থন করেন কিনা?
ডিরোজিও তার প্রিয় ব্যক্তিত্ব উইলসনের চিঠি পেয়ে প্রথমে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগপত্রে বেশ আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন “কোন কিছু যাচাই না করে, আমার কথা না শুনে, বিচারের প্রহসনটুকুও না করেই আপনারা বরখাস্ত করেছেন আমাকে।” ২৫ এপ্রিল ডিরোজিওর পদত্যাগপত্র কলেজ কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছে দেন ডক্টর উইলসন। কর্তৃপক্ষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বেশিরভাগ শিক্ষক ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এই পদত্যাগে খুশি হন। শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণ সিংহ নামে ভিন্নমত দেন এবং বরখাস্তের বিষয়ে নাখোশ হন।
২৬ এপ্রিল তারিখে ডক্টর উইলসনের তিনটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে বিশাল এক চিঠি লিখেন ডিরোজিও। ভাই-বোনের বিয়ে বিষয়ে করা তৃতীয় প্রশ্নে তিনি যারপরনাই বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং সরাসরি এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন। বাকি দু’টি প্রশ্নের যুক্তি নির্ভর জবাব দেন। ডিরোজিও বলেন, তিনি কখনোই ছাত্রদেরকে নাস্তিক বা আস্তিক হওয়ার উপদেশ দেন না। কেবলমাত্র যুক্তি, প্রমাণ ও পক্ষে বিপক্ষে মতামত বিবেচনা করে সত্য অনুসন্ধানের উপদেশ দেন।
ডিরোজিওর জবাবের একাংশ-
ঈশ্বরে বিশ্বাস নিয়ে কোন কথা বলাই যদি দোষ হয়, তাহলে আমি দোষী। কেননা, এ বিষয়ে দার্শনিকদের সংশয়ের কথা আমি তাদের বলেছি -এটা স্বীকার করতে এতটুকুও ভীত বা লজ্জিত নই। কারণ ঐসব সংশয়ের সমাধানের কথাও তাদের সামনে তুলে ধরেছি। এই প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করা কি কোথাও নিষিদ্ধ? যদি তা-ই হয় তাহলে প্রশ্নটির পক্ষে বা বিপক্ষে কোন দিকেই যুক্তি দেওয়া উচিত নয়। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে শুধু একটি দিক হতে জানা এবং সেই দিকটির বিরোধী সবকিছু থেকে নিজেদের চোখ-কান সরিয়ে রাখা কি কোন জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ?
…কিছুদিন তরুণদের শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। তাদেরকে ধৃষ্ট ও মূর্খ গোঁড়ামিবাদীতে পরিণত করাই কি আমার উচিত ছিলো? …নিজ দায়িত্ব ভেবে কলেজের বেশ কিছু ছাত্রকে হিউম লিখিত ক্লিহেস ও ফিলোর সুবিখ্যাত কথোপকথনের সাথে পরচিত করেছি। ঐ কথোপকথনে ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে সবথেকে সুষম ও পরিমার্জিত যুক্তিসমূহ উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু একই সাথে হিউমের বক্তব্যের যে তীক্ষ্ণ উত্তর দিয়েছিলেন ডক্টর রীড এবং ডুগান্ড স্টুয়ার্ট, তাও পড়িয়েছি।
এই হচ্ছে আমার অপরাধ
– অসীমকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বাংলার রেনেসাঁ’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত ও কিছুটা সংক্ষেপিত। আমরা পরে ইংরেজিতে লিখিত ডিরোজিওর সম্পূর্ণ চিঠির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করবো।
ডিরোজিও পদত্যাগ করলেন, হিন্দু নেতারা খুশি হলো। কিন্তু তাতে কি হিন্দু সমাজের আসলেই কোন লাভ হয়েছে হয়েছে? পদত্যাগের পর রক্ষনশীল হিন্দুরা পড়লেন মহা মুশকিলে। হাত মাত্র দু’টো। কান ঢাকবেন, নাকি নিজের দুইগাল স্পর্শ করে ভগবানের সামনে জিভ কাটবেন! প্রিয় শিক্ষককে কলেজ থেকে তাড়ানোর ঘটনা ছাত্ররা মেনে নেননি, নেয়ার কথাও না। তাই ডিরোজিওর শিষ্যদের গলার জোর আরো বেড়ে যায়, কথাগুলো আরো ধারালো হয়, চিন্তাসমূহ হয় আরো তীক্ষ্ণ। হঠাৎ আসা এক ঝড়ে হিন্দু ধর্মের সমালোচনা শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও যেতে থাকে। মত প্রকাশের পথে বাধাগুলো শক্তি হারাতে থাকে। এবং ডিরোজিওর সাথে তার ছাত্রদের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হতে থাকে।
তখন কলকাতায় ইউরোপিয়ান-এশিয়ান বংশদ্ভুতরা সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। নিজ সম্প্রদায়ের কল্যাণ সাধনের কাজেও ডিরোজিও সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। এসময় ‘দি ইস্ট ইন্ডিয়ান’ নামে একটি ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্র সম্পাদনা করতে শুরু করেন। সে সময় তিনি তার কিছু তরুণ হিন্দু শিষ্যকে সাংবাদিকতা পেশা গ্রহণে এবং এ গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের প্রগতিবাদী ধারণাগুলি প্রচার করতে উৎসাহিত করেন।
এভাবে ১৮৩১ সালের মে মাসে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দি ইনকোয়ারার’ নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং পরের মাসে দক্ষিণারঞ্জণ মুখোপাধ্যায় ও রসিককৃষ্ণ মল্লিক জ্ঞানান্বেষণ নামে বাংলায় (পরে ইংরেজিতেও) একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করতে শুরু করেন। ডিরোজিওর নির্দেশনায় এসব পত্রিকার মাধ্যমে তরুণ প্রগতিবাদীরা হিন্দু রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ চালায়।
কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারেননি হেনরি ডিরোজিও। হিন্দু কলেজ ছাড়ার কিছুদিন পর সেসময়ের আরোগ্যহীন কলেরা রোগে আক্রান্ত হন। খবর পেয়ে তার শিষ্যরা ছুটে আসেন। অর্থসংকটে থাকা ডিরোজিওর চিকিৎসার ভার নিয়ে সেবা শুশ্রুষা করেন। যদিও তাদের পক্ষে আরোগ্যেহীন এই রোগ নিরাময় সম্ভব ছিলো না। কিছুদিন রোগে ভোগার পর তৎকালীন হিন্দু সমাজকে রেহাই দিয়ে ১৮৩১ সালের ২৪ ডিসেম্বর ছোট জীবনের সমাপ্তি টানেন ডিরোজিও। তার মৃত্যু ছিলো, আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত। কলকাতার প্রগতিশীল শ্রেণী এরকম ধাক্কার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। কিন্তু ধাক্কা সামলে ওঠার ব্যবস্থা ডিরোজিও নিজেই করে রেখেছেন। তার যত্নে বেড়ে ওঠা মশালবাহকরা এরচে বড় অমাবশ্যা মোকাবেলা করতে সক্ষম। তাই ডিরোজিওর মৃত্যুতে বঙ্গে হিন্দু ধর্মের সংস্কার কিছুটা বাধাগ্রস্থ হয়তো হয়েছে, কিন্তু তা থেমে রয়নি।
—
না-ফোটা কুঁড়ির মতো তোমাদের মনগুলি দেখি
যখন পাপড়ি মেলে—কখনো বা সুস্মিত মধুরে
সঙ্ঘবদ্ধ ক্ষমতায়—উদ্যমে ডানা মেলে সে-কি
ছোট্ট পাখির মতো, মৃদুমন্দ গ্রীষ্মের দুপুরে
সময়ের সমীরণে—শুচিস্মিতা বৈশাখী বর্ষণে;
প্রথম প্রজ্ঞার বৃষ্টি ঝর-ঝর অযুত কণায়
নতুন ভাবনারাশি সমুজ্জ্বল সত্যের শরণে—
তোমাদের মগ্ন দেখি—লীন দেখি ধ্রুব সাধনায়
যখন, তখন আমি কী আনন্দে হই আত্মগত!
ভবিষ্য-দর্পণে দেখি সুনিপুন কালের বুননে
তোমাদের যশ্রোমাল্য গাঁথা হয়ে চলে অবিরত,
তখন তৃপ্তির ঢেউ দোলা দেয় আমার এ-মনে,
অনুভবে বুঝি তবে, ব্যর্থ নয় আমার জীবন—
কী সাফল্যে ধন্য হলো জীবনের পরম অর্জন।
—
ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ডিরোজিওর লেখা
‘Sonnet to the Pupils of the Hindu College’
কবিতার অনুবাদ। অনুবাদের কৃতিত্ব পল্লব সেনগুপ্ত’র।
গুরুর মৃত্যুর পর শিষ্যদের মাঝে কৃষ্ণমোহন, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, দক্ষিণারঞ্জন, প্যারিচাঁদ, রামগোপাল ঘোষ ও রামতনু লাহিড়ী ছিলেন সবচে বেশি সক্রিয়। তারা যার যার মত করে হিন্দুদের প্রাচীন বিশ্বাসে আঘাত করে যান এবং সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাদের কাজের পরিধি ও আওতা বেড়ে যায়, বাড়ে তৎপরতাও। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কৃষ্ণমোহন, রসিককৃষ্ণরা আরো বেশি দায়িত্বশীলতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে শুরু করেন। মেধা, প্রতিভা, সাহস আর পরিশ্রমের গুণে সংস্কারের ময়দানে দাপিয়ে বেড়ান।
ডিরোজিওর শিষ্যরা কর্ম বা ভ্রমণসূত্রে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে গেলে সেখানেও তাদের চিন্তাচিহ্ন রেখে আসতেন। এমনই এক শিষ্যের সন্ধান পাওয়া যায় তৎকালীন কাটিওয়াড়ে। তিসি সেখানে সন্ন্যাস জীবনযাপন করছিলেন। সে রাজ্যে তখন চরম অরাজকতা চলছিলো। প্রজাদের মুখে তাদের দুঃখ কষ্টের নিদারুণ বর্ণনা শুনে ব্যথিত হন। মুম্বাই থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় রাজার সমালোচনা করে লিখতে শুরু করেন। সন্ন্যাসীকে খুঁজে বের করে জেলে পাঠানো হয়। শেষে প্রজাদের প্রতিবাদের মুখে মুক্তি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বানানোর প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। প্রধানমন্ত্রী না হলেও পরের এক বছর ওই রাজ্যে সন্ন্যাস শাসন চলে। তার পরামর্শ অনুযায়ী রাজ্য শাসিত হয়।
অনেকে বলে থাকেন বাংলায় সমাজ সংস্কারে ডিরোজিও দর্শন খুব বেশি কার্যকরী ছিলো না। কারণ তার বিস্তৃতি ছিলো সীমিত। কথাটি সত্য নয়। ডিরোজিওর মৃত্যুর পরের অন্তত একটি প্রজন্ম তার উদ্যোগসমূহ নিজ দায়িত্বে বয়ে নিয়ে গেছেন। এরপর হয়তো সরাসরি ডিরোজিওর অনুসারী দাবি করে কেউ সমাজ সংস্কার করেনি, কিন্তু বঙ্গে মুক্তচিন্তার যে ধারায় আমরা প্রবাহমান তার জন্ম ডিরোজিও’র চিন্তালয়ে। এই অঞ্চলে মুক্তচিন্তার যত প্রশস্ত সড়ক দেখা যায়, তার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন হেনরি ডিরোজিও ও তার প্রিয় ছাত্ররা। আমরা সেই পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি।
তথ্যসূত্র
১. বাংলাপিডিয়া
২. দৈনিক প্রথম আলো
৩. আনন্দবাজার পত্রিকা।
৪. রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ —শিবনাথ শাস্ত্রী
৫. Henry Derozio: The Eurasian Poet, Teacher and Journalist —THOMAS EDWARDS
৬. ঝড়ের পাখিঃ কবি ডিরোজিও —পল্লব সেনগুপ্ত
৭. বাংলার রেনেসাঁ —অসীমকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত
কপিরাইট সংক্রান্ত অনুরোধঃ
এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।