প্রবন্ধফ্রিথিঙ্কার্স সমাজ | আহমদ শরীফ

ফ্রিথিঙ্কার্স সমাজ | আহমদ শরীফ

ফ্রিথিঙ্কার্স মাত্রই স্বকালীন বা সমকালীন জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে যা-কিছু আবশ্যিক ও জরুরি, তা নির্বিচারে, নিঃসঙ্কোচে অনুকরণে অনুসরণে গ্রহণ ও অর্জন করে। এতে জাত-জম্ম-বর্ণ-ধর্ম-ভাষা-নিবাস-সংস্কৃতি-আচার-বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণা বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। নিষ্ফল উপযোগরিক্ত তাৎপর্যশূন্য পুরোনো রীতি-নীতি বর্জন করে এ যন্ত্রযুগে ও যন্ত্রজগতে যন্ত্রনির্ভর জীবনে প্রয়োজন ও উপযোগ সচেতন থাকাই ফ্রিথিঙ্কার্সের লক্ষ্য।

ফ্রিথিঙ্কার্স সমাজ | আহমদ শরীফ

ফ্রিথিঙ্কার্স মাত্রই স্বকালীন বা সমকালীন জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে যা-কিছু আবশ্যিক ও জরুরি, তা নির্বিচারে, নিঃসঙ্কোচে অনুকরণে অনুসরণে গ্রহণ ও অর্জন করে। এতে জাত-জম্ম-বর্ণ-ধর্ম-ভাষা-নিবাস-সংস্কৃতি-আচার-বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণা বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। নিষ্ফল উপযোগরিক্ত তাৎপর্যশূন্য পুরোনো রীতি-নীতি বর্জন করে এ যন্ত্রযুগে ও যন্ত্রজগতে যন্ত্রনির্ভর জীবনে প্রয়োজন ও উপযোগ সচেতন থাকাই ফ্রিথিঙ্কার্সের লক্ষ্য।

এই প্রবন্ধটি ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিলো। অর্থাৎ আহমদ শরীফ তখনকার সময়, সামাজিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিবেশ, জন নিরাপত্তা, নাগরিক অধিকারসহ অন্যান্য সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ বিচার করে লিখেছেন। বর্তমান সময়ের সাথে অনেক কিছু মিলবে না, হয়তো এই সময়ে এসে প্রবন্ধে বর্ণিত অনেক কর্মকৌশল কার্যকরী হবে না। তবুও ফ্রিথিঙ্কার্স সমাজ কিভাবে গড়ে ওঠে, এই সমাজ কেমন হয়, কী ভাবে, কী করে এবং কী করা উচিত —সে সম্পর্কে আহমদ শরীফের ব্যক্তিগত অভিমত জানা যাবে। তার অভিমত আমাদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।


 

মানুষ সাধারণভাবে অভ্যস্ত শাস্ত্রিক, নৈতিক, আচারিক, ব্যবহারিক জীবনধারায় স্বস্থ, সুস্থ ও আশ্বস্ত থাকে। কারণ তাদের মনে আশৈশব শ্রুত, লব্ধ, দৃষ্ট ও অভ্যস্ত নীতি-নিয়মের, রীতি-রেওয়াজের ও প্রথা-পদ্ধতির কখনো উপযোগ ও যৌক্তিকতা সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন বা সন্দেহ, জিজ্ঞাসা জাগে না। স্থানগত, কালগত, জীবনের গতিগত নতুন প্রয়োজনের কথাও তাদের মনে ঠাই পায় না। তাদের মন-মগজ-মননও গতানুগতিক ও রক্ষণশীল ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। তাদের মগজের সৃষ্টির, উদ্ভাবনের ও আবিষ্কারের শক্তি অনুশীলনের অভাবে সুপ্ত ও গুপ্ত থাকে, কালে লুপ্তও হয়ে যায়। এ জন্যে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে নতুন চেতনার, নতুন চিন্তার, নতুন সৃষ্টির, নতুন উদ্ভাবনের, নতুন কিছু নির্মাণের, নতুন কিছু আবিষ্কারের, নতুন কিছু জীবনযাত্রায় যোগ করার কোনো নিদর্শন মেলে না তাদের প্রাত্যহিক জীবনের ভাব-চিন্তা-কর্ম-আচরণের মধ্যে।

পুরোনো চিন্তায়, পুরোনো চেতনায়, পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণায়, পুরোনো আচারে-আচরণে কোটি কোটি মানুষ কোথাও কিছুর উপযোগহীনতা, তাৎপর্যহীনতা, পরিহারযোগ্যতা খুঁজে পায় না। তাই স্বকালের মানুষের চিন্তার, চেতনার, মননের, মনীষার গুরুত্ব তাদের সুপ্রাচীন শাস্ত্রিক বিধি-বিধানের মতো কখনো গুরুত্ব, মূল্য, মর্যাদা পায় না। কারণ শাস্ত্রিক বিধি-নিষেধের প্রভাব ও পরিণাম ইহ-পরলোকে প্রসূত। তা যে কেবল প্রশ্নাতীত সত্য তা নয়, তা ঐশ এবং অপার্থিবও, কোনো মর্তমানবই সে-সত্য অস্বীকার করার যোগ্যতা রাখে না। কেবল উদ্ধত নির্বোধই বোঝে না বলেই সত্য অনুভব উপলব্ধি করতে পারে না- নাস্তিক্যের আস্ফালন করে- এ-ই হচ্ছে সাধারণের চিরন্তন ধারণা আজকের এ মুহূর্ত অবধি। এ ধারণার পরিবর্তন ভবিষ্যতেও অসম্ভব বলেই মনে হয়।

তবে বিজ্ঞানের নানা তত্ত্বের, তথ্যের ও সত্যের আবিষ্কারের ফলে, প্রকৌশলপ্রযুক্তির বিস্ময়কর বিকাশের, বিস্তারের ও উৎকর্ষের কারণে আজকের দিনে মানুষের বাস্তব মর্ত্যজীবন-ধারা ঘরে-বাইরে বদলে গেছে। আস্তিক-নাস্তিক কিংবা ইহুদী-জৈন-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান-হিন্দু-মুসলমান সবাই অনিচ্ছায় শাস্ত্রের নানা বিধি-নিষেধ দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যান্ত্রিক জীবনে তথা যন্ত্রনিয়ন্ত্রিত জীবনে লঙ্ঘন ও উপেক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে, ধার্মিক-অধার্মিক সবার জীবনে একটা অস্বস্তিকর-অনভ্যস্ত জীবন-যাপন পদ্ধতি জবরদখল করে বসেছে। শাস্ত্রে যতকিছু নিষিদ্ধ ছিল, তার সবটাই প্রায় ঘরের ভেতরেই রেডিও, টিভি, ভিসিপি, ক্যাসেট, চিত্র, ভাস্কর্য মূর্তি, পরিচ্ছদ প্রভৃতির আকারে আসন গেড়ে বসেছে। এগুলোকে গায়ে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে-পাড়ায়-মহল্লায় ফতোয়াযোগে আর কখনো কেউ সরাতে পারবে না। এর সঙ্গে এ যন্ত্রযুগে ও যন্ত্রনিয়ন্ত্রিত জীবনে সংহত পৃথিবীতে মনুষ্য সমাজে অন্য নানা জটিল সমস্যা-সঙ্কটেরও সৃষ্টি হয়েছে। এ সাম্রাজ্যবাদের-পুঁজিবাদের সঙ্কট নয়, মানব-সঙ্কট। এর জন্যেই অবশ্য আপাতত সবচেয়ে বেশি বিচলিত পুঁজিবাদী আর্থ-বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যবাদী মহাজন রাষ্ট্রগুলোই নিজেদের স্বার্থেই। অন্যরা অসমর্থ বলেই নীরব-নিষ্ক্রিয় অসহায় দর্শক ও ভূক্তভোগী। কায়রো সম্মেলন আপাতত ব্যর্থ মনে হলেও মুক্তির বীজ মাটিতে প্রোথিত হয়ে গেছে, ছড়িয়ে গেছে চিন্তার ও চেতনার বীজ বিশ্বময়। তেমনি কোপেনহেগেনের সম্মেলনের আপাতরূপ কাপট্যকন্টকযুক্ত হলেও পরিণামে তাও বিশ্বমানবের বাঁচা-মরার সমস্যা-সঙ্কটের হয়তো এক প্রকার সমাধান দেবে।

মানুষ নানা ঘটনায়-দুর্ঘটনায়-কোন্দলে-দাঙ্গায়-লড়াইয়ে-যুদ্ধে-সংগ্রামে-আন্দোলনে মরছে বটে, কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিস্ময়কর উন্নতির ফলে অকালমৃত্যুর পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে বলেই অনুন্নত আরণ্য-পার্বত্য-দ্বৈপায়ন উপজাতি, জনজাতি ও আদিবাসী অবধি সবাই এ কালে দীর্ঘজীবী হচ্ছে, চিকিৎসায় হচ্ছে জটিল রোগ থেকেও মুক্ত। এ হচ্ছে উন্নত জীবনযাপন, সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক সমাজলগ্নতা প্রভৃতির অবশ্যম্ভাবী ফল। কালের দাবি ও জীবনের দাবি মানতেই হয়। যুগোপযোগী আধুনিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, বাণিজ্যিক, নৈতিক, যৌক্তিক ও বৌদ্ধিক জীবনযাপন অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। কালোপযোগী জীবনচেতনার ও জগৎভাবনার অনুশীলন করতেই হবে। যথাকালে যথাস্থানে যথাপ্রয়োজনে যথাকর্ম করতেই হয়। এ অবস্থায় কালোপযোগী মন-মগজ-মনন-মনীষা প্রভৃতির অনুশীলন করতে হলে উপযোগরিক্ত, তাৎপর্যহীন সেকেলে বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণার পরিবর্তন, পরিমার্জন, বিবর্তন কিংবা বর্জন আবশ্যিক হয়ে পড়ে। এ জন্যেও ব্যক্তিক এবং দলীয়ভাবে চিন্তার অনুশীলন আবশ্যিক ও জরুরি। আমাদের এ প্রয়াসের প্রথম শর্ত হচ্ছে Emancipation of Intellect- বন্ধ চেতনার মনীষা থেকে মুক্তি। শিখা গোষ্ঠীর ভাষায় ‘বুদ্ধির মুক্তি’। এ জন্যে আমাদের মনে এ কালের প্রতিবাদী তরুণ-তরুণীদের জন্যে An Association of Free Thinkers গড়ে তোলা- বাঙলায় যার নাম হতে পারে মুক্ত চিন্তক সমিত/সঙ্ঘ/আড্ডা/সংস্থা কিংবা Free Thinkers Society ‘মুক্ত চিন্তুক সমাজ বা সঙ্ঘ’। তাদের কাজ হবে যুক্তিবাদী হওয়া, Rational হওয়া। যা যৌক্তিক ও বৌদ্ধিক মাপে ঠেকে না, তা বর্জন করা। যা ন্যায্যতা ও বিবেকানুগত নয়, তা পরিহার করে চলা। মনে রাখতে হবে সংস্কৃতিমানের ষড়গুণ থাকা আবশ্যিক: সংযম, পরমত-পরকর্ম ও পরআচরণ সহিষ্ণুতা, যুক্তিনিষ্ঠা, ন্যায়বোধ, বিবেকানুগত্য ও সৌজন্য। মুক্ত চিন্তুকসমাজ যত বেশি জনবহুল হবে দেশের পক্ষে তা হবে তত বেশি কল্যাণকর। কেননা আমরা জানি, মানুষ ভালো নয়; মন্দও নয়, কখনো ভালো কখনো মন্দ, কারো জন্যে, কারো কাছে ভালো, কারো পক্ষে মন্দ। লাভ-লোভ-স্বার্থ, ক্রোধ-অসূয়া বশে শত্রু মিত্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সভ্য-অসভ্য নির্বিশেষে কেবল সৈনিক-পুলিশ হিসেবে নয়, মানুষ শ্বাপদের চেয়েও বেশি হিংস্র হয়ে প্রতিশোধলিপ্সু হয়ে ওঠে। তাই মানুষের এ স্বভাব সংযমনের ও প্রশমনের জন্যে বিবেকবান যুক্তিবাদী মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধি প্রয়োজন। মুক্ত চিন্তক সমিতি বা সংঘ বা আড্ডা তৈরি এ জন্যেই শ্রেয় বলেই সচেতন মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে আবশ্যিক ও জরুরি বলে বিবেচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

প্রাণী হিসেবে মানুষের মধ্যে হিংসা-ঘৃণা-ঈর্ষা-রেষারেষি প্রতিশোধ স্পৃহা প্রভৃতি থাকবেই। কিন্তু সভ্য মানুষে তা সম্পদ লুটের ও হত্যার রূপ নিলে তাদের প্রাণিত্ব প্রমাণিত হয় বটে, কিন্তু মনুষ্যত্ব যে তাদের নেই, সে-সম্বন্ধেও নিঃসংশয় হওয়া যায়। আমরা মানুষকে সংযত, সহিষ্ণু, বিবেচক, বিবেকী, যুক্তিনিষ্ট, ন্যায্যতাপ্রিয়, সংস্কৃতিমান মানুষ্যরূপে দেখতে চাই। যদি সরকারী আইনের বাধা থাকে কিংবা মৌলবাদীর হামলার আশঙ্কা থাকে, তা হলে সমিতি, সমাজ, সঙ্ঘ, সংস্থা না করে গাঁয়ে-গাঁয়ে, পাড়ায়-পাড়ায়, স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে, মহল্লায়-মহল্লায় পাঁচ/সাতজন সহ ও সমমনা তরুণ-তরুণীর আড্ডা গড়ে তুললেও ফ্রিথিঙ্কারদের প্রভাব দ্রুত প্রসার লাভ করবে।

খসড়া ম্যানিফেস্টো
প্রস্তাবিত ফ্রিথিঙ্কার্স ফোরাম/ক্লাব/সোসাইটি/সঙ্ঘ/সমিতি/আড্ডা

আশৈশব দৃষ্ট, শ্রুত, লব্ধ বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণায় চালিত হতে চায় না ফ্রিথিঙ্কার্স। তারা নিজেদের যুক্তি-বুদ্ধি-জ্ঞান প্রয়োগে জীবনের ও জগতের তথা মর্ত্যজীবনের তাৎপর্য সন্ধান করে।

১. ফ্রিথিঙ্কার্স-এর জীবনের পুঁজি-পাথেয় হচ্ছে Rationalism, Liberalism ও Science আর Technology. ফ্রিথিঙ্কার্স জানে ethnic, racial, religious, regional, linguistic স্বাতন্ত্র-চেতনাই মানুষে মানুষে দ্বেষ-দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ-সংঘাত জিইয়ে রেখেছে।

২. ফ্রিথিঙ্কার্স মাত্রই স্বকালীন বা সমকালীন জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে যা-কিছু আবশ্যিক ও জরুরি, তা নির্বিচারে, নিঃসঙ্কোচে অনুকরণে অনুসরণে গ্রহণ ও অর্জন করে। এতে জাত-জম্ম-বর্ণ-ধর্ম-ভাষা-নিবাস-সংস্কৃতি-আচার-বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণা বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। নিষ্ফল উপযোগরিক্ত তাৎপর্যশূন্য পুরোনো রীতি-নীতি বর্জন করে এ যন্ত্রযুগে ও যন্ত্রজগতে যন্ত্রনির্ভর জীবনে প্রয়োজন ও উপযোগ সচেতন থাকাই ফ্রিথিঙ্কার্সের লক্ষ্য।

৩. ফ্রিথিঙ্কার্স মাত্রই হবে বিজ্ঞানমনস্ক, বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণায় আস্থাহীন এবং বিজ্ঞানের সত্যে, তত্ত্বে ও তথ্যে আস্থাবান এবং যন্ত্র-প্রকৌশল-প্রযুক্তির অবদানের গুরুত্ব সচেতন বলেই যন্ত্র-প্রকৌশল-প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক জীবন যাপনে আগ্রহী এবং উপযোগ ও তাৎপর্যহীন ভাব-চিন্তা-কর্ম- আচরণ-বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণা নিস্ফল বলে আবর্জনার মতো বর্জনে এবং আধুনিক বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক জীবন-যাপন পদ্ধতি গ্রহণে ও অর্জনে উৎসাহী। ফ্রিথিঙ্কার্স নিত্য নতুনের প্রত্যাশী ও প্রাগ্রসরতার সাধক। ফ্রিথিঙ্কার্সের ধারণা, সবাই কেবল যদি স্রষ্টা মানে, কিন্তু শাস্ত্ৰবৰ্জন করে কিংবা নাস্তিক হয়, অথবা কম্যুনিষ্ট হয় বা নিদেনপক্ষে সেক্যুলার হয়, তা হলেই কেবল মানুষের স্বাতন্ত্র্য বুদ্ধিজাত রক্তক্ষরা প্রাণহরা হিংস্রতা কমবে।

৪. ফ্রিথিঙ্কার্স মাত্রই হয় প্রগতিবাদী। কাজেই ফ্রিথিঙ্কার্স মাত্রই হয় প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিপক্ষ। প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার এ দ্বন্দ্বে প্রগতিশীলরা অহিংসনীতি অনুসরণে জাতিসঙ্ঘ-স্বীকৃত মৌল মানবিক অধিকার প্রয়োগে স্বমত, মন্তব্য, সিদ্ধান্ত ও জীবনযাপন পদ্ধতি গ্রহণের, প্রকাশের, মুদ্রিত আকারে প্রচারের অধিকার বাস্তবায়নের দাবির ভাষিক সংগ্রাম চালিয়ে যায় কথায়, লেখায়, আঁকায়, গানে, নাটকে- যাতে আমজনতার মন প্রগতি প্রভাবিত হয় এবং প্রতিক্রিয়াশীলতা পরিহারে আগ্রহী হয়। প্রতিক্রিয়াশীলদের অস্তিত্ব তারা উপেক্ষা করে চলে। কারণ প্রতিক্রিয়াশীলেরা থাকে রক্ষণশীল, অভ্যস্ত জীবনের অনুরাগী, অনুগামী ও অনুগত অর্থোডকস, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক চেতনাদুষ্ট, বিজ্ঞানের তত্ত্বে তথ্যে সত্যে আস্থাহীন, শাস্ত্রের গোত্রের অঞ্চলের ভাষার স্বাতন্ত্র্য প্রিয় (Race, Religion, Region ও Language-এর)। প্রগতিবাদীরা যৌক্তিক, বৌদ্ধিক ও বিবেকী ভাব-চিন্তা-কর্ম-আচরণে রক্ষণশীলদের মন্থরগতিতে প্রভাবিত করে প্রতিক্রিয়াশীলতা প্রতিরোধ করবে।

৫. প্রগতিশীল মাত্রই হবে সর্বসংস্কারমুক্ত, সংযত, পরমত-কর্ম-আচরণ-সহিষ্ণু যুক্তিনিষ্ট, ন্যায্যতাবাদী, বিবেকী সজ্জন। প্রগতিবাদী মাত্রই যুক্তি-বুদ্ধি-জ্ঞান-প্ৰজ্ঞা-ন্যায় ও বিবেক অনুগ জীবন যাপন করবে। যৌক্তিক-বৌদ্ধি-বিবেকী জীবন শোষণ-পীড়ন-বঞ্চনা-প্রতারণা বিমুখ হবেই। বন্টনে বাঁচার নীতিতে হবে আস্থাবান।

৬. ফ্রিথিঙ্কার্স নিজেদের মধ্যে যে-কোনো বিষয়ে প্রশ্নোত্তরে, তর্কে-বিতর্কে স্বাধীনভাবে নিঃশঙ্ক নিঃসংকোচ আলোচনা করবে। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে আলাপে অপরিচিতির বাধা থাকলে তার সঙ্গে মতামত বিনিময়ে ‘ask not, tell not’ জিজ্ঞাসাও করো না, উত্তরও দিয়ো না’- এ নীতিই হবে অনুসৃত।

৭. ফ্রিথিঙ্কার্স মর্ত্যজীবনেই কেবল গুরুত্ব দেয়। মর্ত্যজীবনের আর্থ-বাণিজ্যিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক, বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক ভাব-চিন্তা-কর্ম আচরণে ও নীতিতে-রীতিতে গুরুত্ব দেয়। জাত-জম্ম-বর্ণ-ধর্ম-ভাষা-গোত্র-নিবাস-যোগ্যতা-দক্ষতা নির্বিশেষে প্রাণীর প্রজাতি মানুষ মাত্রেরই প্রাণের মূল্য তাদের কাছে সমান।

৮. ফ্রিথিঙ্কার্সের প্রভাবে পরিণামে ব্যক্তিগতভাবে মানবিকগুণের বা মানবতার তথা মনুষ্যত্বের বিকাশ সম্ভব হবে এবং ফলে চাকমা, মার্মা, ত্রিপুর, গারো, নাগা, কুকি, সাঁওতাল, মুণ্ডা, পাঞ্চা, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান-মুসলিম নিয়ে জাত-জন্ম-বর্ণ-ধর্ম-ভাষা-নিবাস-গোত্র নির্বিশেষে দৈশিক বা রাষ্ট্রিক জাতি গড়ে উঠবে। জয় হবে মনুষ্যত্বের। ফ্রিথিঙ্কার ছাড়া কেউ আশৈশব শ্রুত, লব্ধ ও অভ্যন্ত-গৃহাবদ্ধ জীবনের চিন্তা-চেতনা নিয়ে আলোর জগতে আসতে পারে না।

 


এরকম আরো গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ পড়ার জন্য আহমদ শরীফের প্রবন্ধ সংকলন
দেশ-কাল-জীবনের দাবি ও সাক্ষ্য

নতুন লেখার নোটিফিকেশন পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

কপিরাইট সংক্রান্ত

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।

মন্তব্য করুন