প্রবন্ধধর্মযে বিষফোঁড়া লুকানো যাচ্ছে না

যে বিষফোঁড়া লুকানো যাচ্ছে না

সাধারণত দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের শিশুরা এই মাদরাসাগুলোয় পড়াশোনা করে। পড়াশোনা করতে গিয়েই শিকায় হচ্ছে বিভৎস যৌন নির্যাতনের। আর নির্যাতক কারা? ওই ধর্মানুভূতি সম্পন্ন ইসলামের সেবকগণ। অর্থাৎ মাদরাসার হুজুর। যারা ধর্ষণের কারণ হিসেবে দায়ী করে নারীর পোশাক, চালচলন ও ঘরের বাইরে নারীর স্বাধীন পদচারণাকে। যারা হত্যা করতে চায় সমকামী মানুষদের। সেই হুজুররাই মাদরাসাগুলোতে শিশুদের ওপর চালায় যৌন নির্যাতন। যেহেতু অধিকাংশ শিশু দরিদ্র এবং অনেকেই অনাথ, ফলে নিরবেই এই নির্যাতন সহ্য করে নেয় তারা। এছাড়া পরলোকের ভয়, আর বেতের ভয় অবুঝ বালকগুলোকে সর্বদাই তাড়িত করে।

যে বিষফোঁড়া লুকানো যাচ্ছে না

সাধারণত দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের শিশুরা এই মাদরাসাগুলোয় পড়াশোনা করে। পড়াশোনা করতে গিয়েই শিকায় হচ্ছে বিভৎস যৌন নির্যাতনের। আর নির্যাতক কারা? ওই ধর্মানুভূতি সম্পন্ন ইসলামের সেবকগণ। অর্থাৎ মাদরাসার হুজুর। যারা ধর্ষণের কারণ হিসেবে দায়ী করে নারীর পোশাক, চালচলন ও ঘরের বাইরে নারীর স্বাধীন পদচারণাকে। যারা হত্যা করতে চায় সমকামী মানুষদের। সেই হুজুররাই মাদরাসাগুলোতে শিশুদের ওপর চালায় যৌন নির্যাতন। যেহেতু অধিকাংশ শিশু দরিদ্র এবং অনেকেই অনাথ, ফলে নিরবেই এই নির্যাতন সহ্য করে নেয় তারা। এছাড়া পরলোকের ভয়, আর বেতের ভয় অবুঝ বালকগুলোকে সর্বদাই তাড়িত করে।

বাঙালি মুসলমানের মনে বড় দুঃখ। তাদের ধর্মানুভূতি কেবলই আহত হয়। সকালে আহত হয়, বিকালে আহত হয়, সন্ধ্যায়, দুপুরে, গভীর রাতে তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। না, দুনিয়াব্যপী দুর্বৃত্তের প্রবল আধিপত্যে নয়। হত্যা-ধর্ষণ, দুর্নীতির সীমাহীন প্রাদুর্ভাবেও নয়। মানবতার কিংবা নৈতিকতার চরম অবক্ষয়েও নয়। নয় কোন বেদনার্ত শিশুর গভীর ক্রন্দনে। অসুন্দর দৃশ্য নয়, শব্দ দূষণ নয়, নর্দমার দুর্গন্ধেও বিচলিত নয় বাঙালি মুসলমান। তাদের বিচলন কেবলই ধর্মানুভূতিতে।

কেউ হাসলে তাদের ধর্মানুভূতি আহত হয়। কেউ নিঃসঙ্কোচে কথা বললে তাদের ধর্মানুভূতি আহত হয়। কেউ কারো বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গেলে তাদের ওই বিশেষ অনুভূতিটি আহত হয়। কার্টুন আঁকলে, ভাস্কর্য গড়লে, দুর্গাপূজায় প্রতিমা তৈরি হলে তাদের ধর্মানুভূতি আহত হয়। পরিস্থিতি এমন হয়েছে ঠিক কীসে, আধুনিক কোন্ চিন্তায়, তাদের ধর্মানুভূতি আহত হয় না সেটাই এখন গবেষণার বিষয়।

এই আহত হতে হতে তারা আবার ভোগে ষড়যন্ত্রের দুঃস্বপ্নে। তাদের অভিযোগ, পৃথিবীর সকলেই তাদের ও তাদের ধর্মকে নিয়ে রাতদিন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ষড়যন্ত্রে ষড়যন্ত্রে বিপর্যস্ত বাঙালি মুসলমানের দেহ-মন। ইসলামের বিরুদ্ধাচারণকারিদের জবাব দিতে গিয়ে তারা হাতে তুলে নিয়েছে চাপাতি। খুন করতে দ্বিধা করছে না ভিন্ন চিন্তার মানুষকে। ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ তুলে জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে ভিন্ন ধর্মের বাড়িঘর। এমনকি রেহাই পাচ্ছে না অনেক মুসলমানও। সংখ্যালঘুদের বাড়ি ঘরে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে এই বাঙালি মুসলমান ভাবে, ইসলাম হুমকীর মুখে; সংখ্যালঘুর জমি দখল করতে করতে বাঙালি মুসলমান ভাবে, মুসলমান বলেই আজ সে এত নির্যাতিত!

এদিকে আবার এই নির্যাতিত মুসলামানই রাজপথে হুঙ্কার দিয়ে দিয়ে ঘোষণা করবে, ৯৯ ভাগ মুসলামানের দেশে এই চলবে না, সেই চলবে না। ৯৯ ভাগ মুসলমানের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা চলবে না, নারীদের মুক্ত চলাচল চলবে না; এই নির্যাতিত মুসলমান, আহত মুসলমান, নির্যাতিত হতে হতে, আহত হতে হতে মাইকে ঘোষণা দিয়ে জড়ো করবে মুসল্লি। তারপর চালাবে তাণ্ডব, কখনও হিন্দু বাড়িতে, কখনও রামুতে, কখন রাজপথে, শাপলায়, সারাদেশে তাদের তাণ্ডবে সন্ত্রস্ত জনপদ। তবু তারা আহত, তবু তারা নির্যাতিত।

এই নির্যাতিত মুসলিম প্রায়শই রাস্তায় নামে বিভিন্ন দাবী-দাওয়া নিয়ে। সেই সাথে শুরু করেছে পুলিশি কার্যক্রম। অর্থাৎ কোথাও ইসলামের তথাকথিত অবমাননা হলে তারা নিজেরাই অ্যাকশনে নেমে পড়ছে। রীতিমতো বাইনোকুলার দিয়ে খুঁজে খুঁজে তারা ইসলাম বিরোধিদের শনাক্ত করছে। তাদের সেই পুলিশি কার্যক্রমে রাষ্ট্রও যথাসাধ্য সহযোগিতা করে যাচ্ছে। আগামী দিনে এই ইসলামিস্টরা বাংলাদেশের বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।

*
গত বই মেলায় একটি উপন্যাস প্রকাশ করেছিল ‘জংশন’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা। বইটির নাম ‘বিষফোঁড়া’, লেখক সাইফুল বাতেন টিটো। কিন্তু অতি দ্রুতই নিষিদ্ধ হয়ে যায় উপন্যাসটি। তার কারণ এটি নাকি মুসলমানদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। ফলে সরকারি বেসরকারি ধর্মীয় পুলিশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। মেলার স্টল থেকে নিয়ে যায় বই। অনলাইনে, অফলাইনে বইটির বিরুদ্ধে শুরু হয় প্রচারণা। আমাদের মোল্লা-বান্ধব, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ সরকার দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেয়। নিষিদ্ধ হয়ে যায় উপন্যাসটি। উপন্যাসকে ‘জননিরাপত্তার জন্য হুমকি’ হিসেবে বিবেচনা করে ১৮ জুন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণার বিজ্ঞপ্তি ২৪ আগস্ট গেজেট আকারে প্রকাশ করে সরকার। (সূত্র: বাংলাট্রিবিউন)

কী আছে উপন্যাসটিতে? বইিটর প্রচ্ছদেই লেখা আছে—কওমি মাদরাসার শিশুধর্ষণ উপাখ্যান। আমাদের দেশের কওমি মাদরাসার ভেতরকার খবর খুব একটা বাইরে আসে না। সেখানকার ভেতরের অন্ধকার দিকটি তুলে ধরেন লেখক তার উপন্যাসে। লেখক ভূমিকায় জানাচ্ছেন, এই বইটি রচনা করতে তিনি সরেজমিনে ঘুরছেন মাদরাসাগুলোতে। অর্থাৎ এটা কোন কল্প উপাখ্যান নয়। উপন্যাসের কাঠমোতে এই বইয়ের মধ্যে দিয়ে তিনি তুলে এনেছেন অপ্রকাশিত এক সত্যকে। যাকে তিনি চিহ্নিত করেছেন কওমি মাদরাসার ‘বিষফোঁড়া’ হিসেবে।

কওমি মাদরাসাগুলো সাধারণত আবাসিক হয়। সাধারণত দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের শিশুরা এই মাদরাসাগুলোয় পড়াশোনা করে। আর পড়াশোনা করতে গিয়েই শিকায় হচ্ছে বিভৎস যৌন নির্যাতনের। আর নির্যাতক কারা? ওই ধর্মানুভূতি সম্পন্ন ইসলামের সেবকগণ। অর্থাৎ মাদরাসার হুজুর। যারা ধর্ষণের কারণ হিসেবে দায়ী করে নারীর পোশাক, চালচলন ও ঘরের বাইরে নারীর স্বাধীন পদচারণাকে। যারা হত্যা করতে চায় সমকামী মানুষদের। সেই হুজুররাই মাদরাসাগুলোতে শিশুদের ওপর চালায় যৌন নির্যাতন। যেহেতু অধিকাংশ শিশু দরিদ্র এবং অনেকেই অনাথ, ফলে নিরবেই এই নির্যাতন সহ্য করে নেয় তারা। এছাড়া পরলোকের ভয়, আর বেতের ভয় অবুঝ বালকগুলোকে সর্বদাই তাড়িত করে। কি ভয়াবহ বিষয়! সারাদেশে, অসংখ্য মাদরাসায় প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে এমন নির্যাতন! একজন ইসলামিস্টও এ নিয়ে টু শব্দ করতে নারাজ। সেই না বলা কথাই উঠে এসেছে টিটোর ‘বিষফোঁড়ায়’।

কিন্তু দিন রাত এর ওর ভুল খোঁজা ইসলামিস্টরা পছন্দ করেনি নিজের অন্ধকার ইতিহাস। ‘বিষফোঁড়া’ নিষিদ্ধ করে লুকাতে চেয়েছে নিজেদের অন্যায় ইতিহাস। তাতে খানিক সাফল্য পেলেও শেষ পর্যন্ত মাদরাসার বিষফোঁড়া লুকানো যাচ্ছে না। যাচ্ছে না, কারণ ধীর ধীরে মুখ খুলতে শুরু করেছে মাদরাসার ভিক্টম ও তাদের পরিবার। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও থেকে খবর আসছে মাদরাসার শিক্ষক কর্তৃক শিশু ধর্ষণের। গ্রেফতারও হচ্ছে অনেকে। যদিও সেই সংখ্যাটা খুবই নগন্য।

সাইফুল বাতেন টিটোও তার উপন্যাসের ভূমিকায় জানাচ্ছেন, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসছে, তা প্রকৃত ঘটনার তুলনায় খুবই কম। এমনকি অনেক যৌন নির্যাতনের সংবাদ পত্রিকায়ও আসছে না। মাদরাসার শিক্ষক দ্বারা ছাত্র ধর্ষণের কিছু ঘটনা প্রকাশ্যে আসলেও সিনিয়র ছাত্র দ্বারা জুনিয়র ছাত্রের ওপর নির্যাতনের খবর একেবারেই গোপন হয়ে আছে। অথচ এই ধরনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে মাদরাসাগুলোতে।

অবিশ্বাসের টাইমলাইনে মাদরাসায় ছাত্রছাত্রী নির্যাতনের একটি পরিসংখ্যান রাখার চেষ্টা করা হয়। মূলত দেশের গণমাধ্যমের যে খবরগুলো প্রকাশিত হয় তার ভিত্তিতেই পরিসংখ্যানটা করা। যদিও লোকবল সংকটে সেই তালিকাটা ঠিকভাবে রাখা যায় না। তবু যে হিসাবটা উঠে আসছে তাও কম আতঙ্কের নয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের ৯ তারিখ পর্যন্ত ১৭০ জন ছাত্রছাত্রী মাদরাসা শিক্ষক কর্তৃক যৌন নির্যাতন/ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যার মধ্যে ৩৭ জন মেয়ে। তবে প্রকৃত সংখ্যাটা এর চেয়ে বেশি। পাঠক যদি শুধু অবিশ্বাসের টাইমলাইনটা ফলো করেন তবে শিউরে উঠবেন। প্রায় প্রতিদিনই মাদরাসায় নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে; বিরামহীনভাবে। এখানে মনে রাখা দরকার সব ঘটনা দেশের গণমাধ্যমেও উঠে আসে না। স্থানীয়ভাবে বা মাদরাসার ভেতরই অনেক ঘটনার মীমাংসা হয়ে যায়। মীমাংসা মানে আপোষ। ধর্মের দোহাই দিয়ে চেপে যাওয়া হয় বেশরভাগ ঘটনাই।

কিন্তু এতো এতো পুলিশি করে, মাদরাসায় কঠোর অবরোধ আরোপ করেও মাদরাসার শিশু নির্যাতনের বিষফোঁড়া লুকনো যাচ্ছে না। আসলে সম্ভব নয়। ফোঁড়া একদিন চামড়া ভেদ করেই বেরিয়ে আসেবেই। হুজুরদের প্রবল শাসন, ধর্মীয় গোঁজামিল, জাহান্নাম-জান্নাতের লোভেও কণ্ঠরোধ করা যাচ্ছে না নির্যাতিতদের। ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহী হয়ে উঠছে নির্যাতিত শিশুরা, তাদের পরিবারও বেরিয়ে আসতে চাইছে অবদমন থেকে। তারই প্রকাশ দেখা যাচ্ছে, সমাজে প্রবল সম্মানিত, এর বাড়ি ওর বাড়ি ফ্রিতে গোস্ত-রুটি খাওয়া, শিশু ধর্ষণকারী হুজুরদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে মুখ খুলতে শুরু করেছে মানুষ। গ্রন্থ নিষিদ্ধ করেও আর পার পাচ্ছে না ধর্মব্যবসায়ী ধর্ষকরা। বেরিয়ে আসছে বিষফোঁড়া।

নতুন লেখার নোটিফিকেশন পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

কপিরাইট সংক্রান্ত

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।

মন্তব্য করুন