মুক্তচিন্তা আন্দোলনইয়ং বেঙ্গলকৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় | ক্ষ‍্যাপাটে সমাজ সংস্কারক

কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় | ক্ষ‍্যাপাটে সমাজ সংস্কারক

কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় | ক্ষ‍্যাপাটে সমাজ সংস্কারক

বাংলায় নবজাগরণের নেতৃস্থানীয় ব‍্যক্তিত্ব, ইয়ং বেঙ্গলের তুখোড় সদস‍্য কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮১৩ সালের ২৪ মে কলকাতার তৎকালীন ঝামাপুকুর বর্তমান বেচু চ‍্যাটার্জি স্ট্রীটে তার নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। কৃষ্ণমোহনের পিতা জীবনকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঝামাপুকুরের সম্ভ্রান্ত রামজয় বিদ‍্যাভূষনের কন‍্যা শ্রীমতি দেবীকে বিয়ে করার পর হতে শ্বশুরালয়ে বসবাস করতেন। তাদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। পরিবারের সদস‍্য সংখ‍্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্বশুরালয় ছেড়ে গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনে একটি ছোট বাড়ি নির্মাণ করে অত‍্যন্ত নিম্নবিত্ত জীবনযাপন শুরু করেন। কৃষ্ণমোহনের বাবা মা পাটের তৈরি সুতো, পৈতা ইত‍্যাদি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সন্তানদেরকে উচ্চশিক্ষিতরূপে গড়ে তোলার বাসনা থাকলেও তা সাধ‍্যের আওতায় ছিলো না।

সাধ‍্যের আওতায় না থাকলেও কৃষ্ণমোহনের মা বাবার সাধ অপূর্ণ থাকেনি। স্কটিশ ঘড়ি নির্মাতা ভারতপ্রেমী শিক্ষানুরাগী ডেভিড হেয়ারের আর্থিক সহায়তায় স্কুল সোসাইটি ইনস্টিটিউটে অন্তর্ভুক্ত ছাত্র হিসেবে পটলডাঙা স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন। এরপর ১৮২২ সালে নবনির্মিত হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে স্কুল সোসাইটির একজন অবৈতনিক ছাত্র হিসেবে বিশেষ বৃত্তি নিয়ে ঐতিহাসিক হিন্দু কলেজে ভর্তি হন।

হিন্দু কলেজে ভর্তি হয়ে সুবিখ‍্যাত হেনরি ডিরোজিও’র সন্ধান পান। যদিও ডিরোজিও তার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না, তবুও লোকমুখে সুনাম শুনে কৃষ্ণমোহন তার প্রতি আগ্রহী হন। অন‍্য ছাত্রদের মত তিনিও ডিরোজিওতে মুগ্ধ হন এবং তার শিষ‍্যরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে অ‍্যাকাডেমিক অ‍্যাসোসিয়েশন নামক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হন।

সে সময় ডিরোজিও’র নেতৃত্বে তার শিষ‍্যরা হিন্দু ধর্মের কুসংস্কার ও সেকেলে প্রথার বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ফলে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তাদের নিন্দা করতে শুরু করে। একজন অহিন্দু ও অবাঙালির নেতৃত্বে সমাজ সংস্কারের কাজ করলেও শিষ‍্যদের কেউ তখনো ধর্ম ত‍্যাগ করেনি। তবুও হিন্দু সমাজ তাদের উপর ধর্মত‍্যাগী, খ্রিস্টান ইত‍্যাদি অভিধা আরোপ করতে থাকে।

তখন কৃষ্ণমোহনের আবাসস্থলে প্রায়ই ডিরোজিও ও তার শিষ‍্যদের আড্ডা বসতো। একদিন ডিরোজিও ও কৃষ্ণমোহনের অনুপস্থিতিতে তার কিছু বন্ধু বাসায় গোমাংস ও রুটি খেয়ে হাড়গুলো রেখে যায় প্রতিবেশী হিন্দু বাড়ির সামনে। এ নিয়ে পাড়া উত্তপ্ত ও নালিশের ঘটনা ঘটলে কৃষ্ণমোহনকে ওই বাড়ি ছাড়তে হয়। এরপর তিনি চলে যান সহযোদ্ধা জনহিতৈষী দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ‍্যায়ের বাড়িতে। অবশ‍্য সেখানে তিনি বেশিদিন থাকেননি।

এদিকে হিন্দু কলেজের একদল ছাত্র কলেজ পরিচালনা পর্ষদে শিক্ষক ডিরোজিও’র বিরুদ্ধে বঙ্গীয় সংস্কৃতি ও হিন্দু ধর্মের প্রতি আঘাত হানার নেতৃত্বদানের অভিযোগ আনার প্রেক্ষিতে তাকে কলেজ থেকে বরখাস্ত করা হয়। এর কিছুদিন পর ডিরোজিও মৃত্যুবরণ করেন।

ডিরোজিওকে বরখাস্তের ঘটনায় ভীষণ ক্ষেপে যান কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। বিক্ষুব্ধ কৃষ্ণমোহন পরের মাসেই এনকোয়ার নামে একটি ইংরেজি সাময়িকী প্রকাশ করেন। এ সাময়িকীতে তিনি হিন্দু ধর্ম ও এর সমাজনেতাদের তুলোধুনো করেন। কথিত আছে, তখনকার হিন্দু নেতা, হিন্দু কলেজ পরিচালনা পর্ষদের প্রধান রাধাকান্ত দেবকে তিনি ‘গাধাকান্ত দেব’ বলে অবহিত করেছিলেন।

এরপর আরো কিছু বাংলা সাময়িকীও প্রকাশ করেন তিনি। প্রতিটি সাময়িকীতে তিনি হিন্দু ধর্মকে আক্রমণ করে যান। এত কিছু করেও তার রাগ কমেনি। হিন্দু সমাজের কাছ থেকে আগেই ধর্মত‍্যাগী খ্রিস্টান খেতাব পাওয়া কৃষ্ণমোহন ১৮৩২ সালে খ্রিস্টধর্ম প্রচারক আলেকজান্ডার ডাফের কাছ থেকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং কাছের মানুষদেরও খ্রিস্টধর্ম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। বাংলার প্রথম ব‍্যারিস্টার জ্ঞানেন্দ্রমোহন তার মাধ‍্যমে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগরের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পেছনে এই জ্ঞানেন্দ্রমোহন মহাশয় ভূমিকা রাখেন। খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করার পর কৃষ্ণমোহন তার নামের সাথে রেভারেন্ড নামটি যোগ করেন।

পৈত্রিক ধর্ম ত‍্যাগ করে নতুন ধর্ম গ্রহণ করার পর সমাজ ও স্বজনদের কাছে অগ্রহণযোগ‍্য হয়ে পড়েন। এমনকি পটলডাঙা স্কুলের শিক্ষকের পদও হারান। তার স্ত্রী নিজেকে কৃষ্ণমোহনের জীবনসঙ্গী হিসেবে অস্বীকার করেন। এতকিছুর পরও দমে যাননি কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি তার সমাজ সংস্কারের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।

ডিরোজিও’র মৃত্যুর পর যে ক’জন শিষ‍্য তার শুরু করা সমাজ আন্দোলন দ্বিগুন উৎসাহে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন, কৃষ্ণমোহন তার অন‍্যতম। ১৮৩৯ সালে একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজকে পরিণত হলেও তার প্রগতিবাদিতা থেমে থাকেনি।

জীবদ্দশায় সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করার পক্ষে, নারী শিক্ষার বিকাশে এবং আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি ভারতের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন ইন্ডিয়ান অ‍্যাসোসিয়েশনের সদস‍্য ছিলেন। এছাড়াও কলকাতায় নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেথুন সোসাইটি, বঙ্গীয় সমাজ-বিজ্ঞান সভা, ভারত সংস্কার সভার সাথে যুক্ত ছিলেন।

তার পরবর্তী জীবনের সময়রেখাঃ

  • ১৮৫২ সালে বিশপস কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়।
  • ১৮৬৪ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগরের সাথে তিনিও রয়‍্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির (বর্তমান এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা) সদস‍্যপদ লাভ করেন।
  • ১৮৬৭-১৮৬৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো হন।
  • ১৮৭৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টরেট উপাধি দেন।
  • ১৮৮০ সালে কলকাতার অধিবাসীরা তাকে পৌরসভার প্রতিনিধিপদে বরণ করেন।

জীবদ্দশায় তার রচিত গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোঃ

  • ১৮৪৫ সালে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জের অনুরোধে ‘সর্বার্থ সংগ্রহ’ নামে মহাকোষ প্রণয়ন শুরু করেন। এটি সম্পূর্ণ হয় ১৮৫১ সালে। তার কাজে খুশি হয়ে হার্ডিঞ্জ তাকে এলফিনস্টোন প্রণীত ”ভারতবর্ষের ইতিহাস” উপহার দেন।
  • ১৮৪৬ থেকে ১৮৫১ সালের মধ্যে তিনি ইংরেজী বিশ্বকোষের অনুকরণে ”বিদ্যাকল্পদ্রুম”’ নামক তেরো খণ্ডের একটি বাংলা বিশ্বকোষ রচনা করেন।
  • ১৮৩৭ সালে তিনি দ্য পার্সিকিয়টেড নামক একটি ইংরেজী নাটকও রচনা করেন।
  • ১৮৬১-১৮৬২ সালে তিনি হিন্দু ষড়দর্শন সম্পর্কে এক গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেন।
  • ১৮৬১ সালে রচনা করেন ডায়লগস অন দ্য হিন্দু ফিলোসফি।
  • ১৮৭৫ সালে লিখেন দ্য এরিয়ান উইটনেস।
  • ১৮৮১ সালে দ্য রিলেশন বিটউইন ক্রিশ্চিয়ানিটি অ্যান্ড হিন্দুইজম নামক গ্রন্থ রচনা করেন।

১৮৮৫ সালের ১১ মে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন।

নতুন লেখার নোটিফিকেশন পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

কপিরাইট সংক্রান্ত

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।

মন্তব্য করুন