হজে গেলে কিতা অয় বাবজান?
প্রশ্নটা আকস্মিক, তাই মেয়ের দিকে একবার মুখ তুলে তাকাল করমআলী। কিন্তু কিছুই বলল না সে, নীরবে ধানের চারাগুলি পরিস্কার করতে লাগল দু-হাতে।
হজে গেলে কিতা অয় বাবজান?
আবার প্রশ্ন। জবাব দিল না করমআলী। তাকালও না এবার।
হজে গেলে কিতা অয় বাবজান? কণ্ঠস্বরে আরো তাগিদ, আরো ব্যস্ততা।
তোর মাথা অয় হারামজাদী, কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঘামের ফোঁটাগুলিকে বাঁ-হাতের তালু দিয়ে মুছে ফেলে মুখ বিকৃত করল করমআলী।
কৌতুহলী ছোট্ট মেয়েটি বাবার এ অর্থহীন রাগের ভয়ে চুপসে গেল। অভিমানে চোখ দুটো ওর ছলছল করে উঠল পানিতে। উপুড় হয়ে চারাগুলো বাছাই করতে ব্যস্ত থাকে করমআলী, অনেকক্ষণ পর কী মনে করে মেয়ের দিকে একবার মুখ তুলে তাকাল সে। ‘আলের’ উপর গুটিসুটি হয়ে বসে আছে মেয়েটি শীর্ণ হাতদুটোকে কোলের ওপর জড়ো করে। কচি মুখখানায় অভিমানের ভার। বড় করুণা হল করমআলীর। নিজের অসংযত ক্রোধের জন্য মনে মনে ধিক্কার দিল নিজেকে।
‘কিরে মুন্না? মুখ বড় বেজার দেহি যে। হজে যাইবার ইচ্ছা অইছে বুঝি।’ যথাসম্ভব স্বরটাকে কোমলতর করতে চেস্টা করল করমআলী।
আশ্বাস পেয়ে নড়েচড়ে বসল মেয়েটি। হজে গেলে কিতা অয় বাবজান?
পুরনো প্রশ্ন, এবার দ্বিরুক্তি করল না করমআলী। সানন্দে উত্তর দিল, হজে গেলে গুনাহ খাতাহ সব মাফ অইয়া যায়, বুঝলি বেটি?
উত্তর শেষে আবার কাজে মন দিল করমআলী। এখনো অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে তার, সেগুলো আজকেই শেষ করতে হবে। বর্ষার মওসুম। বলা যায় না কখন কী হয়।
গুনা কারে কয় বাবজান? অদম্য কৌতুহলী মেয়ে।
একটা বড় আগাছার মূলকে সাবধানে মাটি থেকে উপড়ে ফেলতে-ফেলতে করমআলী জবাব দিল, গুনাহ অইল গুনা, মানি খুদার হুকুম না মাইনলে, নামাজ না পড়লে, রোজা না রাখলে, সুদ খাইলে, চুরি ডাকাতি করলে গুনা অয়, বুঝলি?
গুনা অইলে কী অয় বাবজান?
তোর মাথা অয় হারামজাদী – আবার মুখ বিকৃত করল করমআলী। মেয়েটাকে বাড়িতে মায়ের কাছে রেখে এলে ভালো হতো। ভীষণ পাজি মেয়ে – দেখছে এখন কথা বলার ফুরসত নেই, তবুও এমনি বকবক করবে।
কিন্তু তবুও উত্তর দিতে হল করমআলীকে। গুনাহ অইলে দোজখে যায় দোজখে। দোজখের নাম শুনলে চোখ বড় বড় করে বাবার দিকে তাকাল মেয়েটি। ভ্রু কুঁচকিয়ে কী যেন ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর জিজ্ঞেস করল, দোজখ কারে কয় বাবাজান?
এ আবার আরেক ফ্যাসাদ, না-শোনার ভান করে প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যেতে চাইল করমআলী। একটা ছোট মেয়ের সাথে আর কাঁহাতক বকবক করা যায়। বিশেষ করে যখন কথা বলার একটুও ফুরসত নেই তার।
দোজখ কারে কয় বাবজান?
কপালের শিরাগুলো ফুলে উঠল করমআলীর। বিরুক্তিভরে দাঁতে দাঁত চাপল সে।
জোরে একটা চড় বসিয়ে দিবে নাকি মেয়েটির গালে।
আগাছার গোছাটা একপাশে ফেলে দিয়ে এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল করমআলী।
রক্তিম চোখে মেয়ের দিকে তাকাল এক পলক।
দোজখ হইল দোজখ। যেইহানে সারা দিনরাইত আগুন জ্বলে। সাপবিচ্ছু গিজগিজ করে, আর মানুষের লাঠির বাড়িতে তুলাপেজা বানাইয়া ফেলায়।
দোজখের বীভৎস চিত্রের কথা শুনে ভয়ে গুটিসুটি হয়ে বসল মেয়েটি। এপাশে ওপাশে বারকয়েক ফিরে ফিরে তাকাল সে। গাটা কেমন ছমছম করে উঠল ওর এই দিন-দুপুরেই।
বেহেস্ত বড় সুন্দর জায়গা না বাবজান?
‘হু’-আগাছাগুলোকে আলের উপর তুলে রাখতে রাখতে মৃদুস্বরে উত্তর দিল করমআলী। পাটের দড়ি দিয়ে আগাছার আঁটিটাকে কষে বাঁধল সে।
তারপর মেয়ের হাত ধরে বাড়ির পথে হাঁটতে লাগল জোর পায়ে। কোলে উঠবি?
মাঝপথে এসে জিজ্ঞেস করল করমআলী। মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাল মেয়েটি।
তুমি হজে যাইবানা বাবজান?
উত্তর শেষে পাল্টা প্রশ্ন করল সে, অকস্মাৎ।
মেয়ের এ অদ্ভুত প্রশ্নে না-হেসে পারল না করমআলী।
আমি কিয়ের লাইগা যামু হজে। আমার উপর কি হজ ফরজ হইসে নাকি পাগলী। যাগো বহুত টাহা তারা যাইবো। ওগো হজে যাওন ফরজ করছে আল্লায়।
হজে গেলে গুনাহ খাতাহ সব মাফ অইয়া যায়, না বাবজান? বাবার মুখের দিখে আর একবার তাকাল মেয়েটি।
অনেকক্ষণ একটি কথাও বেরুল না তার মুখ দিয়ে। একটা প্রশ্নও করল না সে। চুপ করে কী যেন ভাবল। গভীরভাবে ভাবল সে। তারপর হঠাৎ বলে উঠল, অপ্রত্যাশিত ভাবেই বলে উঠল, যাগো টাহা আছে তারা গুনা করলেও বেহেস্তে যাইবো, না বাবজান?
দ্রুত মেয়ের দিকে চোখ নামিয়ে আনল করমআলী। একবার হাসতেও পারল না সে, রাগ করতেও না। শুধু ভাবতে লাগল গভীরভাবে।
একটি জিজ্ঞাসা | জহির রায়হান
কপিরাইট সংক্রান্ত
এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।