সমাজের সামগ্রিক ক্ষয়, পশ্চাৎপদতা, মৌলবাদিতা ও সংকীর্ণতার বিপরীতে মহৎ মূল্যবোধের অসামান্য একটি প্রবন্ধ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য।’ আবু জাফর শামসুদ্দীন ব্যক্তিগত ভাবে সমাজতাত্ত্বিক-নৃতাত্ত্বিক জ্ঞানে পরিপূর্ণ একজন সাহিত্যিক। সাহিত্যের ভাষায় তিনি সমালোচনা করেছেন মুসলমানদের ১৪শ বছর আগের ধর্মকে। সুবিস্তৃত আলোচনার মাধ্যমে বুঝিয়েছেন বর্তমান সভ্যতার সাথে, দর্শনের সাথে বাংলার মুসলমান এবং ইসলাম ধর্মের সাগরসম দূরত্ব। যাকে তিনি তুলনা করেছেন প্লেগ রোগের সাথে, সেই সাথে মূলে আঘাত করে এই রোগ থেকে মুক্তির উপায় সম্পর্কে রচিত দারুণ এই প্রবন্ধটি অবিশ্বাসের পাঠকদের জন্য আরও একটি উপহার। পাঠে জ্ঞান বাড়ুক।
এখন হতে প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে প্রোটাগোরাস নাকি বলেছিলেন, man is the measure of all things অর্থাৎ মানুষ সব কিছুর মানদণ্ড। অনেক পরবর্তীকালে পোপ বলেছিলেন, The proper study of mankind is human being অর্থাৎ মানবজাতিকে ভালোভাবে জানার উপায় মানুষ। বাঙালী কবি চণ্ডীদাস পোপের আগের লোক। তিনি বিষয়টাকে আরো স্পষ্ট করে ঘোষণা করেন, “শুনহে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।”
গুণীজনের উক্তি উদ্ধৃত করে আমি এ-কথাটাই বোঝাতে এবং বুঝতে চাই যে, metaphysics অধিবিদ্যা হোক আর physics পদার্থবিদ্যা হোক, বিদ্যা চর্চা করে মানুষ। কেন করে? করে মানব-সমাজকে জানার জন্যে-মানুষের শক্তি কতটুকু বোঝার জন্যে এবং নৈসর্গিক জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নির্ণয় এবং তার ফলাফলের ভিত্তিতে মানব সমাজকে যথাস্থানে প্রতিষ্ঠার জন্যে। এই জানার কাজটাই বিদ্যা অর্থাৎ জ্ঞানচর্চা।
সংশয় ও সংশয়-জনিত অনুসন্ধিৎসা জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায়। সংশয় ও অনুসন্ধিৎসা সমাজবদ্ধ জীবন যাপনকারী মানবজাতির গুণ। জন্মগত জৈব-ধর্ম পালনের বাইরে বিচ্ছিন্ন মানুষের অন্য কোনো গুণ নেই। শিশু যদি ঘটনাচক্রে জনমানবহীন বনে একা মানুষ হয় তাহলে সেও হয়ে যায় কিপলিঙের মৌগলিস ব্রাদার্সদের (Mowglis brothers) একজন অর্থাৎ জঙ্গলের পশু। পরিণত বয়সে তাকে উদ্ধার করে আনলে সে সমাজ বদ্ধ মানুষের ভাষা বোঝে না। পশুর যেমন সংশয় ও অনুসন্ধিৎসা নেই, যা কিছু সে করে তার সব কিছুই স্বাভাবিক জৈবস্বভাবজাত ক্রিয়া, তেমনি সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন মানুষ জীব হিসাবে বেঁচে থাকলেও তার মধ্যে স্বোপার্জিত জ্ঞানের নিদর্শন পাওয়া সম্ভব নয়। সাগর মহাসাগরের দ্বীপে বৃহত্তর মানবসমাজ হতে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসকারী এমন কিছু কিছু মানুষের সন্ধান এখনও পাওয়া যায় যাদের কথা-বার্তা খুব অল্পসংখ্যক ধ্বনির মধ্যে সীমাবদ্ধ। হাজার হাজার বছর যাবৎ ওরা একই অবস্থায় আছে।
সব পশুই কিছু কিছু ধ্বনি করতে সক্ষম। কিন্তু ভাষা একমাত্র সমাজবদ্ধ মানব জাতির সম্পদ। ভাষা সমাজবদ্ধ মানবজাতির সংশয়ী ও অনুসন্ধিৎসু মস্তিষ্কের সবচেয়ে বিস্ময়কর ফসল। আমরা বোধ করি ভাষায়; পরস্পর কথা-বার্তা বলি ভাষায়; স্বপ্নও দেখি ভাষায়। এই ভাষা কোনো এক ব্যক্তির অবদান নয়, স্বর্গ হতে পতিত বস্তুও নয়। একটি একটি করে ইট বা পাথর গেঁথে যেমন দালান তৈরী করা হয় তেমনি ধ্বনির সঙ্গে নতুন নতুন ধ্বনি যোগ, শব্দের সঙ্গে নতুন নতুন শব্দ যোগ এবং সব শেষে যৌগিক ধ্বনি পৃথক এবং পৃথকীকৃত মূল ধ্বনির সংখ্যা নিরূপণ এবং তার প্রতীক চিহ্নরূপে অক্ষর প্রবর্তন—এভাবে ক্রমে ক্রমে হাজার হাজার বছরের সাধনায় ভাষা নির্মাণ ও তার বিস্ময়কর উন্নতি সাধন করেছে শৃঙ্খলাবদ্ধ সামাজিক জীবন যাপনকারী মানব সমাজ। ভাষা মানব জাতিকে তার আজকের অবস্থানে এগিয়ে নিয়ে এসেছে।
ভাষার উদ্ভব ও বিকাশের বিষয়টা উল্লেখ করতে হচ্ছে; কেননা ভাষার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানব-সমাজের সংশয় ও অনুসন্ধিৎসা শক্তিও বিকাশ লাভ করেছে। অপর দিকে ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ কোনো বিচ্ছিন্ন একক ঘটনা নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ সমাজের বিশেষ ধরনের আর্থ সামাজিক পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে ভাষার শ্রী ও শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য কথায় মানব জাতির কোনো কর্মকাণ্ডকে তার সামগ্রিক জীবন হতে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। ভাষার দারিদ্র ও পশ্চাৎপদতা জাতির দারিদ্র ও পশ্চাৎপদতাই প্রমাণ করে। অধিক ফসল ফলাবার জন্যে ব্যাপকভাবে কৃষির কাজ করার প্রয়োজন অনুভূত হওয়ার পর লাঙল আবিষ্কৃত হয়েছে। আমাদের ভাষায় লাঙল শব্দটি আছে। কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলের জুম চাষীদের ভাষায় লাঙল শব্দটি নেই। এই সামান্য দৃষ্টান্তটি দিয়ে আমি এ-কথাটাই বোঝাতে চাই যে, সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে উৎপাদন পদ্ধতি এবং সামাজিক জীবন পরিবর্তনের আবশ্যকতা উপলদ্ধ হয়েছে। এই উপলদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে মানুষের সংশয় এবং অনুসন্ধিৎসা অর্থাৎ জিজ্ঞাসা এবং তার জবাব পাওয়ার নেশা। এই জিজ্ঞাসা এবং তার জবাব খোঁজার প্রবৃত্তি আসলে প্রকৃতির খেয়াল খুশি হতে মানব-জীবনকে মুক্ত করার মানবিক গুণ। খেয়ালি প্রকৃতির সংহারী মূর্তিকে তুষ্ট করার জন্যে ব্যবহৃত নানা তুকতাক জাদুমন্ত্র পূজার্চনা প্রভৃতির ব্যর্থতা দেখেই মানুষ তার প্রাকৃতিক পরিবেশকে বশীভূত করার আবশ্যকতা অনুভব করে। এ অনুভূতি তার মস্তিষ্কে প্রচলিত আর্থ-সামাজিক প্রথা পদ্ধতির কার্যকরতা সম্বন্ধে সংশয় জাগ্রত করে; সংশয় জাগ্রত করে অনুসন্ধিৎসা। এই সংশয় এবং অনুসন্ধিৎসাই মানব জাতিকে দাসত্বপ্রথা ভিত্তিক ধর্মান্ধ সামাজিক পদ্ধতি হতে আজকের বিজ্ঞান ও টেকনোলজি ভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ আর্থসামাজিক রাজনৈতিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠায় একমাত্র হাতিয়ার রূপে কাজ করেছে। বিজ্ঞান ও টেকনোলজির সহায়তায় মানুষ তার পরিবেশকে যত বেশি বশীভূত বা পরিবর্তিত করছে ততই তারা বংশগতিক্রমে লব্ধ নানা অন্ধ কুসংস্কার এবং অভ্যস্ত চিন্তার দাসত্ব হতে মুক্ত হচ্ছে।
সংশয় ও অনুসন্ধিৎসা হতে দর্শন শাস্ত্রের উদ্ভব। এ-প্রসঙ্গে পরলোকগত মনীষী মওলানা আবুল কালাম আজাদের কিছু উক্তি মনে পড়ছে। তিনি যখন ভারত সরকারের শিক্ষামন্ত্রী তখন বিখ্যাত ভারতীয় দার্শনিক স্যার সর্ব পল্লী রাধাকৃষ্ণনের তত্ত্বাবধানে এবং ভারত সরকারের অর্থানুকূল্যে History of Eastern and Western Philosophy নামক দু’খণ্ডে সমাপ্ত একটি বই রচিত ও প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের ভূমিকা লেখেন মওলানা আবুল কালাম আজাদ। মাত্র ১৩ পৃষ্ঠার এ-ভূমিকার শুরুতে তিনি জনৈক ইরানী কবির দু’টি পঙক্তির উদ্ধৃতি দিয়েছেন। পঙক্তি দুটোর সারমর্ম এই, পৃথিবী এমন একটি গ্রন্থ যার প্রথম পৃষ্ঠা ও শেষ পৃষ্ঠা হারিয়ে গেছে। উদ্ধৃতির পর মওলানা আজাদ নিজে যে বক্তব্য রেখেছেন তার সারার্থ এই, দার্শনিকগণ পৃথিবী নামক এ-গ্রন্থের উক্ত হারানো পৃষ্ঠা দুটো উদ্ধারের চেষ্টা করেছে। সে চেষ্টা এখনও সফল হয় নি। কিন্তু ব্যর্থও হয়নি। হারানো পাতা দু’টি উদ্ধার প্রচেষ্টারই ফল সকল শাখা প্রশাখার আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও টেকনোলজি। অর্থাৎ মওলানা আজাদ দর্শন শাস্ত্রকে সকল বিদ্যার জননী বলেছেন। তার বক্তব্যের সঙ্গে শুধু এটুকু যোগ করাই যথেষ্ট যে অদ্যাবধি লব্ধ আমাদের জ্ঞান বলে, সূর্যের মতো আরো কোটি কোটি নক্ষত্র সঙ্কুল মহাবিশ্বের আরম্ভও নেই শেষও নেই। এবং এই মহাবিশ্ব না কি আবার ফুৎকারে প্রস্ফীত বেলুনের ন্যায় সততঃ তার আয়তন বৃদ্ধি করছে। যে-বস্তু আদি অন্তঃহীন তার পরিবৃদ্ধি চিন্তা করা যায় না। সে যা হোক, হারানো পত্রদ্বয় অনুসন্ধান করতে গিয়ে মানুষ মহাবিশ্ব নামক নক্ষত্রলোকের অনেক তথ্য জেনেছে। চন্দ্র ছিল এ যাবত পবিত্র, সেই চন্দ্রে অবতরণ, মলমূত্র ত্যাগ এবং সেখানকার মৃত্তিকা মুঠোয় করে নিয়ে এসে মানুষ প্রমাণ করেছে যে, পৃথিবীর মতো চন্দ্রের পবিত্রতা অপবিত্রতা নামক দু’টি সামাজিক বোধের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তথ্য সংগ্রহ করা মানে সব কিছু জানা নয়। পণ্ডিত ব্যক্তিগণ নানা প্রাচীন পুঁথি পুস্তক এবং দালান কোঠার ভগ্নস্তুপ ঘেঁটে যে-সব তথ্য সংকলন করেন তার মূল্য আছে, বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পুরস্কৃতও করে। কিন্তু সংকলন মৌলিক জ্ঞান নয়; অসংখ্য মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ এবং সেগুলো প্রয়োগ করে মানব জীবনকে অশ্রুতপূর্ব সমৃদ্ধ করা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত আমরা জানি না মহাবিশ্ব কেন আছে? কী আবশ্যকতা ছিল মহা অস্তিত্বের? আমরা মহা অস্তিত্ত্বের ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র পরমাণু। আমাদের জন্ম-মৃত্যু আছে। অর্থাৎ আমরা সসীম। আদি অন্তহীন অস্তিত্বের মধ্যে বসবাস করে আমরা nothingness-কিছুই নেই-অনস্তিত্ব চিন্তাও করতে পারি না। অন্ধকারও অস্তিত্ব, শূন্যতাও অস্তিত্ব, এমন কি অনস্তিত্বও তো এক ধরনের অস্তিত্ব। কিন্তু এই কেন’র জবাব জানি বা না জানি তাতে কিছু আসে যায় না। আমার বক্তব্য, আদি অন্তহীন অথচ সতত সম্প্রসারণশীল মহাজাগতিক অস্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করতে হলে মানুষের চিন্তাশক্তির সীমা বেঁধে দেয়া চলে না; বলা চলে না, Thus far and no further.
সর্বেশ্বরবাদ যে স্তরে গিয়ে অদ্বৈতবাদ পরিণতি লাভ করেছে সেখানে মানুষে ঈশ্বরে ভেদাভেদ নেই। মনসুর হাল্লাস বললেন, আমিই সেই পরম সত্য। শঙ্করাচার্যে তার সমর্থন ছিল। আমিই সেই পরম ও চরম সত্য উন্নীত হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক ধর্ম পালন করার আবশ্যকতা নেই। কেননা সেই পরম ও চরম সত্য শুধু আদি অন্তহীন নয়, শঙ্করাচার্যের মতে নিরাকার নির্বিকার এবং নির্গুণ। এ-ধরনের সত্তার উপর সাকার, সগুণ, বিকাশশীল এবং জন্মমৃত্যুর অধীন মানব সমাজের কোনো বিধি বিধান আইন কানুন প্রয়োগ করা যায় না। সুতরাং যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ “পরম ও চরম সত্যে” উন্নীত লাভ করল অর্থাৎ “আমিই সেই” হয়ে গেল, তাদেরকে ধর্মের দোহাই দিয়ে বলা চলে না, “তোমার ভাবনাচিন্তার সীমা ঐ প্রস্তরফলক পর্ষন্ত, তার বাইরে এক কদমও যেতে পারবে না; গেলে তোমাকে কতল করা হবে।” ফ্রেডরিক নিটশে সম্ভবত এ চিন্তাটাকেই আরো একটু পরিমার্জিত করে বলেছিলেন, God is dead-ঈশ্বরের মৃত্যু হয়েছে এবং dead God-এর শুন্য স্থানে স্থাপন করেছিলেন superman বা অতিমানবকে। বলা বাহুল্য, নিটশের অতিমানব সামাজিক আইন কানুনের ঊর্ধ্বে। ফ্যাসিস্ট ডিক্টেটরশিপের বিভিন্ন তত্ত্বীয় ভিতের মধ্যে নিটশীয় তত্ত্বের ভূমিকাই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য।
ফ্যাসিবাদকে আমি ঘৃণা করি; আমি মনে করি, সমাজের বাইরে একক মানুষের কোনো স্বাধীনতা নেই। এবং নেই যে, তার প্রমাণস্বরূপ সামান্য যুক্তিই যথেষ্ট যে, স্বাধীনতা-পরাধীনতা নামক বোধের উদ্ভব সামাজিক এবং পরিবেশগত অবস্থান হতে। এখানে intuition অর্থাৎ সজ্ঞার বিষয়টি আসতে পারে জানি। কিন্তু সজ্ঞা প্রকৃতপক্ষে দৃষ্ট ঘটনা অথবা বিশেষ পরিবেশ গত অবস্থার তাৎক্ষনিক জৈব প্রতিক্রিয়া। বিপদ দেখলে, উটপাখী বালিয়াড়িতে মাথা গোঁজে, কচ্ছপ তার মাথা গুটিয়ে নেয়। সুযোগ-সুবিধা দেখলে আনন্দও করে। সম্মুখে বাঘ দেখলে নিরস্ত্র মানুষ পালায়, অথবা গাছে আরোহন করে, অবার দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত কোনো যানবাহন দেখলে তার মাল লুটও যেমন করে কিছু লোক তেমনি কিছু কিছু মানুষ যাত্রী এবং তাদের মালসামনি উদ্ধার করে। এই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার বশে কৃত তাৎক্ষণিক ক্লিয়ার গুণাগুণ বিচার করতে গেলে সজ্ঞাজাত কর্ম বলে কিছু থাকে না; কেননা গুণাগুণ সামাজিক বোধ। দু’চার দিনের ক্ষুধার্ত মানুষের সামনে আহার্য পড়লে তার সজ্ঞাজাত প্রতিক্রিয়া হলো ক্ষুধার্ত পশুর মতো সেই আহার্য ভক্ষণ-সাধুতা বা চৌর্য বৃত্তির পার্থক্য নির্ণয় নয়। এখানে সাহিত্য বিশেষ করে কবিতা রচনার বিষয় উত্থাপিত হতে পারে। সামাজিক এবং পরিবেশগত ঘটনাবলী এবং দৃশ্য কবির মনে যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করে ঠিক সেটাই কবিতা নয়। কবিতা সমাজে প্রচলিত সুসংবদ্ধ ভাষায় রচিত। সুতরাং রচিত হওয়া মাত্র এটা সামাজিক বস্তু হয়ে যায়। তার গুণাগুণ বিচার করে সমাজ। যে কবি বলেন, বিশৃঙ্খল মন আমার পবিত্র ধন, তিনিও সামাজিক ভালোমন্দ বোধের বাইরে অবস্থান করেন না; কেননা শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলা পাগলামি এবং সুস্থতাও সামাজিক বোধ। নিটশের একটি উক্তির আলোচনাকে এতদূরে নিয়ে আসার কারণরূপে আমার বক্তব্য এই যে, অতিমানব নয়, সকল মানুষই জন্মকালে নগ্ন শিশু এবং অজ্ঞ। সুতরাং জ্ঞানী হওয়ার, এবং সমাজবদ্ধ মানুষ হিসেবে যতখানি স্বাধীন হওয়া বা স্বাধীন চিন্তা করা তার পক্ষে সম্ভব তা করার অধিকার মানব জাতির জন্মগত অধিকার–বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা অতিমানুষের নয়।
নিটশে ব্যক্তি মানুষকে সবার ওপরে সত্য না বলে যদি চণ্ডীদাসের মতো বলতেন, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই, তা হলে কোনো আপত্তির কারণ থাকতো না। এখানে সর্বেশ্বরবাদ সম্বন্ধেও দু’টি কথা বলে নেয়া আবশ্যক মনে করি। রবীন্দ্রনাথ মাত্র দু’টি পঙক্তির মধ্যে সর্বেশ্বরবাদের নির্যাস আমাদের জন্যে পরিবেশন করেছেন। তিনি বলেছেন,
“সীমার মধ্যে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর-
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত সুমধুর। “
অসীম তার অসীমতার মধ্যে থেকেই তার সুর বাজান আর সীমার মধ্যে অবস্থান করেই তার সুর বাজান সে-সুর শুধু মধুর হবে না ‘অসীমও’ হবে। তাই ‘সসীমের’ চিন্তা-ভাবনার সমুখেও কোনো দেয়াল তোলা যাচ্ছে না। একমাত্র সীমারেখা হচ্ছে, সমাজবদ্ধ মানুষ হিসেবেই সে চিন্তা করে ; এবং “ভাষার অতীত তীরে” অস্তিত্ব থাকলেও চিন্তাশক্তি নেই।
অপরদিকে একেশ্বরবাদ যে পর্যায়ে গিয়ে আদি অন্তহীন নিরাকার সগুণ ঈশ্বর কল্পনায় উন্নীত হয়েছে, সেখানে ঈশ্বর প্রাণীজগৎ সহ মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। সেখানে স্রষ্টা এবং সৃষ্ট বস্তু পৃথক পৃথক সত্তা। ঈশ্বর সতত আছেন থাকবেন তার উদ্ভব ও ধ্বংস নেই—জন্ম মৃত্যু নেই। তার সৃষ্ট বাকী সব কিছু বিলীন হচ্ছে এবং হবেও। এ-মতের ঈশ্বরচিন্তা হতে এ-অনুসিদ্ধান্তে আসাই যুক্তিসঙ্গত যে, যেহেতু ঈশ্বরসৃষ্ট সব বস্তুরই আদি অন্ত উদ্ভব ধ্বংস এবং জন্ম মৃত্যু আছে সুতরাং মানব-সমাজে প্রচলিত সমস্ত প্রথা পদ্ধতি ও মতামতেরও উদ্ভব এবং অবসান আছে। অবশ্য অবসান না বলে বিবর্তন শব্দটিও ব্যবহার করা যায়। মানব-জীবন পরম্পরাক্রমে প্রবহমানতা। মৃত ব্যক্তির স্থান পূরণ করছে নবাগত ব্যক্তি। এই অনুক্রমের মধ্যে বিবর্তিত হচ্ছে মানব-সমাজের সমস্ত ইতিহাস। সুতরাং দ্বিতীয় মতের ঈশ্বর চিন্তায়ও মানুষের চিন্তাশক্তির অগ্রাভিযানের পথে কোনো প্রাচীর তোলা যায় না : বলা যায় না, Thus far and no further. অর্ধশতাব্দীরও অধিককাল পূর্বে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ কথাটাই আরো স্পষ্টভাবে বলেছিলেন।
মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;-গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য এই যে, বাংলাদেশের মতো অনুন্নত অঞ্চলের মানব-সমাজে এই সাধারণ যুক্তির কথাগুলোও মানা হয় না। যারা সীমা-সরহদ্দ বেঁধে দেয়, প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বাধা দেয় তারা মূর্খ নয়; ওদের মধ্যে সকলেই কেতাবী বিদ্যায় বিদ্বান–অনেকে দার্শনিকরূপেও খ্যাত।
প্রসঙ্গত অষ্টাদশ শতাব্দীর মনীষী হেলভেটিয়াসের (Helvetius) নামটা মনে পড়ছে। তাঁর সম্বন্ধে বাট্রাণ্ড রাসেল লিখেছেন, “Helvetius considered the differences between individual’s interest due to differences of education, in every individual, his talents and his virtues are the effect of his instruction. Genius, he maintains, is often due to chance; if Shakespeare had not been caught poaching, he would have been a wool merchant. His interest in legislation comes from the doctrine that the principal instructor of adolescence are the forms of Government and the consequent manners and customs. Men are born ignorant, they are made stupid by education.”
মূল কথাটা হচ্ছে, জন্মকালে মানুষ অজ্ঞ, বিদ্যা তাকে নির্বোধ বানায়। একালে বিদ্যাশিক্ষা দেয় সরকার। পৃথিবীর সকল দেশের সরকারের আলাদা শিক্ষাবিভাগ আছে। কোনো কোনো সরকারের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ও আছে। প্রাচীনকালে এবং মধ্যযুগে শিক্ষাদানের বিষয়টা পুরোহিততন্ত্রের অধীনে ছিল। শিক্ষা গ্রহণও করত প্রধানত পুরোহিত শ্রেণী। নাম স্বাক্ষর করতে অক্ষম রাজ-রাজড়াদের নামও ইতিহাসে পাওয়া যায়। সমকালীন উৎপাদন পদ্ধতির অধিকাঠামো রাষ্ট্র এবং তার গভর্নমেন্ট। শাসকশ্রেণী প্রচলিত আর্থ-সামাজিক প্রথা-পদ্ধতির রক্ষক আগেও ছিল এখনও তাই। বিরল ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে সেকাল একাল সবকালেই পুরোহিতরা প্রচলিত আর্থ-সামাজিক প্রথা পদ্ধতির রক্ষক শাসক শ্রেণীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে; কেননা পরিবর্তন উভয় পক্ষের স্বার্থ-হানিকর হবে বলে ওরা ভেবেছে। সুতরাং শাসিত ও শোষিত জনসাধারণকে “stupid” তৈরীর উপযোগী শিক্ষাদান করাটাই সরকার এবং পুরোহিততন্ত্র যুক্তিযুক্ত মনে করেছে। ঐ নীতির ফলে বহু সু-প্রাচীন সভ্যতা ও জাতি ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়েছে। প্রাচীন মিশরের পুরোহিত শ্রেণী সে দেশের জনসাধারণ এবং রাজ-রাজড়াদের মমি শিল্প (mummy industry)-তেই নিযুক্ত রাখল, ওদের গণিত ও জ্যামিতি জ্ঞান অন্য কোনো কাজে লাগল না। যুক্তি বিদ্যা ও দর্শন শাস্ত্রে গ্রীক মনীষীদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই; কিন্তু ওরাও দাসদের প্রাণী মনে করতো–মানুষ জ্ঞান করতো না। এ যুগে পৃথিবীর সর্বত্রই সাক্ষরতা প্রসার লাভ করেছে; কিন্তু সাধারণ ভাবে পূঁজিবাদী আর্থ-সামাজিক পদ্ধতিতে শাসিত সকল অঞ্চলে এবং বিশেষভাবে আধা পূঁজিবাদী আধা-সামন্তবাদী প্রথা-পদ্ধতিতে শাসিত বাংলাদেশের ন্যায় অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের সরকারী শিক্ষাদান পদ্ধতি যতটা না জ্ঞান বিস্তারের সহায়তা করে তার চেয়ে অনেক বেশী সহায়তা করে stupid অর্থাৎ শিক্ষিত মূর্খ তৈরীর মেশিনরূপে। বাংলাদেশের নামটা যখন এসে গেছে তখন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সংস্কৃতি বিষয়ে কিছুটা আলোচনা এখানেই করে নেয়া যাক। দর্শনশাস্ত্রের ছাত্র, শিক্ষক এবং অনুরাগীরা বিশ্বনাগরিক। কেননা দর্শনশাস্ত্র সহ এ-যুগের সকল শাস্ত্রই যুগপৎ বিশ্বজনীন এবং স্থানিক। সুতরাং বৃহত্তর পরিসরে জ্ঞান চর্চার সময়ে স্বদেশের প্রতি উদাসীন থাকলে কর্তব্য কর্মে অবহেলা করা হয় বলেই আমার ধারণা, কেননা বিশ্বজনীনতার প্রভাব স্বদেশের সামাজিক জীবনে যদি না পড়ে তাহলে জ্ঞানচর্চা সেকালের মতো একালেও একটি ক্ষুদ্র শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
এ-দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যা সহ সকল শাখার সর্বাধুনিক বিদ্যা। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও টেকনোলজি মানবজাতিকে দিয়েছে ইঞ্জিন চালিত রেলগাড়ী, জাহাজ, বিমানযান, পারমাণবিক রি-এক্টর, নানা ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র, উৎক্ষেপন যন্ত্রের সাহায্যে চাঁদে অবতরণের ক্ষমতা, টেলিগ্রাম, টেলিফোন, টেলিভিশন এবং সর্বোপরি বিশাল বিশাল কল কারখানায় যে কোনো দ্রব্য লাখে লাখে প্রস্তুত এবং পৃথিবীর সর্বত্র অল্প সময়ের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করার যোগ্যতা। কম্পিউটার এখন মানব-মস্তিষ্কের বহু জটিল প্রশ্নের তাৎক্ষণিক জবাব দিচ্ছে। ঢাকায় বসে মেক্সিকোর খেলা দেখছি। রাডার বহু দূরের দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে। বিশাল বিশাল মুদ্রণযন্ত্রে শতাধিক পৃষ্ঠার বিষয়বস্তু ঘন্টায় বিশ ত্রিশ হাজার করে ছাপা হচ্ছে। দর্শনশাস্ত্রও এখন আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব, পাভলতের প্রতিবর্তী ক্রিয়া তত্ত্ব (theory of conditioned reflex), জ্যোতির্বিজ্ঞান, সংখ্যাতত্ত্ব, উচ্চতর গণিত, পরমাণু-বিভাজনকৌশল, সমাজ-বিজ্ঞান, এমন কি বাইওলজি ফিজিওলজির সঙ্গেও মিশে গেছে। বলা বাহুল্য, এসব কিছুই মানুষের আবিষ্কার; কোনো কিছু সহসা উলকা পিণ্ড পতিত হওয়ার মতো আকাশ হতে ভূমণ্ডলে পতিত হয় নি। বিজ্ঞান এবং টেকনোলজির এ-অসাধারণ উন্নতির ফলে সুদূরও হয়ে গেছে অত্যন্ত নিকট-বিশ্ব আজ ওয়েনডেল উইলকির এক বিশ্ব। নারী-পুরুষ জাতি ধর্ম রং নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল মানুষ এই একীভূত বিশ্বের সকল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হোক সম্পৃক্ত। পৃথিবীতে আজ মাত্র দুটি আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক সিস্টেম বিদ্যমান। তার একটি পূঁজিবাদী পদ্ধতি। অন্যটি সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি। দু’টি পদ্ধতির মধ্যে লক্ষ্যাদর্শের লড়াই আছে; কিন্তু শিল্প বিপ্লবোত্তর যুগের লেনদেনের জটিল জালের বাইরে আলাদাভাবে অবস্থান করার উপায় কারো নেই। অপরদিকে কোনো জাতি দেশ বা রাষ্ট্রের সাধ্য নেই উক্ত দু’টি পদ্ধতির বাইরে অবস্থান করার।
এগুলো আমার মনগড়া কথা নয়; সবার চোখের সামনেই আছে। কিন্তু বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী এবং পুরোহিত শ্রেণী বলছে, ইসলাম ধর্ম না কি complete code of life-অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধি। এ উক্তিকে আমরা দু’দিক থেকে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি। প্রথমত পারলৌকিক চিন্তা, দৈনন্দিন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি, সৎ অসৎ কার্যাবলী সব কিছুই ইহজগতে করণীয়-পরলোকে সদাচরণ অসদাচরণ, নীতি-দুর্নীতি, পাপপুণ্য, আইন কানুন, ধর্মাধর্ম, সত্য-মিথ্যা প্রভৃতি কিছুই নেই। ইসলাম ধর্মমতে আছে শুধু অন্তহীন বেহেশত এবং দোজখ। সুতরাং ইহলোকে যখন যে অর্থ সামাজিক রাজনৈতিক সিস্টেম প্রচলিত তার মধ্যে অবস্থান করেই জীবিত মানুষকে তার ধর্মকর্ম করতে হয়। এর বাইরে থাকার কোনো উপায় নেই। এমন কি, পরলোকের বেহেশত দোজখের যে বিবরণ আমরা পাই সে-তো ধর্মপ্রবর্তিত হওয়ার স্থানে প্রচলিত সমকালীন পরম সুখ এবং চরম শাস্তি সম্বন্ধীয় ধ্যান-ধারণারই প্রতিলিপি।
দ্বিতীয়ত, শাসকশ্রেণী এবং পুরোহিতন্ত্র প্রচারিত তের-চৌদ্দ শতাব্দী পূর্বের complete code of life এর মধ্যে রেলগাড়ী, স্টিমার, মোটরগাড়ী, বিমানযান, পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র, ডুবোজাহাজ, বিদ্যুৎশক্তি, গ্যাস, টেলিফোন, টেলেক্স, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, অসাধারণ গতিদানক্ষম উৎক্ষেপণ যন্ত্র, বন্দুক কামান, ইনকাম ট্যাক্স, সুপার ট্যাক্স, মাকড়সার জালের মতো বিস্তৃত আঠাল এ-যুগের সরকারী যন্ত্র ও ব্যুরোক্রাসি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সরকারী লেনদেনে সুদ আদান প্রদানের বাধ্যবাধকতা, কোম্পানিজ ‘ল’, কমার্শিয়াল কোর্ট প্রভৃতি কিছুই ছিল না। ছিল না অসংখ্য প্রকার ভোজ্য ও ভোগ্য পণ্য, লাখ লাখ লোকের বিশাল বিশাল মহানগর, অগণিত বড় বড় সুউচ্চ দালান কোঠা, তার এসকেলেটর, লিফট, ব্যাঙ্ক ইসিউরেন্স কোম্পানি, মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশন প্রভৃতি কিছুই। ভূগর্ভে খনি ছিল কিন্তু ভূপৃষ্ঠে খনিজ তৈল ছিল না। এসব কিছু নিয়েই এ যুগের complete code of life। বলা বাহুল্য, code of life কখনও complete অর্থাৎ ফাইনলাটিতে পৌছার নয়; তার মধ্যে ক্রমাগত যোগ বিয়োগের ক্রিয়া চলছে। এ প্রক্রিয়াতেই এগিয়ে চলছে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি। এ যুগের রাষ্ট্রে কোটি কোটি লোক বসবাস করে। অতি সৎ এবং পরম মানবহিতৈষী রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষেও এ-যুগে বাড়ী বাড়ী ঘরে অধিবাসীদের সুখ-দুঃখের খোঁজ খবর নেয়া এবং অভুক্তের বাড়ীতে নিজ মাথায় বহন করে আটা বা চালের বস্তা পৌছে দেয়া সব নয়। সে-কালের complete code of life এর মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগামী যান হিসেবে আমরা উট, ঘোড়া এবং পাল চালিত জাহাজের উল্লেখ দেখতে পাই। নেজা, গুরজু, ঢাল, তরবারি, কুঠার, প্রস্তর খণ্ড প্রভৃতি ব্যতীত অন্য কোনো মারণাস্ত্রেরও উল্লেখ দেখতে পাই না। তখন সূর্য ঘুরতো, পৃথিবী ছিল স্থির এবং চ্যাপটা-চলতে চলতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এখন সূর্যও ঘোরে বটে, কিন্তু পৃথিবীও সূর্যের চারদিকে ঘোরে বলেই দিন রাত হয় ঋতুর পরিবর্তন ঘটে। মানুষের তৈরী কৃত্রিম উপগ্রহ, চাঁদের মতো পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে এবং সেই উপগ্রহের সহায়তায় আমরা দেশদেশান্তরের তথ্য আদান প্রদান করি।
সকল একেশ্বরবাদীর কাছে ঈশ্বর সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। উপরিউক্ত বস্তু এবং বিষয়গুলো বিষয়ে ঈশ্বর অবগত থেকেও কেন চৌদ্দ শত বছর পূর্বে তিনি মানবজাতিকে এ-সব জ্ঞান দিলেন না এমন কি তার উল্লেখও করলেন না কোথাও—এ-প্রশ্ন মানব মনে জাগা স্বাভাবিক। আমরা ঈশ্বরের বিশেষ অনুগ্রহভাজন সম্প্রদায় বলে বিশ্বাস করি। শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবৎ আমরা জামাতে বসে মোনাজাত করি, হে আল্লাহ আমাদের ইজ্জত বৃদ্ধি করে, কাফেরদের জিল্লতি বৃদ্ধি করে এবং ওদের বাড়ীঘর ধূলিসাৎ করে দাও—ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ফলাফল কি? চর্মচক্ষেই দেখতে পাচ্ছি, আমরা যাদের কাফের বলি তারাই এখন ইসলামের আদিভূমি আরব সহ সমগ্র ইসলাম জগতের উপর আধিপত্য করছে। মুসলমানদের প্রথম কাবা বায়তুল মোকাদ্দেস এখন ইয়াহুদীর দখলে। কাফেরদের বাড়ীঘর ক্রমাগত মজবুত এবং সুন্দর হচ্ছে। এসব নিদর্শন বা আয়াত কি এ ইঙ্গিতই দেয় না যে, মানুষকে নিজের চেষ্টায়ই যার যার ভাষার সহায়তায় জ্ঞান অর্জন ও প্রয়োগ করতে হয়। ঈশ্বর কাউকে আগাম জ্ঞান দান করেন না। এবং ব্যৈক্তিক বা সাম্প্রদায়িক প্রার্থনাও ঈশ্বরকে প্রভাবিত করতে পারে না। কেননা ধর্মমতানুযায়ী তিনি শুধু সর্বভূতেশ্বর নহেন, মহাবিশ্বের সব কিছুর ঈশ্বর। এটাও একটি ঐতিহাসিক সত্য যে, মক্কা মদীনার বাইরের দেশ বিজিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম রাজা বাদশাহগণকে রোমান অথবা ইরানীদের রাজ্য শাসন প্রণালী গ্রহণ করতে হয়। ধর্মগ্রন্থে কিছু কিছু ফৌজদারী দেওয়ানী আইন আছে। ফৌজদারী এবং দেওয়ানী আইনের প্রায় সবকিছুই প্রাচীন বেবিলনীয় রাজা হাম্বুরাবি হতে মুসা হয়ে আগত। এমনকি বাড়তি ত্বকচ্ছেদ, খাদ্যাখাদ্য ও বিবাহ সম্পর্কিত বিধি নিষেধ এবং সুদ আদান প্রদান সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা প্রভৃতিও। এটাকেই আমি বলতে চাই বহমান আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক অবস্থার তথা ঐতিহাসিক বাধ্য বাধকতা। এই বাধ্যবাধকতার বাইরে থাকার উপায় যেমন নেই; তেমনি সমকালীন অবস্থার মধ্যেই পরবর্তী ঐতিহাসিক অধ্যায়ের বীজ উপ্ত থাকে। কেননা বলপ্রয়োগে সাধিত বিপ্লবই হোক আর ক্রমান্বয়ে সাধিত পরিবর্তনই হোক মানবেতিহাস চিন্তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছে; কোনো বিশেষ কালকে যেমন আলাদা করে বিচার বিশ্লেষণ করা যায় না তেমনি কোনো একটি সামাজিক সমস্যাও তার অন্য সমস্যাবলী হতে পৃথক করে সমাধান করা সম্ভব নয়। স্থানে স্থানে বাধা বিপত্তি এমন কি সময়ে পশ্চাদ্ধাবন সত্ত্বেও সামগ্রিক বিচারে মানবেতিহাসের প্রতিটি যুগ-প্রবর্তক পরবর্তী অধ্যায় মানবজাতির অগ্রগতি ও উন্নতির ইতিহাস। মোটরগাড়ী, রেলগাড়ী ও বিমানযান, বিজলীবাতি, টেলিফোন, টেলিভিশন, আধুনিক পোশাক পরিচ্ছদ, খাদ্যাখাদ্য প্রভৃতি ছেড়ে যেমন উষ্ট্র, অশ্ব, গরুর গাড়ী, পিদিমের নিবু নিবু আলো, সেলাইহীন লুঙ্গি, চাদর, খেজুর, উষ্ট্রদুধ ও উষ্ট্ৰমাংসের যুগে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয় তেমনি সম্ভব নয় এ যুগের দু’টি আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক সিস্টেম পুজিবাদ অথবা সমাজতন্ত্রের বাইরে অবস্থান করা। তের-চৌদ্দ শত বৎসর পূর্বের complete code of life-এ ফিরে যাওয়ার অর্থ উষ্ট্র, অশ্ব, গরুর গাড়ী, পিদিমের আলো, চোখের বদলে চোখ, ফ্রী মানুষের বদলে ফ্রী মানুষ, দাসদাসীর বদলে দাসদাসী, দাসত্ব-প্রথা প্রভৃতিতে ফিরে যাওয়া। এক মুখে এক সময়ে দুধ ও তামাক সেবন সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্মীয় ও দার্শনিক সিস্টেম উদ্ভাবক ও প্রবর্তকগণ ছিলেন যার যার কালে বিদ্রোহী। যীশুখস্ট তো বিদ্রোহী হিসেবেই প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন।
বাংলাদেশ সহ মুসলিম অধ্যুষিত সকল দেশের মুসলিম রাজনীতিক এবং ওদের সঙ্গে সহযোগিতাকারী তথাকথিত ওলামায়ে কেরাম এ-সব জানেন এবং জীবন যাপন করছেন এ-যুগের code of life অনুযায়ী। ওরা টেলিফোন টেলেক্স করছেন, রেলগাড়ী মোটরগাড়ী, বিমান প্রভৃতিতে চড়ছেন, পীড়িত হলে এ্যান্টিবায়টিক ঔষধও ব্যবহার করছেন, কৃত্রিম উপগ্রহ মারফৎ আগত দৃশ্যাবলী রঙিন টেলিভিশনে দেখছেন, মাইক যন্ত্রের মাধ্যমে ওয়াজ নসীহত করছেন, আজান দিচ্ছেন, বক্তৃতা করছেন, রেডিয়োতে গান শুনছেন, প্রয়োজন বোধে বন্দুক কামান বোমারু বিমান প্রভৃতি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র স্বদেশের মানুষের উপর প্রয়োগ করছেন, এ-যুগের যাবতীয় খাদ্যাখাদ্য পানীয় ও পোশাক পরিচ্ছদ দেশে বিদেশে ভোজন, পান ও ব্যবহার করছেন, বিজলী বাতির সাহায্যে ঘর আলোকিত করছেন, ব্যবসা বাণিজ্য ও রাষ্ট্রীয় লেনদেনে সুদ আদান প্রদান করছেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে। ক্রীতদাস ক্রীতদাসী রাখার জায়েজ প্রথাটিও বর্জন করেছেন। হাম্মুরাবী হতে মুসা হয়ে আগত দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনের অনেক কিছু বর্জন এবং সংশোধন করেছেন। এখানে এ কথাটি বলে রাখা আবশ্যক যে বর্তমান যুগের উপরিউক্ত অপরিহার্য দ্রব্যগুলোর কোনো একটিও পৃথিবীর কোনো একজন মুসলমান আবিষ্কার করেন নি। প্রকৃতপক্ষে পুত্র কর্তৃক নিহত মির্জা উলুগ বেগের পরে পৃথিবীর কোথাও নামোল্লেখ করার মতো কোনো মুসলিম বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক এমন কি কবি সাহিত্যিকের সন্ধান পাওয়া যায় না। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত একমাত্র মুসলিম আবদুস সালাম। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকশ্রেণী তাঁকে অমুসলমান ঘোষণা করেছে। বাঙালী মুসলিম সমাজের প্রায় আটশত বছরের ইতিহাসে একমাত্র অসামান্য প্রতিভাবান ব্যক্তি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাকেও কাফের ঘোষণা করা হয়েছিল। বেদীন কাফেরদের আবিষ্কৃত এবং তাদের কাছ থেকে নগদ দাম দিয়ে ক্রীত যানবাহন, যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র প্রভৃতি দ্রব্য ব্যবহারী মুসলিম শাসকশ্রেণী এবং তাদের সহযোগী তথাকথিত ওলামায়ে কেরাম তবু সাধারণ মানুষকে এই বলে বেড়াচ্ছেন যে, তের চৌদ্দ শতাব্দীপূর্বের complete code of life-এর পশ্চাদ্ধাবনের মধ্যেই না কি এ-যুগের বাংলাদেশের দশ কোটি মানুষের সকল সমস্যার সমাধান নিহিত। শিক্ষার নামে, বক্তৃতায়, ওয়াজ নসীহতে, পাঠ্য-পুস্তকে, স্কুল মাদ্রাসায় মূর্খতা এবং গোমরাহি সম্প্রসারণের এই যে অবিরাম চেষ্টা চলছে তার বিরুদ্ধে বিদগ্ধ মহলের–দেশের দার্শনিক, দর্শনশাস্ত্রের ছাত্র, পদার্থবিজ্ঞানী, রসায়নশাস্ত্রী, এবং গণিতজ্ঞদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর কোথায়? মূর্খতা এবং গোমরাহি সম্প্রসারণোপযোগী সিলেবাস, কারিকুলাম, বইপত্র প্রভৃতি তো আর নিরক্ষর সাধারণ মানুষ প্রণয়ন করে না। সাধারণ মূর্খ মানুষ শিক্ষকতাও করছে না। বিদ্বান ব্যক্তি যখন বিদ্যা বিতরণ না করে গোমরাহি এবং মূর্খতা সম্প্রসারণকারী ভণ্ডদের সঙ্গে সহযোগিতা করে তখন তাকে চাণক্য বা মেকিয়াভেলির সঙ্গে আসন দিলেও সে লোক দুটোর প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হয়। সব কিছু দেখে শুনে মনে হয়, মুসলিম সমাজ হতে লজ্জা ও লজ্জিতবোধ করে পালিয়ে গেছে।
মানবতাবাদ বলতে আমি বুঝি মানব কল্যাণ। আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক প্ৰথাপদ্ধতি সংশোধিত, বিবর্তিত এবং বৈপ্লবিকভাবে পরিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে মানব-কল্যাণ সম্বন্ধীয় ধ্যান-ধারণাও রদবদল হয়েছে। এ্যারিস্টটলের মধ্যে গণতন্ত্রের কথাও আছে। কিন্তু দাসদাসীরা সচেতন মানুষরূপে গণ্য নয়। সুতরাং তাদের কল্যাণ-চিন্তা সেখানে নেই। ইসলাম ধর্মেও দাসত্ব প্রথা, মানুষ-কেনা-বেচার প্রথা, যুদ্ধে বন্দী শত্রু পক্ষের স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে মালে গণীমতরূপে দাস-দাসীতে পরিণত করার প্রথা বহাল রয়েছে। তবে সঙ্গে সঙ্গে বলা হয়েছে দাস-দাসীকে মুক্ত করে দেয়া, তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করা ভালো কাজ। কিন্তু এ-দয়া-দাক্ষিণ্য স্বেচ্ছামূলক, বাধ্যতামূলক নয়। সুতরাং মানব-কল্যাণ চিন্তার ক্ষেত্রে এটা মৌলিক পরিবর্তন নয়। রাজা-বাদশা ও ধনী ব্যক্তিগণ পালা পার্বণ বা বিশেষ কোনো উপলক্ষে যে দান-খয়রাত করেন, সেটা-তো প্রকৃত পক্ষে যে আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পদ্ধতি একটি বিশেষ শ্রেণীকে অবিরত ধন মান যশ এবং ক্ষমতা প্রদান করে এবং বাকী বৃহত্তর জনসাধারণকে অবিরত গরীব হতে অধিকতর গরীব, নিরক্ষর এবং ভিক্ষুকে পরিণত করে সেই পদ্ধতি চিরস্থায়ী করারই কৌশল মাত্র : জুতো মেরে নমস্কার করার শামিল। philanthrophy-র মধ্যে মানব-কল্যাণবোধ থাকতে পারে—বিশেষ অবস্থাধীনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হিতৈষণামূলক প্রতিষ্ঠানের মূল্যও হয়তো আছে কিন্তু কোনটাই মানবকল্যাণের স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। রবার্ত আওয়েন, আলিবাট সোয়েটজার প্রমুখ সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ব্যর্থ হয়েছেন। ফোর্ড ফাউণ্ডেশন, রকফেলার ফাউণ্ডেশন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রদত্ত খাদ্য-লিল্লাহ, ক্ষুদ্র পরিসরে আমাদের দেশের কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্ট প্রভৃতি জাতীয় অসংখ্য হিতৈষণামূলক প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের দুঃখ দুর্দশা ঘোচেনি; একদিকে চলছে সংখ্যালঘু শ্রেণীর অতিমাত্রায় ভোগ-বিলাসী জীবন এবং অপরদিকে চলছে ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, মূর্খতা, ভিক্ষাবৃত্তি, যাযাবর বৃত্তি, বেকারত্ব প্রভৃতি। এ অবস্থার মধ্যে যারা মনে করেন মানুষের ভালোমানুষী অর্থাৎ স্বেচ্ছামূলক উদ্যোগে সাম্য মৈত্রী এবং ভ্রাতৃত্ব ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে–একদিকে বিলাস-ব্যসন এবং অপর দিকে প্রকট দারিদ্র থাকবে না, তাদের সদিচ্ছা সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ না করেও বলা যায়, বক্তারা সমাজ-বিজ্ঞানী নহেন। তারা রোমান্টিক, তারা টমাস মোর কল্পিত ইয়োটপিয়াবাসী। রবার্ট আওয়েনের মতো ইমানদার এবং নিষ্ঠাবান মানব হিতৈষীরাও তাই ইয়োটপিয়ান সোসালিস্ট। বৃটেন এবং আমেরিকা দু’জায়গাই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। রিকার্ডো, আওয়েন প্রমুখের আর্থ-রাজনৈতিক মতামত দর্শন খেতাব পায়নি। রোমান্টিক কবিতা আছে, কিন্তু রোমান্টিক দর্শন হয় না। রোমান্টিক সাধারণত অত্যন্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। পক্ষান্তরে দার্শনিকের পদ্ধতি সমাজের উপর প্রয়োগ করা হয়। তাই সমাজবিজ্ঞানী না হয়ে দার্শনিক হওয়া যায় না। দৃষ্টান্ত কার্ল মার্কস। তিনি যুগপৎ সমাজ-বিজ্ঞানী, অর্থ শাস্ত্রবিদ এবং দার্শনিক। তাঁর পদ্ধতি আজ পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়্যংশ লোক গ্রহণ করেছে।
বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে অতিমাত্রায় রোমান্টিকদের গুণ হচ্ছে, “proneness to emotion and more particularly to the emotion of sympathy. To be throughly satisfactory, the emotion must be direct and violent and quite uninformed by thought. The man of sensibility would be moved to tears by the sight of a single destitute peasant family, but would be coldto well thiqught out schemes for ameliorating the lot of peasant as a glass,” আসলে এই শ্রেণীচিন্তাই বড় কথা এবং সকল প্রকার সামাজিক দর্শন চিন্তার মূলে সেকালে একালে সকলকালেই ক্রিয়া করেছে শ্রেণীচিন্তা। তিনতলা দালানের উপরের প্রশস্ত বারান্দায় বসে নীচে সহসা কোনো দুস্থরুগ্ন ব্যক্তি কেন এমন কি একটা রুগ্ন কুকুর দেখলেও দর্শক বড়লোকটির মনে দয়া-দাক্ষিণ্যের প্রবল ভাবাবেগ জাগতে পারে; কিন্তু তিনি যখন ক্ষমতাবান শাসক শ্রেণীর একজনরূপে রাষ্ট্রীয় নীতি নিরূপণ এবং “উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন তখন দেখা যায় তার নীতি এবং পরিকল্পনা রচিত হয়েছে প্রকৃতপক্ষে তার স্বশ্রেণীভুক্ত ধনী এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের আরো অধিক ধনী ও ক্ষমতাশালী এবং বুভুক্ষু দরিদ্র শ্রেণীকে আরো অধিক বুভুক্ষু ও দরিদ্র করার বিশেষ উদ্দেশ্যে।”
বাংলাদেশে এখন এ-ক্রিয়াই চলছে। মঞ্চে অভিনীত হচ্ছে প্রহসন। মূলে প্রবেশ না করে এ-প্লেগের চিকিৎসা অর্থাৎ মানব কল্যাণ-সাধন সম্ভব নয়। মানব কল্যাণের অর্থ সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণ। অর্থ সামাজিক রাজনৈতিক পদ্ধতি পরিবর্তন ব্যতীত এ-যুগে মানবকল্যাণ সাধন অসম্ভব। বাংলাদেশের মতো স্বল্পায়তন জনবহুল প্রাকৃতিক সম্পদহীন দেশের সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণ সাধন করতে হলে সমাজতান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পদ্ধতি গ্রহণ অপরিহার্য মনে করি। যাদের কথা এবং ব্যক্তিগত আচরণের মধ্যে মিল নেই তারা জ্ঞানপাপী ভণ্ড মোনাফিক। ভণ্ড মোনাফিকদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহযোগিতাকারী পণ্ডিত ব্যক্তিরা আর যাই হউন ইমানদারও নন দার্শনিকও নন।