প্রবন্ধদর্শননৈতিকতার সমস্যা । শওকত ওসমান

নৈতিকতার সমস্যা । শওকত ওসমান

অধিকন্তু, সামাজিক ও রাজনৈতিক আইন কালের তাগিদেই বদলায়। নৈতিক আদর্শের এমন চঞ্চল প্রতিমূর্তি সমাজের পক্ষে সুখকর নয়। দর্জির ফিতা কখনও ষোল কখনও আঠার ইঞ্চি মাপে ফুট ধরলে জামা সেলাই যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার। সামাজিক-রাজনৈতিক আইন যেহেতু উপায় মাত্র, লক্ষ্য নয়, তা পালনের জন্য কোন নৈতিক-বাধ্যতাবোধ মোরাল অবলিগেশন থাকতে পারে না। এমনকি গোষ্ঠীপতিদের আইনও আদিম সমাজ চিরদিন মেনে নিয়েছে, এমন নজির নেই ইতিহাসে।

নৈতিকতার সমস্যা । শওকত ওসমান

অধিকন্তু, সামাজিক ও রাজনৈতিক আইন কালের তাগিদেই বদলায়। নৈতিক আদর্শের এমন চঞ্চল প্রতিমূর্তি সমাজের পক্ষে সুখকর নয়। দর্জির ফিতা কখনও ষোল কখনও আঠার ইঞ্চি মাপে ফুট ধরলে জামা সেলাই যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার। সামাজিক-রাজনৈতিক আইন যেহেতু উপায় মাত্র, লক্ষ্য নয়, তা পালনের জন্য কোন নৈতিক-বাধ্যতাবোধ মোরাল অবলিগেশন থাকতে পারে না। এমনকি গোষ্ঠীপতিদের আইনও আদিম সমাজ চিরদিন মেনে নিয়েছে, এমন নজির নেই ইতিহাসে।

মানবসমাজে ‘নৈতিকতা’ গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। মানব জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে—পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে—নৈতিকতা প্রধান ভূমিকা নিয়ে অধিষ্ঠিত। না, এই অধিষ্ঠান নৈতিকতার নিজস্ব নয়। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার প্রতিনিয়ত মানুষের ওপর নৈতিকতা নামক বিভিন্ন বিধান আরোপ করেছে। তবে এই নৈতিকতার নেই কোন সার্বজনীন রূপ। শাশ্বত নৈতিকতা বলে কিছু নেই। স্থানকালপাত্র ভেদে পরিবর্তিত হয় এর রূপ। মানব সমাজের বিকাশে নৈতিকতা নিয়ে রয়েছে বেশ কিছু দার্শনিক ও প্রায়োগিক সমস্যা। প্রবন্ধটিতে শওকত ওসমান নৈতিকতার সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করেছেন বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।— অবিশ্বাস টিম।


A life unexamined is not worth living
-Socrates.

সংঘবদ্ধ সমাজ-জীবনে ঔচিত্য-অনৌচিত্যের প্রশ্ন-অপরিহার্য। মানুষে মানুষে মুখ্য বা গৌণ পারস্পরিক সম্পর্ক থাকার ফলে নৈতিক বিচার এবং অনেক সময় পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয়তো একমাত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাধ্যকতা এড়িয়ে যাওয়ার কঠিন। তাই সরল রেখায় বিবেক ও রিপুর মাপকাঠি হালে পানি পায় না। এমন কি নৈতিকতার স্বরূপ নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে সক্রেটিস জিজ্ঞেস করেছিলেন, “একটা কাজ সঠিক বলেই কী ঈশ্বর তা ইচ্ছা করেন,- না, ঈশ্বরের ইচ্ছা বলেই তা সঠিক?” প্রথম ক্ষেত্রে ঈশ্বর আর সর্বশক্তিমান থাকেন না, ঈশ্বরত্ব ক্ষুণ্ন হয়। যেহেতু নৈতিকতা ঊর্ধ্বে শির পোড়ো সেজে বসে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে নৈতিকতা লোপ পেয়ে যায়। ঈশ্বরের হুকুম বলেই কোন নৈতিক নিয়ম পালন করলে তা হয়ে পড়ে বিচক্ষণতা বা বুদ্ধিমানের কাজ। স্বর্গের লোভ কি নরকের অগ্নি এড়াতে যে প্রার্থনা করে, সে বুদ্ধিমান ব্যক্তি, সাধু নয়। নৈতিকতার সঙ্গে এইসব প্রশ্ন স্বতঃই জড়ানো। প্রাচীন দার্শনিকের উপমা অনুসরণে বলা যায়, নৈতিকতা যেন সৈন্যদের কিটব্যাগ বা পিঠে বওয়া রসদের থলি, যা রাস্তায় ফেলে রেখে যাওয়া চলে না, আবার কুচকাওয়াজের পক্ষে খুব সুখকরও নয়। অনেক সময় যুদ্ধের হারজিৎ নির্ভর করে হাতিয়ার আর এই রসদের থলির ওপর।

অভিজ্ঞতাবাদী দর্শনের আধুনিক প্রতিষ্ঠাতা ফ্রান্সিস বেকন সক্রেটিসের প্রথম মোকাবিলার চেষ্টা পান। তাঁর মতে, ঐশী শক্তির ওপর নির্ভর করলে পাপ সম্পর্কে অতি সচেতনতা বাড়ে। কর্তব্যের পূর্ণ স্বরূপ সম্পর্কে কোন আলোকপাত করতে অক্ষম এই জাতীয় চিন্তা। উচ্চতর নৈতিক আদর্শের স্বরূপ অস্পষ্টই থেকে যায়। টমাস হবস এই পথে আরো এক ধাপ অগ্রসর হন। তার ধারণা জড় ব্যাপারের মত নৈতিক জগতও কার্যকারণের নিয়ম মেনে চলে। ফলে নৈতিকতার ব্যাখ্যায় ঐশী শক্তির আর প্রয়োজন কোথায়? যা কাম্য তাই কল্যাণ। যা অকাম্য তা অকল্যাণ। একদম চরম কল্যাণ-অকল্যাণ কিছু নেই। সবই আপেক্ষিক দেশকালপাত্রের ওপর নির্ভরশীল। যা সমাজের পক্ষে মঙ্গলকর তা-ই কল্যাণ।

অন্যথায় অকল্যাণ। ব্যক্তি ও সমাজের স্বার্থ অঙ্গাঙ্গী জড়িত। আত্মরক্ষাই মানুষের প্রধান জীববৃত্তি। প্রাকৃত নৈরাজ্য থেকেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি। যেহেতু আত্মরক্ষাপ্রয়াসী সকল মানুষই নিরাপত্তা চায়। তার আশ্বাস রাষ্ট্রের আইন ছাড়া আর কোথায় মিলবে? মানুষ জন্মগতভাবে নৈতিক জীব। কিন্তু তা চালু রাখতে গেলে রাষ্ট্র প্রয়োজন। হবসের অনেক সমসাময়িকগণ মনে করতেন সামাজিক আইনই নৈতিকতার বুনিয়াদ। ন্যায় অর্থ সমাজের অনুমোদনপ্রাপ্ত। অন্যায় তার বিপরীত। নৈতিকতা এক ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সামাজিক শাস্তি এবং আপ্ত-শাসন দ্বারাই তা চালু থাকে। রেওয়াজ, প্রথা ইত্যাদির ওপর এই চিন্তানায়কগণ জোর দিয়েছিলেন। আদিম সমাজে গোষ্ঠীপতি বা ট্রাইব্যাল চীফ-দের হুকুমই ছিল বাধ্যতামূলক নৈতিক আইন- এই দৃষ্টান্ত দিতে তারা ভোলেননি।

পূর্বোক্ত মতামত থেকে সোজা লক্ষণীয়, নৈতিকতা বাইরে থেকে চাপানো সামগ্রী। সাধু ভাষায়, বহিরারোপণ। ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার ওপর বনিয়াদ গড়লে নৈতিকতা আর কোথায় দাঁড়ায়? ইচ্ছার স্বাধীনতা নৈতিক বিচারের অপরিহার্য শর্ত। এখানে সেই স্বাধীনতাই ক্ষুণ্ন। ঠ্যাং ভেঙে দেওয়ার পর খুঁড়িয়ে হাঁটার জন্য কাউকে উপহাস করা চলে, দায়ী করা যায় না। নৈতিকতার প্রথম শর্ত, মানুষের জিজ্ঞাসার অধিকার থাকবে, “কেন আমি সদাচারী হব? কেন এই নৈতিক আইন মানবো; অন্য বা বিপরীত আইন নয়?” নচেৎ নৈতিকতা পূর্বোক্ত খঞ্জ পায়ের ব্যাপার হয়ে পড়ে। অন্য পক্ষে, সামাজিক রাজনৈতিক আইন ও উপায় কোন আদর্শ বা লক্ষ্য নয়। মানুষের সর্বাঙ্গীন বিকাশই সেখানে বড় কথা। সুতরাং তা-ই কি নৈতিকতার আদর্শ হওয়া উচিত নয়? বহু যুগের চাপে চাপে বহু নৈতিক আদর্শ অনড় মানুষের মনে চেপে বসে, তখন আর কেউ কোন প্রশ্নই তোলে না তার যাথার্থ নিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন তোলা উচিত।

অধিকন্তু, সামাজিক ও রাজনৈতিক আইন কালের তাগিদেই বদলায়। নৈতিক আদর্শের এমন চঞ্চল প্রতিমূর্তি সমাজের পক্ষে সুখকর নয়। দর্জির ফিতা কখনও ষোল কখনও আঠার ইঞ্চি মাপে ফুট ধরলে জামা সেলাই যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার। সামাজিক-রাজনৈতিক আইন যেহেতু উপায় মাত্র, লক্ষ্য নয়, তা পালনের জন্য কোন নৈতিক-বাধ্যতাবোধ মোরাল অবলিগেশন থাকতে পারে না। এমনকি গোষ্ঠীপতিদের আইনও আদিম সমাজ চিরদিন মেনে নিয়েছে, এমন নজির নেই ইতিহাসে। মানুষের স্বাধীন মর্মশক্তি বা স্পিরিট কি তার মোকাবিলা করেনি? নজীর অজস্র। বরং সামাজিক-রাজনৈতিক আইন স্বতঃই নৈতিক বিচারের সামগ্রী। তার মধ্যে কিছু নৈতিক কিছু অনৈতিক থাকতে পারে। রাষ্ট্রের বনিয়াদ নৈতিকতার উপরই প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। নচেৎ সামাজিক দুর্দশার অবসান ঘটবে না। হবসের সমালোচনায় বার্ট্রান্ড রাসেল লিখেছে:

The tendency of every Government towards tyranny cannot be kept in check unless governments have fear of rebellion-Government would be worse than they are, if Hobbes’s submissive attitude were universally adopted by subjects. This is true in the political sphere, where government will try, if they can, to make themselves personally irremovable, it is true in economic sphere, where they will try to enrich themselves and their friends at the public expense; it is true in intellectual sphere, where they will suppress every new discovery or doctrine that seems to menace their power.”
(History of western philosophy: 1946 edition page 578).

অর্থাৎ, রাজনৈতিক আইন কোন নৈতিকতার বুনিয়াদ হতে পারে না, কারণ তা নিজেই নৈতিকতার কাঠগড়ায় আসামী। শাস্তির ভয় দেখিয়ে নৈতিকতা চালু করতে গেলে তা হয়ে দাঁড়ায় বিচক্ষণতার নামান্তর। তাছাড়া বাইরে থেকে চাপানো নৈতিক আদর্শ বাহ্যিক কিছু কাজের পর খবরদারী করতে পারে, সব কাজের ওপর নয়। মানসিক জগৎ প্রায় অস্পষ্ট থেকে যায়। অথচ মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা কল্পনা-বাসনার সঙ্গেই নৈতিক বাধ্যতাবোধের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। বাইরে থেকে চাপানো আদর্শ ফলে ভ্রষ্ট।

নৈতিকতার সঙ্গে রাষ্ট্রের যোগাযোগ থাকার ফলে আর এক প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ধরা যাক, মানব কল্যাণই নৈতিক আদর্শ। সমস্ত কাজের লক্ষ্য হওয়া উচিত এই আদর্শে পৌঁছানো। তখন প্রশ্ন উঠবে— সমস্ত সমাজের কল্যাণ, না, ব্যক্তিবিশেষের ভোগকৃত কল্যাণের সমষ্টি ফল? এবং এই কল্যাণ কি গোটা সমাজের প্রাপ্য— কোন অংশ বিশেষের নয়? দার্শনিকের উপমা-অনুকরণে ব্যাপারটা খোলাসা করা যাক। দেহের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে ভোগ-সুখের সম্পর্ক জড়িত। কিন্তু তবু কেউ মনে করে না ‘হাত সুখ পাচ্ছে’। বলা হয়, মানুষটা সুখ পাচ্ছে। নাকে ভাল খোশবু এলো। কেউ বলবে না, নাক মজা পাচ্ছে। মজা ব্যক্তির ওপর ফেলে তবে নিস্তার। অনেক চিন্তাবিদ তা-ই মনে করেন, কল্যাণের ক্ষেত্রে গোটা সমাজের পাওনার দিকে জোর দেওয়া উচিত, অংশের দিকে নয়। সমষ্টিগতভাবে সমাজের কল্যাণই শ্রেয়। ব্যক্তির দিকে দৃষ্টির অত প্রয়োজন নেই। হেগেলের মত অধিবিদ্যাবিদ বলবেন যে সমস্ত গুণ তো আসলে পরম সত্তার গুণ। উদাহরণত, রাষ্ট্রের ওপর অনেক গুণ বর্তায়। বলা যায়, রাষ্ট্র জনাকীর্ণ, বিস্তীর্ণ হতে পারে না। নৈতিকতার ক্ষেত্রে তাই সমষ্টির দিকেই লক্ষ্য থাকা দরকার। এই সমষ্টি-ব্যষ্টির দ্বন্দ্ব তাই বিশেষ জটিল সমস্যা। মানুষ নিয়েই নীতিবিজ্ঞানের, এথিকসের কারবার। মানুষ রাষ্ট্রের অধিবাসী। এখন জোর কোন দিকে দেবেন, আদর্শও তার ওপর নির্ভরশীল। এক দলের চাপ সমষ্টির দিকে অন্যদের ব্যষ্টির ওপর। কোন কোন সমাজতাত্ত্বিক মনে করেন, রাষ্ট্র যখন স্বৈরাচারী হয়, তখন সার্বভৌমতার জিগির ওঠে। সুস্থ সমাজে ব্যক্তিই প্রাধান্য লাভ করে। তা মত মাত্র।
কিন্তু সমস্যা দূরীভূত হয় না।

ঊনিশ শতকের সুখবাদী হিডোনিস্ট এবং উপযোগবাদীগণ, য়ুটিলিটেরিয়ান মতবাদীরা ব্যক্তির সুবিধা ও কামনার পরিতৃপ্তির ওপর নৈতিকতার সৌধ গড়ার চেষ্টা পান। এখানে একটা খুঁৎ স্পষ্ট। তাদের দৃষ্টির কাছে প্রথম ব্যক্তি ধরা দেয়, গোটা সমাজ নয়। এমন ক্ষেত্রে সহজেই বহু পরিস্থিতি দেখা দেবে, যেখানে নৈতিকতা পালনের চেয়ে অবহেলার মধ্যেই সুখ-সুবিধা ও পরিতোষ অধিক ব্যক্তি যখন মাপকাঠি তখন এই পরিস্থিতি দেখা দিতে বাধ্য। তাছাড়া নৈতিকতার যদি একমাত্র ভিত্তি হয় পরিতৃপ্তি-লাভ তখন কীভাবে মানুষকে বোঝাবেন যে নৈতিকতার জন্য, অপরের পরিতৃপ্তির জন্য, তার নিজের পরিতৃপ্তি বিসর্জন দেওয়া উচিত। আর সেই সময়ে বহু লোকই সমাজে থাকবে যারা অপর ব্যক্তির পরিতৃপ্তির জন্য নিজেদের পরিতৃপ্তি বিসর্জন দিতে সর্বদা পরান্মুখ। জেরেমী বেন্থাম স্বীয় তত্ত্বের এই ছিদ্র দেখতে পেয়েছিলেন। সেই হেতু তিনি ওকালতি করেন এমন আইন-প্রণয়নের যেন অসৎ লোকেরা নিজেদের কাম্য না পায়। বেন্থাম বলেছেন, মানুষকে ভয় প্রদর্শন বা ধমক-দান ছাড়া নৈতিক করে তোলা যায় না। সুতরাং ব্যাপারটা আবার বাইরের আরোপিত জিনিস হয়ে দাঁড়ায়।

বহিরারোপিত নৈতিকতার অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল ছিলেন যুক্তি-বিচারবাদী দার্শনিকগণ। কান্ট ঘোষণা করেন, নৈতিকতা বিশ্বজনীন।

নৈতিকতার শর্ত অন্তরের তাগিদ— বহিরারোপিত কিছু নয়। অন্যদিকে সুখবাদের ওপর খড়গ হেনে তিনি নৈতিকতার উপাদান-বাসনা-কামনা ঝেড়ে ফেলে আর এক চরম প্রান্তে দাঁড়ান। বিচারশক্তি সব সৎ জীবনে পৌঁছানোর জন্যে প্রয়োজন। জ্ঞানের সাহায্যে ধাপে ধাপে জীব-বৃত্তির বিনাশ সাধনই নৈতিকতার শিখরে পৌঁছানোর পথ। একদিকে সংবেদনশীলতা অন্যদিকে অনুভূতি। এই দ্বৈততা কান্ট মেলাতে পারেননি। তাঁর মতে ব্যবহারিক বিচার-শক্তিই বিবেক। অন্তরের তাগিদেই মানুষ নিজ কর্তব্য সম্পন্ন করবে, বাইরের চাপে নয়। অন্যথায় নৈতিকতা বিকার-তত্ত্ব, কান্টের ভাষায় প্যাথলজিক্যাল হয়ে পড়ে। ‘কর্তব্যের জন্য কর্তব্য’ এই হওয়া উচিত নৈতিকতার শ্লোগান। নৈতিক নিয়ম স্বজ্ঞার সাহায্যে পাওয়া যায়। কাজের ঔচিত্য-অনৌচিত্য নির্ভর করে এই নিয়মের সঙ্গে সংগতি রাখা, না রাখার ওপর। নৈতিক আইন বিশ্বজনীন। পরিস্থিতি অনুযায়ী তার পরিবর্তন ঘটে না। তা নিজেই লক্ষ্য, উপায় নয়-বরং ‘শর্তহীন আদেশ’ সম্পাদনের খাতিরেই পালিতব্য। গীতার নিষ্কাম কর্মের সেই প্রতিধ্বনি:

কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি।

[বাংলা অনুবাদ: স্বধর্ম নির্ধারিত কর্মে তোমার অধিকার আছে, কিন্তু কর্মফলে তোমার অধিকার নেই। তাই ফলের প্রত্যাশা করে কর্ম করো না। আবার ফলের আশা বাদ দেয়ায় কর্ম করা ছেড়ে দিও না— অবিশ্বাস টিম]

কান্ট শর্তহীন আদেশের স্বরূপ ব্যাখ্যায় বলছেন, এমনভাবে কাজ করো যেন তা চিরন্তন হোয়ে ওঠে। এমনভাবে কাজ করো যেন অনুরূপ পরিস্থিতিতে সকলের তা-ই করা উচিত।

মূলত কান্ট ছিলেন ইনট্যুইশনিস্ট। বিচার-বুদ্ধির ওপর জোর দিয়েও তিনি শেষে মরমী। অস্পষ্টতার মধ্যে আশ্রয় খোঁজেন। অথচ নৈতিক নিয়ম তারাই পালনের অধিকারী যারা বুদ্ধির অধিকারী। অন্যপক্ষে, নৈতিক নিয়মকে ‘শর্তহীন আদেশ’ বলার জন্য তা একটা বাধ্যতায় পরিণত হয়। যার ফল বহিরারোপিত নৈতিকতার অনুরূপ এবং বহিরারোপিত নৈতিকতার সব অপকর্ষ এখানে ভিড় জমায়। কান্টের নৈতিক আদর্শও শেষ পর্যন্ত ওই কলঙ্ক এড়াতে পারেনি।

হার্বাট স্পেন্সরেও এই ছোঁয়াচ স্পষ্ট। তাঁর মতে, জীববিজ্ঞান বা বায়োলজির নিয়মাবলী নৈতিকতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। জীব বা অর্গানিজম পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজন, এ্যাডপ্টেশন দ্বারা বিকাশ লাভ করে। নৈতিক জীবনের মূলমন্ত্র এই অভিযোজন বা সংগিত-স্থাপন। লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য-বিধায়ক কাজই আচরণ। অভিযোজনের মাত্রা অনুযায়ী একটা কাজ ভাল কি মন্দ বিচার্য। ভাল কাজ সুখের আকর, মন্দ কাজ দুঃখের। সুখ জীবনীশক্তির সহায়, দুঃখ অন্তরায়। এইজন্য সুদীর্ঘ আয়ুর সাধনাও লক্ষ্য হওয়া উচিত। “জীবনের চরম উদ্দেশ্য সুখ”। তবে নিকটতম লক্ষ্য: জীবনের বিস্তার ও বৈচিত্র্য, কিন্তু নৈতিক চেতনার উৎপত্তি বিশ্লেষণে স্পেন্সার মনে করেন, ব্যক্তি এবং জাতীয় জীবনের সংরক্ষণকল্পে বাইরের চাপ একান্তই প্রয়োজন। এই প্রেষণ সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয়। আভ্যন্তরীণ অনুশাসনের স্যাংকশনের উল্লেখও স্পেন্সারে আছে। রাষ্ট্র ও ব্যক্তির অভিযোজন প্রয়োজন। আদর্শ রাজ্যে এই অভিযোজন পূর্ণতা লাভ করবে। সোজা বোঝা যায়, স্পেন্সর নৈতিক বাধ্যতাবোধের কোন সুষ্ঠু ব্যাখ্যাদানে অপারগ। বাইরের চাপ তো নৈতিক চেতনা সৃষ্টি করে না।

নীতিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পূর্ণতাবাদী পারফেকশনিষ্ট কল্যাণবাদীরা বহিরারোপণের খপ্পর-মুক্ত হতে ঘোষণা করলেন, বিবেকই মানুষের সমগ্র সত্তা। অন্য দিকে, বাসনা-কামনার জগৎ আংশিক সত্তা। নৈতিক নিয়ম মানুষের সত্তা উদ্ভূত। নৈতিক বাধ্যতাবোধের উৎস হচ্ছে অন্তর। নৈতিক জগতে মানুষ সার্বভৌম। সেখানে জাগতিক কর্তৃপক্ষ নিতান্তই তুচ্ছ। কারো চোখ-রাঙানির ধার বিবেক ধারে না। আত্মোপলব্ধিই চরম আদর্শ। মানুষের মধ্যে বহু গুপ্ত ও সুপ্ত শক্তি আছে। তাদের সংগতিময় বিকাশই চরম কল্যাণ। পূর্ণতাবাদীদের অন্যতম সারথী ব্র্যাডলের মতে, দেহের বিভিন্ন শাখা-উপশাখা যেমন গোটা দেহের কল্যাণে স্ব স্ব কর্তব্য সমাধা করে, তেমন মানুষের নিজ নিজ অবস্থান-অনুযায়ী কর্তব্য সম্পাদনের মধ্যেই সমাজকল্যাণ নিহিত। গীতায় আছে :

স্বে স্বে কর্মন্যভিরতঃ সংসিদ্ধিং লভতে নরঃ।
স্বকর্মনিরতঃ সিদ্ধিং যথা বিন্দতি তচ্ছুনু॥
অর্থাৎ, স্ব স্ব কর্মে রত এবং নিষ্ঠাবান ব্যক্তিই সিদ্ধি লাভ করে।

আত্মোপলব্ধির পথেই মানুষের অসীম সত্তা আপন ব্যক্তিগণ্ডি, সমাজগণ্ডী ছাড়িয়ে অসীম সত্তা অভিমুখে অগ্রসর হোতে সক্ষম। এই চিন্তা অতীতে এ্যারিস্টটল থেকে বর্তমান যুগে ম্যুরহেড পর্যন্ত দার্শনিকের সমর্থন পেয়েছে। পার্থক্য থাকলেও তাঁরা একবিন্দুতে স্থির-যার মর্মবাণী: নিজেকে জানো। আত্মানং বিদ্ধি।

রাষ্ট্র ও ব্যক্তির বিরোধ, বহিরারোপণ দ্বারা নৈতিকতার মর্যাদা খর্ব—ইত্যাদি সমস্যা এইসব মতবাদে অনেকটা মীমাংসিত। কিন্তু এখানে বড় প্রশ্ন, আত্মোপলব্ধির স্বরূপ কী? তা এত ছায়াময়, অস্পষ্ট যে, আদর্শ হিসাবে দাঁড় করনো কঠিন। রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন তুলে শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মকে জানার মত নেতি-নেতি পন্থায় একটা জবাব দেওয়ার চেষ্টা পেয়েছেন:

কে সে। জানি না কে। চিনি নাই তারে—
শুধু এইটুকু জানি, তারি লাগি রাত্রি অন্ধকারে
চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর পানে
ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্রপাতে জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে
অন্তর প্রদীপখানি। …

হৃৎপিণ্ড করিয়া ছিন্ন রক্তপদ্ম অর্ঘ্য উপহারে
ভক্তিভরে জন্মশোধ শেষ পূজা পূজিয়াছে তারে
মরণে কৃতার্থ করি প্রাণ।
মহাপ্রাণ সহিয়াছে পলে পলে
সংসারের ক্ষুদ্র উৎপীড়ন, বিধিয়াছে পদতলে
প্রত্যহের কুশাঙ্কুর, করিয়াছে তারে অবিশ্বাস
মূঢ় বিজ্ঞজনে, প্রিয়জন করিয়াছে পরিহাস
অতি পরিচিত অবজ্ঞায়। …

প্রাচীন বিশিষ্ট ধর্মসমূহ আত্মোপলব্ধির ভিত্তির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বিভিন্ন ধর্মে কী, একই ধর্মের সম্প্রদায়-উপসম্প্রদায়ে কলহ এবং যার পরিণতি-রক্তপাত, হত্যাজাতীয় সর্বপ্রকার বর্বরতা থেকে সিদ্ধান্ত করা যায়—নৈতিক আদর্শ ধোঁয়াটে রাখা চলে না। খোদ গ্যেটে একবার য়েকারম্যানকে বলেছিলেন যে, ‘নিজেকে জানো’ সক্রেটীয় এই আদর্শ বেশী দূর মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায় না। এই ‘জানো-পন্থীরা’ নিজেদের আত্মা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে, তাদের চোখের সামনে সমাজ ধ্বংস হোক, মানুষ জন্তুতে পরিণত হোক, অত্যাচার-অনাচার বেড়ে যাক কিছু আসে যায় না। কেবল আত্মা ঠিক থাকলেই হলো। তা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে তারা উপদেশ ঝাড়ে। য়ুরোপ থেকে গ্যেটে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন: আদর্শের অস্পষ্টতা মানুষকে কর্ম-বিমুখ, কলহপরায়ণ করে তোলে; কুর্মবৃত্তির বিলাস যোগায়। আর তা সমাজ পরিবর্তনের কোন সাহায্য করে না। পূর্ণতাবাদীদের তাই ব্যর্থ নমস্কারে ফেরাতে হয়, যদিও বহু ক্ষেত্রে তাঁরা নমস্য।

নৈতিক বিচারও কম মাথাব্যথা নয়। প্রাত্যহিকতায় জটিল জট, মানুষে-মানুষে শ্রেণীতে-শ্রেণীতে, সম্প্রদায়-উপসম্প্রদায়ে জীবিকার ময়দানে এত দ্বন্দ্ব সম্পর্কের টানাপোড়েনে এমন ঘূর্ণিপাক যে দিশেহারা হওয়ার অবকাশ যথেষ্ট। উদাহরণত মিতব্যয়িতা এবং বদান্যতা উভয়ই সমাজে সদগুণ বা ভার্চু। অন্য দিকে, অমিতব্যয়িতা ও নীচ সংকীর্ণতা কদাচার। যদি দানবীর হতে চান, অমিতব্যয়ী না হয়ে পারা যায় না। আবার মিতব্যয়ীতার সঙ্গে নীচতা সহজেই এসে জুটবে। আরো একটি উদাহরণ। কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য এবং অপরের প্রতি বিবেচনা—(কারো মনে কষ্ট না দেওয়া, কারো কোনো অসুবিধা না করা)—উভয়ই সমাজে সদগুণ রূপে অভিহিত। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসক যখন কোন মানুষের অস্তিস্ত ধরে টান দেয়, তার মা-বোনের ইজ্জৎ কাড়ে, দিনের পর দিন তার বিবেকের উপর জগদ্দল পাথর চাপিয়ে রাখে-তখন সে কী করবে? আনুগত্য বজায় রাখবে, না অপরের প্রতি বিবেচনা দেখাবে? লক্ষ্য করা দরকার এখানে সংঘাত কোন আদর্শের সঙ্গে অনাদর্শের নয়। সংঘাত আদর্শের সঙ্গে আদর্শের। জীবনের ঘূর্ণিপাক এমনই ক্ষিপ্ত ও দ্বন্দ্বকীর্ণ যে সৎ হওয়ার চেষ্টা করলেও সৎ হওয়া যায় না। স্বতঃই বিচারবুদ্ধি হাবুডুবু খায়।

এইসব সমস্যার নিরাকরণ অবিশ্যি কর্তব্য। মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভিত্তিতেই সমস্যার উৎস খুঁজে বের করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কারণ সৎ আদর্শ মানুষকে মানুষের কাছে এগিয়ে দেয়। এখানে চারুকলা ও নীতিশাস্ত্র বৈশিষ্ট্য এক। আবার অসৎ আদর্শ মানুষের কাছ থেকে মানুষকে দূরে ঠেলে সরায়, আধুনিক সমাজতাত্ত্বিকের ভাষায় এ্যালিয়েনেশান বা পরকৃতি। অপর মানুষ যখন একজনের কাছে বস্তু মাত্র। সামাজিক সম্পর্কে সে-ও অপরের কাছে বস্তু অর্থাৎ পরকৃত। বস্তুজগতে ত মনুষ্য-জগতের আদর্শ রূপায়িত হতে পারে না।

আদর্শের সার্বিকতায় পৌঁছতে গেলে এসব চিন্তার খেই নতুন করে পাকড়ানো প্রয়োজন। চিরাচরিত বিশ্বাস সেখানে খুব বেশী সাহায্য করতে পারে কী? গান্ধীজী প্রার্থনা-সভায় যে রামধনু গাইতেন তার শেষ দুই পংক্তি:

ঈশ্বর আল্লা তেরি নাম
সবকো সুমতি দে ভগবান।

আত্মোপলব্ধির বাসনায় ভগবানের কাছে সুমতি প্রার্থনার তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু স্রষ্টার ওপর কতখানি নির্ভর করা চলে? তিনি যে সকলকে সুমতি দেন না, তার প্রমাণ গান্ধীজী নিজেই হয়তো উপলব্ধি করেছিলেন বুলেট প্রাপ্তির সময়। নাথুরাম গড়সে যে স্রষ্টার আশীর্বাদ-প্রাপ্ত নয়, তা আজ সকলের জানা। নৈতিক আদর্শে স্পষ্টতা, সার্বিকতা একান্তভাবে বাঞ্ছনীয়। কবি জেরার্ড হপকীনসের দ্বন্দ্ব উন্মথিত হৃদয় জিজ্ঞাসার ছলে হেনে যায়:

“Thou art just indeed, Lord, if I contend
With thee; but Sir, so what I plead is just.
Why do sinners’ ways prosper? and why must
Disappointment all I endeavor end?
Wert thou my enemy, O thou my friend,
How wouldst thou worse, I wonder, than thou dost defeat,
thwart me? Oh, the sot and thralls of lust
Do in spare hours more thrive than I that spend
Sir, life upon they cause …”

তাই হয়ত ধর্ম থেকে ধর্মশাস্ত্রের চিন্তা থেকে পন্থার দিকে মানুষ ছুটে যায়। তার ফল: হিন্দুর নিকট গোমাংস নিষিদ্ধ। মুসলমানের কাছে মদ্য ও শুয়োরের গোস্ত হারাম। একজন খ্রিস্টান তাবৎ এই তিন পদ মাল পেটে ঢোকায়, অথচ তার ধর্ম-নিষ্ঠা বেমালুম আস্ত থাকে।

 

নতুন লেখার নোটিফিকেশন পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

কপিরাইট সংক্রান্ত

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।

মন্তব্য করুন