পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালিদের অবদান ছিল ব্যাপক। তবু ধর্মভিত্তিক এ রাষ্ট্রটির সঙ্গে শেষ পর্যন্ত মিলিত থাকতে পারেনি এ ভূখণ্ডের মানুষ। মাত্র ২৩ বছরের ব্যবধানে পাকিস্তানের রাজনৈতি মানচিত্র থেকে নিজেদের অপসারণ করে নেয় বাঙালি। কিন্তু ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান থেকে কেন বেরিয়ে এসেছে বাঙালি মুসলমান? সংক্ষিপ্ত এই প্রবন্ধটিতে হাসান মুরশিদ জানাচ্ছেন, পাকিস্তান বিরোধী যে রাজনৈতিক আন্দোলন এই অঞ্চলে সংগঠিত হয়েছে, তার পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে মুসলমানদের প্রগতিশীল অংশের মুক্তবুদ্ধির চর্চা। যার সূচনা বিখ্যাত ‘শিখা’ গোষ্ঠীর হাত ধরে। শিখা গোষ্ঠীর বৃদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনই ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ও অনগ্রসরতার বিরুদ্ধে পরবর্তিতে দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে। —অবিশ্বাস টিম।
মাত্র চব্বিশ বছর আগে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা একটি ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের আত্যন্তিক উৎসাহে মুসলিম লীগকে ভোট দিয়ে পাকিস্তান গড়েছিলেন, তারাই এমন ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি থেকে মুক্ত হয়েছেন, এ কথা এখন প্রায়শ শোনা যায়। কিন্তু কী করে ক্ষুদ্রতার বন্ধন কেটে চিত্তের এই জাগরণ সম্ভব হলো, সে রহস্য কৌতূহল জাগালেও অজানা সাধারণ মানুষের কাছে। অনেকে এমন মনে করেন যে পূর্ব বাংলার সমাজ-অর্থনীতির ক্ষেত্রে নির্লজ্জ ও উদ্ধত পশ্চিমী আক্রমণের মুখে রাতারাতি এ পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। সন্দেহের কারণ নেই, সে হামলা পূর্ব বাংলার সুপ্ত চিত্তকে স্বল্প সময়ে জাগ্রত করেছে এবং আকস্মিক এক প্রচণ্ড আঘাতের ফলশ্রুতিস্বরূপ তার ধর্মীয় মোহ চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক ঔদার্যের বীজ উপ্ত না থাকলে, সহসা তাকে অঙ্কুরিত কিংবা পল্লবিত করা যেতো না। ধর্মবিমুক্ত প্রশস্ত দৃষ্টিলাভের সাধনা পূর্ব বাংলার অন্তত অর্ধ শতাব্দীর। বিপ্রতীপ সমাজ-অর্থনীতির গণ্ডিতে স্বাধীনতা-পূর্ব কালে সে সাধনায় বাঙালি মুসলিম সমাজ সিদ্ধি লাভ করতে পারেনি। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর কালে যুগপৎ পশ্চিমী মুসলমানদের শোষণ এবং হিন্দুদের প্রতিযোগিতার অভাবে শিক্ষাসম্প্রসারণ ও বর্ধিত অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার অনুকূল প্রতিবেশে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে, দীর্ঘদিন-পোষিত ভেদবুদ্ধির অন্ধকার দ্রুত দূর করে তার পক্ষে হৃদয় ও বোধের মহত্ব লাভ করা সম্ভব হয়েছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সাংস্কৃতিক পটভূমি বর্তমান শতাব্দীর প্রথম পাদের শেষ দিকেই ঢাকার কিছু সংখ্যক মুসলমান শিক্ষক ও ছাত্র সাম্প্রদায়িক হীনমন্যতা বিসর্জন দিয়ে তার বদলে ধর্মমুক্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এই শিক্ষক ও ছাত্ররা ১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। ‘শিখা’ নামক একটি সাহিত্য পত্রিকাকে আশ্রয় করে যেহেতু এরা আপনাদের মনোভাব ব্যক্ত করতেন, সে কারণে এদের ‘শিখা গোষ্ঠী’ও বলা হতো। ‘জ্ঞানের দিগন্তকে প্রসারিত করা, বুদ্ধি ও যুক্তির নির্দেশকে প্রতিষ্ঠা করা এবং ধর্মভীরুতার বদলে মনুষ্যত্ববোধকে লালন করা ছিল এই সমাজের লক্ষ্য’। আলোচ্য সমাজের উদ্দেশ্যে সম্বন্ধে সে গোষ্ঠীরই লেখক আবুল ফজল সংক্ষেপে যা বলেছেন, তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। এদের আন্দোলনের নাম দেওয়া হয় ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’।
‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ নামটি যেমন কাজী আবদুল ওদুদ-প্রদত্ত, তেমনি এ আন্দোলনের—আবুল ফজলের ভাষায়—তিনিই ছিলেন ভাবযোগী। আর এর কর্মযোগী ছিলেন আবুল হোসেন। কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হোসেন, কাজী মোতাহার হোসেন এরা তখন অধ্যাপক। আর ছাত্র সদস্যদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আবুল ফজল ও মোতাহার হোসেন চৌধুরী। পরবর্তীকালে উল্লিখিত এ পাঁচজন সাহিত্যিকই তাঁদের রচনায় উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন মুক্তবুদ্ধির। অনোয়ারুল কাদির, তাহেরউদ্দীন, আবদুল কাদির, আবুল মনসুর আহমদ, আবদুল গনি—এঁরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন এ আন্দোলনের সঙ্গে।
‘মুসলিম সাহিত্য সমাজের’ যে বাৎসরিক অধিবেশন হত, সেখানে পঠিত প্রবন্ধসমূহে মুসলিম সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি ও হীনমন্যতাকে, সেকালের তুলনায় যথেষ্ট কঠোর ভাষায় আক্রমণ করা হতো। মুসলমানদের জন্যে চাকুরি সংরক্ষণ রীতির ক্ষতিকারক বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন দিক, কামাল পাশার খেলাফত লোপের যৌক্তিকতা প্রভৃতি নানা বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ পড়া হয়েছে এ সমস্ত অধিবেশনে। যারা এ অনুষ্ঠানসমূহে যোগদান করেছেন অতিথি হিশেবে তাদের মধ্যে বিপিনচন্দ্র পাল, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম ও চারু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এ সমাজের আলোচনা যে তৎকালীন সংকীর্ণতার অনেক উর্ধ্বে ছিলো তার প্রমাণ পাই কট্টর মৌলানা আহমদ আলীর তীব্র বিরূপ সমালোচনা অথবা কাজী নজরুল ইসলামের অকুণ্ঠ প্রশংসা থেকে। নজরুল তাঁর স্বকীয় ভঙ্গিতে এ সমাজের মুক্ত বুদ্ধির প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘আমি যখন সভায় প্রবেশ করলাম তখন অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির সাহেব যে প্রবন্ধটি পড়ছিলেন তাতে স্পষ্টভাষায় উল্লিখিত হয়েছিলো ধর্মবিষয়ে মুসলমানদের অন্ধতা ও মুসলমানদের সমাজমানসে সংকীর্ণতার কথা। শুনে কেবলই আমি আশঙ্কা করছিলাম এই বুঝি পিঠে লাঠি পড়ল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সেটি ঘটেনি। দেখলাম এই সমাজের অনেকগুলো লোক আমার মতোই কাফের’।
কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হোসেন ও কাজী মোতাহার হোসেন ছাড়াও এ সমাজের অপেক্ষাকৃত অল্প বয়স্ক সদস্য মোতাহার হোসেন চৌধুরী এবং আবুল ফজল পরবর্তীকালে পূর্ব বাংলার সাহিত্যক্ষেত্রে মুক্ত বুদ্ধির জয়গান উচ্চারণ করেছেন। মোতাহার হোসেন চৌধুরী তাঁর ‘সংস্কৃতি-কথা’ ও ‘সভ্যতা’ গ্রন্থদ্বয়ে যে প্রশস্ত মানবতার কথা বলেছেন, তা স্ফটিকস্বচ্ছ মুক্তমনেরই পরিচায়ক। স্বল্পায়ু বলে তিনি যথেষ্ট লিখতে না পারলেও, তাঁর মহৎ প্রতিভার দ্যুতি দৃষ্টিকে কখনোই প্রবঞ্চনা করতে সক্ষম হয়নি।
আবুল ফজলের বয়স বর্তমানে প্রায় সত্তর বছর; কিন্তু বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এদেশীয় সাধারণ রীতি অনুসারে তিনি ধর্মীয় মোহে আচ্ছন্ন হননি। বরং প্রতিনিয়ত তার মন আধুনিকতা ও প্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছে। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজ ভাবনায় তিনি ধর্মকে প্রাপ্যের চেয়ে বড়ো আসন কখনোই দেননি।
পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি, ধর্মীয় শিক্ষার নামে সাম্প্রদায়িক শিক্ষাদানের প্রয়াস, কৃত্রিম ইসলামি সংস্কৃতি ও পূর্ব বাংলার এক শ্রেণির সাহিত্যিকের ইসলামি ও পাকিস্তানি সাহিত্য-রচনার প্রযত্ন সব কিছুকেই চিরতরুণ আবুল ফজল সাহসের সঙ্গে আঘাত করেছেন। এবং তাঁর মতো মুক্ত বুদ্ধির অধিকারী সংস্কৃতিসেবীদের অব্যাহত সংগ্রামের মুখেই পূর্ব বাংলায় জন্মলাভ করেছে আজকের বহু প্রশংসিত অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি।
প্রাক-স্বাধীনতা কালের বাংলা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পাক সরকার বারংবার অস্বীকার করতে চেয়েছেন। সুবিধাভোগী ও সুবিধাবাদী সাংস্কৃতিক দালালরা সরকারের প্রস্তাবিত তহজিব ও তমদ্দুনের প্রচারে আপ্রাণ প্রযত্ন করেছেন। তবু ধর্মীয় নেশা থেকে মুক্ত হবার যে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন আবুল ফজল ও তাঁর মতো অন্য লেখকরা তা-ই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে। সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের ক্ষীণ যোগসূত্র সম্বন্ধে আবুল ফজল বলেছেন, প্রচলিত ধর্মীয় আচার বা শিক্ষা সংস্কৃতি নয়। যে-কোনো ধর্মাবলম্বী হয়েও লোক আনকালচার্ড থাকতে পারে। সাম্প্রদায়িক সংস্কার ও তার মোহ ত্যাগ করতে না পারলে প্রকৃত সংস্কৃতিসাধক হওয়া যায় না। পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে অতঃপর আবুল ফজলের মন্তব্য, সরকারি সকল প্রচার সত্ত্বেও তা আর যাই হোক ধর্মীয় উত্তরাধিকার নয়। কেননা ‘সংস্কৃতি আজ অনেকখানি পেশাওয়ারি রূপ নিয়েছে — ধর্ম আর ভূগোল তাতে আর এখন হালে পানি পাচ্ছে না’।
ধর্মসম্পৃক্ত রাজনীতি যে অত্যন্ত অবাস্তব, অনাধুনিক ও প্রতিক্রিয়াশীল এবং তার ফলাফল যে একান্তই বিষময় আবুল ফজল সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধর্মের ধরতাই বুলি যে নিতান্তই রাজনৈতিক হাতিয়ার এবং মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামি, নেজামে ইসলাম, পাকিস্তান ডেমোক্রটিক পার্টি প্রভৃতি কয়েকটি দল তাকে আপনাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপায় হিশেবেই কাজে লাগায় (যদিও নিজেরা প্রচারিত আদর্শে অবিশ্বাসী), একথা সুস্পষ্টভাবে আবুল ফজল বলেছেন। রাজনীতিতে ধর্মের দোহাই দেওয়া আবুল ফজলের কাছে অনভিপ্রেত, তেমনি শিক্ষার মৌলনীতি হিশেবে ইসলামের কথা বলা তার কাছে সমান ঘৃণার বস্তু। ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়ার বর্তমান জঙ্গী সরকার একটি শিক্ষানীতি রচনা করেন। তাতে ধর্মীয় শিক্ষার প্রস্তাব ছিলো। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির সমর্থনে পূর্ব বাংলার সবগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল শিক্ষক এবং অন্যান্য উদার বুদ্ধিজীবী এক যোগে দাবি জানান। ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অবশ্য ‘ইসলামি ছাত্র সংঘ’ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো— ইসলাম যাদের মূলধন ও হাতিয়ার প্রবল বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। প্রকৃতপক্ষে, ইসলামি ছাত্র সংঘের একটি ধর্মান্ধ ও ধর্মোন্মাদ ছাত্র, তাদের ভাষায়, এই মহান কারণে শহীদ হন। আবুল ফজল, যদিও মাদ্রাসায় লেখা-পড়া শিখেছেন এবং পড়িয়েছেন, প্রত্যাশিতভাবেই স্বভাববিরুদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষানীতির সমর্থন করতে পারেননি। ‘সমকালীন চিন্তা’ গ্রন্থে তাঁর সেই উদার ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বিধৃত আছে। ‘সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন’ ‘সমাজ সাহিত্য রাষ্ট্র’ ‘রাঙ্গা প্রভাত’ ‘রেখাচিত্র’ প্রভৃতি গ্রন্থে ওঁর মুক্তমনের পরিচয় অনায়াসলভ্য।
স্বাধীনতা লাভের পূর্ব থেকেই বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মতো একটি ধর্মবিমুক্ত সাংস্কৃতিক ধারা বাঙালি মুসলিম-সমাজে চলে আসছিলো। তারই জন্যে অনুকূল পরিবেশে স্বল্পকালের পরিধিতে পূর্ব বাংলার অসাম্প্রদায়িক একটি চরিত্র গঠিত হতে পেরেছে। অকস্মাৎ মহাশূন্য থেকে এ ঔদার্য বাঙালিদের ওপর আরোপিত হয়নি, রীতিমতো সাধনার দ্বারা তাঁরা তা অর্জন করেছেন।