প্রবন্ধপ্রাচ্য ও প্রতীচ্য | কামালউদ্দীন

প্রাচ্য ও প্রতীচ্য | কামালউদ্দীন

প্রাচ্য ও প্রতীচ্য | কামালউদ্দীন

শ্রদ্ধেয় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় খ্রিস্টের দীক্ষাগুরু ‘জন’-কে স্বস্তিকধারী বৌদ্ধ শ্রমণ বলেই অনুমান করেছেন। (যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিনে প্রাচ্য সাধু পুরুষগণ তাহাকে সুতিকাগারে দর্শন করিতে গিয়াছিলেন, এ কথা খ্রিস্টধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত আছে। তৎকালে এশিয়াখণ্ডের জলে স্থলে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের অব্যাহত গতির ও স্বধর্ম বিস্তারের অক্লান্ত অধ্যবসায়ের কথা স্মরণ করিলে যিশুখ্রিস্টের দীক্ষাগুরুকে ভারতীয় বৌদ্ধশ্রমণ বলিয়াই স্বীকার করিতে ইচ্ছা হয়।—ফিরিঙ্গি বণিক, ৭৪ পৃষ্ঠা)।

পরবর্তী যুগের বিখ্যাত ঐতিহাসিকদের লেখা এ বক্তব্যের যথেষ্ট প্রমাণ না পাওয়া গেলেও, একথা নিখুঁত সত্য যে প্রাথমিক খ্রিস্ট ধর্মনীতির উপর বৌদ্ধধর্মের বিপুল প্রভাব প্রতিফলিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যিশুখ্রিস্ট ছিলেন প্রাচ্যেরই অধিবাসী। তার তিরােধানের বহুদিন পরে পর্যন্ত তার প্রচারিত ধর্মমত প্রাচ্যদেশেই নিবদ্ধ ছিল। প্রতীচ্য প্রাচ্যভূমি হতেই এ ধর্ম নিজের অলিতে গলিতে বহন করে নিয়েছিল এবং পরিণামে সমগ্র ইউরােপকে এক করে গড়ে তুলতে, এক লক্ষ্যে নিয়ােজিত করতে, অনেকখানি সহায়তা করেছে এ খ্রিস্টধর্ম। কোনাে একটা বিশিষ্ট ধর্মমতের বিশেষ প্রয়ােজন ইউরােপ আজ অনুভব না করলেও একদিন করেছিল। সেই দিন সে খ্রিস্ট বনাম প্রাচ্যকে প্রাণের সাথেই গ্রহণ করেছিল। কোনাে জাতির অভুদাযুগের ইতিহাস আলােচনা করলে এই সত্যটি দেখতে পাই—তারা তখন সবল হস্তে গ্রহণ করতে ও দান করতে শেখে। যুগ-যুগের সংস্কার তাদের বেঁধে রাখতে যথেষ্ট প্রয়াস পেলেও এ প্রেরণাই তাদের জয়ী হয়। দুনিয়ার কালচারকে গ্রাস করে নিতে এবং দুনিয়ার সভ্যতার পর্যায়ে তাদের নিজস্ব কালচারের বিশিষ্ট ছাপ এঁকে দিতে তারা দিকে দিকে ছুটে যায় অদম্য উৎসাহে, অখণ্ড প্রাণে।

এর বিপরীত সত্যটিও কিন্তু মানুষের ইতিকথা অনেক দিন ধরে পুনরাবৃত্তি করে আসছে। অধঃপতনের যুগে জাতি এমনই আত্মসর্বস্ব হয়ে পড়ে যে, তারা মনে করে, ভুপৃষ্ঠে মানুষ যদি থেকে থাকে তবে তারাই, কালচার যদি কিছু থাকে, তবে তাদের এককালে যা ছিল তাই। উদ্দেশ্যহীনভাবে নিজের অতীতের দিকে চেয়ে গর্ব অনুভব করে বা চোখের জল মুছে তারা দিন কাটায়। এ মনােবৃত্তির বশবর্তী হয়েই ইহুদিরা অ-ইহুদীদের Gentile নাম দিয়েছিল, আর্যগণ ‘যবন ম্লেচ্ছ’ -শব্দের ও মুসলমানগণ ‘কাফের’ আখ্যার এত ছড়াছড়ি করেছিল।

খ্রিস্টান সমাজের আর একটি কথা মনে পড়ে। দিগদর্শন-শলাকাকে তারা এক সময় ‘শয়তানের যন্ত্র’ মনে করত; কোনাে নাবিক সে যন্ত্র ব্যবহার করে পােত চালনার সাহস বা চেষ্টা করলে তার জন্য পরকালে নরকের ব্যবস্থা হত। এর একমাত্র হাস্যাস্পদ কারণ হচ্ছে এই যে কম্পাস আবিষ্কৃত হয়েছিল অ-খ্রিস্টান মুসলমানের দ্বারা। [১]

আজ ভারতবাসীর জাতীয় চরিত্রের এই একই অবস্থা দেখি। ইউরােপের শাসনাধীন পৌণে দু’শ বছর বসবাস করেও আমরা যেন সত্যিকার প্রাণ দিয়ে তাকে গ্রহণ করতে পারছিনে। একটা স্বজাতীয়-বিজাতীয় বিদ্বেষ-ভাব আমাদের সব সময় তার প্রকৃত স্বরূপ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। আমরা পাশ্চাত্য সভ্যতার যা গ্রহণ করছি বা আয়ত্ত করছি, তা যেন নিতান্ত বাধ্য হয়ে। বাধ্য হয়ে যে নয় তা সত্য না হলেও বাধ্যতামূলক সব কাজই যে খুব মন্দ তার কোনাে মানে নেই। ধরা যাক ইংরেজি শিক্ষার কথা। রাজভাষা বলে প্রকারান্তরে বাধ্য হয়ে যদিও আমরা এটি শিখছি এবং এর চর্চা করছি, তথাপি এর ভিতর দিয়ে যে বর্তমান সভ্য জগতের সাথে আমাদের যােগ ঘনীভূত হচ্ছে, তা অস্বীকার করারও উপায় নেই। ইংরেজি সাহিত্যকে এক কথায় সর্বভুক বলা যায়। দুনিয়ায় এমন বড় কবি বা সাহিত্যিক কমই জন্মেছেন যার সাধনার পরিচয় ইংরেজি দিতে পারে না। পাশ্চাত্য বিজ্ঞান আজ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড শাসন করছে। তাকে আয়ত্ত না করে কোনাে জাতিই খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারছে না; কারণ তা সুচিন্তিত অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।

পশ্চিমের ভাল দিকটা আমরা আনন্দেই গ্রহণ করতে পারি এবং এ আনন্দ দিয়ে বাধ্যতার তিক্ততাটুকুর অনেকটা উপশমও হতে পারে স্বাচ্ছন্দে।

তথাপি আমাদের এ ক্ষুন্নতার, কথান্তরে কূপমণ্ডুকতারও যে সঙ্গত কারণ আছে সত্য বলতে তা স্বীকার করতে হবে। তার মূলে রয়েছে আমাদের প্রতি পশ্চিমের জাতীয়তা জাত তাচ্ছিল্য ও ঘৃণার ভাব। তবে এ ঘৃণা আমাদের বর্ণের জন্যই সম্পূর্ণ নয়। আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধােগতিই এর প্রকৃষ্ট কারণ। আরও সূক্ষ্মদৃষ্টিতে দেখতে গেলে, আমাদের দাসত্বের চাইতে দাস-মনােভাবই এর জন্য অধিক দায়ী।

আবার নতুন করে আমাদের দেনা-পাওনার সম্বন্ধ খাড়া করতে হবে। কারণ এ যুগে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সম্বন্ধ—সুখের হোক বা দুঃখেরই হােক,—অবিচ্ছেদ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের কথায়, আমরা পশ্চিমের দুয়ারে দাঁড়িয়েছি ভিক্ষাপাত্র হাতে। তাই পাচ্ছিও তাদের কাছে অবমাননার চাইতে বেশি কিছুই না। প্রতীচ্যের মন জয় করতে হবে আমাদের শক্তি ও প্রতিভা দিয়ে। পাশ্চাত্য সভ্যতা থেকে ভালটুকু সাধনা দিয়ে আয়ত্ত করে নিতে হবে আমাদের ন্যাশনাল চরিত্রে। পশ্চিমকে দেবার আমাদেরও আছে। দানের উপযুক্ত আমাদের আগে হতে হবে। তখন আগ্রহে তারা লালায়িত হাত বাড়িয়ে দাঁড়াবে প্রাচ্যের দরবারে। এ সাম্য-মৈত্রীর যুগেও যে Kipling-49 ‘East is East and West is West and never the twain shall meet’ কথা বিদ্বেষদুষ্ট ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হচ্ছে না, তার কারণ এশিয়ার, বিশেষ করে ভারতবর্ষের, অজ্ঞতা ও স্থবিরতা। ভারতের এ কলঙ্ক-কালিমা মুছাতে হবে, প্রতীচ্যের এ উদ্ধত মনােবৃত্তির অযৌক্তিকতা প্রমাণ করতে হবে একাগ্র সাধনা দিয়ে আমাদের—এ বিংশ শতাব্দীর নবালােকজাগরিত তরুণদলকে।

[১] খ্রিষ্ট-পূর্ব ২০৬ সালের হ্যান রাজত্বকালে প্রাচীন চীনারা কম্পাস আবিষ্কার করে বলে ধারণা করা হয়। তখনকার দিনে এটাকে নিছক খেলা হিসেবেই দেখা হত। তবে যেহেতু কম্পাস সবসময় উত্তর দক্ষিণমুখী হয়ে থাকে, তাই ধীরে ধীরে দিক নির্দেশকের জন্য এর ব্যবহার বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে ১০৪০-১০৪৪ সাল পর্যন্ত সং রাজত্বকালে সামরিকবাহিনীর মাধ্যমে নৌপথ পর্যবেক্ষণের কাজে ব্যবহার করতো। পারস্যে মুসলমানরা ১২৩২ সালে কম্পাস ব্যবহার করা শুরু। আর ইউরোপে ১৩০০ সালে শুষ্ক কম্পাস আবিষ্কৃত হয়।

নতুন লেখার নোটিফিকেশন পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

কপিরাইট সংক্রান্ত

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।

মন্তব্য করুন