মুক্তচিন্তা আন্দোলনইয়ং বেঙ্গলরসিককৃষ্ণ মল্লিক | প্রথাবিরোধী সাহসী মানুষ

রসিককৃষ্ণ মল্লিক | প্রথাবিরোধী সাহসী মানুষ

রসিককৃষ্ণ মল্লিক | প্রথাবিরোধী সাহসী মানুষ

সেই সময় কলকাতা সুপ্রিম কোর্টে সাক্ষীদের তামা, তুলসি ও গঙ্গাজল স্পর্শ করে শপথ গ্রহণ করতে হতো। একবার এক মামলায় সাক্ষী হিসেবে আদালতে এসেছে গোঁফ না গজানো এক বালক। গুরুত্বপূর্ণ মামলা। বিচারকের সামনের আসনগুলিতে শহরের নামকরা সমাজপতি ও পন্ডিতব‍্যক্তিগণ উপবিষ্ট। উড়িষ‍্যা থেকে আগত ব্রাহ্মন যখন তাম্রকুন্ড নিয়ে সাক্ষীকে শপথ পড়াতে গেলেন, সাক্ষী শপথ নিতে রাজি হন না। বিচারক জিজ্ঞাসা করলেন, কেন? বালকের জবাব, “আমি গঙ্গার পবিত্রতা বিশ্বাস করি না, মানি না।” সবাই প্রথমে ভাবলেন ভুল শুনেছেন, কিন্তু ব্রাহ্মন যখন পুনরায় ইংরেজিতে অনুবাদ করে শোনালেন, আদালত ভর্তি লোকজনের তখন কানে হাত। কী বলে এই বালক!

সেই বালকের নাম রসিক কৃষ্ণ মল্লিক। ১৮১০ সালে কলকাতার সিন্দুরিয়া পটীতে জন্ম নেয়া রসিক কৃষ্ণের বাবার নাম নবকিশোর মল্লিক। তিনি ছিলেন শহরের সুতো ব‍্যবসায়ী। আর্থিক সঙ্গতি মোটামুটি সচল থাকায় সন্তানকে শিক্ষাদানে অনিচ্ছুক ছিলেন না নবকিশোর মল্লিক।

পাঠশালা ও ইংরেজি শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ চুকিয়ে রসিককৃষ্ণ মল্লিক ভর্তি হন ঐতিহাসিক হিন্দু কলেজে। এর কিছুদিন পর সেখানে শিক্ষক হয়ে আসেন বিখ‍্যাত হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। ছাত্রের চেয়ে শিক্ষক মাত্র এক বছরের বড়! রসিক কৃষ্ণ দেখলেন বয়সের ব‍্যবধান মাত্র এক বছর হলেও শিক্ষকের সাথে তার জ্ঞানের ব‍্যবধান কয়েক যুগ বড়। জ্ঞানের কদর করতেন রসিক কৃষ্ণ। তাই ডিরোজিও’র সান্নিধ‍্যলাভ করতে বেশি দেরি করেননি। ধীরে ধীরে নতুন নতুন চিন্তা চেতনা লাভ করে কলেজের পাঠ চুকিয়ে বন্ধুদের সাথে নেমে পড়েন সমাজ সংস্কারের সংগ্রামে।

রসিক কৃষ্ণের মত আরো গোটা বিশেক শিষ‍্যবেষ্টিত ডিরোজিও যখন ‘অ‍্যাকাডেমিক অ‍্যাসোসিয়েশন’ এর মত বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে হিন্দু ধর্মের কুসংস্কার ও মানুষের জন‍্য ক্ষতিকর রীতিনীতি সংস্কারে উঠেপড়ে লাগলেন, তখন অন‍্য সবার মত রসিক কৃষ্ণ মল্লিকও বেকায়দায় পড়েন। এক্ষেত্রে রসিক কৃষ্ণের সমস‍্যাটা একটু বেশিই ছিলো। তার বাবা এবং পিতামহ ছিলেন শেঠবংশীয় বণিক। কলকাতার আদিবাসী। পারিবারিক ধর্ম ও এতদিনের পুরোনো সামাজিক রীতিনীতিতে আঘাত লাগছে দেখে রসিক কৃষ্ণকে থামানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তার পরিবার। এক বালকের কারণে বংশী মর্যাদা ক্ষুন্ন হোক, এটা তারা চাননি।

কিন্তু রসিক কৃষ্ণের থামবার উপায় নেই। ইয়ং বেঙ্গল অভিধা লাভকারী তাদের দলে কৃষ্ণমোহন বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় ও রামগোপাল ঘোষের পর রসিক কৃষ্ণকেই নেতৃস্থানীয় বলে গণ‍্য করা হতো। তিনি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তার অসাধারণ বক্তৃতাগুণের কারণে। যদিও বক্তা হিসেবে রামগোপাল ঘোষের নাম বেশি উচ্চারিত হতো, তবুও সবাই রসিক কৃষ্ণের প্রতিই বেশি আগ্রহী ছিলেন। রামগোপাল ঘোষের রক্তে শিহরণ জাগানিয়া বক্তৃতার চেয়ে রসিক কৃষ্ণের সুসংগঠিত, যৌক্তিক আলোচনা শুনতে লোকজনের উৎসাহ ছিলো দেখার মত। শ্রোতারা বসে থাকতেন তার বক্তৃতা শোনার জন‍্য। এমনকি শত্রুপক্ষের লোকজনও।

এদিকে শহরজুড়ে তখন আলোচনার বিষয়বস্তু ‘ইয়ং বেঙ্গল।’ এরা জাত পাত, উঁচু নিচু, পাপ পূণ‍্য মানে না। ধর্ম-কর্ম, রীতি-নীতি, উঁচুজাত-নিচুজাত যাকে যেভাবে পারছে, যুক্তির বাক‍্যতীর ছুঁড়ে যাচ্ছে। আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর নিন্দা কুড়াতে কুড়াতে রসিকের পরিবারের ত্রাহিদশা। পরিবার সিদ্ধান্ত নিলেন যে করেই হোক, ডিরোজিও’র দল থেকে দূরে রাখতে হবে। দল থেকে দূরে রাখলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

পাড়া প্রতিবেশীর পরামর্শে রসিক কৃষ্ণকে আড্ডায় যাওয়ার আগে জোর করে পাগলাগুঁড়ো (অবচেতন করার ভেষজ ঔষধ) খাইয়ে দিতেন। সেই বিকেল থেকে শুরু করে রাতভর অচেতন অবস্থায় বিছানায় পড়ে থাকতেন তিনি। এভাবে কিছুদিন চলার পর পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় তাকে কাশী পাঠিয়ে দিবে।

ঘাটে নৌকা প্রস্তুত, বিছানায় হাত পা বাঁধা প্রায় অচেতন রসিক কৃষ্ণ। একটু পর নৌকায় তোলা হবে। ঘটনা টের পেয়ে বাঁধন খুলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান রসিককৃষ্ণ। প‍্যারীচাঁদ মিত্র রচিত ভারতপ্রেমী স্কটিশ ব‍্যবসায়ী ডেভিড হেয়ারের জীবন চরিততে এরকম আরো কিছু ঘটনার বর্ণনা আছে।

পালিয়ে পৈত্রিক ভিটা থেকে অনেক দূরে চোরবাগানে বাসা নিয়ে থাকতেন তিনি। কিছুদিনের জন‍্য এ বাসাটি হয়ে ওঠে ডিরোজিও এবং তার শিষ‍্যদের আড্ডাস্থল। ১৮৩১ সালে ডিরোজিও’র আকস্মিক মৃত্যুর পর রসিক কৃষ্ণ কিছুটা অসহায় অবস্থার মাঝে পর্যবসিত হন। তখন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন দক্ষিণারঞ্জণ মুখোপাধ‍্যায়। মুখার্জী মহাশয় এরকম আরো অনেককেই সাহায‍্য সহযোগিতা করতেন। তিনিও ইয়ং বেঙ্গল দলের অতিগুরুত্বপূর্ণ সদস‍্য ছিলেন।

১৮৩৩ সালে রাজা রামমোহন রায় মৃত্যুবরণ করেন। সমসাময়িক অনেকের স্মৃতিকথায় উঠে আসে রসিক কৃষ্ণ কেবল ডিরোজিও’র নন, বরং রামমোহনেরও শিষ‍্য ছিলেন। রামমোহনের মৃত্যুর পর ১৮৩৪ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত স্মরণসভায় রসিক কৃষ্ণ উপস্থিত ছিলেন।

এই ফাঁকে দক্ষিণারঞ্জণ মুখোপাধ‍্যায়ের প্রত‍্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞানান্বেষণ নামক একটি পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন। পত্রিকাটি বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় প্রকাশিত হতো। এর আগে কিছুদিন ডেভিড হেয়ারের স্বনামে প্রতিষ্ঠিত হেয়ার স্কুলে শিক্ষকতা করেন।

১৮৩৪ সালে তিনি ডেপুটি কালেক্টর পদে নিযুক্ত হন। এসময় বেশ কিছুদিন বর্ধমানে বসবাস করেন। বর্ধমানের রাজ পরিবার তাকে বিভিন্ন প্রকার লোভ দেখিয়ে হিন্দু ধর্মে আঘাত ও সমাজ সংস্কারমূলক কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করলেও তিনি সেই লোভে বশীভূত হননি।

১৮৫৮ সালে অসুস্থ হয়ে তিনি আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। সহযোদ্ধা রামগোপাল ঘোষ ও প‍্যারীচাঁদ মিত্র তার চিকিৎসার ব‍্যবস্থা করলেও তিনি আরোগ‍্য লাভ করতে পারেননি। সে বছরই মৃত্যুবরণ করেন রসিক কৃষ্ণ মল্লিক।

নতুন লেখার নোটিফিকেশন পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

কপিরাইট সংক্রান্ত

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।

মন্তব্য করুন