প্রবন্ধদর্শনসংজ্ঞায় ও সংজ্ঞার্থে সেক্যুলারিজম | আহমদ শরীফ

সংজ্ঞায় ও সংজ্ঞার্থে সেক্যুলারিজম | আহমদ শরীফ

জনসংযোগ ব্যতীত অর্থাৎ জনগণকে শিক্ষিত ও দীক্ষিত আর সংগঠিত না করে উপর থেকে চাপিয়ে দিতে গেলে ব্যর্থতা যে অনিবার্য ও অপ্রতিরোধ্য আফগানিস্তানই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আফগানিস্তান থেকে এটিই আমাদের শিক্ষণীয়।

সংজ্ঞায় ও সংজ্ঞার্থে সেক্যুলারিজম | আহমদ শরীফ

জনসংযোগ ব্যতীত অর্থাৎ জনগণকে শিক্ষিত ও দীক্ষিত আর সংগঠিত না করে উপর থেকে চাপিয়ে দিতে গেলে ব্যর্থতা যে অনিবার্য ও অপ্রতিরোধ্য আফগানিস্তানই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আফগানিস্তান থেকে এটিই আমাদের শিক্ষণীয়।

ধর্মনিরপেক্ষতা, ইহজাগতিকতা, বিভিন্ন শাস্ত্রিক সম্প্রদায়ের সংযমে-সহিষ্ণুতায়-সৌজন্যে নির্বিরোধে প্রতিবেশীরূপে বসবাস প্রভৃতি কোনটাই সেক্যুলারিজমকে স্বরূপে জানার, বোঝার ও মানার সহায়ক হয় না। ঐহিক জীবনবাদে কিংবা মর্ত্যজীবনবাদে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন জাত জন্ম বর্ণ ধৰ্ম ভাষা নিবাস পেশার লোক অধ্যুষিত আধুনিক গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিক নির্বিশেষকে কেবল প্রাণীর মানবপ্রজাতিরূপে দেখা-জানা বোঝা ও যথাযোগ্য সুযোগ-সুবিধে দেয়াই জীবন-জীবিকার সর্বক্ষেত্রে-সেক্যুলারিজমের মর্ম কথা। কম্যুনিস্ট তথা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাত-জন্ম-বর্ণ-ধর্ম-ভাষা-নিবাস-ঐতিহ্য সংস্কৃতি প্রভৃতির গৌষ্ঠিক স্বাতন্ত্র্যগৌরব উচ্চারণ রাষ্ট্রিকভাবে নিষিদ্ধ ছিল বলে সেখানে সরকার ছিল বা থাকে আক্ষরিক অর্থেই সেক্যুলার।

অতএব সেক্যুলারিজম স্বরূপে কেবল ‘মানুষ’ পরিচিতিই স্বীকার করে। ব্যক্তির, গোষ্ঠীর, গোত্রের শাস্ত্রিক বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণার-আচারের-আচরণের-পার্বণের স্বাতন্ত্র্য ও অস্তিত্ব, ভাষার পার্থক্য আঞ্চলিক বা নৈবাসিক ব্যবধান সেক্যুলার রাষ্ট্র বা সরকার স্বীকার করে না। সেক্যুলার রাষ্ট্র বা সরকার নাগরিক নির্বিশেষের মর্ত্যজীবন-জীবিকার সর্বপ্রকার চাহিদা মেটানো ও সাচ্ছল্য-স্বাচ্ছন্দ্য উন্নয়ন লক্ষ্যেই কাজ করে। প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার এবং প্রতিটি মানুষকে কাজ দিয়ে বা ভাতা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে সরকারের তথা রাষ্ট্রের। আস্তিক মানুষের শাস্ত্রিক বিশ্বাস সংস্কার-ধারণা, আচার-আচরণ-পার্বণ প্রভৃতি ব্যক্তিক, পারিবারিক কিংবা গৌষ্ঠীক-গৌত্রিক বিষয়রূপেই সরকার জানবে। কিন্তু এসবের অস্তিত্ব রাষ্ট্র বা সরকার স্বীকারই করবে না। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকমাত্রকেই মানুষকে কিংবা ব্যক্তিমানুষমাত্ৰকেই শুধু নাগরিক বলেই জানা এবং তার মর্ত্যজীবনের প্রয়োজন মেটানো। সরকার ঈদের বা পুজোর বা পার্বণের ছুটি দেবে কর্মচারীদের-শ্রমিকদের যেমন দেয় বিয়ের জন্যে, মৃতের সৎকারের-শ্রাদ্ধের জন্যে ব্যক্তিকে। কাজেই আস্তিক মানুষের শাস্ত্রিক বিশ্বাস ও জীবন হবে ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ে সামাজিক সীমায় নিবদ্ধ। অতএব যথার্থ তাৎপর্যে সেক্যুলারিজম স্বরূপে হবে জাত-জম্ম-বর্ণ-ধর্ম-ভাষা-নিবাস-পেশাজাত পার্থক্যের ও স্বাতন্ত্র্যের এবং শাস্ত্রের ও আস্তিক্যের স্থিতি বা অস্তিত্ব রাষ্ট্রিক বা সরকারী স্তরে অস্বীকৃতি।

১৯৭২ সনে বাঙলাদেশের প্রথম সংবিধানে সমাজতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে যে-নীতি ঘোষিত হয়, তা আসলে সমাজতন্ত্রেরই মূলভিত্তি। সমাজতান্ত্রিক সরকার মাত্রই শাস্ত্রে থাকে আস্থাহীন আর রাষ্ট্রিক জাতীয়তায়, সমাজতন্ত্রে ও দলীয় গণতন্ত্রে আস্থাবান। কাজেই কুমীরের এক বাচ্চাকে চার করে দেখানো হয়েছিল মাত্র। তবু সংবিধানটা স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকৃতির ভিত্তিতে মর্তমানবসাম্যের অঙ্গীকারে তৈরি হয়েছিল। তাই এটি যথার্থ সেক্যুলার সংবিধানই ছিল। কিন্তু সরকার সব প্রচল শাস্ত্রের ও শাস্ত্রিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি দান করায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ তাৎপর্যরিক্ত হল অর্থাৎ সব ধর্মশাস্ত্রকে ও সম্প্রদায়কে রাষ্ট্র বা সরকার সমচোখে দেখবে-পক্ষপাতিত্ব করবে না-সবশাস্ত্রের লালনে, রক্ষণ ও প্রয়োজনে সাহায্য-সহায়তা দানই পরিণামে সেক্যুলারিজম নামে আখ্যাত বা অপব্যাখাত হল। আর এ গোঁজামিলের ফাকে বাঙালীসত্তা হারাল গুরুত্ব। সংবিধানও হল আদি ও অকৃত্রিম মুসলিম রাষ্ট্রের দলিল। ভারত ও আরব সাগর থেকে চীনের সীমা অবধি বহুজাতিক ভূখণ্ডগুলোকে অভিন্ন ভারত রাষ্ট্রভুক্ত রাখার মতলবে ১৯৬৩ সনে একবার রাজ্যের বা প্রদেশগুলো বিচ্ছিন্ন ও স্বাধীন হবার সাংবিধানিক ব্যবস্থা রদ করল এবং এ বিশাল ভূভাগ অবিচ্ছিন্ন রাখার মতলবে ১৯৭৬ সনে বিশাল ভারতের নানা রাজ্যে শাস্ত্রিক, গৌত্রিক, ভাষিক, আঞ্চলিক স্বাতন্ত্রের ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের যুক্তিতে বিচ্ছিন্ন ও স্বাধীন হবার স্বপ্ন জনমনে জেগেছে বা জাগছে উপলব্ধি করে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দিভাষীপ্রধান সরকার ১৯৭৬ সনে সেক্যুলারিজমকে সংবিধানে সংযোজিত করে, যাতে জাত জন্ম বর্ণ ধর্ম ভাষা গোত্র নিবাস প্রভৃতির অজুহাতে কোন অঞ্চল বিচ্ছিন্ন বা স্বাধীন হয়ে হাতছাড়া না হয়। ভারতেও তখন থেকেই সেক্যুলারিজম অর্থে সব শাস্ত্রে, ধর্মে ও ধর্মাচারে রাষ্ট্রিক বা সরকারী সমদর্শিতা বলে অপব্যাখ্যাত হতে থাকে, যদিও বাস্তবে এ সাম্রাজ্যবাদী চাল হিসেবেই প্রযুক্ত। যেমন ভিন্ন ধর্মের শিখদের কিংবা কাশ্মীরের মুসলিমদের অথবা রক্তে, ভাষায়, ধর্মে, নৈবাসিক অবস্থানে ইংরেজ পূর্বকালের ভারতবহির্ভূত নাগা, কুকি, মণিপুরী, বড়ো, খাসিয়া, গারো, গোধা, ত্রিপুর, হাজং, চাকমা প্রভৃতি অধ্যুষিত তথাকথিত ভারত রাজ্যগুলোকে স্বাধীনতা দিচ্ছে না ওই সেক্যুলার রাষ্ট্রাদর্শের নামে এবং বিচ্ছিন্নতার সাংবিধানিক ব্যবস্থা অনস্তিত্বে বিলুপ্ত বলে। নাগরিকদের সেক্যুলার আদর্শে দীক্ষিত করার কোন চেষ্টাই হয়নি। বরং মুসলিমদের গো বধ করার অধিকার হরণ করে তথা হিন্দুর স্বার্থে গো-বধ নিষিদ্ধ করে সেক্যুলারিজমের গোড়াই শেকড়সমেত উৎপাটন করা হল। ফলে আজো ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণহিন্দুর সেক্যুলার শাসনেই অহিন্দু শিখ-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান-মুসলিম এবং ছুৎ-অচ্ছুৎ নিম্নবর্ণের হিন্দু, আদিবাসী, উপজাতি, জনগোষ্ঠী বর্ণহিন্দুর হাতে শোষিত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত ও নিহত হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। এ যুগে মানবমুক্তি নিহিত রয়েছে সেক্যুলারিজমে। কেননা, সেক্যুলার হওয়ার জন্যে বিজ্ঞানের তথ্যে আস্থা, যুক্তিবাদিতা, বিবেকানুগত্য, পরমত-পরকর্ম-পরআচরণ সহিষ্ণুতা, ন্যায্যতা প্রভৃতি উদারতার সঙ্গে কল্যাণকর সবকিছুর গ্রহণে, মানুষমাত্রকে অভেদে জ্ঞাতি ভাবা প্রভৃতি গুণের ও শক্তির বিকাশ প্রয়োজন হয়। এ তাৎপর্যে সেক্যুলারিজম ও মনুষ্যত্ব অভিন্নাত্মক ও অভিন্নার্থক। একজন সেক্যুলার ব্যক্তি একজন মানবিক গুণসম্পন্ন মানবতাপ্রতীক সংস্কৃতিমান মানুষ। সেক্যুলার ব্যক্তিমাত্রই অপরিচিত বিপন্ন মানুষের অভয় শরণ। অতএব সংস্কৃতি, মনুষ্যত্ব, মানবতা প্রভৃতির প্রতীক, প্রতিম ও প্রতিভূ হচ্ছে সেক্যুলার ব্যক্তি ও সেক্যুলারিজম।

১.
একটি বিবেচ্য প্রস্তাব

প্রাণীজগতে খাদ্য-খাদক সম্পর্কটা প্রধান ও প্রবল। আবার খাদ্য-খাদক সম্বন্ধ না হলেও প্রজাতিগত দ্বেষ-দ্বন্দ্বও থাকে। যেমন সাপ-নেউল, বাগ-মোষ, সিংহ-হাতী প্রভৃতি। আর মানুষের মধ্যে তো জাত-জন্ম-বর্ণ-ধর্ম-ভাষা-নিবাস-পেশাগত দ্বেষ-দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ-সংঘাত। তো সুপ্রাচীন কাল থেকেই আজো প্রায় সমভাবে রয়েছে। তবু আর কিছু প্রাণীর মধ্যে রয়েছে নিরুপদ্রব-নিরাপত্তায় সহাবস্থানের প্রবৃত্তি। ওদেরও অবশ্য নিজেদের মধ্যে সময়বিশেষে ও বস্তুবিশেষে খাদ্য কাড়াকাড়ি, দ্বন্দ্ব-বিবাদ কদাচিৎ দেখা যায়। কোন কোন উদ্ভিদও নাকি কীট-পতঙ্গাদি প্রাণীভুক। আমরা জানি মানুষ ব্যতীত অন্য জীব-উদ্ভিদ সহজাত বৃত্তি-প্রবৃত্তি চালিত জীবনী যাপন করে। কিন্তু মানুষের সংস্পর্শে এসে অর্থাৎ মনুষ্যপোষ্য ও লালিত হলে যথাপ্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পেলে তাদের মধ্যেও মানবিক গুণের তথা সংস্কৃতির সংযম, সহিষ্ণুতা ও সজ্জনতা কিংবা হৃদয়ের ও মগজের অনুশীলনে এক প্রকারের যৌক্তিক-বৌদ্ধিক-বিবেকী-বিবেচনাশক্তি অর্জন বা আয়ত্ত করে, যার ফলে ভাষিকভাবে হৃদয়ের কথা, কাজের কথা, আচরণের কথা প্রয়োজনের কথা, জানানো শোনানো-বোঝানো না গেলেও ইশারায়-আভাসে মনোভাবে প্রকাশ ও বিনিময় করা সম্ভব ও সহজ হয়। আমরা সার্কাসে-সিনেমায় নয় শুধু, অন্যত্রও অন্য কাজেও অনেক পশু পাখি-মাছ ব্যবহার করি। এ সূত্রে এখানে বাজ, পায়রা, বানর, শিমপাঞ্জি, গরিলা, হাতী, ঘোড়া, কুকুর, কুর্ম, ডলফিন প্রভৃতির অসামান্য বোধশক্তি ইঙ্গিত বোঝার সূক্ষ্মবুদ্ধি প্রভৃতি স্মরণ করতে পারি।

প্রশিক্ষণে পশু-পাখি-মাছ-গরু-ছাগল-ভেড়া-ঘোড়া-হাতী-সিংহ-কুকুর-বেড়াল প্রভৃতি যেখানে জম্মগত বৃত্তি প্রবৃত্তি সংযত, পরিশীলিত, এমন কি পরিবর্তন করতে পারে ও করে সেখানে তাদের মগদী বুদ্ধিমত্তা অস্বীকার করা যায় কি? কুকুরের, ঘোড়ার, হাতীর আনুগত্য তো আমরা চোখেই দেখি ও জানি, এমনকি বাজের ও পায়রার অনন্য বুদ্ধিমত্তা ছাড়াও মোরগের, ষাঁড়ের, মোষের মতো একটা লড়াকু রূপও রয়েছে। বিশেষ করে এমন সুশীল পায়রা ও মোরগ যখন প্রশিক্ষণ পেয়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে প্রভুর নির্দেশে মরণপণ যুদ্ধ শুরু করে তখন তার সাহস, শক্তিমত্তা ও হিংস্রতা দেখে বিস্মিত হতে হয়।

তা হলে আমরা যারা মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণী মাত্ৰকেই কেবল সহজাত ও প্রাকৃত বৃত্তি-প্রবৃত্তি চালিত যান্ত্রিক ও মন-মননবিহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত বলে জানি ও মানি এবং মৌমাছিতন্ত্রে আস্থা রাখি, আমাদের সে-ধারণা কি তত্ত্ব, তথ্য ও সত্য ভিত্তিক?

একালে আমরা বিজ্ঞানের প্রসাদে সঙ্করজাতের জীব-জন্ত-মানুষ-তরুলতা সব সৃষ্টি করে চলেছি। আমরা এখন তিন সপ্তাহের মধ্যে গর্ভের শিশুর লিঙ্গও বদলে দিতে পারি, আমরা টেস্ট টিউবে প্রাণী জন্মাতে পারি, আমরা শরীরের অস্থি-চর্ম নয় শুধু, দেহের ভেতরকার বহু কিছু মেরামত করতে, কাটা, ছেঁড়া করতে, বদলাতে ও বাদ দিতে পারি। এমন কি হৃৎ-বৃক্ক প্রভৃতিও বদলাতে পারি।

তা হলে আমাদের মানুষের স্বভাব-চরিত্র কেন সম ও সহস্বার্থে সংযমে, পরমত পরকর্ম-পরআচরণ সহিষ্ণুতায়, সাময়িক সহযোগিতায় ও বিনিময়ে সহাবস্থান করার মতো করে গড়ে তুলতে পারব না? কেন মনের, মগজের, মননের, মনীষার, মর্মের সংকীর্ণতা মোচন করতে পারব না? কেন আমরা ‘ভুমৈব সুখম’ ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ তত্ত্বে মানুষকে দীক্ষিত করতে পারব না, কেন বোঝাতে পারব না যে নির্বিরোধে, নির্বিবাদে, নিরুপদ্রবে, নিরাপদে সম ও সহস্বার্থে সংযমে সহিষ্ণুতায় ও সৌজন্যে সাময়িক সহযোগিতায় সহাবস্থানেই সুখ-শান্তি, আনন্দ-আরাম মেলে ও মানবিক গুণের প্রসার ঘটে? কেন বুঝব না সেক্যুলার হওয়াতেই নিহিত রয়েছে মানবমুক্তি?

২.
আর একটি বিবেচ্য প্রস্তাব

সমাজ পরিবর্তনের জন্যে মন-মানসিকতার পরিবর্তন আবশ্যিক ও জরুরী। কারণ নতুন তত্ত্ব, তথ্য ও সত্য গ্রহণ-বরণের জন্যে পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণা, নীতি-নিয়ম, রীতি-রেওয়াজ, বিধি-নিষেধ, প্রথা-পদ্ধতি বর্জন করে মনে-মগজে-মননে ঠাঁই শূন্য করা প্রয়োজন। যেমন নতুন পত্রের জন্যে বৃক্ষ-লতা পুরোনো পাতা বর্জন করে, যেগুলো আগে ওই তরুলতার জন্যে খাদ্য সংগ্রহ করত। বৃদ্ধি পেতে হলে, এগিয়ে যেতে হলে পুরোনোকে অকৃতজ্ঞের মতো পরিহার করতেই হয়, নইলে জীবন বাড় পায় না, গতি পায় না, অভীষ্ট সিদ্ধ হয় না। আমাদেরও ঘরোয়া জীবনে একটা প্রবচন রয়েছে, ‘বাড়ি না ছাড়লে বড়ো হয় না’। আত্মবিকাশের জন্যে নতুন পুঁজি-পাথেয় যোগাড়ের জন্যে কাঙ্ক্ষা- উদ্যম-উদ্যোগ অঙ্গীকার নিয়ে দিকবিদিকে ছুটে বেড়াতে হয়।

কাজেই আমরা যারা সমাজ পরিবর্তন চাই, সমাজতন্ত্র চাই, মানুষ নির্বিশেষকে তার খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জম্মগত অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, আমাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে আমাদের আশৈশব শ্রুত, দৃষ্ট, লব্ধ, অভ্যস্ত, পোষ্য বিশ্বাস সংস্কার-ধারণা, ভয়-ভক্তি-ভরসা, লাভ-লোভ-স্বার্থবোধ পরিহার করার সচেতন সযত্ন প্রয়াসে বা অনুশীলনে নিষ্ঠ হওয়া।

আর প্রথমত, প্রাকৃতিক নিয়মচালিত বিশ্বতত্ত্বে আস্থাবান হওয়া। সূর্যের নৈকট্য ও দূরত্বই জীব-উদ্ভিদ জগতে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছে, একেই বলে বৈচিত্র্যে ঐক্য। একেই বলে নিয়মের রাজত্ব। কেননা জল-বায়ু-মাটি-তাপের তারতম্যই বৈচিত্র্যের কারণ, বিনে কারণে কোনো কার্য হয় না।

দ্বিতীয়ত, আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক হতেই হবে। বিজ্ঞানের তত্ত্বে, তথ্যে ও সত্যে আস্থা রাখা আবশ্যিক। বিজ্ঞানীর আবিষ্কার, উদ্ভাবন, সৃষ্টি, প্রমাণিত ও প্রমাণসম্ভব জ্ঞান আন্দাজ-অনুমান-ধারণা প্রভৃতির মতো প্রাতিভাসিক সত্য বা তথ্য নয়। বিজ্ঞানলব্ধ জ্ঞান অসম্পূর্ণ হতে পারে, কিন্তু মিথ্যা বা ভিত্তিহীন নয়।

তৃতীয়ত, মানুষকে জাত জম্ম বর্ণ ধর্ম ভাষা নিবাস যোগ্যতা নির্বিশেষে কেবল মানুষ রূপে জানতে ও মানতে হবে। তা হলেই আমাদের মানবিক গুণের তথা মানুষ্যত্বের বিকাশ, উৎকর্ষ এবং প্রয়োগ ব্যক্তিক জীবনে, সমাজে, সরকারে ও রাষ্ট্রে সম্ভব। এবং বৈশ্বিক-আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মানুষে মানুষে ভেদ ঘুচে যেতে পারবে এ চেতনার উন্মেষে, বিকাশে সংরক্ষণে। আমরা সহজেই হতে পারব মনে-মর্মে-ভাব-চিন্তা-কর্ম-আচরণে যথার্থ সেক্যুলার। মানুষের প্রথম পরিচয় সে মানুষ, তার শেষ পরিচয়ও সে মানুষ।

আর স্বদেশে স্বরাষ্ট্রেও জাত জম্ম বর্ণ ধর্ম ভাষা নিবাস যোগ্যতা নির্বিশেষে ব্যক্তিমাত্রকেই একাধারে ও যুগপৎ মানুষ, নাগরিক ও বাঙালী-বাঙলাদেশী বলে গ্রহণ বরণ করতে বাধবে না। মানুষ, নাগরিক, বাঙালি ও বাঙলাদেশী তখন অভিন্নার্থক ও অভিন্নাত্মক হয়ে উঠবে। স্বদেশে আমরা মানুষকে ভালবাসতে শিখলে ও জানলে মতের পথের-বর্ণের-ভাষার-যোগ্যতার পার্থক্যজাত হিংসা-ঘৃণা থাকবে না, থাকবে না দ্বেষ-দ্বন্দ্ব, যার সাম্প্রতিক নাম সাম্প্রদায়িকতা। শাস্ত্রিক, ভাষিক, আঞ্চলিক, বার্ণিক, শ্রেণীক স্বাতন্ত্র, বিচ্ছিন্নতা, দ্বেষ-দ্বন্দ্ব, প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রভৃতির অবসান ঘটানোর জন্যেও আমাদের অন্তর্লোকে সংযমের, সহিষ্ণুতার, সৌজন্যের, ন্যায্যতার ও বিবেকানুত্যের অনুশীলন আবশ্যিক।

আর সর্বোপরি আমাদের মধ্যে যুক্তিবাদের (র‍্যাশনালিজমের মূল্য-মর্যাদা ও গুরুত্ব চেতনা জাগরূক রাখতে হবে। যৌক্তিক-বৌদ্ধিক জীবনযাপনই হবে আমাদের লক্ষ্য। বুদ্ধির সঙ্গে জ্ঞানের, সাহসের সঙ্গে শক্তির, কর্মের সঙ্গে নিষ্ঠার লক্ষ্যের সঙ্গে সততার, উদ্যমের সঙ্গে উদ্যোগের, অঙ্গীকারের সঙ্গে আয়োজনের ও প্রয়োগের সংযোগ ঘটলে সমাজ পরিবর্তনে সাফল্য সম্ভব। এসব গুণের ও যোগ্যতার, আদর্শের ও লক্ষ্যের প্রয়োজন কৃষক-শ্রমিক-সমাজবাদী কর্মীর ও নেতামাত্রেরই।

জনসংযোগ ব্যতীত অর্থাৎ জনগণকে শিক্ষিত ও দীক্ষিত আর সংগঠিত না করে উপর থেকে চাপিয়ে দিতে গেলে ব্যর্থতা যে অনিবার্য ও অপ্রতিরোধ্য আফগানিস্তানই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আফগানিস্তান থেকে এটিই আমাদের শিক্ষণীয়।

৩.
আধুনিক রাজনীতি পার্থিব : ধর্ম স্বর্গীয়

আমাদের মানতেই হবে যে মর্ত্যজীবনই বাস্তব ও প্রত্যক্ষ। কাজেই আমাদের পক্ষে সেক্যুলার চিন্তা-চেতনাকে ও কর্ম-আচরণকেই কল্যাণের জন্যেই গুরুত্ব দেয়া আমাদের ব্যক্তিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক জীবনে-প্রশাসনে আবশ্যিক ও জরুরী। কেননা জীবনের জন্যে ধর্ম, ধর্মের জন্যে জীবন নয়, তেমনি জীবনের জন্যে রাজনীতি, রাজনীতির জন্যে জীবন নয়, তেমনি ধর্মের জন্যেও রাজনীতি নয়, রাজনীতির জন্যেও ধর্ম নয়। তা হলেই সরকার, রাষ্ট্র ও রাজনীতিকরা নিবদ্ধ থাকবে মানুষের মর্ত্যজীবনের, পার্থিব জীবনের চাহিদা, সঙ্কট, সমস্যা, প্রভৃতিতে। বস্তুত সরকার তো মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অন্ন, বস্ত্র, নিবাস, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবিকাব্যবস্থা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয়ের চাহিদা মেটানোর দায়িত্বেই নিযুক্ত থাকার কথা। লোকের পারলৌকিক জীবনের সুব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য হতে পারে না। কেননা, আধুনিক রাষ্ট্র কমবেশি গণমানবের অধিকার স্বীকার করে। আর গণমানবেরা সাধারণত বিভিন্ন ধর্মের ও মতবাদী সম্প্রদায়ের হয়ে থাকে। কাজেই সরকারের পক্ষে সব ধর্মশাস্ত্রে বিশ্বাসীদের ঐহিক ও পারত্রিক উপকার একাধারে ও যুগপৎ করা অসম্ভব। এ জন্যেই গণতান্ত্রিক কিংবা রাজতান্ত্রিক অথবা নায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সেক্যুলার হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

আধুনিক রাজনীতি হচ্ছে বাস্তব জীবন ও জীবিকা সম্পৃক্ত। পার্থিব জীবনের লাভ ক্ষতি, আয়-উন্নতি, গণমানবের জীবনের নানা চাহিদা-সরবরাহ সম্পৃক্ত কাজই সরকারী ও রাষ্ট্রিক দায়িত্বের ও কর্তব্যের বিষয়। এখানে শাস্ত্রের স্থান নেই। ধর্মবিশ্বাস থাকবে ব্যক্তির বুকে ও মুখে, মনে ও মর্মে, আচারে ও আচরণে পারিবারিক সামাজিক জীবনে। কাজেই আধুনিক রাজনীতি নিতান্ত মাটিলগ্ন মর্ত্যের বিষয়, আর ধর্ম হচ্ছে ইহ-পরলোকে প্রসূত জীবনের কল্যাণ সম্পৃক্ত। কাজেই তার স্থান ভাত-কাপড়, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, লাভ লোভ-স্বার্থ-জীবিকা সম্পৃক্ত হতেই পারে না। কেননা সব ধর্মশাস্ত্রের বিধি-নিষেধ একরূপ নয়। তাই আধুনিক রাজনীতিতে ধর্মের ঠাই নেই। রাজনীতি পার্থিব আর ধর্ম হচ্ছে স্বর্গীয়। অতএব রাজনীতিকদের কাছে আমাদের সবিনয় নিবেদন তারা যেন প্রাত্যহিক প্রয়োজনের রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কথা তার আদর্শ-উদ্দেশ্য-লক্ষ্য মিলিয়ে মিশিয়ে রাজনীতির এবং শাস্ত্রের লক্ষ্যিক পার্থক্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে অকারণ-বিবাদ-বিরোধ-দ্বেষ দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি না করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষকদের আবেদনে সাড়া দিলে রাজনীতিকরা নিজেরা এবং দেশবাসীরা নিরাপদ-নিরুপদ্রব-জীবনের আশ্বাস পাবেন। শিক্ষকরা বলেছেন রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, ধর্মের উল্লেখ বন্ধ করতে ও নিষিদ্ধ করতে।

 

নতুন লেখার নোটিফিকেশন পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

কপিরাইট সংক্রান্ত

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।

মন্তব্য করুন