আঠারো, ঊনিশ বা বিশ শতকে এই অঞ্চলে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমাজ, বঙ্গীয় মুসলিম সমাজ, বঙ্গীয় মুসলিম উন্নয়ন সভা সহ অনেক ধরনের সভা সমিতি ছিলো। সংগঠনের নামের সাথে ‘পুরুষ’ শব্দটি ছিলো না, কিন্তু এর সবগুলোই ছিলো পুরুষের সমাজ, পুরুষের সভা, পুরুষের সমিতি। কারণ এখনো সমাজ মানেই পুরুষের সমাজ, সভা মানেই পুরুষের সভা। তাই নারীরা কোন কিছু করতে গেলে তখন নামের সাথে ‘নারী’ বা ‘মহিলা’ শব্দটি যুক্ত করে লিখতে হয় ‘নারী সাহিত্য সমাজ’ বা ‘নারী উন্নয়ন সমিতি’ ইত্যাদি। আমরা এবং আমাদের সমাজের বদ্ধমূল ধারণা ‘পেশাসমূহ’ মূলত পুরুষের। যেমন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিক্ষক হবেন পুরুষরা। কোন নারী যদি এসব পেশায় আসে তাহলে পেশার নামের সাথে আ-কার, ই-কার, নারী-কার বসিয়ে উপযোগী করে নিতে হবে।
অবশ্য অনেকদিন ধরে ‘মহিলা কবি’ শব্দটা শোনা যায় না। আমরা এখন সুফিয়া কামালকে ‘কবি সুফিয়া কামাল’ই বলি। তার মেয়ে সুলতানা কামালকে ‘নারী মানবাধিকার কর্মী’ না বলে মানবাধিকার কর্মী বলি। তার মানে পরিবর্তন হয়েছে। শুধু পরিবর্তন না, সত্যিকার অর্থে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। আর এই পরিবর্তনের শুরু হয় রুকাইয়া খাতুন নামে এক অসামান্য মানুষের হাত ধরে যিনি পরবর্তীতে ‘বেগম রোকেয়া’ নামে পরিচিতি লাভ করেন।
ভারতবর্ষে মুসলমানদের অগ্রযাত্রা সবসময় বাধাগ্রস্থ হয় ধর্মীয় কারণে। যেকোন প্রগতি বা উন্নতি শুরুতে একবাক্যে ফিরিয়ে দেয় মুসলমানরা। এই উন্নতি হারাম, ওই প্রগতি অনৈসলামিক, সেই পরিবর্তন ইহুদী খ্রিস্টানদের -এসব বলে বলে সবসময় প্রগতির দৌড়ে অন্য ধর্মের মানুষদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে। পরে একসময় ঠিকই এসব পরিবর্তন মেনে নেয়, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। এ কারণে মুসলমান সমাজে যেকোন পরিবর্তনের শুরুটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই বাঙালি মুসলমান নারীদের মাঝে শিক্ষা ও অধিকার আদায় আন্দোলনের সূচনা করার কারণে বেগম রোকেয়া আমাদের কাছে মহানের চেয়েও মহান হয়ে আছেন, থাকবেন।
ভারতবর্ষে মুসলমানদের উচ্চশিক্ষা থেমে ছিলো গুনে গুনে ১০৯ বছর। ১৮১৭ সালে হিন্দুরা যখন ব্রিটিশ রাজের কাছ থেকে কলকাতা হিন্দু কলেজ আদায় করে নেয়, তখন মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষাকে হারাম টারাম বলে এড়িয়ে যায়। কেউ এগিয়ে এসে মুসলমানদের জন্য একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেনি। তারপর ১০৯ পর্যন্ত আর ‘কেউ না কেউ’ এগিয়ে আসেনি। ১৯২৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শত বছরের মূর্খতার অবসান হয়। অর্থাৎ বেগম রোকেয়া যদি ওই সময় নারী শিক্ষার কথা না বলতেন, অবরোধ বাসিনীদের সার্বজনীন সমাজের অংশীদার হতে না বলতেন, তাহলে হয়তো এরকম শত বছর কেটে যেত এবং কোন পরিবর্তন হতো না।
সময় হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে বেগম রোকেয়া যখন নারী শিক্ষার কথা বলেছিলেন তখন মুসলিম পুরুষদেরই উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা ছিলো না। বুঝুন মুসলমান সমাজ কতটা পিছিয়ে ছিলো। আর বিশেষভাবে নারীদের জন্য সমাজটা কেমন ছিলো তা বেগম রোকেয়ার ‘অবরোধ বাসিনী’ পড়লে বুঝা যায়। এরকম একটি সমাজে তিনি নারী শিক্ষার কথা বলার সাহস করেছেন, ঘর হতে বেরিয়ে আসতে বলেছেন, পুরুষের সমকক্ষ হয়ে অফিস আদালতে কাজ করতে বলেছেন। এমন কথা এই অঞ্চলে এর আগে কোন মুসলিম নারীতো দূরে থাক, শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে থাকা হিন্দু নারীরাও বলেনি। রোকেয়ার আগে যেসব হিন্দু নারী প্রগতিশীল কাজে যুক্ত ছিলেন, তারা ‘নারীর শিক্ষা গ্রহণ’ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিলেন। রোকেয়াই প্রথম নারী, যিনি পুরুষের সমকক্ষ হওয়ার আওয়াজ তোলেন।
অসীম সাহসী এ মানুষটির জন্ম ১৮৭৮ সালে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার অন্তর্গত পায়রাবন্দ ইউনিয়নে।[১] রোকেয়ার পিতা জহীরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের এবং মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। আলী হায়দার সাহেবের আরো তিনজন স্ত্রী ছিলেন। এর মধ্যে দুইজন ছিলেন বিদেশিনী। সর্বশেষ বিদেশিনীর সাথে বেশিদিন বন্ধন টিকেনি। তাকে বাদ দিলে রোকেয়ার বাবা তিন স্ত্রী নিয়ে থাকতেন। রোকেয়ার মা রাহাতুন্নেসা সাবেরা ছিলেন প্রথম স্ত্রী। তার তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। বোনদের মাঝে বেগম রোকেয়া দ্বিতীয়।
বেগম রোকেয়ার বাবা নিজ বিবাহের বেলায় খুব উদার থাকলেও নারী শিক্ষার বেলায় ছিলেন রক্ষণশীল। এমনকি আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় নিজের পারদর্শিতা থাকা সত্ত্বেও পরিবারের মেয়ে শিশুদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। ছেলেদেরকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে আলী হায়দার সাবের ছিলেন যথেষ্ট যত্নবান। এর বিপরীতে পরিবারে মেয়েদের শিক্ষা দীক্ষা এক প্রকার নিষিদ্ধ ছিলো। রোকেয়ার দুই ভাই ছিলেন আধুনিকতা ও প্রগতির পক্ষে। মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান আবু যায়গাম সাবের কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে লেখাপড়া করেন। ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি দর্শনের সাথে পরিচিত হয়ে নিজেরা যে সুফল লাভ করেছেন, বোনকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে কার্পণ্য করেননি তারা। ফলে এক পুরুষের (বাবা) বাধায় রোকেয়া পিছিয়ে পড়তে গিয়েও দুই পুরুষের (ভাই) সহায়তায় এগিয়ে গেলেন অনেক দূর।
নিজের এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য মুসলিম নারীদের এগিয়ে নেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। এই প্রাণপণ চেষ্টা সে সময়ের চেষ্টা, যখন নারীর আকাশে কেবল পুরুষের ঘুড়ি উড়ে বেড়াতো। তাদের নিজস্ব কোন চেতনা ছিলো না, নিজেদেরকে অবলা ভিন্ন মানুষ ভাবার সাহস ছিলো না। স্বামীর পায়ের জুতার তলার মাটিকেও পবিত্র ভাবতো কারণ এর নিচে নাকি বেহেশত আছে। পর-পুরুষের সাথে দেখা হয়ে গেলে গুনাহ হবে -এই ভয়ে বন্ধ ঘরে আগুনে পুড়ে মরেছে। এক কথায় নিজের দেহ, মন, জীবনের প্রতি নিজের মালিকানা অনুভব করতো না। এমন পরিস্থিতিতে বেগম রোকেয়া সুধালেন পুরুষ এবং নারী উভয়ে মানুষ ভিন্ন অন্য কিছু না। কেউ কারো মালিক নয়, কেউ কারো সম্পত্তি নয়। রোকেয়া বলেছেন চিন্তার দাসত্ব থেকে বেরিয়ে স্বাধীন হতে। বলেছেন পুরুষের সমকক্ষ হওয়ার জন্য যা করা প্রয়োজন ঠিক তাই করতে।
পুরুষের সমক্ষমতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জ্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডী কেরাণী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডী ম্যাজিষ্ট্রেট, লেডী ব্যারিস্টার, লেডী জজ-সবই হইব! পঞ্চাশ বৎসর পরে লেডী Viceroy হইয়া এ দেশের সমস্ত নারীকে “রাণী” করিয়া ফেলিব!! উপার্জ্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কি নাই? যে পরিশ্রম আমরা “স্বামী’র” গৃহকার্য্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব না?
– স্ত্রীজাতির অবনতি, মতিচূর (প্রথম খন্ড) -বেগম রোকেয়া
বেগম রোকেয়া বুঝতে পেরেছেন আসল সমস্যা কোথায়! নারীকে তার যোগ্যতা ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে পুরুষের মতই অর্থ উপার্জন করতে হবে। তিনি কেন সমকক্ষ হওয়ার উপর জোর দিয়েছেন, তার উপযুক্ত কারণ আছে। পুরুষের কর্তৃত্ব-পরায়ণ মনোভাবের শিকড় কোথায় বুঝতে পারলে কারণটাও জানা যাবে।
পুরুষেরা নারীদের উপর কৃর্তত্বশীল এ জন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোক চক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাযত করে।
– কোরআন ৪:৩৪
পুরুষের রচিত ধর্মগ্রন্থগুলো এসব যুক্তিতে পুরুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে এবং নারীকে বানিয়েছে পুরুষের সম্পত্তি। যুগ যুগ ধরে এভাবেই পুরুষ শ্রেষ্ঠ হয়েছে। শ্রেষ্ঠ হওয়ার এরচে সহজ উপায় ধর্মগ্রন্থ লেখকদের জানা ছিলো না। সুতরাং যার শ্রেষ্ঠত্বের কারণে তুমি অবরোধ বাসিনী, তার শ্রেষ্ঠত্বে আঘাত করো। অর্থাৎ উপার্জন করো। স্বজনদের মধ্যে যারা পুরুষ, তারা যদি ধর্মগ্রন্থমতে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে না চায়, তাহলে নারী স্বজনের উপার্জনে তার অসুবিধা হবে না বরং সুবিধা হবে।
শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, ঘর থেকে বের হয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হবে, চাকরি বা ব্যবসা করতে হবে, নিজের দরকারি জিনিসগুলো নিজে গিয়ে কিনতে হবে – বর্তমান যুগের প্রেক্ষিতে এই সহজ কথাগুলো সেই যুগের সবচে কঠিন কথা ছিলো। বেগম রোকেয়া সব কিছুর আগে নিজের দুর্নিবার ইচ্ছে ও নিরলস চেষ্টা নিশ্চিত করেছেন। পরে বড় বোন, বড় ভাই ও স্বামীর সহযোগিতায় সেই কঠিনকে ধাপে ধাপে সহজ করে নিয়েছেন।
পাঁচ বছর বয়সে কলকাতা যাওয়ার পর একজন বিদেশি শিক্ষিকার কাছে কিছুদিন লেখাপড়া শিখেন। কিন্তু সমাজ ও আত্মীয় স্বজনদের প্রতিরোধের মুখে তা বন্ধ হয়ে যায়। রোকেয়ার বড় বোন করিমুন্নেসা তার ভাইদের সহযোগিতায় কিছুদূর লেখাপড়া শিখেন। ছোট বোনের আগ্রহ দেখে তিনি তার সাধ্য অনুযায়ী রোকেয়াকে সহযোগিতা করেন। দুই ভাই ও বড় বোনের কল্যাণে অল্প সময়ে বাংলা-ইংরেজি দুই ভাষা অল্প স্বল্প রপ্ত করতে সক্ষম হন।
রোকেয়ার জ্ঞানার্জনের স্বপ্নতরী বার বার দস্যু আক্রান্ত হলেও ধর্ম ও সমাজ নামের এসব দস্যু মোকাবেলার রসদ তার কাছে ছিলো। আর সেই রসদ ‘নিজ লক্ষ্যে অবিচল থাকা’ ছাড়া অন্য কিছু নয়। রোকেয়া ঠিক ঠিক বুঝেছিলেন তার পায়ের তলার মাটি কিছুটা নড়বড়ে হলেও এই মাটি দেড় হাজার বছর আগের মাটি নয়। তিনি খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন মেয়েদেরকে যে সময়জ্ঞানের শিক্ষা দেয়া হয় তা ভুল। তাই তিনি সাহসের বিনিময়ে সময় কিনেছেন, তিনি তার বর্তমানে থেকেছেন এবং আমাদের জন্য ভবিষ্যত নির্মাণ করেছেন।
রোকেয়ার সংগ্রাম মোটেও সহজ ছিলো না। জীবনের অনেক কিছু বিসর্জন দিয়ে তাকে বাঙালি মুসলিম নারীর জন্য ভবিষ্যৎ তৈরি করতে হয়েছে। প্রথম বিসর্জন রচিত হয় রোকেয়ার বিয়ের মাধ্যমে। বড় ভাই ইব্রাহীম নিজে পাশ্চাত্য দর্শন দ্বারা কিছুটা প্রভাবিত হলেও ৪০ বছর বয়স্ক এক বিপত্নীকের সাথে ছোট বোনের বিয়ে দেন। ওই ব্যক্তির নাম সাখাওয়াত হোসেন, পেশায় ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি রোকেয়ার ভাই ইব্রাহীমের বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। রোকেয়ার প্রেমে পড়ে বন্ধুর কাছে তার বোনকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন সাখাওয়াত। বন্ধুর আবদার রক্ষা করতে গিয়ে বোনের জীবনের আনন্দের কথা চিন্তা করেননি। অবশ্য রোকেয়ার অমতে বিয়ে হয়েছে, এমন কোন তথ্য কখনো পাওয়া যায়নি। সেক্ষেত্রে ধরে নেয়া যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহস দেখাতে পারেননি তিনি। অপরিপক্ক বলা যায় না, কারণ আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, পরিণত বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয়। অন্তত তখনকার পরিস্থিতি বিচারে অবশ্যই আশ্চর্যজনক। বিয়ের সময় রোকেয়ার বয়স ছিলো ১৮ বছর। তার মানে রোকেয়ার স্বামী ছিলেন তার ২২ বছরের বড়। শুধু তাই নয়, বিপত্নিক সাখাওয়াতের একজন মেয়ে সন্তানও ছিলো।
হ্যাঁ, সাখাওয়াত হোসেন বয়সে ‘বুড়ো’ হলেও রোকেয়ার শিক্ষা, সাহিত্য চর্চা ও স্বাধীনতায় তিনি ছিলেন তারুণ্যের মত স্বচ্ছল। রোকেয়াকে তিনি সম্মানের সাথে মূল্যায়ন করতেন। তার আগ্রহ ও অনাগ্রহ গুরুত্বের সাথে দেখতেন। সাহিত্যচর্চার প্রধান পৃষ্ঠপোষকও তিনিই ছিলেন। সেক্ষেত্রে স্বার্থপরের মত বলা যায় ‘বুড়ো’ সাখাওয়াতের সাথে বিয়ে হয়েছে, তা খুবই ভালো কাজ হয়েছে। কোন যুবক সাখাওয়াতের সাথে বিয়ে হলে হয়তো কেউ রুকাইয়া খাতুনের নামও মনে রাখতো না, এখন যেমন বেগম রোকেয়াকে মনে রাখছে। ‘স্বার্থপর’ শব্দটি হয়তো কম হয়ে যায়, কারণ স্বাধীনচেতা এই মানুষটির দাম্পত্য জীবনের স্থায়িত্বকাল মাত্র ১৪ বছর। এর মধ্যে শেষ দুয়েক বছর সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন খুবই অসুস্থ, ডায়াবেটিক রোগী।
রোকেয়ার বিয়ে হয় ১৮৯৬ সালে, স্বামীর মৃত্যু হয় ১৯০৯ সালের মাঝামাঝিতে। দাম্পত্যজীবনে তাদের দুই মেয়ে শিশু জন্ম নেয় এবং দুঃখজনভাবে দু’জনেরই অকাল মৃত্যু হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর রোকেয়া মূলত একা হয়ে যান। ঘরে একটি বালিকা থাকলেও সাখাওয়াতের অপরপক্ষীয় সেই মেয়ের সাথে রোকেয়ার সম্পর্ক ভালো ছিলো না, বরং মোটামুটি খারাপই ছিলো।
জীবদ্দশায় স্বামী সাখাওয়াত হোসেন ভেবেছিলেন নারী শিক্ষার জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু যখন বুঝলেন তিনি হয়তো আর বাঁচবেন না, রোকেয়ার হাতে দশ হাজার টাকা তুলে দিলেন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য। স্বামীর মৃত্যুজনিত বেদনা ও স্বামীর স্বপ্ন বাকি জীবন সঙ্গে রাখলেন তিনি। এমনকি মাত্র ৩২ বছর বয়সে বিধবা হয়েও পরে আর বিয়ে করেননি। বঙ্গের প্রথম নারীবাদী রোকেয়া স্বামী চিন্তায় ছিলেন অস্বাভাবিক পুরাতনী।
বিধবার স্বামী-স্মৃতিরূপ বহুমূল্য সম্পদ থাকে। পতিধ্যান তাহার নিত্যসহচর। ভীষণ কণ্টকাকীর্ণ সংসারে পতিস্মৃতি তাহার একমাত্র সহায়। …দেবর, ভাশুর এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ছলে কৌশলে সম্পত্তি কাড়িয়া লইতে পারে, কিন্তু এই ‘সতীর দেবতা পতি, জীবনে সার/ সেঁই যাচি পূজিবারে চরণ তোমার’ —ভাবটুকু অপহরণ করিতে পারে না।
– বেগম রোকেয়া
স্বামীর মৃত্যুর পর এইরূপ চিন্তা ও সংকল্প নিয়ে নয় বছর সাহিত্য চর্চা থেকে বিরত ছিলেন। এই বিরতি শুরু হয় সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যুর চার বছর আগে থেকে। অথ্যাৎ টানা ১৩ বছর তিনি কোন গল্প, প্রবন্ধ কিংবা কবিতা লিখেননি। লেখালেখি বাদ দিয়ে স্বামীর স্বপ্ন পূরণে নিয়োজিত হলেন। ১৯০৯ সালের শেষের দিকে মাত্র ৫ জন মুসলিম ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। কিছুদিনের মধ্যে স্কুলতো বটে, ভাগলপুর ছেড়ে চলে যেতে হয় তাকে। চলে যাওয়ার একমাত্র কারণ সাখাওয়াতের পূর্ব স্ত্রীর মেয়ে ও তার বর। তারা রোকেয়ার প্রতি খুব সভ্য ছিলো না, বরং সীমাহীন উৎপীড়ন করতো।
স্কুল প্রতিষ্ঠার বিষয়টাকে কেবলই স্বামীর স্বপ্ন বলা উচিৎ হচ্ছে না। ফলে রোকেয়ার প্রতি অবিচার করা হয়। একই স্বপ্ন রোকেয়ারও। লেখা পড়া শেখার জন্য তিনি কত চেষ্টাই না করেছেন এবং সারা জীবন শিক্ষার গান গেয়ে গেলেন। দুই জনের পৃথক স্বপ্ন একত্র হয়ে রোকেয়া ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। প্রথমবার ব্যর্থ হয়ে থেমে থাকেননি। ১৯১১ সালে কলকাতায় আটজন মুসলিম ছাত্রী নিয়ে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল’ নামে আরো একটি স্কুল খোলেন। ১৯১৭ সালে স্কুলটি যখন নিম্ন-মাধ্যমিকের মর্যাদা পায়, তখন ছাত্রী সংখ্যা ছিলো ১০৭ জন। মুসলিম পরিবারগুলো নিম্ন-মাধ্যমিকের পর মেয়েদের আর লেখাপড়া করাতে চায়নি। তাই মাধ্যমিকে উন্নীত হতে স্কুলটির লেগে যায় আরো ১২ বছর। সাখাওয়াত মেমোরিয়ালে তখন শতাধিক শিক্ষার্থী, রোকেয়া অবশ্যই খুশি ছিলেন। স্বপ্নপূরণে আনন্দিত হবেন এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
তবে স্কুল নিয়ে রোকেয়ার দুঃখও কম ছিলো না। সবচেয়ে বড় দুঃখের নাম ছিলো ‘বাংলা’। উপচে পড়া ইচ্ছে থাকার পরও নিজের স্কুলে কখনো বাংলা পড়াতে পারেননি তিনি। ১৯২৭ সালে আলাদা করে বাংলা স্কুল খোলার চেষ্টা করেও সফল হননি। তখন অবস্থাসম্পন্ন মুসলমানদের পারিবারিক ভাষা ছিলো উর্দু। এরপর আরবি ও ফারসি। বাধ্য না হলে বাংলায় কথা বলতেন না। এমতাবস্থায় একজন মুসলিম নারী যদি স্বগোত্রীয় নারী সমাজকে শিক্ষিত করতে চান, তাহলে যেভাবে ইসলামের সম্মান ও ‘শ্রী’ বৃদ্ধি পায়, সেভাবেই করতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে এটাকে আপোস বলতে পারেন, সমস্যা নেই। রোকেয়া স্কুলের জন্য আরো অনেক আপোস করেছিলেন। পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেও তিনি বোরকা পরতেন। কারণ খুবই সহজ। বোরকাহীন কোন নারীর স্কুলে মুসলিম পরিবারগুলো তাদের মেয়ে শিশু পাঠাবে না।
তবে বোরকার ক্ষেত্রে রোকেয়া দুই কূল রক্ষা করতে চেয়েছেন। তিনি পর্দাকে দুইভাগে ভাগ করেছেন। ধর্মের নামে পুরুষ কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া পর্দা এবং শালীনতা রক্ষায় নিজ পছন্দে পর্দা। তিনি শালীনতা রক্ষার জন্য পর্দার পক্ষে ছিলেন। এর মাধ্যমে নিজে নারীর যে স্বাধীনতার কথা বলতেন তা এবং তার পিছু লাগা মুসলমানদের মন -দুই’ই রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এর বিষদ বিবরণে যা বলেছেন, তাতে প্রথম দেখায় রোকেয়ার বেশ সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ধরা পড়ে।
আমি অনেকবার শুনিয়াছি যে, আমাদের ‘জঘন্য অবরোধ প্রথা’ই নাকি আমাদের উন্নতির অন্তরায়। উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত ভগ্নিদের সহিত দেখাসাক্ষাৎ হইলে তাঁহারা প্রায়ই আমাকে ‘বোরকা’ ছাড়িতে বলেন। বলি, উন্নতি জিনিসটা কী? তাহা কি কেবল বোরকার বাহিরেই থাকে? যদি তাই হয় তবে কি বুঝিব যে জেলেনী, চামারনী, কি ডুমুনী প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা আমাদের অপেক্ষা অধিক উন্নতি লাভ করিয়াছে?
– বোরকা, বেগম রোকেয়া
নিশ্চয় জেলেনী, চামারনী, ডুমুনী প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা বোরকা পরলে উন্নতি করতে পারবেন, তাও সত্য নয়। এমন পেশাজীবীদের উন্নয়ন এবং অনুন্নয়নের সাথে বোরকা জড়িত নয়। তাদের পেশা নির্বাচন, পূর্বসূরীদের গরিবী অবস্থা, শিক্ষাহীনতা এর প্রধান কারণ। সেদিক দিয়ে রোকেয়ার ইঙ্গিত যৌক্তিক। তিনি বলতে চেয়েছেন পর্দা থাকুক আর না থাকুক, শিক্ষাই হচ্ছে উন্নতির মূল হাতিয়ার। আবার বিভিন্ন লেখায় নারীর ‘উন্নতি’ বলতে যা বুঝিয়েছেন, সেই অর্থে রোকেয়ার ইঙ্গিত স্ববিরোধী। নারীর স্বাধীনতা, কাজে পুরুষের সমকক্ষ হওয়া, অবরোধ বাসিনী পরিচয় থেকে বেরিয়ে আসা যদি বোকেয়া দর্শনে ‘উন্নতি’ হয়, তাহলে জেলেনী, চামারনীরা সত্যিকার অর্থে উন্নত ছিলেন।
কেহ বলিয়াছেন যে, ‘সুন্দর দেহকে বোরকা জাতীয় এক কদর্য ঘোমটা দিয়া আপাদমস্তক ঢাকিয়া এক কিম্ভুতকিমাকার জীব সাজা যে কী হাস্যকর ব্যাপার যাঁহারা দেখিয়াছেন তাঁহারাই বুঝিতে পারিয়াছেন’ —ইত্যাদি। তাহা ঠিক। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস যে, রেলওয়ে প্লাটফরমে দাঁড়াইয়া কোন সম্ভ্রান্ত মহিলাই ইচ্ছা করেন না যে, তাঁহার প্রতি দর্শকবৃন্দ আকৃষ্ট হয়। সুতরাং ঐরূপ কুৎসিত জীব সাজিয়া দর্শকের ঘৃণা উদ্রেক করিলে কোন ক্ষতি নাই। বরং কুলকামিনীগণ মুখমণ্ডলের সৌন্দর্য দেখাইয়া সাধারণ দর্শকমণ্ডলীকে আকর্ষণ করাই দোষণীয় মনে করিবেন।
– বোরকা, বেগম রোকেয়া
রোকেয়ার উপরের কথাগুলো এখনকার অনেক নারীবাদীকে বিব্রত করে। কারণ বর্তমান সময়ে বেগম সাহেবার ভাবমূর্তি যথেষ্ট বিপদে আছে। মুসলমান রক্ষণশীল সমাজ রোকেয়ার কর্মের ততটুকু উল্লেখ করে যতটুকু ইসলামের সাথে খুব বেশি বিরোধ করে না। আবার অনেক মুক্তমনা ও নারীবাদী ততটুকু উল্লেখ করেন যতটুকু উল্লেখ করলে তর্কে মুসলিম রক্ষণশীল সমাজ ও পুরুষতান্ত্রিকতাকে কোনঠাসা করে রাখা যায়। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে রোকেয়া কোন ‘ওয়েল কোডেড সফটওয়্যার’ নন, কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত পণ্ডিত নন। তার চিন্তার যেমন সীমাবদ্ধতা ছিলো, ছিলো সামাজিক সীমাবদ্ধতাও। যদিও তার সমাজ বুঝার সক্ষমতা বেশ উৎকৃষ্ট ছিলো। কারণ তিনি বোরকা পরিয়ে হলেও মুসলিম মেয়েদেরকে স্কুলে আনতে চেয়েছেন, কর্মে টানতে চেয়েছেন। বঙ্গে নারীবাদের সূচনাকারীর এই চাওয়া তার নারীবাদী পরিচয়কে একটুও প্রশ্নবিদ্ধ করে না। সেই বোরকা পরে স্কুলে আসা মেয়েদের উত্তরসূরীরাই আজ বোরকা নামক চাপিয়ে দেয়া ভার থেকে মুক্ত হওয়ার কথা বলছে।
শুরুটা এমনই হয়। রোকেয়া প্রসূত অগ্রগতির শুরু এর ব্যতিক্রম নয়। সমাজ সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপেই তিনি টের পেয়েছেন এই পথে কী কী বাধা আসে আর কোথা হতে আসে। এসব দেখে তিনি সতর্ক হয়েছেন। কিছু ‘আপোস’ এর বিনিময়ে মুসলমান সমাজে পরিবর্তন আনার সংগ্রাম জিইয়ে রেখেছিলেন। এবং অবশ্যই চিন্তা-ভাবনা করে বুঝেশুনে এই আপোস করেছেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘মতিচূর’ এর প্রবন্ধ ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’তে।
প্রথমে জাগিয়া উঠা সহজ নহে, জানি; সমাজ মহা গোলযোগ বাধাইবে জানি; ভারতবাসী মুসলমান আমাদের জন্য “কৎল” এর (অর্থাৎ প্রাণদণ্ডের) বিধান দিবেন এবং হিন্দু চিতানল বা তুষানলের ব্যবস্থা দিবেন, জানি! (অর্থাৎ ভগ্নিদিগেরও জাগিবার ইচ্ছা নাই, জানি!) কিন্তু সমাজের কল্যাণের নিমিত্তে জাগিতে হইবেই। বলিয়াছি ত কোন ভাল কাজ অনায়াসে করা যায় না। কারামুক্ত হইয়াও গ্যালিলিও বলিয়াছিলেন, কিন্তু যাহাই হউক পৃথিবী ঘুরিতেছে (“but nevertheless it (Earth) does move”)!! আমাদিগকেও ঐরূপ বিবিধ নির্যাতন সহ্য করিয়া জাগিতে হইবে।
– স্ত্রীজাতির অবনতি, বেগম রোকেয়া।
১৯০৪ সালে এই প্রবন্ধটি প্রথমে ‘অলঙ্কার না Badge of Slavery?’ শিরােনামে ‘মাসিক মহিলা’ পত্রিকার পর পর তিন সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। লেখক হিসেবে নিজের নাম প্রকাশ করেননি। ‘ভাগলপুরস্থ সম্ভ্রান্ত মোসলমান পরিবারের একটি মহিলা হইতে প্রাপ্ত’ বলে উল্লেখ করা হয়। কারণ প্রবন্ধে ধর্ম কর্তৃক নারীর অগ্রযাত্রা দমিয়ে রাখার কথা উল্লেখ করে ধর্মের কঠোর সমালোচনা করা হয়। এক বছর পর শিরোনাম বদলে ‘আমাদের অবনতি’ নামে ‘নবনূর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এবং পরে একই নামে ‘মতিচূর’ গ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত হলে রক্ষণশীল মুসলমানদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। আর এই দৃষ্টি মোটেও সুদৃষ্টি ছিলো না। ফলে প্রবন্ধটির সবচে শক্তিশালী অংশগুলো বাদ দিতে বাধ্য হন তিনি। মোট পাঁচ প্যারা বাদ দিয়ে নতুন করে অপেক্ষাকৃত ভোঁতা সাতটি প্যারা লিখেন। এরপর প্রবন্ধটি যে নতুন রূপ লাভ করে, আমরা এখন ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ নামে সেই রূপই পাঠ করি। নিঃসন্দেহে সময় বিচারে সংশোধিত প্রবন্ধেও রোকেয়া ছিলেন অত্যন্ত সাহসী।
বাদ দেয়া অংশসমূহ পড়লে বুঝা যাবে নারী প্রগতির প্রশ্নে ধর্ম নিয়ে রোকেয়ার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিলো।
প্রবল সব বাধা অগ্রাহ্য করে যখনই কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। …আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্যে পুরুষগণ এই ধর্মগ্রন্থগুলি ঈশ্বরের আদেশ বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। …এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পান, কোন স্ত্রী-মুনির বিধানে হয়ত তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন। …ধর্ম আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে; ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন।
– ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধের বাদ দেয়া কিছু অংশ
উপরের অংশটি পড়ে তাকে নাস্তিক মনে হলেও পুরোপুরি নাস্তিক বলা যায় না। কারণ তিনি ঈশ্বরকে দায়মুক্তি দিয়েছেন। ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখে তারপর কথাগুলো বলেছেন। অন্যভাবে বিচার করলে -যেহেতু তিনি ধর্মের দ্বিতীয় প্রধান বিষয়ে অবিশ্বাসী ছিলেন, সেহেতু তাকে নাস্তিক বলা যেতে পারে। তবে, আস্তিক ছিলেন নাকি নাস্তিক ছিলেন, এটা উদ্ধার করতে পারলে হয়তো বেগম রোকেয়াকে নিয়ে আরো একটি তথ্য বৃদ্ধি পেতো, কিন্তু তাতে খুব বেশি লাভ বা ক্ষতি হয় না। বড় কথা হলো, নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার পথে ধর্ম যে প্রধান বাধা, সে বিষয়ে তিনি পরিষ্কার মতামত জানিয়েছেন। এবং নবী রাসুলগণ সম্পর্কে তার মনোভাবও খোলাসা করেছেন। ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধের বাদ দেয়া বাকি অংশসমূহ পড়লে বিষয়টি আরো বোধগম্য হবে।
পুরাকালে যে ব্যক্তি প্রতিভা বলে দশ জনের মধ্যে পরিচিত হইয়াছেন, তিনিই আপনাকে ঈশ্বরের প্রেরিত দূত বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। …যদি ঈশ্বর কোন দূত রমণী শাসনের জন্য প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত বোধ হয় কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন না। দূতগণ ইউরোপে যান নাই কেন? আমেরিকা এবং সুমেরু হইতে কুমেরু পর্যন্ত যাইয়া ‘রমণীজাতিকে নরের অধীনে থাকিতে হইবে’ ঈশ্বরের এই আদেশ শুনান নাই কেন? …আরও দেখ, যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ় সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক। যেখানে ধর্মবন্ধন শিথিল, যেখানে রমণী প্রায় পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থায় আছেন। ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন।
– ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধের বাদ দেয়া কিছু অংশ
রোকেয়া তার বিবেচনা অনুযায়ী স্বপ্ন ও বাধা পাশাপাশি রেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি কিভাবে কাজ করবেন। মুসলমানরা তখন ধর্মের সমালোচনা শোনাতো দূরে থাক, স্ত্রী পর্দা না মানলে স্বামীটিও ভয়ে থাকে সে দোযখে যাবে নাতো! তখনকার জলবায়ু কেমন ছিলো, তা বলতে পারবো না। কিন্তু তখন জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে কেবল ভয় আর ভয়, অন্ধকার আর অন্ধকার। রোকেয়ার কাছে আলো ছিলো, তীব্র আলো। তার খানিকটা দেখাতেই মুসলমানরা ঝলসে গেছে। হয়তো এই কারণে তিনি তার আলোর বৈয়ামের মুখ পুরোপুরি না খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মুসলমানদের ঝলসে যাওয়া শরীরে অষুধ দাগানোর জন্য অল্প কিছু লেখালেখি করেন।
আগুন হাতে ময়দানে নেমে একটুখানি কাদাজলও গায়ে মাখলেন। যেমন তার ‘সুগৃহিণী’ প্রবন্ধটি। এই প্রবন্ধে ঘর হতে বেরিয়ে আসা নারীদের আবার কিছুটা ঘরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। সংস্কারযাত্রার প্রথমে তিনি বললেন কোরআন বাইবেল পুরুষের রচিত গ্রন্থ এটা মানার দরকার নাই। এরপর বললেন ঘর থেকে বেরিয়ে আসো, শিক্ষাগ্রহণ করো, পুরুষের সমকক্ষ হয়ে কাজ করো। তারপর হঠাৎ তিনি বললেন বোরকা পরা পরাধীনতা নয়। আরো বললেন-
বেশ কথা। আশা করি আপনারা সকলেই সুগৃহিণী হইতে ইচ্ছা করেন, এবং সুগৃহিণী হইতে হইলে যে যে গুণের আবশ্যক, তাহা শিক্ষা করিতে যথাসাধ্য চেষ্টাও করিয়া থাকেন। কিন্তু আজ পর্য্যন্ত আপনাদের অনেকেই প্রকৃত সুগৃহিণী হইতে পারেন নাই। কারণ আমাদের বিশেষ জ্ঞানের আবশ্যক, তাহা আমরা লাভ করিতে পারি না। সমাজ আমাদের উচ্চশিক্ষা লাভ করা অনাবশ্যক মনে করেন। পুরুষ বিদ্যালাভ করেন অন্ন উপার্জ্জনের আশায়, আমরা বিদ্যালাভ করিব কিসের আশায়? অনেকের মতে আমাদের বুদ্ধি বিবেচনার প্রয়োজন নাই। যেহেতু আমাদিগকে অন্নচিন্তা করিতে হয় না, সম্পত্তি রক্ষার্থে মোকদ্দমা করিতে হয় না, চাকরীলাভের জন্য সার্টিফিকেট ভিক্ষা করিতে হয় না, “নবাব” “রাজা” উপাধিলাভের জন্য স্বেতাঙ্গ প্রভুদের খোসামোদ করিতে হয় না, কিংবা কোন সময়ে দেশরক্ষার্থে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতে হইবে না। তবে আমরা উচ্চশিক্ষা লাভ (অথবা Mental culture) করিব কিসের জন্য? আমি বলি, সুগৃহিণী হওয়ার নিমিত্তই সুশিক্ষা (Mental culture) আবশ্যক।
– সুগৃহিণী, বেগম রোকেয়া
সুগৃহিণী কিভাবে হতে হয় বা একজন সুগৃহিণীর কাজ কী, তা এই প্রবন্ধে উদাহরণ সহ বলেছেন বেগম রোকেয়া।
(ক) গৃহ এবং গৃহসামগ্রী পরিস্কার ও সুন্দররূপে সাজাইয়া রাখা।
(খ) পরিমিত ব্যয়ে সুচারুরূপে গৃহস্থালী সম্পন্ন করা।
(গ) রন্ধন ও পরিবেশন।
(ঘ) সূচিকর্ম্ম।
(ঙ) পরিজনদিগকে যত্ন করা।
(চ) সন্তানপালন করা।
প্রথম ভাবনায় মনে হয় তিনি নারীদের বলেছেন “শিক্ষিত হও, যেন ঘরের কাজগুলো ঠিকমত করতে পারো।” কিন্তু এমনটা কি মনে হতে পারে না যে তিনি বুঝানোর চেষ্টা করেছেন “গৃহস্থালি কাজের জন্যও শিক্ষার প্রয়োজন আছে। তুমি যাই করো না কেন, তোমাকে শিক্ষিত হতে হবে।” সে সময় রোকেয়া যখন কোন অবস্থাসম্পন্ন মুসলিম পরিবারে গিয়ে তার স্কুলের জন্য ছাত্রী প্রার্থনা করতেন, তখন তাকে ধাপে ধাপে ‘অযুহাত’ ভাঙতে হতো। প্রথমেই আছে ধর্মীয় নিষেধ। ধর্মীয় নিষেধের অযুহাত সহজেই ভাঙতে পারতেন। কারণ পরিবারের শিক্ষিত পুরুষরা রোকেয়ার সাথে যুক্তিতে না জিতে সচরাচর অভদ্র আচরণ করতেন না। হয়তো অভদ্র আচরণ করতেন না, আবার মেয়ে শিশুকে স্কুলে না পাঠানোর সিদ্ধান্তও বদলে যেতো না। তখন রোকেয়া সবচে বেশি অসহায় মাখানো যে অযুহাতের মুখোমুখি হতেন, “মেয়েরা লেখাপড়া করে কী হবে, তারাতো ঘরের কাজ করবে।” রোকেয়া এই কথাটির মোক্ষম জবাব তৈরির চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে তার বিশেষ সুবিধাও ছিলো। তখনকার প্রগতিশীল সমাজে রোকেয়ার সমালোচনা করার মত লোকজন তেমন একটা ছিলো না। তাই আপসকামিতা করতে গিয়ে তাকে খুব বেশি বিরুদ্ধমতের সামনে যেতে হয়নি।
তার স্কুলে ছাত্রী সমাগম বৃদ্ধির জন্য দুই একটা প্রবন্ধ লিখেই ক্ষান্ত হননি। আরো অনেক কিছু করেছেন। ‘মেয়েরা ঘরের কাজ করবে, এর জন্য স্কুলে যাওয়ার কী দরকার?’ শুধু এই কথাটি মোকাবেলার জন্য তিনি তার স্কুলে উর্দু, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, শরীরচর্চা ও সঙ্গীত শেখানোর পাশাপাশি হোম নার্সিং, ফার্স্ট এইড, রান্না ও সেলাইয়ের কাজও শেখাতেন। আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে অর্থসহ কোরআন শরীফও শেখাতেন। এর মাধ্যমে মেয়ে শিশুদের পরিবারের সামনে তিনি এবার পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করলেন। গৃহস্থালী কাজ শেখার জন্য ঘরে বন্দী থাকার কোন প্রয়োজন নেই, এসব কিছু এখন স্কুলেও শেখানো হয়। -আর এভাবেই মাত্র ৫ জন ছাত্রী দিয়ে শুরু করা স্কুলটি কয়েক বছরের ব্যবধানে শতাধিক ছাত্রীর কলতানে মুখর ছিলো।
উপরে কোন এক জায়গায় স্বামীভক্তির বিষয়ে রোকেয়ার মনোভাব তুলে ধরেছি। সেই সূত্রে মনের মাঝে একটি কথা উঁকি মারতে পারে। মুসলিম নারী শিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের সফলতার জন্য তিনি এতটা মরিয়া কেন ছিলেন? এতটা স্ব-বিরোধী কেন হয়েছেন? স্কুলের সাথে স্বামীর স্বপ্ন জড়িত ছিলো বলে!? তার মানে তার স্বামী যদি মাদ্রাসা তৈরির কথা বলতেন, রোকেয়া তাই করতেন? অথবা যদি মসজিদ তৈরির কথা বলে যেতেন? —এর জবাব আমরা কোথায় পাবো? জনাব সাখাওয়াত হোসেন এমন কোন স্বপ্নের কথা বলে যাননি, রোকেয়াও এমন স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেননি। আমরা বরং রোকেয়ার স্বপ্নকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি, যে স্বপ্নের খোঁজ পেয়েছিলেন তার স্বামী। রোকেয়ার স্বপ্নের উপর ভর করেই সাখাওয়াত সাহেবের পরিকল্পনা নির্মিত হয়েছে।
রোকেয়া যে নারী শিক্ষার প্রসারে আসলেই কৌশলী ছিলেন, তার অনেক প্রমাণ আছে। একটি বিশেষ দিক উল্লেখ না করলেই নয়। অর্থসহ কোরআন শিক্ষা। মুসলমানদের জন্য এটি অত্যন্ত জরুরী। এতটাই জরুরী যে, হুজুররা বলেন অর্থ না বুঝে আরবীতে কোরআন পড়ার সওয়াব বেশি। সওয়াবের লোভ দিয়ে হলেও তারা বাঙালি মুসলমানকে অর্থসহ কোরআন পড়তে দিবেন না। কারণ ওই হুজুররা ভালোমত জানে কোরআনে আসলে কী আছে। আমরাও জানি। রোকেয়াও জানতেন। তাই তিনি মেয়েদেরকে বিদেশি ভাষায় কোরআন না পড়ে মাতৃভাষায় অর্থ বুঝে পড়ার কথা বলতেন। তবেই না মেয়েরা বুঝতে পারবে কোরআন কিভাবে প্রতি পদক্ষেপে তাদের হাতে পায়ে শেকল পরিয়েছে, অপমান করেছে, অবজ্ঞা করেছে। তাই তিনি বোরকা পরে হলেও, গৃহস্থালী কাজ শেখার জন্য হলেও, আরবি ফারসি শেখার জন্য এমনকি অর্থসহ কোরআন শেখার জন্য হলেও স্কুলে আসার প্ররোচনা দিয়েছেন। এখানে এসে ইংরেজি শিখে বিদেশি সাহিত্য ও চিন্তার সাথে পরিচিত হও, শরীরচর্চার মাধ্যমে নিজেকে কিছুটা হলেও শক্তিশালী ভাবো, হাতের কাজ শিখে নিজের সক্ষমতা বুঝে নাও, সঙ্গীতের সৌন্দর্যে জীবনের আনন্দ খুঁজে নাও। শেষ কথা হলো, যেভাবেই হোক তোমরা স্কুলে আসো।
তিনি যে বোরকা অথবা ‘আদর্শ গৃহিণী’ হওয়ার জন্য ধর্মঘেঁষা কথাগুলো ইচ্ছের বিরুদ্ধে বলেছেন, এর সবচে বড় প্রমাণ ১৯২৪ সালে প্রকাশিত ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসটি। সাহিত্য সমালোচকরা বলেছেন পদ্মরাগ বইটিকে উপন্যাস বলা চলে না। এটিকে কিছুটা গল্প ও কিছুটা প্রবন্ধের মিশ্রণ বলা যায়। লেখক তার মতামত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন উপন্যাসের চরিত্রগুলো দিয়ে। উপন্যাস হিসেবে পদ্মরাগ যথেষ্ট কাঁচা হাতের লেখা, ইত্যাদি ইত্যাদি। কাঁচা হোক পাকা হোক, এই উপন্যাসে রোকেয়া অসাধারণভাবে তার অসহায়ত্ব এবং স্বপ্ন তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের মূল চরিত্র ‘দীনতারিণী’র মাঝে রোকেয়াকে খুঁজে পাওয়া যায়। দীনতারিণী একজন ব্রাহ্ম নারী। তারিণীভবনে তিনি স্কুল খুলেছেন। যে স্কুলে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান সবাই একসাথে শিক্ষাগ্রহণ করছে। সবার মাঝে দারুণ সখ্যতা ও সদ্ভাব …এরকম আরো অনেক ‘অবাস্তব’ সৌন্দর্যে ভরা তার পদ্মরাগ। দীনতারিণীর মাঝে তিনি তার অসহায়ত্বের বিসর্জন দিয়েছেন। সাখাওয়াত মেমোরিয়ালে যা করতে পারেননি কিন্তু করা উচিত, উপন্যাসের তারিণীভবনে ঠিক তাই করেছেন।
এই লেখার শুরুর দিকে পর্দার পক্ষে ইনিয়ে বিনিয়ে বলা রোকেয়ার কথাগুলো পড়েছি। কেন এসব বলেছেন, তার পক্ষে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও পড়েছি। এবার দেখি পর্দার বিপক্ষে তিনি কী বলেছেন।
বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সম্মেলনে এক বক্তৃতায় পর্দা নিয়ে কিছুটা আলোচনা করেন। যদিও সে সময় ধর্মীয় ইস্যুতে মুসলিম সমাজের বিরোধিতার মুখে ছিলেন তিনি, তবুও সেদিন কথাগুলো বলা থেকে বিরত থাকেননি।
পর্দা সম্বন্ধে আমি নিজের কোন মত প্রকাশ করিতে ইচ্ছুক নহি —কেবল এইটুকু বলি যে, শেখ সাহেব[২] পর্দাকে ‘সর্বাপেক্ষা যন্ত্রণাদায়ক ক্ষত’ বলিয়াছেন, আমি তাহা মনে করি না। ‘যন্ত্রণাদায়ক’ হইলে অবলাগণ ‘বাবারে! মা’রে! মলুমরে! গেলুম রে!’ বলিয়া আর্তনাদে গগন বিদীর্ণ করিতেন! অবরোধ প্রথাকে প্রাণঘাতক কাবর্নিক এসিড গ্যাসের সহিত তুলনা করা যায়। যেহেতু তাহাতে বিনা যন্ত্রণায় মৃত্যু হয় বলিয়া লোকে কার্বনিক গ্যাসের বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বন করিবার অবসর পায় না! অন্তঃপুরবাসিনী নারী এই অবরোধ গ্যাসে বিনা ক্লেশে তিল তিল করিয়া নীরবে মরিতেছে।
– বেগম রোকেয়া।
পর্দা প্রথা যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, বাঙালি মুসলমানকে তা চোখে সরিষা মেখে বুঝিয়ে দিয়েছেন বেগম রোকেয়া। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত ‘অবরোধ বাসিনী’ বইয়ের ৪৭টি ছোট ছোট ঘটনাগল্প তার সাক্ষি। ‘অবরোধ বাসিনী’ হতে একটি অতি ছোট ঘটনার উল্লেখ করি।
এক বাড়ীতে আগুন লাগিয়াছিল। গৃহিণী বুদ্ধি করিয়া তাড়াতাড়ি সমস্ত অলঙ্কার একটা হাত বাক্সে পুরিয়া লইয়া ঘরের বাহির হইলেন। দ্বারে আসিয়া দেখিলেন সমাগত পুরুষেরা আগুন নিবাইতেছে। তিনি তাহাদের সম্মুখে বাহির না হইয়া অলঙ্কারের বাক্সটী হাতে করিয়া ঘরের ভিতর খাটের নীচে গিয়া বসিলেন। তদবস্থায় পুড়িয়া মরিলেন, কিন্তু পুরুষের সম্মুখে বাহির হইলেন না। ধন্য! কুল-কামিনীর অবরোধ!
– অবরোধ বাসিনী -৮
বাঙালি নারীরা আজ আর এই অবস্থায় নেই। কেউ এভাবে মারা যাওয়ার গল্প এখন আর শোনা যায় না। পর্দা প্রথার এই ভয়াবহ অধ্যায় থেকে আমাদের নারীগণ অনেক দূরে সরে এসেছেন। তারা চাইলে এজন্য রোকেয়াকে ধন্যবাদ দিতে পারেন। নিশ্চয় দেনও।
ধর্মীয় দমন পীড়নের বিরুদ্ধে, গোঁড়ামি আর অসহ্য পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন। এজন্য সুযোগ পেলেই ধর্মের নাকে দড়ি লাগিয়ে টান মারতেন। এই টানাটানির জন্য তিনি পর্যাপ্ত পরিমান প্রশ্ন ও বিরোধিতার মুখোমুখি হতেন। মুখোমুখি হয়ে চুপসে না গিয়ে জবাবটা ঠিকঠাকমত দিতেন।
কেহ বলিতে পারেন যে, ‘তুমি সামাজিক কথা বলিতে গিয়া ধর্ম লইয়া টানাটানি কর কেন? তদুত্তরে বলিতে হইবে যে, ‘ধর্ম’ শেষে আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ় করিয়াছে; ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন। তাই ‘ধর্ম লইয়া টানাটানি করিতে বাধ্য হইলাম । এজন্য ধার্মিকগণ আমায় ক্ষমা করিতে পারেন।
– বেগম রোকেয়া
বেগম রোকেয়া শুধু নারী শিক্ষা বা মুক্তির জন্য কাজ করেছেন, এটা সত্য নয়। তিনি আরো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। বাঙালি উচ্চবিত্ত মুসলিম পরিবারে মাতৃভাষা তালিকায় উর্দু সরিয়ে বাংলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য অবদান আছে। সে সময় এসব পরিবারে বাংলা ভাষার মর্যাদা কোথায় ছিলো, রোকেয়ার লেখাতেই তার উল্লেখ আছে। তার বড় বোন করিমুন্নেসা খানমকে নিয়ে রচিত এক প্রবন্ধে তিনি লিখেন —
একদিন করিমুন্নেসা গোপনে একটা বটতলার পুঁথি লইয়া অস্ফুটস্বরে পড়িতেছিলেন — ‘কোরআনেতে আল্লাতালা কয়েছে এমতি, ফাদ খুলি ফী ইবাদি ওয়াদ খুলি জান্নাতি।’ সেই সময় হঠাৎ তাঁহার পিতা আসিয়া পড়েন। ইহাতে তিনি অত্যন্ত ভয় পাইয়া ভাবিলেন যে, ‘আজ আমার সর্বনাশ, —বুঝি এখনই আমাকে যমালয়ে যাইতে হইবে!’ কিন্তু না, শোকর আলহামদুলিল্লাহ! পিতা কন্যার হাতে পুঁথি দেখিয়া রাগ করিলেন না, —বরং ভয়ে মূর্ছিতা-প্রায় বালিকাকে কোলে লইয়া আদর করিলেন এবং সেইদিন হইতেই একটু একটু ‘সাধুভাষা’র বাঙ্গলা পড়াইতে লাগিলেন। ব্যস! আর যায় কোথা? যত মোল্লা মুরব্বির দল একযোগে চটিয়া উঠিলেন —’হে, মেয়েকে বাঙ্গলা পড়ান হইতেছে!’ তাঁহাদের নিন্দা ও বাক্য-জ্বালায় অধীর হইয়া পিতা তাঁহার পড়া বন্ধ করিয়া দিলেন।
– লুকানো রতন, বেগম রোকেয়া
রোকেয়া যে দেশের মানুষ, আজ সেই দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। হিন্দু, মুসলমান সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলে। এমনকি চরমভাবে বাংলা বিদ্বেষী হুজুররাও বাংলা ভাষায় ওয়াজ করে, করতে হয়। শিক্ষিত মুসলমান সমাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার জনপ্রিয় করতে না পারলে বাংলাদেশে বাংলা বর্ণমালা আজ এই মর্যাদার আসনে থাকতো না। হামাগুড়ি দিয়ে কিছুদূর আসলেও আবার খোঁড়া হয়ে যেতো। পাকিস্তান আমলে যখন আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব দেয়া হয়, তখন এর বিরোধিতাকারীদের মাঝে শিক্ষিত মুসলমানের সংখ্যা ছিলো উল্লেখ করার মত। বাংলা ভাষাপ্রেমী এই উচ্চবিত্ত মুসলমান শ্রেণী তৈরিতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। যারা ভাষার শরীর থেকে ধর্মীয় বিদ্বেষ সরিয়ে বাঙালির ঘরে বাংলা ভাষা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন, রোকেয়া তাদের একজন।
নারী শিক্ষা, সাখাওয়াত মেমোরিয়াল, লেখালেখি আর ধর্মীয় অবরুদ্ধতা থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করে জীবন কাটিয়ে দিলেন। পেশা হিসেবে নয়, এই সংগ্রামকে তিনি দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছিলেন। তাই দায়িত্ব থেকে একদিনের জন্যও কখনো ছুটি নেননি। এমনকি জীবনের শেষমুহূর্তেও কিছু না কিছু লিখেছেন। মৃত্যুর রাতে লিখেন ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি অসমাপ্ত প্রবন্ধ, যা পরদিন লেখার টেবিলে পেপারওয়েটে চেপে রাখা অবস্থায় পাওয়া যায়। পরে মাহে-নও পত্রিকায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধে তিনি তালাকে নারী ও পুরুষের ভূমিকা এবং অধিকার নিয়ে আলোচনা করেছেন। পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম-সমাজ কিভাবে সর্বক্ষেত্রে নারীর অধিকার হরণ করে, তা মুসলিম নারীদের উদাহরণসহ বুঝানোর চেষ্টা করেন।
১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বরের পর তিনি আর কখনো লিখতে পারেননি, সভা সমিতিতে বক্তৃতা দিতে পারেননি, স্কুলে মেয়েদেরকে পড়াতে পারেননি। সেই রাতে লেখালেখি শেষ করে এগারোটার দিকে ঘুমাতে যান। ভোরে শেষবারের মত ঘুম ভাঙে। কিছুক্ষণ পর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েন। সে ঘুম আর ভাঙেনি।
কিন্তু বাঙালি মুসলমান নারীদের ঘুম ভাঙানোর পর্যাপ্ত বন্দোবস্ত করে রেখে যান। জীবদ্দশায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল এর পাশাপাশি বিপন্ন নারীদের পাশে থাকার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম বা মুসলিম মহিলা সমিতি। এই সমিতিতে যারা বিভিন্ন সময়ে সম্পৃক্ত হয়েছে পরবর্তীতে তারাই সমাজের নেতৃত্ব দিয়েছেন। রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহ একটি নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি করে। আমাদের সুপরিচিত বেগম সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহিমরা সেই প্রজন্মের নারী।
রোকেয়ার উলেখযোগ্য রচনার মধ্যে প্রবন্ধগ্রন্থ মতিচূর (১ম খন্ড ১৯০৪, ২য় খন্ড ১৯২২), গদ্য Sultana’s Dream (১৯০৮), উপন্যাস পদ্মরাগ (১৯২৪), গদ্যগ্রন্থ অবরোধবাসিনী (১৯৩১) অন্যতম। এছাড়া অসংখ্য প্রবন্ধ, ছোটগল্প, কবিতা, ব্যঙ্গাত্মক রচনা ও অনুবাদও লিখেছেন।
এছাড়াও নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী, নবপ্রভা, মহিলা, ভারতমহিলা, আল-এসলাম, নওরোজ, মাহে নও, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, The Mussalman, Indian Ladies Magazine প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। ১৯০২ সালে নবপ্রভা পত্রিকায় তাঁর প্রথম লেখা ‘পিপাসা’ (মহরম) প্রকাশিত হয়।
টীকা
১. বিভিন্ন জায়গায় রোকেয়ার জন্ম তারিখ ৯ ডিসেম্বর ১৮৮০ বলা হলেও তার জন্ম তারিখ পরিবার মনে রাখেনি বলে দাবি করেছেন গবেষক ও ইতিহাসবিদ গোলাম মুরশিদ। তবে রোকেয়ার বড়বোন করিমুন্নেসার জন্ম তারিখ তার বাবা লিখে রেখেছিলেন। আবার করিমুন্নেসার মেজো ছেলে আবদুল হালিমের জন্মতারিখও লেখা ছিলো। রোকেয়া অবরোধ বাসিনী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন হালিমের বয়স যখন ছয়, রোকেয়ার বয়স তখন পাঁচ। সেই সূত্র মতে গোলাম মুরশিদ হিসাব কষে বের করলেন রোকেয়ার জন্ম ১৮৭৮ সালে, ১৮৮০ সালে নয়।
২. শেখ সাহেব, অর্থাৎ শেখ মুহম্মদ আবদুল্লাহ ছিলেন আলীগড়ের প্রসিদ্ধ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি। তিনি নারী শিক্ষার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন এবং সে লক্ষ্যে কাজ করতেন।
সূত্র
১. নারীপ্রগতির একশো বছর: রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া – গোলাম মুরশিদ
২. নারী সাহসিকা -শাহনাজ নাসরীন
৩. শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ -ড. মিজান রহমান সংকলিত ও সম্পাদিত
৪. মতিচূর (১ম খন্ড) -বেগম রোকেয়া
৫. অবরোধ বাসিনী -বেগম রোকেয়া
৬. হোসেন, রোকেয়া সাখাওয়াৎ -বাংলাপিডিয়া