যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হাসান ফেরদৌস দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি করছেন। ২০১৬ সালে সময় প্রকাশন থেকে ‘একাত্তর, যেখান থেকে শুরু’ নামে মুক্তিযুদ্ধের ওপর তার গবেষণাধর্মী একটি বই বের হয়। বইটিতে ১৩টি প্রবন্ধ ঠাঁই পেয়েছে। যেখানে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেছেন। রয়েছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়েও তার পর্যবেক্ষণ। ওই বইয়ের সপ্তম প্রবন্ধ ‘সাম্প্রদায়িকতা, প্রথম বীজ’। প্রবন্ধটিতে আলোচিত হয়েছে কীভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থে ধর্ম ও মোল্লাতন্ত্রকে প্রশ্রয় দিয়েছে। কিভাবে দিনে দিনে ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশটির শাসন ব্যবস্থায়। আজ থেকে কয়েক দশক আগে যেভাবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ডানপন্থীরা রাজনীতিকদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দেশের শাসনব্যবস্থার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বনে গেছে, ঠিক একই প্রক্রিয়া চলছে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও। বাংলাদেশও কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানের পথ অনুসরণ করছে। দেশে ক্রমশ নির্বাসিত হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, অকার্যকর হয়ে পড়ছে উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ; কোণঠাসা হয়ে পড়ছে প্রগতিশীল কণ্ঠস্বর। স্বাধীনতার মৌল চিন্তার বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্রমশই শক্তিশালী হচ্ছে। দেশের শাসন ব্যবস্থা ও ভবিষ্যতের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী। এই অবস্থায় হাসান ফেরদৌসের প্রবন্ধটি খুবই প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় অবিশ্বাস পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল। —অবিশ্বাস টিম।
১
পাকিস্তান সৃষ্টির দুবছরের মাথায়, ১৯৪৯ সালে, লাহোরে কাদিয়ানি বা আহমদিয়াবিরোধী দাঙ্গা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মজলিশ-এ-আহরার-এ-ইসলাম নামের একটি কট্টর দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল সে দাঙ্গার ডাক দিলেও তাদের পেছনে মশাল হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন আবুল আলা মওদুদী, জামায়াতে ইসলামীর প্রধান নেতা। মওদুদী ও তাঁর দলের মতো আহরার-এ-ইসলামও পাকিস্তান সৃষ্টির বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, জিন্নাহকে কাফির-এ-আজম বলেছিল এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনো ভেদরেখা আছে তা মানত না। পাকিস্তান সৃষ্টির বিরুদ্ধাচরণ করায় জামায়াত ও আহরার এই দুটো দলই তখন রাজনৈতিকভাবে ভীষণ কোণঠাসা। আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি তুলে দেশের রাজনীতিতে ফিরে আসার চেষ্টা ছিল ১৯৪৯ সালের দাঙ্গার প্রধান উদ্দেশ্য।
প্রথমে পাঞ্জাবে, পরে সিন্ধুতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। চার বছর স্থায়ী হয় সে দাঙ্গা। লাহোরে পরিস্থিতি এতটা জটিল হয়ে পড়ে যে শেষ পর্যন্ত সেখানে ১৯৫৩ সালে সামরিক আইন জারি করতে হয়। সেই যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সে দেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করে, আজও তারা রাজনীতির মঞ্চ ত্যাগ করেনি। একইভাবে ধর্মও পাকিস্তানের রাজনীতির মধ্যমঞ্চ ছেড়ে যায়নি। এসবের ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, পাকিস্তান নামের এই দেশটি সৃষ্টির ছয় দশক পরে ক্রমশ একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ধর্মের নামে উগ্র সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও রক্তপাত সেখানে এখন দৈনন্দিন ঘটনা।
পাকিস্তানের এই হাল একদিনে, হঠাৎ করে হয়নি। ধীরে ধীরে ক্রমান্বয়ে তা ঘটেছে। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার লক্ষ্যে সে দেশের ক্ষমতাসীন মহল ধর্মীয় রাজনীতিকদের সঙ্গে ক্রমাগত আপস করে গেছে। ধর্মীয় নেতাদের হাত করা গেলে দেশের অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন নাগরিক গোষ্ঠীকেও হাতে রাখা যাবে, এই ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে তারা মৌলবাদীদের একের পর এক ছাড় দিয়ে গেছে। ভুলটা হয়ে যায় সেখানেই। শুধু কড়ে আঙুল দিয়ে শুরু করলেও মৌলবাদীরা এক সময় খপ করে ক্ষমতার পুরো হাতটাই কব্জা করে ফেলে।
প্রথম ভুলটি করেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান। তাঁর পূর্বসূরি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো তিনিও ছিলেন উদার গণতন্ত্রী। ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিলেন বটে, কিন্তু দেশটি ধর্মব্যবসায়ীদের কবলে চলে যাক, তা তিনিও চাননি। কিন্তু আহরার-জামায়াতিদের যৌথ আন্দোলনের মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়লে তিনি প্রথম আপসটি করেন সংবিধান প্রশ্নে জামায়াতিদের ছাড় দিয়ে। পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে যে তথাকথিত ‘অবজেকটিভ রেজুল্যুশন অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তার পেছনে লিয়াকত আলির উৎসাহ ও সমর্থন ছিল। ধর্মকে নবগঠিত রাষ্ট্রটির ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয় সেই অবজেকটিভ রেজুল্যুশনে। এর চার বছর পর ১৯৫৩ সালে গৃহীত হয় আইন পরিষদের তথাকথিত বেসিক প্রিন্সিপাল কমিটির রিপোর্ট। দেশের শাসনতন্ত্রের রূপরেখা নির্ধারণ ছিল সে কমিটির দায়িত্ব। এই কমিটির কাছে জামায়াত নেতা মওদুদীর দাবি ছিল, পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র হবে ‘শুদ্ধ’ ইসলামিক, শরিয়তি আইননির্ভর। কিন্তু পাকিস্তানের প্রথম পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা ছিলেন রাজনৈতিকভাবে পশ্চিমাঘেঁষা, ওয়েস্ট মিনস্টার ধাঁচের পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার সমর্থক। তারা শরিয়তি আইন চালুর পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্মবাদীদের ঠেকানোর বদলে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করার সিদ্ধান্ত নিলেন তারা। রাজনৈতিক দলাদলি ও অন্তর্দ্বন্দ্বও এ ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তৃতীয় দফা চেষ্টার পর ১৯৫৪ সালে অবশেষে যে রিপোর্টটি গৃহীত হয় তাতে একদিকে পাকিস্তানের জন্য পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থা চালুর পক্ষে মত দেওয়া হয়, অন্যদিকে শরিয়তবিরোধী কোনো আইন গ্রহণ না করার দাবি মেনে নেওয়া হয়। কোনো আইন শরিয়তবিরোধী কিনা তা নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয় পাঁচ সদস্যের একটি উলেমা বোর্ডকে।
জনগণের ভোটে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যদের পরিবর্তে শুধু উলেমাদের নিয়ে একটি একস্ট্রা পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করার অর্থ ছিল দেশের সবচেয়ে অগণতান্ত্রিক ও অনগ্রসর একটি গ্রুপের হাতে দেশের আইন, বিচারব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সকল পর্যায়ে চূড়ান্ত ভেটো দেওয়ার অধিকার অর্পণ করা। এসব তথাকথিত উলেমার হাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার দিলে অবস্থা কী দাঁড়ায়, তা সবচেয়ে ভালোভাবে টের পাওয়া যায় আহমদিয়াবিরোধী দাঙ্গা তদন্তের জন্য গঠিত বিচারপতি মুনির তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে।
আহরার-জামায়াতিদের প্রধান দাবি ছিল আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করা। তদন্ত কমিশন দেশের সবচেয়ে নামজাদা উলেমাদের ডেকে আলাদা আলাদাভাবে প্রশ্ন করেছিল, আপনাদের চোখে প্রকৃত মুসলমান কে? পাকিস্তানি উলেমারা কী জবাব দিলেন, তা মুনির কমিশনের রিপোর্ট থেকেই শুনুন:
বিভিন্ন আলেমবৃন্দ প্রকৃত মুসলমানের যে সংজ্ঞা দিলেন তার ভিত্তিতে বলা যায় যে, এই মৌলিক প্রশ্নে কোনো আলেমই একে অপরের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। যদি এসব পণ্ডিতজনের মতের ভিত্তিতে আমরা কে মুসলমান তা নির্ধারণের চেষ্টা করি, তাহলে আমরা সবাই ইসলামের বৃত্ত থেকে বহিষ্কৃত হই। আর আমরা যদি কোনো একজন আলেমের মত গ্রহণ করি তাহলে আমরা হয়তো তার চোখে মুসলমান বলে পরিগণিত হই, কিন্তু আর সকলের চোখে হয়ে পড়ি কাফের।
মুনির কমিশন পরামর্শ দিয়েছিল, পাকিস্তানের মুসলমানদের যদি চলতি অনগ্রসরতা ও ধর্মীয় ঘোরপ্যাঁচ থেকে উদ্ধার করতে হয়, তাহলে দরকার এসব ধর্মপণ্ডিত ও ধর্মব্যবসায়ীদের হাত থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করা। দরকার নির্জীব কুসংস্কার থেকে ইসলাম ধর্মের মৌলিক প্রাণশক্তিতে প্রত্যাবর্তন। বলাই বাহুল্য, পাকিস্তানের রাজনীতিকরা সে পথে না গিয়ে নির্জীব কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরার পক্ষেই সিদ্ধান্ত নিলেন। ক্ষমতায় টিকে থাকার সেটাই ছিল সহজ পথ। একজোট হয়ে ১৯৫৬ সালে গৃহীত শাসনতন্ত্রে তারা পাকিস্তানকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে বসলেন।
সেই শুরু। এরপর পাকিস্তানের রাজনীতিকরা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য বারবার ধর্মকে ব্যবহার করেছেন, ধর্মব্যবসায়ীদের ধর্মের মুলো দেখিয়ে নিজের দলে ভিড়িয়েছেন। ধর্মকে রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহারের সেরা উদাহরণ হলেন পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান। ১৯৫৮ সালে তিনি রাজনীতিকদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেন তারা অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ, এই যুক্তিতে। সে সময় তিনি মোল্লাতন্ত্রের বিরোধী হিসেবেই নিজেকে স্থাপন করেছিলেন। হুইস্কি খাওয়া জেনারেল তিনি, তার সেনাবাহিনীর সব অফিসারই একই ধাঁচের। বলাই বাহুল্য, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর তালিবানিকরণ তখনো ঘটেনি। এই জেনারেলদের ভরসায় ১৯৬২-তে তিনি যে শাসনতন্ত্র ঘোষণা করেন, তাতে পাকিস্তানের নামের আগে ইসলামি নামটি বাদ দেওয়া হয়। এমনকি শাসনতন্ত্রের মুখবন্ধে দেশের জনগণের ক্ষমতা ‘আল্লাহ কর্তৃক আরোপিত সীমাবদ্ধতা দ্বারা নির্ধারিত’ এই বাক্যবন্ধ থেকে ‘আল্লাহ কর্তৃক আরোপিত সীমাবদ্ধতা’ কথাটি পর্যন্ত বাদ দিয়ে দেন তিনি।
কিন্তু আইয়ুবের মোল্লাতন্ত্র বিরোধিতা খুব বেশিদিন টিকে থাকেনি। রাজনীতি করতে হলে, ক্ষমতা দখল জায়েজ করতে হলে মোল্লাদের চাই। সে জন্য শাসনতন্ত্র ঘোষিত হতে না হতেই প্রথম সংশোধনী গৃহীত হলো, আর তাতে পাকিস্তানের নামের আগে ওই ইসলামি নামটি আবার ফিরে এল। মোল্লাদের সঙ্গে তার লেজুড়বৃত্তির আরো বড় প্রমাণ মিলল ১৯৬৫-তে। সে সময় তিনি হঠাৎ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজেকে দেশের ও বিশ্বের কাছে আইনসিদ্ধ করতে চাইলেন। সে নির্বাচনে বিরোধী দলের সম্মিলিত প্রার্থী ছিলেন জিন্নাহর কনিষ্ঠ ভগিনী ফাতেমা জিন্নাহ । সৎ ও মুক্ত নির্বাচন হলে সেবার ফাতেমা জিন্নাহই যে নির্বাচিত হতেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিপদ টের পেয়ে আইয়ুব হাত বাড়ালেন মোল্লাদের দিকে। তার বশংবদ-কিন্তু আলেম হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত মোল্লাদের দিয়ে তিনি বলিয়ে ছাড়লেন যে ফাতেমা জিন্নাহকে ভোট দেওয়া অনৈসলামিক হবে। কোনো ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান মহিলা হতে পারেন না। বলাই বাহুল্য, ফাতেমা জিন্নাহ সে নির্বাচনে জেতেননি। কাগজে-কলমে জিতলেন আইয়ুব, কিন্তু তার বিজয়ের আসল ফায়দা পেলেন ধর্মীয় রাজনীতিকরা। পাকিস্তানি রাজনীতিতে তাদের গুরুত্ব কতখানি, সে কথা পেশাদার রাজনীতিকদের তারা ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিলেন।
ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে রাজনৈতিক কারণে আত্মসমর্পণের আরেক জবরদস্ত উদাহরণ জুলফিকার আলি ভুট্টো। ইংরেজি বলা, হুইস্কি খাওয়া, বোলচালে মহা চতুর ভুট্টো ধর্মকে তার নির্বাচনের মুখ্য বিষয় না করে দেশের মানুষকে সমাজতান্ত্রিক দাবি-দাওয়া গুলে খাওয়ালেন। যুক্তি দেখালেন, পাকিস্তানে শাসক ও শাসিত, শোষক ও শোষিত, উভয়েই মুসলমান। ফলে ধর্ম নিয়ে কোনো বিবাদ সেখানে নেই। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার ছয় বছরের মাথায় রাজনৈতিক বিরোধিতার মুখে তার যখন নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়, তখন তিনিও হাত বাড়ালেন সেই ধর্মের দিকে। পাকিস্তানের মানুষদের ঘুম পাড়ানোর সেটাই সেরা বড়ি। দেশে প্রথমবারের মতো শরিয়াভিত্তিক কিছু কিছু আইন চালু করলেন তিনি। সেই জামায়াতের চাপে তিনিই ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো আহমদিয়াদের ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে ঘোষণা করলেন।
ভুট্টোর হাতে আহমদিয়ারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হলেও সরাসরি অমুসলিম হয়নি। সে কাজটি করলেন দেশের পরবর্তী সামরিক শাসক জিয়াউল হক।
ভুট্টোকে শূলে চাপিয়ে ক্ষমতা দখলের পর তা আইনসিদ্ধ করতে এই সামরিক একনায়কও ধর্মকে ব্যবহারের সেই পথই ধরলেন। ভাবলেন আফিমের মাত্রাটা যত বাড়ানো যাবে, তার ক্ষমতা দখলকে তত দ্রুত আইনসিদ্ধ করা যাবে। দেশে পুরো মাত্রায় শরিয়তি আইন চালু তারই বুদ্ধি। ইসলামি আইন মোতাবেক শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে হুদুদ আইন চালু, তাও জিয়ার বুদ্ধি। ইসলামিকরণ প্রশ্নে গণভোট করতে গিয়ে তিনি বললেন, যারা তাকে সমর্থন করে ভোট দেবে, তারা ইসলামের পক্ষেই ভোট দেবে। জিয়ার আদত লক্ষ্য ছিল যেভাবে হোক পেশাদার রাজনীতিকদের দেশের রাজনীতির বাইরে রাখা, তাদের জোট বাঁধতে না দেওয়া। তার পক্ষে কথা বলার জন্য জিয়া এ সময় একটি ইসলামি পরিষদ গঠন করেছিলেন। এই পরিষদ রায় দিল, নির্বাচন হতে হবে দলনিরপেক্ষ, কারণ দলীয় ভিত্তির নির্বাচন ইসলামবিরোধী। এই মাসলা তারা কোথায় পেলেন জানি না, কিন্তু তাদের দেওয়া সে ফতোয়া জিয়াউল হককে ক্ষমতায় পোক্ত হতে বিপুলভাবে সাহায্য করে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, তার তাবৎ চক্করের সঙ্গে আগাগোড়া গাঁট বেঁধে ছিল জামায়াতে ইসলামী। অনুমতি ছাড়া রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল এই দলটি।
জামায়াতের চাপের কারণেই জিয়া আহমদিয়াদের সরাসরি অমুসলমান বলে ঘোষণা করেন। তার জারি করা ইসলামি আইন মোতাবেক আহমদিয়াদের সরকারি চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়, আহমদিয়াদের মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তাদের ওপর বিশেষ কর চালু করা হয়। আহমদিয়ারা নিজেদের মুসলমান বললে তাদের জেলে ঢোকানোর ব্যবস্থাও তিনিই পাকাপোক্ত করেন। এমনকি আহমদিয়াদের জন্য বিশেষ আইডেন্টিটি কার্ডের ব্যবস্থাও করেন তিনি। তার সেসব ব্যবস্থার ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, পাকিস্তানে এখন আহমদিয়ারা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করতে পারে না, একে অপরের সঙ্গে দেখা হলে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলতে পারে না, নিজেদের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে পারে না, এমনকি সংরক্ষিত আসনের বাইরে অন্য কোনো আসনের জন্য নির্বাচনে ভোটও দিতে পারে না।
ইসলামিকরণের সেই যে ঘোড়ার গাড়ি জিয়া গড়গড়িয়ে চালু করে দেন, তার পরবর্তী সরকারপ্রধান বেনজির ভুট্টো বা নওয়াজ শরিফ, কারো পক্ষেই তার গতি রুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। বেনজির হুদুদ আইনের বিরোধী ছিলেন, কিন্তু ধর্মীয় দলগুলো ক্ষেপে যাবে ভেবে শরিয়তি আইনের বিরুদ্ধে কোনোরকম রা করেননি। আর নওয়াজ শরিফের সময় তো পাকিস্তানে তালেবানি প্রভাব পূর্ণমাত্রায় চালু হয়ে যায়। পাকিস্তানের রাজনীতির আপাদমস্তক ধর্মীয়করণের ষোলকলা তার হাতেই পূর্ণ হয়।
লিয়াকত আলি খান থেকে নওয়াজ শরিফ, এরা কেউই ব্যক্তিগতভাবে প্রবল ধার্মিক বলে পরিচিত ছিলেন না। পাকিস্তানি শাসকদের কেউ কেউ, যেমন জুলফিকার আলি ভুট্টো ও তার কন্যা বেনজির— শিক্ষায় ও সংস্কৃতিতে উদারমনা ছিলেন বলেই ভাবা যায়। অথচ ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে বলে সেই ধর্মকেই হজমি বড়ি বানিয়ে দেশের মানুষকে বেটে খাওয়ালেন তারা। ফলটা কী দাঁড়াল? ক্ষমতায় তারা নিজেরা কিন্তু কেউই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারলেন না। উল্টো যে ধর্মব্যবসায়ীদের ছত্রছায়ায় তারা আশ্রয় পাবেন বলে বড় আশা করেছিলেন, ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়ে গেলেন সেই ব্যবসায়ীরাই। তাদের প্রভাবে ও নেতৃত্বে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার যে আবহাওয়া তৈরি হলো তার পরিণাম দাঁড়াল এই যে, আজ পাকিস্তানে চার্চে প্রার্থনারত মানুষকে বোমা ফেলে হত্যা করা হয়, জুম্মার দিন শিয়া ও আহমদিয়া মুসল্লিদের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। পাকিস্তানকে আজ আর কেউ সভ্য দেশ বলে ভাবে না। তাকে ইসলামি বলা যায় কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।
ধর্মের নামে সহিংসতা, এই শিক্ষা পাকিস্তানে এসেছে মওদুদী নামের সেই জামায়াতি নেতার কাছ থেকে। তিনিই প্রথম জানিয়েছিলেন, ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য অস্ত্রের ব্যবহার বিধিসম্মত। ‘আমরা কোনো মুসলমানকে যেমন তার ধর্ম বদলাতে দেই না, তেমনি অন্য কোনো ধর্মের মানুষকে তার ধর্ম প্রচার করতেও দেই না’, এ কথা মওদুদীর। ধর্মের নামে যেকোনো সহিংসতায় তার সম্মতি ছিল। ‘মুরতাদ কি সাজা ইসলামমে’— এই নামের একটি গ্রন্থে তিনি যে ধর্মীয় বিধিব্যবস্থা চালুর স্বপ্ন দেখেন, আমি তার অংশবিশেষের ইংরেজি অনুবাদ তুলে দিচ্ছি:
…whenever an Islamic revolution takes place, all non-practicing Muslims should, within one year, declare their tuming away from Islam and get out of Muslim society. After one year all born Muslims will be considered Muslim. All Islamic laws will be enforced upon them. They will be forced to practice all the faraid and wajibat of their religion and, if anyone then wishes to leave Islam, he will be executed. Every effort will be made to save as many people as possible from falling into the lap of kufr. But those who cannot be saved will be reluctantly separated from society forever (executed). After this purification Islamic society will start afresh with Muslims who have decided voluntarily to remain Muslims.
কী আশ্চর্য! এই অভাবনীয় নিষ্ঠুরতার কথা বলা হচ্ছে এমন এক ধর্মের নামে যার অর্থ শান্তি, যে ধর্মের প্রবর্তক সহিষ্ণুতাকে অন্য সকল গুণাবলির চেয়ে ওপরে স্থান দিয়েছিলেন, ভিন্ন ধর্মের মানুষকে সাগ্রহে তার আশ্রয়ের ছায়ায় স্থান দিয়েছিলেন।
২
মওদুদী বেঁচে নেই। কিন্তু মওদুদীবাদ বেঁচে রয়েছে। শুধু পাকিস্তানে নয়, আমাদের বাংলাদেশেও। তার প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী এখনো বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে সোচ্চার। মওদুদীর অন্যতম দাবি ছিল আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করা। পাকিস্তানে সে দাবি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। এখন বাংলাদেশেও সেই একই দাবি তুলেছে জামায়াত ও তার নিকটবর্তী ধর্মীয় কতগুলো দল। সে দাবি প্রতিষ্ঠায় প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ইতিমধ্যে আহমদিয়াদের সকল ধর্মীয় প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সেটা ২০০৪ সালের কথা। তখন বাংলাদেশ সরকার যুক্তি দেখিয়ে বলেছে, দেশে অশান্তি ও হানাহানি ঠেকাতে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমরা জানি, ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়েছে। আহমদিয়ারা কারো বিরুদ্ধে হামলা চালায়নি। দেশে যদি অশান্তি ও হানাহানি হয়, তো তার জন্য দায়ী আহমদিয়াবিরোধী ধর্মীয় দলগুলো। দেশে অশান্তি দেখা দিলে, হানাহানি হলে, সরকার তা রোধে ব্যবস্থা নেবে, পুলিশ মোতায়েন করবে, যারা হানাহানির জন্য দায়ী তাদের শাস্তি দেবে। তা না করে নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলো তাদের বিরুদ্ধে, যারা সে হামলার শিকার? এমন যুক্তিও শুনেছি, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনায় যাতে আঘাত না লাগে সে জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হলো, প্রয়োজনে আরো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কী আশ্চর্য। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অধিকারের কথা ভাবা হলো, ধর্মপ্রাণ আহমদিয়াদের অধিকারের কথা ভাবা হলো না! বাংলাদেশের সংবিধানে সে অধিকারের স্বীকৃতি কি আমরা দেইনি? আহমদিয়াদের ধর্মপালনের অধিকার ক্ষুণ্ন করে বাংলাদেশ মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করল— সে কথাটাও একবার ভাবা হলো না। উগ্র-মৌলবাদীদের হাতে একের পর এক ব্লগার হত্যা, তাও এই প্রক্রিয়ার অংশ। খুনীদের খুঁজে বের করার বদলে সরকার উল্টো হুমকি দিয়েছে, ধর্মের বিরুদ্ধে কোন কথা বলা যাবে না।
সন্দেহ নেই, মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোকে খুশি করতেই বাংলাদেশ সরকার এ পথ ধরেছে। ধর্মবাদীদের খুশি করার চেষ্টার ফল কী হয়েছে, তার প্রমাণ তো আজকের পাকিস্তান। সন্দেহ নেই, এই ধারা অব্যাহত থাকলে আমাদের পরিণতিও ভিন্ন কিছু হবে না। ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ আসন গেড়ে নিচ্ছে, এই অভিযোগ এখন ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে দেশের বাইরে সে অভিযোগ আরো জোরদার হবে।
বিদেশিরা কে কী বলল উদ্বেগ তা নিয়ে নয়। আসল উদ্বেগ আমাদের দেশ, রক্তের মূল্যে যার স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি, আমাদেরই চোখের সামনে তা সম্পূর্ণ একটি অপরিচিত ও বৈরী দেশে বদলে যাচ্ছে, তা নিয়ে। ধর্ম পালনের ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রাজনৈতিক স্বাধীনতার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার ভয় হচ্ছে, আমরা বোধহয় ক্রমশ সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। সে বিপদ ঠেকাতে হলে প্রতিরোধ করতে হবে এখনই। প্রবাসে বসে আমরা মৌলবাদী ও ধর্মব্যবসায়ীদের উসকানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উদ্যোগ নিয়েছি শুনে ঢাকার একজন নামজাদা সাংবাদিক পত্র মারফত জানিয়েছেন, প্রতিবাদ করে কিছু হবে না। দেশের মানুষ আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে, তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া যেকোনো ব্যবস্থা খুবই জনপ্রিয় হবে। সরকার সে পথেই এগুচ্ছে। শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছি। রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয় হবে ভেবে পাকিস্তানে ধর্মের ফাঁস রাজনীতিবিদের সমর্থনেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে। তাকে ঠেকানোর কথা ভাবেনি কেউ। আমরা কি সে দেশের পরিণাম দেখেও কিছু শিখব না?
আজ আহমদিয়াদের ও মুক্তমনা ব্লগারদের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠেছে। কিন্তু কাল যখন ভিন্নমত পোষণের জন্য আপনার বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠবে, সংহতির আশা নিয়ে কার দিকে আপনি হাত বাড়াবেন?