বিশেষআবুল হুসেন | বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার পথপ্রদর্শক

আবুল হুসেন | বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার পথপ্রদর্শক

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মাঝে মুক্তচিন্তার যতটুকু প্রভাব দেখা যায়, তার উৎসমূলে আছেন মহান সমাজ সংস্কারক আবুল হুসেন। বিশ শতকের শুরুতে মুসলিম শিক্ষিত সমাজে পরিবর্তনের আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তিনি।

আবুল হুসেন | বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার পথপ্রদর্শক

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মাঝে মুক্তচিন্তার যতটুকু প্রভাব দেখা যায়, তার উৎসমূলে আছেন মহান সমাজ সংস্কারক আবুল হুসেন। বিশ শতকের শুরুতে মুসলিম শিক্ষিত সমাজে পরিবর্তনের আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তিনি।

পৃথিবীর বুকে আরও একজন মুসলমান যাকে সমসাময়িক মুসলমানরা অস্বীকার করেছে এবং মৃত্যুর অনেক পর গৌরব হিসেবে জড়িয়ে ধরেছে। তিনি আবুল হুসেন। ১৮৯৬ সালের ৬ জানুয়ারি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। মায়ের নাম আছিরুননেসা, বাবা হাজী মোহাম্মদ মুসা। মোহাম্মদ মুসা একইসাথে বিশিষ্ট আলেম, অনুসন্ধানী ও জ্ঞানপিপাসু ছিলেন। দাদা মোহাম্মদ হাশিম ছিলেন বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষার পন্ডিত। তিনি জ্ঞানানুরাগী ও সংস্কারবাদী ছিলেন। একজন ধার্মিক পরিচয়ে নীতি নৈতিকতার প্রচার করতেন। চিন্তাচর্চা, বুদ্ধির মুক্তি চেষ্টা এবং সমাজ-সংস্কার তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। পূর্বপুরুষদের ধারাবাহিকতায়  প্রগতি চিন্তার পূর্ণ বিকাশ ঘটে আবুল হুসেনের সময়ে এসে।

ছোটবেলা থেকেই আবুল হুসেন সকলের কাছে সাহসী, স্পষ্টবাদী ও চিন্তাশীল হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। আবুল হুসেনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় নানার বাড়ির পাশের একটি স্কুলে। সেখানে কিছুদিন লেখাপড়া করে তারপর ভর্তি হন ঝিকরগাছার এম.ই স্কুলে, এরপর যশোর জিলা স্কুলে। তিনি স্কুলছাত্র থাকা অবস্থায় সৃজনশীল লেখালেখিতে ঝুঁকে পড়েন। ১৯১৩ সালে স্কুলের রচনা প্রতিযোগিতায় ‘যশোর সরকারি স্কুল পদক’ লাভ করেন। এই স্কুল থেকে ১৯১৪ সালে ১০ টাকা বৃত্তিসহ ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৬ সালে বৃত্তিসহ আই.এ এবং ১৯১৮ সালে বি.এ পাস করেন।

আবুল হুসেন কিশোর বয়সেই ছিলেন উজ্জ্বল চিন্তাশীল ব‍্যক্তি। বি.এ পাস করার পরের বছর তার নাম ছড়িয়ে পড়ে তৎকালীন বুদ্ধিজীবী সমাজে। ১৯১৯ সালের ২৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র সাধারণ অধিবেশনে ‘সুদ বা রেবা ও ধনজ’ শিরোনামে স্বলিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেন। যে প্রবন্ধে তিনি বৈশ্বিক অর্থনীতি আমলে নিয়ে সুদ ব্যবস্থার বৈধতার পক্ষে কথা বলেন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ বিচারে তার এই অবস্থান মুসলমান সমাজে বিতর্কের সৃষ্টি করতে এক মুহূর্ত সময় নেয়নি। অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে আবুল হুসেনের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন।

১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাস করে একই বছর বিখ্যাত হেয়ার স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। এর পরের বছর ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিভাগের প্রভাষক পদে নিযুক্ত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার পর তার সংস্কারবাদী মনে নতুন করে দোল খেতে থাকে। একটি সংগঠন পাকানোর জন্য কর্মযোগী খুঁজতে শুরু করেন। পাশাপাশি নিজের লেখাপড়াও চালিয়ে যেতে থাকেন। একদিকে শিক্ষক, অপরদিকে ছাত্র।

১৯২২ সালে আইন বিষয়ে বি.এল পাশ করার পর সাংগঠিনক কাজে মনোনিবেশ করেন। যার শুরু হয় ১৯২৫ সালে ‘তরুণপত্র’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে। তখনকার প্রকাশনা সমাজে পত্রিকাটি শুরুতেই নজর কাড়ে। এই পত্রিকায় ধর্মান্ধতা এবং ধর্মগ্রন্থের শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে তরুণ সমাজকে জ্ঞানচর্চা ও নতুন নতুন চিন্তার সাথে যুক্ত হওয়ার আহবান জানানো হতো। পত্রিকাটি অল্প সময়ের মধ্যে তরুণদের মাঝে জনপ্রিয়তা লাভ করে। আবুল হুসেন পত্রিকার সম্পাদনা, পরিচালনা এবং পৃষ্ঠপোষকতা একাই করতেন। সে সময় কলকাতা থেকে বিখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘সবুজপত্র’ নামে আরেকটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো। একদিন ঢাকা থেকে প্রকাশিত তরুণপত্র হাতে নিয়ে তিনি মুগ্ধ হলেন। দেখলেন একই কর্মোদ্দেশ্য, একই স্বপ্নের কাগজ। তার সম্পাদিত কাগজে লিখলেন ‘সবুজপত্রে তরুণপত্র’ নামে একটি শুভেচ্ছা প্রবন্ধ। প্রবন্ধের শেষ বাক্য ছিলো – ”সবুজপত্র তাই তরুণপত্রকে ডেকে বলছেঃ ভাই, হাত মিলা না!”

তরুণপত্র ছাড়াও আবুল হুসেন ‘জাগরণ’ ও ‘অভিযান’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। আর শিখা পত্রিকার কথা ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ‘ নিবন্ধে আপনারা ইতিমধ্যে জানতে পেরেছেন। তার উদ্যোগে প্রকাশিত প্রতিটি পত্রিকার স্লোগান ছিলো প্রখর মাত্রায় চিন্তা জাগানিয়া। তিনি যাই লিখেন না কেন, তা একটি বিশাল প্রবন্ধ হোক আর এক বাক্যের স্লোগান হোক, শুভবোধের আহবান তাতে থাকবেই। পরিবর্তনের প্রত্যাশা থাকবেই।

‘তরুণপত্র’র স্লোগান ছিলো ‘যদি সত্যের থাকে বল, তবে নির্ভর চিত্তে চল।’ আবুল হুসেন সন্দেহাতীতভাবে জানতেন তারুণ্যের প্রধান শক্তি ও সাহস হচ্ছে সত্য। তাই তিনি তরুণদের সত্য নির্ভর হয়ে নির্ভীক চিত্তে চলার আহবান জানিয়েছেন। ‘জাগরণ’ পত্রিকার স্লোগান, ‘রাত্রি যে তোর হয়েছে ভোর, কাটবে না কি ঘুমের ঘোর?’ যে পত্রিকার নাম ‘জাগরণ’ সে পত্রিকার এরচেয়ে উৎকৃষ্ট স্লোগান আর কী হতে পারে?

আবুল হুসেন তার চিন্তা প্রকাশে অকপট ও সৎ-সাহসী ছিলেন। তিনি সংস্কারে ভীত সমাজকে সমীহ করতে অপছন্দ করতেন। কে কী বলবে, এই ভয়ে চুপ থাকাকে লজ্জাজনক বিবেচনা করতেন। এ কারণে তিনি যেমন অনেকের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন, তেমনি তার নিন্দুকের সংখ্যাও একেবারে কম ছিলো না।

পত্রিকার পাশাপাশি একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন তিনি। শুধু পত্রিকা দিয়ে বাংলার মুসলমান সমাজে যতটুকু আলো ছড়ানো যাচ্ছে, তাতে সন্তুষ্ট নন আবুল হোসেন। প্রয়োজন সংঘবদ্ধ তৎপরতা, যেন সে আলো ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। কিন্তু সংগঠন ছাড়া তা সম্ভব নয়। তাই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ও শিক্ষককে এক করলেন। যাদের মধ্যে আব্দুল ওদুদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল ফজল ও কাজী মোতাহের হোসেন অন্যতম। এরা সকলে যে সকলের বন্ধু বা সহমতী তা বলা দুস্কর। কিন্তু বাঙালি মুসলমানকে গোঁড়ামি, কট্টরপন্থা ও পরিবর্তন অনিচ্ছুকতা থেকে বের করে এনে জাগরণ অভিযানে সম্পৃক্ত করতে সকলেই একমত ছিলেন।

১৯২৬ সাল। অনেক আশা-প্রত্যাশা নিয়ে ঢাকায় জন্ম হয় একটি সংগঠনের। সংগঠনের নাম ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। আবুল হুসেন নেপথ্যে রইলেন পথনির্দেশক হিসেবে। কারণ ইতোমধ্যে মুসলমান সমাজে তিনি নাস্তিক হিসেবে সন্দেহ পরিচিতি লাভ করেন। তাই সামনে রইলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল ফজলের মত অপেক্ষাকৃত শুদ্ধ মুসলিম ভাবমূর্তির শিক্ষক ও ছাত্ররা। একই সাথে সংগঠনের মুখপত্র হিসেবে আরো একটি পত্রিকা প্রকাশনার উদ্যোগ নেয়া হয়। পত্রিকার নাম রাখা হয় ‘শিখা।’ স্লোগান ঠিক করা হলো “জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।” বরাবরের মত এই পত্রিকার স্লোগানও সন্দেহাতীত তাৎপর্যপূর্ণ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

আবুল হুসেনের সম্পাদনায় ১৯২৭ সালে শিখা পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হলেও পরের সংখ্যাগুলো তিনি সম্পাদনা করেননি। সংগঠনের উপর ঝেঁকে বসা কিংবা কর্তৃত্ব দখল করে রাখার নীতিতে বিশ্বাস করতেন না তিনি। তাইতো নিয়ম করা হলো শিখা পত্রিকার একেক সংখ্যা একেকজন সম্পাদনা করবে এবং সংগঠনের প্রতিটি বার্ষিক সভায় ভিন্ন ভিন্ন সভ্য সভাপতিত্ব করবেন। এমনটিইতো হওয়া উচিত। সমাজকে সংস্কার, উদারতা, প্রগতির বাণী শোনাতে হলে প্রথমে নিজেকে সংস্কারবাদী, উদার ও প্রগতিশীল হতে হয়। না হয় কর্মে সততা থাকে না আর মিথ্যা দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় না।

শিখা পত্রিকার গুণগত মান, কার্যকরিতা ও শক্তিশালী অবস্থানের কারণে মুসলিম সাহিত্য সমাজের সংগঠকরা মূলত ‘শিখা গোষ্ঠী’ নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। শুভাকাঙ্ক্ষীরা  ভালোবেসে, এবং নিন্দুকেরা শ্লেষের সহিত তাদেরকে শিখাগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে আনন্দ পেতেন। পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই বাজিমাত। ধর্মকে পুঁজি করে চলা মেকি বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এমন আঘাতের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাই এর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগতে একটুও সময় নেননি তারা।

১৯২৭ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম অধিবেশনে ‘আদেশের নিগ্রহ’ নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন আবুল হুসেন। প্রবন্ধে তিনি লিখেন, “কোরআন শরিফ পাঠ (তেলাওয়াত) করার হুকুম আজ যেরূপভাবে পালন করা হচ্ছে, তাতে মনে হয়, তেলাওয়াত বন্ধ করে দিলেই মন ও মস্তিষ্কের পক্ষে পরম মঙ্গলকর হবে। সকালে মসজিদের মধ্যে কেরাত করে দলে দলে এক বর্ণও না বুঝে শুধু সওয়াবের লোভে যারা তেলাওয়াত করে তাদের বুদ্ধি যে সিঁকেয় তোলা থাকে তা বলাই বাহুল্য। এই হুকুমের নিগ্রহ প্রকাশ পায় ওই সব তেলাওয়াতকারীর মূর্খতা ও অজ্ঞতার ভিতর দিয়ে।”

একই বছর সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকায় তার লেখা ‘শতকরা পঁয়তাল্লিশ’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধে তিনি ভারতবর্ষে সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের জন্য শতকরা ৪৫ ভাগ কোটা রাখার তীব্র সমালোচনা করেন। তার মতে এমন কোটাপ্রথা মুসলমানদের জন্য চরম অবমাননাকর এবং যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের অন্তরায়। তিনি লিখেন “এর ফলে আমাদের নবীন সম্প্রদায়ের আকাঙ্ক্ষা ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতর হবে, কর্মস্রোতে ভাটা পড়বে, মন সঙ্কীর্ণ হবে, মস্তিষ্ক শ্রমবিমুখ হবে।” কিন্তু তৎকালীন মুসলমান বুদ্ধিজীবী শ্রেণী তার এই আত্মমর্যাদাবোধ-সম্পন্ন বক্তব্য বিদ্রুপের সাথে প্রত্যাখ্যান করে। অবমাননাকর ভাষায় কটাক্ষ, এমনকি ব‍্যক্তি আক্রমণ করতেও পিছপা হয়নি তথাকথিত শিক্ষিত গোষ্ঠী। এর মধ্যে কবি গোলাম মোস্তফার ব্যক্তি আক্রমণ আবুল হুসেনের মনে গেঁথে যায়। জনাব মোস্তফা একই পত্রিকায় ফিরতি প্রবন্ধে বিদ্রুপ করে বলেন, “এই পঁয়তাল্লিশ ভাগ কোটায় আবুল হুসেনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছেন।” গোলাম মোস্তফার এমন নির্বোধ বিরোধিতা পড়ে আবুল হোসেন হতাশ হয়েছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের চাকরি ছাড়তে দুইবার চিন্তা করেননি। তার পদত্যাগের পর বিশেষ কোটা বাতিলের দাবি আরো যৌক্তিকতা পায়। কারণ নিজ যোগ্যতাবলে আবুল হোসেন এই চাকরি পাওয়ার দাবি রাখেন। অথচ তাকেও কোটাভুক্ত হতে হলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছাড়লেও সাংগঠনিক কাজ থেকে বিরত ছিলেন না। কিন্তু বেশিদিন চালিয়ে যেতেও পারলেন না। ১৯২৭ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের অধিবেশনে পঠিত ‘আদেশের নিগ্রহ’ প্রবন্ধটি ১৯২৯ সালে ঢাকার ‘শান্তি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে গোলাম মোস্তফা গং আবুল হুসেনকে বাগে পেয়ে বসেন। তারা যথারীতি এর বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে নেমে পড়েন। প্রবন্ধটির উর্দু সংস্করণ লিখে তা উর্দুভাষী বুদ্ধিজীবীদের কাছেও বিলি করেন। ফলশ্রুতিতে সে বছর ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় আহসান মঞ্জিলে আবুল হুসেনের বিরুদ্ধে বিচার সভা বসে। যে বিচারের রায় আগেই আন্দাজ করতে পারেন তিনি। বিচারে তার বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহ এবং মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগ এনে লিখিতভাবে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। একই সাথে এই ক্ষমাপত্র জনসাধারণকে অবগত করার উদ্দেশ্যে অনুমতি প্রদানের জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। সহযোগী সংগঠকদের অনুরোধে আবুল হোসেন অভিযোগ স্বীকার করে ক্ষমা চান এবং তা মুদ্রণের অনুমতি দেন।

এর আগে খান বাহাদুর আবদুল হাফিজ নামে ঢাকার এক সমাজপতি পিস্তল নিয়ে আবুল হোসেনের বাসায় হাজির হন। তিনি প্রথমে আপত্তিকর লেখার জন্য আবুল হোসেনকে তিরস্কার করেন। এবং বলেন, এ জাতীয় লেখা বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি না দিলে তাকে গুলি করা হবে। আবুল হোসেনের ছোট ছোট সন্তানরা তখন পিতার পাশে এসে দাঁড়ায়। তাদের মুখের দিকে চেয়ে অবশেষে তিনি প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হন।

হাজার বছর ধরে চলে আসা অন্ধকারের নানান সময় নানান সভায় আবুল হোসেনের মত শত শত মানুষকে এমন দস্তখত দিতে হয়েছে। হয়তো আজ থেকে শতবছর আগে দস্তখত দেয়া কেউ আজ দস্তখত নেয়াদের অনুসারীর কাছে পরম পূজনীয় ব‍্যক্তি। এ হচ্ছে সময়ের শরীরে লেপ্টে থাকা নির্লজ্জ তামাশা। যেমন, বর্তমান সময়ে এসে মৌলবাদীদের পত্রিকা দৈনিক সংগ্রামেও আবুল হুসেনের গুনগাণ গেয়ে প্রবন্ধ লেখা হয়। তাকে মুসলিম মনীষী হিসেবে উল্লেখ করে গর্ববোধ করা হয়। আবার একই সাথে বর্তমান সময়ের সংস্কারবাদীদের বিরুদ্ধে ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগ তুলে দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়া হয়!

সুচিন্তিত বক্তব্য দেয়ার অপরাধে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনাকে আবুল হুসেন স্বাভাবিকভাবে নেননি। তিনি মনে করেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের দায়িত্বে থাকার নৈতিক ভিত্তি আর রইলো না। তাই আব্দুল ওদুদকে কর্তব্য-কাজ বুঝিয়ে দিয়ে মুসলিম সাহিত্য সমাজের সভ্য পদ থেকে নিস্তার নেন। পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেন, ”সম্প্রতি ‘আদেশের নিগ্রহ’ নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছে তাতে আমি এটুকু বুঝতে পেরেছি যে, সমাজের প্রকৃত কল্যাণাকাঙ্ক্ষী দার্শনিকের কথায় কেউ কর্ণপাত করবে না, বরং তার কথার উল্টা অর্থ করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করবে।”

আবুল হুসেনের এই ঘটনা শত বছর আগে কলকাতার হিন্দু কলেজকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট নবজাগরণের নেপথ্য নায়ক ডিরোজিও‘র কথা মনে করিয়ে দেয়। ডিরোজিও ‘লোকে কী বলবে’ জুজুকে তুচ্ছজ্ঞান করে সমাজে সুচিন্তার আলো জ্বালিয়েছেন। তিনিও একজন শিক্ষক ছিলেন এবং তাকেও বিচারের মুখোমুখি হয়ে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। কে জানে, হয়তো ডিরোজিওই ছিলেন আবুল হুসেনের উৎসাহ-উদ্দীপনার প্রধান উৎস। কারণ দু’জনের কাজ-কর্ম, অর্জন ও প্রাপ্তিতে বিস্তর মিল পাওয়া যায়।

এর আগে শিক্ষকতার চাকরি ছেড়েছেন, এবার নিজ হাতে গড়া সংগঠন থেকেও পদত্যাগ করলেন। তবে তিনি সংগঠন থেকে নিজেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রাখেননি। ১৯৩২ সাল পর্যন্ত প্রতিটি সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং কোনো কোনো সভায় প্রবন্ধও পাঠ করেন।

চাকরি ছেড়ে ঢাকা কোর্টে আইন ব্যবসায় যোগ দিয়ে এ বিষয়ে আরো উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের উদ্যোগ নেন। ১৯৩১ সালে তিনি ‘মাস্টারস অব ল’ ডিগ্রী লাভ করেন। উল্লেখ্য, বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম এ ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৩২ সালে আবুল হুসেন ঢাকা ছেড়ে কলকাতা চলে যান। সেখানে আইন পেশায় যুক্ত হোন। এ সময় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ‘The History of Development of Muslim Law in British India’ বিষয়ে ‘Tagore Law Lecture’ প্রণয়ন করেন। যা সর্বমহলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়।

আবুল হুসেন কেবল শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন না। তিনি প্রখর রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন একজন মানুষ। তখন রাজনৈতিক বিষয় আসয় নিয়ে প্রবন্ধের পাশাপাশি একাধিক পূর্ণ বইও লিখেছেন। এসব লেখায় তিনি রাজনৈতিক তৎপরতায় মুসলমানদের ‘ভিক্ষাবৃত্তি’ মনোভাব নিয়ে তীব্র সমালোচনা করতেন। তিনি মনে করতেন যোগ্যতা বিচার না করে নিজেদেরকে সংখ্যালঘু বিবেচনা করে সুবিধা গ্রহণের চেষ্টা এ অঞ্চলের মুসলমানদের ভাগ্য পরিবর্তনে কখনো সাহায্য করবে না। বরং তাদেরকে অধিকতর পশ্চাৎমুখী করবে।

মুসলিম লীগের নেতৃত্বে স্বতন্ত্র নির্বাচনের দাবি যখন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী চিন্তাকে গ্রাস করে, তখন ‘আমাদের রাজনীতি’ প্রবন্ধে তিনি লিখেন, “মুসলমান নেতৃবৃন্দ হিন্দু সংখ্যাগুরুদের ভয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন চাচ্ছেন। কিন্তু সে মনোভাব ভিক্ষুকের। ভিক্ষা করে কেউ কখনও শক্তিমান ও মহৎ হতে পারে না। … স্বাতন্ত্র্যনীতি দুর্বলের নীতি। সে নীতির ফল হচ্ছে চিরদাসত্ব (Perptual slavery)। এতে মুসলমানের মনের ভয় কখনও দূর হবে না।”

কলকাতায় আইনপেশা শুরুর পর তিনি লেখালেখির কাজে গতি আনেন। এসময় প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ও বই প্রকাশ করেন। কিন্তু তার এই অগ্রযাত্রা হঠাৎ থেমে যায়। পাকস্থলীতে ক্যান্সার ধরা পড়ে। কিছুদিন রোগযন্ত্রণা ভোগ করার পর ১৯৩৮ সালের ১৫ অক্টোবর সকালে মাত্র ৪২ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আবুল হুসেনের মৃত্যু কেবল মৃত্যু ছিলো না। তিনি চলে যাওয়ার পর অনেক কিছু বাধাগ্রস্থ হয়, অনেক কিছু থেমে যায়। মুসলিম সাহিত্য সমাজের কার্যক্রম আর এগোয়নি। তিনি ছিলেন এই সংগঠনে ঐক্যের কেন্দ্র। তার মৃত্যুর পর সংগঠনের সদস্যদের মাঝে ঐক্য আর নিজেকে খুঁজে পায়নি। তারা একে অপরের সাথে নানান ধরণের ব্যক্তি বিবাদে জড়িয়ে যাওয়ার ফলে এই সংগঠনের সকল কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, ১৯৩২ সালে আবুল হুসেন যখন ঢাকা ছেড়ে কলকাতা চলে যান, এরপর শিখা পত্রিকার আর একটি সংখ্যাও প্রকাশিত হয়নি। মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও শিখা পত্রিকার সকল কৃতিত্ব আবদুল ওদুদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লার মাঝে বণ্টন করে দেয়ার পরও আবুল হুসেনের অনুপস্থিতিতে এমন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যেতে ব্যর্থ হোন তারা। আবুল হুসেনের মৃত্যুর মাধ্যমে বাঙালি মুসলমান সমাজে মুক্তবুদ্ধি ও উদার চিন্তাচর্চা সংগ্রামের আপাতমৃত্যু ঘটে।

মাত্র ৪২ বছরের জীবদ্দশায় আবুল হুসেনের সৃষ্টিকর্মের তালিকা বেশ দীর্ঘ। বই আকারে প্রকাশিত তাঁর রচিত প্রবন্ধসমূহ- বাংলার বলশী, কৃষকের আর্তনাদ, কৃষি বিপ্লবের সূচনা, কৃষকের দুর্দশা, সুদ ও রেবা, শতকরা পঁয়তাল্লিশ, শতকরা পঁয়তাল্লিশের জের, আদর্শের নিগ্রহ, বাঙালী মুসলানের ভবিষ্যৎ, আমাদের রাজনীতি, হিন্দু-মুসলিম প্রবলেম, নিষেধের বিড়ম্বনা।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, আবুল হুসেনের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা সমাজতন্ত্র ঘেঁষা ছিলো। তিনি রাশিয়ার বলশেভিক পার্টির সূচিত বিপ্লব দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। এই অনুপ্রেরণা থেকে অবহেলিত কৃষক সমাজের মুক্তির লক্ষ্যে বাংলার বলশী, কৃষকের আর্তনাদ, কৃষি বিপ্লবের সূচনা, কৃষকের দুর্দশা‘র মত গ্রন্থগুলো রচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। যেসব গ্রন্থ কৃষকশ্রেণীর দাবি নিয়ে ভারতবর্ষে নবগঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সাথে মধ্যবিত্ত সমাজের সম্পর্কস্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বিভিন্ন সভা ও অনুষ্ঠানে তার স্বলিখিত পঠিত প্রবন্ধসমূহ- পর্দা প্রথার সাহিত্যিক অসুবিধা, বাঙালী মুসলমানদের শিক্ষা সমস্যা, মহাত্না আমীর আলী, স্যার সৈয়দ আহমদ, ইসলামের দাবী, তরুন আনসার, শিক্ষার মাপকাঠি।

আবুল হুসেন স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা সাহিত্য, গণিত এবং আইনের পাঠ্যপুস্তকেরও রচয়িতা। সুকোমল পাঠ (১ম-৪র্থ ভাগ), নব সাহিত্য শিক্ষা (৯ম-৪র্থ ভাগ), মুসলিম সাহিত্য শিক্ষা (১ম-৪র্থ ভাগ), সরল নিম্নগণিত (১ম ও ২য় ভাগ), বাংলা রচনা ও অনুবাদ শিক্ষা এবং গবেষণামূলক প্রবন্ধ ব্রিটিশ ভারতে মুসলমান আইন অন্যতম। তার রচিত উল্লেখযোগ্য সমালোচনামূলক গ্রন্থ নারীর অধিকার, এবং সুলতানার স্বপ্ন

তথ্যসূত্র
১. হুসেন, আবুল -বাংলাপিডিয়া
২. বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ও আবুল হুসেন -হাবিব রহমান
৩. আবুল হুসেন পরিচিতি
৪. মুসলিম সাহিত্য সমাজ এর বার্ষিক অধিবেশন: সভাপতিদের অতিভাষণ, হাবিব রহমান সম্পাদিত

নতুন লেখার নোটিফিকেশন পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

কপিরাইট সংক্রান্ত

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।

মন্তব্য করুন