প্রবন্ধদর্শনবাঙালি সংস্কৃতির ভিতর ও বাহির । আলী আনোয়ার

বাঙালি সংস্কৃতির ভিতর ও বাহির । আলী আনোয়ার

আধুনিকতার একটি মিথ্যে নির্মোকে আবৃত হয়ে বাস করতে লাগলাম। কিন্তু আমাদের মনোজগৎ দখল করে রাখলো মধ্যযুগীয় ভাবনা বিশ্বাস ও সংস্কার। পানি-পড়া, ঝাড়-ফুক, তুকতাক, পীর-মুর্শেদ, মাজার-খানকা শরিফ, যাদু টোনা, তাবিজ-কবজ, ভূত-প্রেতে বিশ্বাস থাকলো অবিচল তিনশো বছর আগের মতই। আধুনিকতা ও আধুনিকায়নের মধ্যে একটা বৈপরীত্য ও বিচ্ছেদ রচিত হল আমাদের মনে।

বাঙালি সংস্কৃতির ভিতর ও বাহির । আলী আনোয়ার

আধুনিকতার একটি মিথ্যে নির্মোকে আবৃত হয়ে বাস করতে লাগলাম। কিন্তু আমাদের মনোজগৎ দখল করে রাখলো মধ্যযুগীয় ভাবনা বিশ্বাস ও সংস্কার। পানি-পড়া, ঝাড়-ফুক, তুকতাক, পীর-মুর্শেদ, মাজার-খানকা শরিফ, যাদু টোনা, তাবিজ-কবজ, ভূত-প্রেতে বিশ্বাস থাকলো অবিচল তিনশো বছর আগের মতই। আধুনিকতা ও আধুনিকায়নের মধ্যে একটা বৈপরীত্য ও বিচ্ছেদ রচিত হল আমাদের মনে।

দীর্ঘ এই প্রবন্ধে আলী আনোয়ার বাঙালি সংস্কৃতির অন্দরমহলে পরিভ্রমণ করেছেন দারুণ বিশ্লেষণী মন নিয়ে। উপমহাদেশের ইংরেজদের আগমণ ও কলকাতাকে কেন্দ্র করে উনবিংশ শতাব্দিতে বাঙালি মননে যে নতুন জোয়ার এসেছিল তারই ধারাবাহিক বয়ান রয়েছে তার প্রবন্ধে। পাশ্চাত্য শিক্ষা এই অঞ্চলে যে অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল ও পরবর্তিতে বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, চিন্তায় কিরকম পরিবর্তন এসেছে তা বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে আলী আনোয়ারের এই লেখায়।


এক
সংস্কৃতির ভিতর ও বাহির বলতে দুটি দিক বোঝানো যায়: একটি মানুষের মানস জীবন—তার ধারণা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও সৌন্দর্যাভিমুখিতা, অন্যটি তার সমাজজীবন–কাঠামো বিন্যাস, ঘটপট-স্থাপত্য-প্রযুক্তি, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এই দুটি মিলিয়েই তার অস্তিত্ব, তার পরিচয়, তার আত্মচেতনা ও গোষ্ঠীচেতনা। সব মিলিয়েই মানুষের সংস্কৃতি এবং সংস্কৃতির বাইরে কোন মানুষ নেই। মানুষ একটি সাংস্কৃতিক প্রাণী। কথাটি যেমন সরলভাবে বলা গেল, ব্যাপারটি মোটেও তেমন সরল নয়। কারণ সংস্কৃতির প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য বলেও দুটি দিক আছে : জাতিবিদ্বেষ, শ্রেণী-নির্যাতন, নারী-শিশু-দুর্বল মানুষের প্রতি নিষ্ঠুরতা সেই অপ্রকাশ্য দিক। অপ্রকাশ্য বলে তা গোপনে চিরবহমান কিন্তু সহজ ব্যাখ্যাধিগম্য নয়। পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটি একদিন স্কুল থেকে এসে যখন বলে: ‘জানো আব্বা বাসুদেব কাকারা না কি হিন্দু, আর আমরা মুসলমান!’ তখন লক্ষ্য করি না যে, সংস্কৃতি ঐ বিভাজনটি সম্পর্কে আমার মেয়েকে সচেতন করে তুলেছে। সংস্কৃতিই আমাদের আপন-পর, হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল, ছোটলোক বড়লোক, চাষাভুষো, গ্রামীণ-নাগরিক, স্ত্রী-পুরুষ, নানা আরোপিত, অস্বাভাবিক, অন্যায় নির্যাতনমূলক, ও অসম্মানসূচক বিভাজন সম্পর্কে, তার তাৎপর্য সম্পর্কে, আমাদের অবহিত করে। শুধু অবহিতই করে না, তা আমাদের মনোভঙ্গি ও ব্যবহারও নিয়ন্ত্রণ করে। এতটাই করে যে, আমরা ঐসব বিভাজনকে চিরন্তন প্রকৃতিদত্ত, স্বাভাবিক ও বৈধ বলে ধরে নিই। তাই যখন গল্পের সেই ছোট্ট মেয়েটি ধৃত চোরকে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে যে, ‘ও চোর কোথায়, ওতো মানুষ!’ তখন আমাদের অভ্যস্ত চিন্তা হঠাৎ ধাক্কা খায়। লালন এই চিন্তাটিকেই কি প্রকাশ করেননি তার গানে: ‘লোকে বলে, লালন কি জাত সংসারে’? লালন প্রশ্নটি করেছেন বলেই সেটি আর শিশু-সুলভ প্রশ্ন থাকে না, তা সামাজিক অস্বাভাবিক বিভাজনসমূহের তীব্র সমালোচনাও হয়ে ওঠে। কাজেই সংস্কৃতির ব্যাপারটি মোটেও সরল নয়।

আমরা অন্যকে দেখতে পাই, কিন্তু নিজেকে দেখতে পাই না। তার জন্য দর্পণের প্রয়োজন হয়। সমাজও হচ্ছে দর্পণ। সমাজ মানে অন্যলোক: অন্যেরই চেনার আলোক দিয়ে আমি চিনি আপনারে। অন্যের ভালোবাসায় বা উপেক্ষায়, ঘৃণায় বা ভ্রুকুটিতে, স্বীকৃতিতে বা অবজ্ঞায় আমার প্রতি অন্যের যে মনোভঙ্গি প্রতিফলিত হয়, তাই দিয়ে নিজের মূল্যায়ন করি। ঐ সমাজ দর্পণে বিম্বিত আমির সঙ্গে আমার একান্ত দর্পণে বিম্বিত আমিকে মেলাই এবং তদনুযায়ী আনন্দিত বা বিষণ্ন হই; সার্থকতার বোধ দ্বারা উজ্জীবিত হই বা ব্যর্থতার বোধ দ্বারা আক্রান্ত। যে মূল্যমানে নিজেকে বিচার করি তাও সমাজ থেকে গৃহীত, অন্যকে যে বিচার করি তাও ঐ সমাজ থেকেই গৃহীত। কবে গ্রহণ করলাম জানি না তা। বস্তুত ঐ গ্রহণের প্রক্রিয়াটি শৈশব কাল থেকেই চলতে থাকে এবং তার অনেকটাই অসচেতন। বড়ো আগ্রহের সঙ্গে ঐ মূল্যমান গ্রহণ করি কারণ আমি সমাজের স্বীকৃতি চাই, সমাজ আমাকে আপন বলে গ্রহণ করুক এমনটি চাই। সমাজে আমার ভূমিকা সুনিশ্চিত করতে চাই তথা ক্ষমতার সাথে সংলগ্ন থাকতে চাই।

এই মূল্যমান অবশ্য বায়ুভূত নির্দেশমালা নয়, ঐ মূল্যমান জীবনের অর্থবিন্যাসেরই নর্ম্যাটিভ নিদান স্বরূপ। ঐ অর্থারোপকেই বলে সংস্কৃতি। সংস্কৃতি মানেই সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা। ঐ অর্থারোপিত হয় জীবনের সমস্ত দিকের ওপরই। সমস্ত দিক বলতে আচার-আচরণ, ধ্যান-ধারণা, ধর্মবিশ্বাস, নান্দনিক বোধ, নৈতিকতা সব কিছুই। আমাদের চারপাশের যে জগৎ তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও ইন্দ্রিয়াতীত সমস্ত প্রপঞ্চ, বস্তু ও নির্বস্তু কল্পনা ও যুক্তি, বাসনা ও বিভ্রম সবই সংস্কৃতি কর্তৃক সংজ্ঞায়িত ও ব্যাখ্যাত হয়। ঐ ব্যাখ্যাই আমাদের জীবনের ব্যাখ্যা। ঐ ব্যাখ্যা ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। আমরা সকলেই মাথায় ঐ অর্থবিন্যাস বহন করি। তবে ঐ অর্থ সমুচ্চয় সর্বতো সমসত্ত্ব নয়। স্থান ও কালভেদে, শ্রেণী ও স্তরভেদে, গোত্র ও গোষ্ঠী ভেদে তা কিছুটা আলাদা হয়েই যায়। তবে কেবল মাত্র শ্রেণীদূরত্ব বা গোত্র বিচ্ছিন্নতাই কেবল লোকের চিন্তার জগৎটি বিচ্ছিন্ন করে দেয় তা নয়, আমাদের একই ধর্ম, শ্রেণী বা সমাজভুক্ত ব্যক্তির মাথাতেও ঐ পরিবাহিত অর্থসমুদয়ের সীমা ও প্রকরণ এক থাকে না, এমনকি সব সময় সমন্বিতও থাকে না। নানা বিরোধী ভাবনা বহন করেই আমরা আমাদের জীবন অতিবাহিত করি। ঐ স্ববিরোধ সম্পর্কে আমরা সচেতনও থাকি না।

চিরকাল অবশ্য এমনটি ছিল না। মানব সভ্যতার কয়েক হাজার বছরের একটা দীর্ঘ পর্যায় ছিল যখন ধর্মই ছিল সকল অর্থের উৎস। মানুষের সব ভাবনা ও চিন্তাকে ধারণ করতো ধর্ম। সমাজের সকলেই ছিল ঐ ধর্ম অনুশাসিত ব্যাখ্যার অনুসারী। ঐ ভূয়োদর্শনের ছিল একটা সমগ্রতা ও সমন্বিত রূপ। ব্যক্তি ছিল ঐ সমগ্রের অংশ। তার একক অস্তিত্ব বা ভাবনা বলে কিছু ছিল না। কিন্তু সমাজ। বদলাচ্ছিল, বদলাচ্ছিল পৃথিবীর ভূগোল, অভিজ্ঞতার আধার ও উপাত্ত, বদলাচ্ছিল চিন্তার আদল। ঐ অদৃষ্টপূর্ব অভিজ্ঞতা ও উপাত্ত যেসব প্রশ্নের অবতারণা করল সনাতন ভাবনা ও বিশ্বাসে তার যথাযথ উত্তর পাওয়া যাচ্ছিল না। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় সমাজের পরিবর্তনের ইতিহাসটি নানা কারণে আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক। বুদ্ধিজীবীদের মনে প্রশ্নবোধকতা ও সংশয় ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছিল। ফলত বিশ্বাসকে পাশ কাটিয়ে বিশ্লেষণের নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত ও ব্যবহৃত হতে লাগল। সপ্তদশ শতক থেকে ইউরোপে একটি ভাববিপ্লবের সূচনা হল যার চূড়ান্ত ফল আজকের আধুনিকতা। গ্যালিলিও ও নিউটন, দেকার্তে ও কান্ট, হবস, রুশো, ডারউইন ও হেগেল, মার্কস ও ফ্রয়েড জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে তত্ত্বসমূহের অবতারণা করলেন তাতে ব্যাখ্যাদানকারী হিসেবে ধর্মের তথা খ্রিষ্টধর্মের প্রতিষ্ঠা নষ্ট হয়ে গেল। শুধু তাই নয় বৈজ্ঞানিক যুক্তির অবলোকনের সামনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গভীরতম রহস্যও উন্মোচিত এমন একটি প্রত্যয় দেকার্তে থেকে লাপ্লাস পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল দেখতে পাই। নেপোলিয়নকে লাপ্লাস তার গ্রন্থ ‘এসেজ অন প্রবাবিলিটি’ দিয়ে এলে নেপোলিয়ন প্রশ্ন করেছিলেন আপনার গ্রন্থে ভগবানের কোন উল্লেখ নেই কেন? লাপ্লাস উত্তরে বলেছিলেন: ‘I have no need for that hypothesis’। এর ফলে শিক্ষিত জনের মধ্যে যে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হল আজো তার নিরসন হলো না। গভীর ধর্মবিশ্বাসী মিল্টন সংশয় তাড়িত হয়ে গ্যালিলিওর সঙ্গে গোপনে দেখা করলেন। বাইবেলে বর্ণিত কাহিনীর ওপর নির্ভর করে ‘প্যারাডাইস লস্ট’ নামক মহাকাব্য রচনা করলেন যার নায়ক প্রথম মানুষ আদম। কিন্তু অষ্টাদশ শতকে এসে সেই ‘হৃত-স্বর্গের স্বপ্ন আর ত্যাগে’র মত প্রতিষ্ঠা পেল না। বরং শেলির দেবদ্রোহী প্রমিথিউস ও গ্যেটের কালাপাহাড়ি ড. ফস্টাস ঊনবিংশ শতকের মনোভূমি যেন দখল করে নিল। বহমান চিন্তার অভিঘাতে ধর্মাশ্রয়ী জ্ঞানের সমগ্রতা ও সমন্বিত রূপটি যেমন গেল চূর্ণ হয়ে, তেমনি সংশয় আক্রান্ত মন ধর্মীয় ট্রান্সডেন্টালিজম থেকে আশ্রয়চ্যুত, নির্বাসিত বোধ করতে লাগল। অনিশ্চয়তা ভারাক্রান্ত বুদ্ধিজীবীরা বিকল্প ভাবাদর্শের সমগ্রতার সন্ধানে আশ্রয় ও সান্ত্বনা খুঁজল সংস্কৃতির বিশাল পাতালে। লুকাচ বললেন, ঊনবিংশ শতকে যে উপন্যাসের বিকাশ ও জনপ্রিয়তা তা ঐ অর্থানুসন্ধানেরই পরোক্ষ প্রকাশ, ‘Transcendental homelessness’-এর আকুতি দ্বারা প্ররোচিত। ম্যাথু আর্নল্ড বললেন, বিশ্বাসরিক্ত পৃথিবীতে কবিতাই ধর্মের স্থান দখল করবে একদিন এবং সংঘাত মুখর রক্তলাঞ্ছিত মানব সমাজে যেখানে মানুষ, ‘Swept with confused alarms of struggle and flight/where ignorant armies clash by night.’ সেখানে সংস্কৃতিই আনবে শান্তির উপাচার।

ম্যাথু আর্নল্ড স্বদেশীয় শ্রমিক বিদ্রোহ রাজনৈতিক সংঘাত ও সামাজিক বিপর্যয়ের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সম্ভাব্য প্রতিষেধক হিসেবে সংস্কৃতি বিচারকে এনেছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে। তাঁর গ্রন্থটির নামকরণই করেছিলেন ‘সংস্কৃতি ও নৈরাজ্য’ (১৮৬৮)। তিনি সংস্কৃতিকে স্থাপন করেছিলেন সামাজিক নির্বেদ ও নৈরাজ্যের বিপরীত কোটিতে। সংস্কৃতিকে ধরেছিলেন সৌষম্য ও বৈদগ্ধের মানবিক মাধুর্য ও মননের প্রকাশ রূপে। মানুষের পাশবিকতাকে প্রশমিত করতে হবে। ব্যাপক নৈরাজ্যের কারণ প্রচলিত সমাজ ও সভ্যতার সীমাবদ্ধতা : ‘Men of culture and poetry are again and again failing, failing conspicuously, in the necessary first stage to a harmonious perfection, in the subduing of the great obvious faults of our animality.’ মৌলবাদী পিউরিটানরা অতীতে সে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাদের অসহিষ্ণুতায় তারা মানব মাধুর্যের ও মননের আলোর দিকটি বিস্মৃত হয়েছিলেন।

আর্নল্ড চান সমাজের সকল স্তরে ঐ ‘মাধুর্য ও মননে’র চর্চা। কিভাবে সেটি হতে পারে তারও ইঙ্গিত দিয়েছেন।

এর পর থেকে একশ বছর ধরে যে সংস্কৃতির প্রশ্নটি নিয়েই নিরন্তর আলোচনা চলে আসছে তার কারণ আর কোন প্যারাডাইম নেই জ্ঞানের সমগ্রতাকে ধরার। এরিক কাহলার, ওর্তেগা ই. গাসেত, আন্তনিয় গ্রামসি, টি. এস. এলিয়ট, সি. পি. স্নো, এফ. আর. লিভিস, জর্জ স্টাইনার, রেমন্ড উইলিয়ামস, অ্যালান বস্নুম, আর্নেস্ট গেলনার, এডওয়ার্ড সাঈদ, ফ্রানৎস ফানন, অমর্ত্য সেন প্রমুখ চিন্তাবিদ নানা দিক থেকে আজকের সমাজে সংস্কৃতির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এরা সকলেই আপন আপন দেশ ও সমাজের সমস্যা ও সঙ্কটের প্রেক্ষিত থেকে ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রকৃতি, তার শক্তি ও সামর্থ্য, হতাশা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। কেউই ‘ভিক্টোরীয় লিবারাল স্বপ্নের কাল্পনিক বাগানে’ আবদ্ধ থাকেননি। বরং কুড়ি বৎসরের ব্যবধানে দুইটি বিশ্বযুদ্ধের সুপরিকল্পিত মারণ-যজ্ঞে তিন কোটি লোকের মৃত্যু, বিশেষ করে খ্রিস্টান নাৎসিদের দ্বারা ত্রিশ লক্ষ ইহুদিদের গ্যাস চুল্লিতে পুড়িয়ে মারার বীভৎসতা, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক হিরোশিমা ও নাগাসাকির দশ লক্ষ বেসামরিক নাগরিককে একেবারে অকারণে পারমাণবিক বোমার বর্ষণে মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার বর্বরতা, গ্যের্নিকার গণহত্যা তাদের চিন্তার ও নৈতিক বোধের মর্মমূলে আঘাত করলো। কী করে এসব ঘটতে পারলো? আর্নল্ড যে মানবিক মাধুর্য ও পরিশীলনের কথা বলেছিলেন তা কি নিতান্তই অবাস্তব ইচ্ছাপূরণ? না কি নৈতিক নিরপেক্ষ বিজ্ঞানের মধ্যে যে অসীম ক্ষমতার প্রলোভন নিহিত আছে তাই ঐ নিষ্ঠুর বর্বরতার জন্য দায়ী? — এসব প্রশ্ন ও আরো সব প্রশ্ন নিয়ে তারা বিশ্লেষণ করেছেন। সেই সব নিয়ে আলোচনায় যাব না। শুধুমাত্র এইটুকু বলব যে, ঐ সব আলোচনা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির মূল্যায়নেও প্রাসঙ্গিক হবে।

দুই
বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে প্রাচীন মধ্য ও আধুনিক এই তিনটি পর্যায়ে বিন্যস্ত করা যায়। এই তিনটি পর্যায়ই বহিরাগত জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক আগ্রাসন ও বিচ্ছিন্নতা দ্বারা চিহ্নিত। তবে সংস্কৃতি যেহেতু রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে না তাই বাঙালি সংস্কৃতির একটি আবহমানতা অব্যাহত ছিল যদিও বহিরাগত জনগোষ্ঠী বাহিত নতুন বিশ্বাস, মূল্যবোধ, মিথ, আচার ও সমাজ কাঠামো প্রভৃতি গভীর প্রভাব ফেলেছে। কালে তার অনেক কিছুই বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গেছে। বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সঙ্গীতে, স্থাননাম, লোকাচারে ও দেবদেবী কল্পনায়, জন্ম, বিবাহ, বধূবরণ অনুষ্ঠানে, উপাচারে তার চিহ্ন উৎকীর্ণ হয়ে আছে। ঐ সংশ্লেষণ একদিনে হয়নি, কোন অনুশাসন বা ঘোষণা দ্বারাও তা প্রচলিত হয়নি। সংস্কৃতির বিরোধ বা সংঘাতও যে ছিল না তাও নয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া যা নিরন্তর উৎকণ্ঠার জন্ম দেয়, সে উৎকণ্ঠা এখনও আছে। উৎকণ্ঠা আত্মপরিচয় থেকে, ঐতিহ্য থেকে, উৎসাদিত হওয়ার।

বাঙালি সংস্কৃতির আধুনিক পর্যায়ের গণ্ডীরেখা অঙ্কিত হয়েছিল ঔপনিবেশিক পরাধীনতা-নিয়ন্ত্রিত অবস্থান দ্বারা। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ এদেশে প্রবেশ করেছিল বণিকতন্ত্ররূপে। রাজনৈতিক ক্ষমতায় আরোহণ করেছিল সামরিক প্রযুক্তি দ্বারা। একই সঙ্গে বহন করেছিল আধুনিক ইউরোপীয় সংস্কৃতি-সঞ্জাত শ্রেষ্ঠত্বের অভিমান, যা আমাদের সংস্কৃতি, জ্ঞান ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে অবমূল্যায়িত করে আমাদের রাজনৈতিক পরাধীনতাকে মানসিক অধস্তনতায় পর্যবসিত করেছিল। প্রবর্তন করেছিল প্রাযুক্তিক জ্ঞানের নতুন প্যারাডাইম তাদের বিজয়কে বৈধ ও স্বাভাবিক বলে প্রতিভাত করতে। আমাদের জন্যও ঐ পাশ্চাত্য জ্ঞানেই মুক্তি ও উন্নয়ন এমন একটি প্রতিশ্রুতির আবহও তৈরি করেছিল শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচারিত ভাবাদর্শের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও পুঁজিতন্ত্রের অমানবিক দাপটে সেটি হওয়ার উপায় ছিল না। পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক যুক্তি যে সর্বজনীন নয়, ক্ষমতা নিরপেক্ষ নয় এই সত্য ক্রমেই প্রকটিত হতে লাগল। এখন দেখা যাচ্ছে যে কোম্পানি কর্মকর্তারা বিলেতে বসে নির্ধারণ করেছেন ‘a limited science’ বিতরিত করাই হবে সুবিবেচনার কাজ। ‘a good policy’ সম্পর্কে স্পিভাক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তাঁর ‘A Critique of Post Colonial Reason’ (২০০৩) গ্রন্থে। পাশ্চাত্যের ‘লিবারাল জ্ঞান’, যুক্তি ও প্রযুক্তির প্রতারণা ধরা পড়ল, যখন দেখা গেল যে, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত দেশীয় উচ্চবর্গের ব্যক্তিরাও ক্ষমতায় অধিকার পেলেন না এবং উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ক্রমবর্ধমান দারিদ্রের উষরতায় মরীচিকার মতো মিলিয়ে গেল এবং তার বদলে পাওয়া গেল মন্বন্তর, নীল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রভৃতি নিরন্তর বিক্ষোভ ও সংঘাত। ঐ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে আমরাও সংস্কৃতির আবিষ্কার ও আলোচনায় প্রবেশ করলাম। আলোচনার সূত্রপাত করলেন নতুন বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। এটিকে তারা দেখলেন তাদের আবিষ্কারের প্রশ্ন হিসেবে। ঐ শ্রেণী ও বিষয় দুইই নতুন প্রপঞ্চ। দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বিদেশি ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের হাত থেকে মুক্তির জন্য বিকল্প ভাবনার অন্বেষণে আপন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পুনর্মূল্যায়নে ব্যাপৃত হলেন। শিক্ষার মিলন ও বিরোধ নিয়ে বিতর্কের অবতারণা হল।

পাশ্চাত্যের পজিটিভিজম ঋদ্ধ নতুন জ্ঞান এবং জন স্টুয়ার্ট মিলের ইউটিলিটারিয়ানিজম অনুসারী বহিরাগত প্রশাসক ও শিক্ষকবৃন্দ নতুন চিন্তার, বিতর্কের, বিশ্লেষণের যে পরিমণ্ডল সৃষ্টি করলেন, তার কোন প্রভাবই আমাদের বুদ্ধিজীবীদের চিন্তায় পড়ল না, ভাবলে অবশ্য ভুল ভাবা হবে। তাদের একাংশের চিন্তার জগতে এক প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি হল। আলোড়ন দেখা দিল রক্ষণশীল হিন্দু সমাজপতিদের নেতৃত্বে পরিচালিত অন্য অংশেও। প্রথম আলোড়নটি ইতিবাচক প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জ্ঞানের সংশ্লেষণ অভিমুখী। দ্বিতীয়টি নেতিবাচক, পাশ্চাত্য জ্ঞানের প্রত্যাখ্যান ও বিরোধিতা সূচক।

প্রথম ধারার বুদ্ধিজীবীরা পাশ্চাত্যজ্ঞানের আধুনিকতা-প্রবণ দিকগুলির আত্মস্থকরণ, দেশীয় ঐতিহ্যের নির্মোহ পুনর্মূল্যায়ন এবং প্রয়োজনবোধে ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার-এর পক্ষে জনমত গঠনে তাদের প্রতিভা ও কর্মোদ্যোগ নিয়োজিত করলেন। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ড. মহেন্দ্রলাল সরকার, অক্ষয়কুমার দত্ত, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ যুগন্ধর ব্যক্তিবর্গ ঐ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নতুন ধরনের কিছু সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনেরও আবির্ভাব হয় এই সময়ে, যাদের সদস্যরা নতুন জ্ঞানের সব বিষয় ও বিতর্ককে পাবলিক ডিসকোর্স করে তোলেন। ইয়াং বেঙ্গল গোষ্ঠী, যাঁরা প্রধানত হিন্দু কলেজের ছাত্র—যথা রামকমল সেন, কাশীপ্রসাদ ঘোষ, রামগোপাল ঘোষ, রাধানাথ শিকদার, কিশোরীচাঁদ মিত্র, রসময় দত্ত প্রমুখ ঐ নতুন ধরনের সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর উদাহরণ। এ ছাড়াও সোসাইটি ফর একুইজিশন অব জেনারেল নলেজের মত প্রতিষ্ঠান ও জ্ঞানান্বেষণের মত পত্রিকাও এর আগে কেউ ভাবেনি বা দেখেনি। নতুন ধরনের সাহিত্যও রচিত হল যার সঙ্গে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের কোনই মিল ছিল না। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, প্যারীচাঁদ মিত্র, কালীপ্রসন্ন ঘোষ, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই নতুন লেখকদের উদাহরণ। এ ছাড়াও কাশীপ্রসাদ ঘোষ ইংরাজি কবিতা লিখেছেন। এমনকি বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম উপন্যাস লিখেছেন ইংরাজি ভাষায়—‘Rajmohan’s wife’, সাগরপারের পাঠকদের মনে রেখে। হোমি ভাবা তাঁর ‘Location of Culture’ গ্রন্থে কলোনিয়াল সংস্কৃতির এই পর্যায়কে বলেছেন হাইব্রিডিটির পর্যায় বা শংকর সাহিত্য। আমাদের ঐতিহাসিকরা ইউরোপীয় রেনেসাঁসের অনুকরণে একে বর্ণনা করেছেন বাংলার রেনেসাঁস বলে। কিন্তু ঔপনিবেশিক গণ্ডীর কারণে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন বিকশিত হল না, দেশের মনোজগতেও তেমনি রেনেসাঁস ঠিক বিকশিত হল না। বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর একাংশকে নতুন ও আধুনিক ভাবনা উদ্বেলিত করলেও, অন্য বৃহত্তর অংশে বর্ণ-বর্গ-ক্ষমতা বিভক্ত হিন্দু সমাজ কাঠামোর পিছুটান, সনাতন মূল্যবোধের সঙ্গে নতুন মূল্যবোধের বিরোধ, ইন্দ্রজাল ও রহস্য উৎসাদনকারী যুক্তি-নির্ভর। ভাবাদর্শের সর্বগ্রাসিতা এক অব্যবস্থচিত্ততার জন্ম দিল যার অন্তরতলে ছিল আধুনিক প্যারাডাইম সম্পর্কে উৎকণ্ঠা ও ভয়। তার সঙ্গে যুক্ত হল রাধাকান্ত দেবের মত বিত্তবান ক্ষমতাশালী সমাজপতিদের সনাতন ধর্মীয় ভাবাদর্শ ও আচার অনুষ্ঠানের বিশ্লেষণাতীত পুনর্বাসনের প্রয়াস, এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসের ক্যারিসমাটিক উপস্থিতি। ফলত রেনেসাঁস আর জনগণের মন স্পর্শ করল না। শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত জনগণের কাছে রেনেসাঁসের ভাবনাসমূহ দূরাগত গুঞ্জনের মতো শোনাল, অস্পষ্ট, অপরিচিত বিপজ্জনক সমাজ সংস্কার পরিচিত ভাবনার অভ্যস্ত পোতাশ্রয়ের নিরাপত্তা ছেড়ে অনিশ্চিত সমুদ্রে ভেসে পড়া তাঁরা মূর্খতা বলেই জ্ঞান করলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় দত্তের সংস্কার প্রয়াস কার্যত ব্যর্থই ছিল।

এই দুই বিরোধী প্রতিক্রিয়ার মধ্যবর্তী একটি তৃতীয় অবস্থানে স্থিত গোষ্ঠীর কথাও বলতে হয়: যারা পাশ্চাত্য শিক্ষিত কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, যাঁরা স্বাজাত্যাভিমানী কিন্তু ধর্ম ও সমাজের নবায়নে আগ্রহী, যাঁরা পাশ্চাত্যের ভাবনা ভাণ্ডার থেকে, কিন্তু নিজস্ব মূল্যমানে জাতীয়তাবাদ, সাম্য ও নারীমুক্তির ধারণা গ্রহণে ইচ্ছুক তাতে যতটা আবেগাছন্নতা ছিল ততটা চিন্তা ও বিশ্লেষণ ছিল না।

এরা যতটা স্বাধীনতা ও আপোসপ্রবণ ততটা সাহসী ছিলেন না। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু এই গোষ্ঠীভুক্ত। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিরোধী ভাবনা এদের মস্তিষ্কে অসমন্বিত সহাবস্থানরূপে থেকে গেল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসুকে এই গোষ্ঠীভুক্ত ধরা যায়। এই মিশ্রিত ভাবনাটাই শেষ পর্যন্ত হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধিত্বশীল ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ যে প্রাধান্য পেলেন তা অবশ্য শুধুমাত্র তাদের অসামান্য সংবেদন মননের জন্য নয়, তারা তাদের লেখার মাধ্যমে যে সমাজ বক্তব্য হাজির করছিলেন তারও জন্য । এদের বক্তব্য উৎকণ্ঠিত হিন্দু পাঠকের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল ও সান্তনাদায়ক। এঁদের পাঠকরা সমাজ পরিবর্তন ও সংস্কার সম্পর্কে একটা মিশ্র সংকেত পেতে থাকলেন, যাকে তারা নিজস্ব প্রবণতা অনুযায়ী প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল দুভাবেই ভাবতে পারলেন। এঁদের যুক্তিচয়নকে রক্ষণশীলতার পক্ষে বা পরিবর্তনের অনুকূলে দুভাবেই পাঠ করা যেতে পারে। সনাতন জীবনাচরণ ও ভাবাদর্শ নির্মিত অধিকাংশ পাঠক রক্ষণশীলতার পাঠটিই গ্রহণ করলেন। তাতে মননের চাইতে ভক্তি, বিশ্লেষণের চাইতে বিশ্বাস প্রাধান্য পেল। রেনেসাঁস ততটাই পরাভূত হল। ইউরোপে রেনেসাঁসের ফলে যে ‘প্যারাডাইম শিফট’ বা চিন্তার কাঠামো বদল ঘটেছিল বাংলাদেশে তা হলো না। ইউরোপে রেনেসাঁসের যোগফল ছিল ভবিষ্যৎমুখী যুক্তি-তাড়িত অন্বেষা, আমাদের রেনেসাঁস হলো অতীতমুখী, ‘অ্যাটাভিস্টিক’ ও বিশ্বাসকাতর। তার মনোভঙ্গি বিদ্রোহের নয়, আপোসের।

এই রেনেসাঁস যে মুসলিম সমাজকে স্পর্শ করল না, এটাও রেনেসাঁসের একটা ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা মুসলিম মননের জাঢ্যতা বা ‘পার্ভাসিটির’ কারণে নয়। সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি তার কারণ। আমরা তার বিস্তারিত বিশ্লেষণে যাব না। শুধুমাত্র ফলাফল সম্পর্কে দুটি একটি ছোট মন্তব্য করব। বাংলার রেনেসাঁসকেও যে হিন্দু-মুসলিম দুটি সাম্প্রদায়িক অভিধায় বিভক্ত করতে হল, সেটিই রেনেসাঁস শব্দটির ব্যবহারের যথার্থতা সম্পর্কে আমাদের সন্দিহান করে। বাংলাদেশে মুসলিম জাগরণ কিছুটা বিলম্বিত হয়েছিল। তবে বিলম্বিত হলেও তা হিন্দু জাগরণের প্যাটার্নটিই অনুসরণ করেছিল। রাধাকান্ত দেবের মতই নওয়াব আব্দুল লতিফ তাঁর প্রতিক্রিয়াশীল মনোভঙ্গি সত্ত্বেও সমসাময়িক দেলোয়ার হোসেন আহমদের মুক্তমনা সেকুলার বিশ্লেষণ ও সংস্কার প্রস্তাবের চাইতে অনেক বেশি প্রাধান্য ও আনুগত্য পেয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের মতই হাজি শরীয়তুল্লাহ অনেক বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন বুদ্ধির মুক্তির মূল্যবোধের চাইতে। ফরায়োজি ও ওয়াহাবি মৌলবাদ অনেক দ্রুত অনেক বেশি ব্যাপকতা পেয়েছিল। আলেমদের ইসলাম ব্যাখ্যানের প্রকোপে মীর মশাররফ হোসেনের অসাধারণ সাহিত্যসৃষ্টি ‘বিষাদসিন্ধু’ পৌত্তলিকতা-সৃষ্ট ও হিন্দু চিত্রকল্পদুষ্ট বলে নিন্দিত হয়েছিল, যা প্রত্যাখ্যানেরই শামিল। সৌভাগ্যক্রমে উপন্যাস-বুভুক্ষু নতুন মুসলমান পাঠক সমাজ ঐ মূল্যায়নকে প্রাসঙ্গিক মনে করেননি। বাঙালি মুসলিম সমাজের নেতৃত্বে ছিলেন যে মুসলিম অভিজাত শ্রেণী তার সঙ্গে ঐতিহাসিক কারণে জনসাধারণের একটা সাংস্কৃতিক ব্যবধান রচিত হয়েছিল। তাও মুসলিম রেনেসাঁসে জটিলতার কারণ। মুসলিম রাজন্যবর্গ ও ভূম্যধিকারীরা ইংরেজদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হলেও দীর্ঘকাল সেটা মেনে নিতে পারেননি। তারা আশা করেছিলেন ক্ষমতায় তাঁরা পুনর্বাসিত হবেন। আলেমরা দেশে গ্রামে অসহযোগের ফতোয়া দিয়েছিলেন। সৈয়দ আহমদ শহীদ ও তার অনুসারীরা সশস্ত্র সংগ্রামের পথ নিয়েছিলেন। ১৮৫৭-তে সিপাহি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। এর কোনটিই সফল হয়নি। সিপাহি বিদ্রোহেও ব্যর্থতা অভিজাত মুসলমানদের হৃতক্ষমতায় পুনর্বাসনের শেষ স্বপ্ন নষ্ট করে দিল এবং ঔপনিবেশিক অধস্তনতার বাস্তবতায় তারাও জাগ্রত হতে লাগলেন।

রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে অপসৃত হলেও সামাজিক ক্ষমতায় তাঁরা থেকে গেলেন এবং আভিজাত্যের অভিজ্ঞান হিসেবে নিজেদের বিদেশাগত পরিচয়ে তারা। এতটাই আত্মমুগ্ধ ছিলেন যে, সেই স্মৃতিকে লালন করেছেন নিত্য জীবনাচরণে। বাঙালি জনসাধারণ, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে কোন আত্মীয়তা বোধ করেননি। ঐ বিচ্ছিন্নতা বাঙালি মুসলমানদের প্রতিও প্রযুক্ত হল। অভিজাতরা বংশ গৌরব, সামাজিক অবস্থান, উর্দু ও ফারসি ভাষা ব্যবহার ও সংস্কৃতি চর্চার। অভিমানে স্থানীয় মুসলিম আতরাফ জনসাধারণের সঙ্গে যে স্পর্শ-সম্পর্ক-হীন দূরত্ব রচনা করলেন, তার ফলে সমাজের ভাবনার সঙ্গে তাদের যোগাযোগই স্থাপিত হচ্ছিল না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত প্রবেশিকা পরীক্ষায় বিষয় হিসাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পত্র অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব উঠলে পরে ফরিদপুরের নওয়াব আব্দুল লতিফ বাংলা মুসলমান ভদ্রজনের ভাষা নয়, ইতর শ্রেণীর ভাষা এবং ভদ্রশ্রেণীর ভাষা উর্দু এই যুক্তিতে শিক্ষায় বাংলা প্রচলনের বিরোধিতা করলেন। নওয়াব আব্দুল লতিফের সামাজিক উচ্চবর্গে অবস্থানের কারণে পরবর্তী পঞ্চাশ বছর ধরে মুসলিম শিক্ষিত মহলে বাংলা যথার্থই মুসলমানের ভাষা কি না এই উদ্ভট অবাস্তব বিতর্ক চলতে লাগল। ‘মিহির ও সুধাকর’ পত্রিকার সম্পাদক সেখ আব্দুর রহিম স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন: ‘একটি মাত্র প্রবল চিন্তা আমার সমস্ত দেহমন অধিকার করিয়া লইয়াছিল। সেই চিন্তাটি এই যে-কেমন করিয়া আমার প্রিয়তম স্বজাতি বাঙ্গালী মুসলমানদিগের মধ্যে বাঙ্গালা ভাষার অবাধ প্রচার করিব, কেমন করিয়া তাহাদের ভ্রান্ত কুহেলিকা ও জড়তা মোচন করিয়া তাহাদিগকে মাতৃভাষার পূণ্যমন্দিরে লইয়া আসিব—এবং কেমন করিয়া তাহাদের মনের মধ্যে মাতৃভাষার সাহায্যে জাতীয় সাহিত্য গঠনের প্রেরণা জাগাইয়া দিব।’ সেখ আব্দুর রহিম আরো ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন: ‘কি শোচনীয় দুরবস্থা। ইংরাজি ও বাঙ্গালাও কাফের ভাষা হইয়া গিয়াছে’। একাধিক লেখকের লেখায় ঐ মনোভাব প্রকাশিত হল।

ভূম্যধিকারী অভিজাতদের একটি বড় অংশই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহান্বিত হলেন না বটে তবে এবার ইংরাজি ভাষা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের গুরুত্ব অনুধাবন করলেন, কারণ, এতো সংস্কৃতির সঙ্গে যোগ নয়, ক্ষমতার সঙ্গেও সেতু রচনা করা। স্যার সৈয়দ আহমদের লেখায় ঐ নতুন উপলব্ধি ও আপোসের মনোভাব দেখা গেল। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও পাশ্চাত্য ভাবধারায় পরিচিত বাংলায় অভিজাত পরিবার সমূহের মধ্যে নওয়াব আব্দুল জব্বার, নওয়াব আলী চৌধুরী, স্যার আব্দুর রহিম, স্যার আমীর আলী, হুগলীর আব্দুস সোবহান, ওয়াজেদ আলী খান পন্নি ও গজনভি পরিবার—এঁদের মধ্যে প্রতিনিধি স্থানীয়। এঁরা আধুনিকত্বের সংস্পর্শে এলেন, কিন্তু বাঙালি মুসলিম রেনেসাঁসে কোন তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারলেন না । ফলত মুসলিম রেনেসাঁসের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বে তারা ছিলেন অনুপস্থিত। যিনি মুসলিম চিন্তার ও সংস্কৃতির আধুনিকায়নে যথার্থই নেতৃত্ব দিতে পারতেন সেই সৈয়দ আমীর আলী সমসাময়িক মুসলিম সমাজের সংস্কারাচ্ছন্নতা থেকে মুক্তি ও ভাবনার নবায়নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে স্বদেশীয়দের উদ্দেশ্য করে তার বক্তব্য না রেখে, ইসলাম ধর্মের ভাষ্য ও মুসলিম ইতিহাসের গৌরবের বয়ান লিখলেন ইংরাজি ভাষায়, পাশ্চাত্য পাঠকমণ্ডলীকে সামনে রেখে যেন বা তাঁদের অনুমোদন প্রত্যাশায়। ভারত-সংস্কৃতি সম্পর্কে, তাতে মুসলমানদের ভূমিকা সম্পর্কে এবং ভারতের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রকল্পে মুসলমানদের স্থান সম্পর্কে যে সমালোচনামূলক বীক্ষার [Critical discourse] সুযোগ তার ছিল এবং প্রয়োজন ছিল, সেই প্রয়োজনীয় কর্তব্যটি পালন করলেন না। তার চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি এই যে, তিনিও শেষে স্বদেশ পরিত্যাগ করে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে গেলেন বিলেতে, নিজের দারিদ্র্যলাঞ্ছিত, তমসাচ্ছন্ন, সংস্কৃতি-বিমুখ সমাজকে ফেলে রেখে—এক পরাভূত এক্সাইল।

হতে পারে, সামাজিক নেতৃত্বে আরূঢ় ভূম্যধিকারী শ্রেণীটি তাঁদের সুরক্ষিত সুযোগ পরিপোষিত অবস্থান থেকে স্বতই রক্ষণশীলতার দিকে ঝুঁকে থাকেন। চিত্ত মুক্তির নামে কোনরূপ সামাজিক কাঠামোগত বা ভাবগত মৌলিক রূপান্তরে উৎসাহ বোধ করেন না। যে কোন সামাজিক সংকট, বিপ্লব, উপপ্লবে তাঁরা রক্ষণশীলতা ও পরিবর্তনহীনতার পক্ষে তাদের বুদ্ধি, চাতুর্য ও শক্তি প্রয়োগ করেন। তিতুমীর, হাজি শরীয়তুল্লাহ ও দুদু মিঞার কৃষক-বিদ্রোহের সময় এবং ওয়াহাবীদের বিপ্লব গর্ভ ‘দারুল হরব’ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার নওয়াব সলিমুল্লাহ যেমন জৌনপুর থেকে মৌলানা কেরামত আলীকে নিয়ে এলেন স্থিতাবস্থার পক্ষে শহরে গ্রামে ওয়াজ করার জন্য। মোহসিন ফান্ডের টাকা কিভাবে খরচ করা হবে তাই নিয়ে যখন বিতর্ক ও মামলা হতে লাগল, তখন নওয়াব আব্দুল লতিফ প্রস্তাব করলেন যে, সব টাকাটাই মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ও ধর্মীয় শিক্ষায় খরচ করা হোক, কোন আধুনিক শিক্ষা দানকারী নতুন স্কুলগুলির জন্য নয়। সরকার অবশ্য ঐ প্রস্তাব নাকচ করে অর্ধেক টাকা স্কুলের মুসলমান ছেলেদের বৃত্তির জন্য এবং বাকি অর্ধেক কলকাতা ও হুগলী মাদ্রাসার জন্য বরাদ্দ করার সিদ্ধান্ত নেন। অভিজাত শ্রেণীর কাছ থেকে রেনেসাঁসের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব যে আসেনি তা বিস্ময়কর নয়। রেনেসাঁস পরিবাহিত আধুনিকতা ইউরোপে এসেছিল পরিবর্তন-প্রয়াসী, উদ্ভাবন অনুকূল, উদ্যোগী বণিকশ্রেণীর নেতৃত্বে ও কালাপাহাড়ি বুদ্ধিজীবীদের দুঃসাহসী চিন্তার প্রণোদনায়। বাঙালি মুসলিম সমাজে এই দুটি শ্রেণীই অনুপস্থিত ছিল।

বাংলাদেশে মুসলিম বিনিয়োগক্ষম বণিকশ্রেণী (entrepreneurial class) ১৯৭২-এর আগে দেখাই দেয়নি। ১৯০৬ নাগাদ মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী হিসেবে আবির্ভূত হলেও এঁরা প্রায় সবাই আমলা-ফয়লা, পেশাজীবী শিক্ষক, উকিল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও নিম্নবর্গের কর্মচারী ছিলেন। তারা শিক্ষিত ছিলেন কিন্তু সমাজ-চিন্তার নির্মাতা বা নিয়ামক ছিলেন না। মীর মশাররফ হোসেন, সেখ আব্দুর রহিম প্রমুখ দু-একজন করে লেখকের আবির্ভাব ঘটছিল—কিন্তু নগরকেন্দ্রিক আধুনিকতা-প্রাণিত ‘ইন্টেলিজেসিয়া’ শ্রেণী যারা রেনেসাঁসের নেতৃত্ব দিতে পারতেন তাঁরা ছিলেন অনুপস্থিত। ফলত একমাত্র বেগম রোকেয়ার লেখায় ছাড়া র‍্যাডিক্যাল নতুন চিন্তার জন্ম হল না সত্য, তবে নানা সূত্রে আধুনিকতার ভাবনাসমূহ পৌঁছে গিয়েছিল বাংলার নগরকেন্দ্রগুলিতে, কিন্তু তার পরিপোষক শক্তিশালী বণিক ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীদ্বয় সেখানে ছিল না। ছিল না বলেই সমাজে পরিবর্তন প্রয়াসী বেগের সঞ্চার হল না। তবে ইউরোপীয় চিন্তাবিপ্লবের উৎকণ্ঠা সমাজকে স্পর্শ করল ঠিকই। সেই উৎকণ্ঠার সুযোগ গ্রহণ করলেন মৌলবাদী আলেম শ্রেণী। উৎকণ্ঠা প্রশমনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এলেন তাঁরা। সামাজিকভাবে নিম্নবর্গের মুসলমানদের সঙ্গে এদের নিত্য ও ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক ছিল।

উৎকণ্ঠার একটি তুচ্ছ অথচ বিভ্রমকারী কারণও ঘটেছিল। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম কেরি কোম্পানির অনুমতি ছাড়াই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এ দেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে আসেন এবং শ্রীরামপুরে খ্রিস্টীয় পুস্তকাদি প্রকাশের উদ্দেশ্যে ছাপাখানা স্থাপন করেন। এ দেশে হিকিই অবশ্য প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন ১৭৭৭ সালে, তার নিজের পত্রিকা ‘হিকিজ জার্নাল’ প্রকাশের জন্য। শ্রীরামপুর থেকে কেরির তদারকিতে রামরাম বসুর অনুবাদে বাইবেলের অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়। শ্রীরামপুর থেকে বাংলা পত্রিকাও প্রকাশিত হল। সেই হল প্রথম বাংলা পত্রিকা। গ্রামেগঞ্জের হাটে ধর্মপ্রচারক পাঠানো হতে লাগল। লোকজন পাদ্রিদের ভাঙা বাংলায় মথি-লিখিত সুসমাচার শ্রবণ করে কৌতূহল ও কৌতুক দুইই অনুভব করতে লাগলেন। কিন্তু কৌতূহল অচিরাৎ উৎকণ্ঠায় রূপান্তরিত হল যখন বর্ণসংস্কার পীড়িত, অধিকার বঞ্চিত, দরিদ্র নিম্নবর্গের হিন্দুজন এবং সমাজের প্রান্তশায়ী উপজাতীয়রা দলে দলে ধর্মান্তরিত হতে লাগল। উৎকণ্ঠা আতঙ্কে রূপান্তরিত হল যখন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, লালবিহারী দে, সূর্যগুডিভ চক্রবর্তী, মহেশচন্দ্র ঘোষের মত উচ্চবিত্ত ও উচ্চবর্ণের ব্যক্তিবর্গও হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে খ্রিস্টান হতে লাগলেন। ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, কেশব সেন প্রমুখের খ্রিস্টধর্ম প্রীতির কথাও উৎকণ্ঠার কম কারণ হয়নি। মেকলে ১৮৩৬ সালে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, ‘No Hindu who has received an English education ever remains sincerely attached to his religion.’ তাই যেন সত্যি হল।

পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ প্রভাবিত ডিরোজিও শিষ্যবৃন্দ হিন্দু কলেজের তরুণ শিক্ষার্থীরা—রামকমল সেন, কাশীপ্রসাদ ঘোষ, রাধানাথ শিকদার প্রমুখ হিন্দুধর্মের নানা অসংগতির তীব্র সমালোচনা করে চলেছিলেন। তাছাড়া বিদ্যাসাগর তো ছিলেনই। হিন্দু সমাজের চারদিকে একটা আতঙ্কের পরিমণ্ডল সৃষ্ট হল। চারদিক থেকেই সংস্কারের কথা উঠছিল। বাইরে থেকে খ্রিস্টধর্মের আগ্রাসন এবং ভেতর থেকে স্বজাতীয়দের আক্রমণে পাছে হিন্দু সমাজ হীনম্মন্যতায় নির্জিত হয়ে পড়ে, তাই এবার অনেক সংস্কারবাদীও ধর্মরক্ষায় এগিয়ে এলেন এবং তাদের সংস্কার প্রকল্প থেকে রক্ষণশীলতার দিকে অনেকটা সরে এলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশব সেন ব্রাহ্ম বিবাহবিধি লংঘন করে সনাতন প্রথায় নিজেদের সন্তানদের বিবাহ-অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন। প্রতাপচন্দ্র মজুমদার এবং বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ব্রাহ্ম প্রার্থনা রীতিতেও পরিবর্তন আনেন। তাদের প্রার্থনা সভায় মনন-সংযত ধ্যান ও নীরব উপাসনার জায়গায় বৈষ্ণবীয় উল্ললিত ভক্তি ও উচ্ছ্বসিত আবেগের পুনরাবাহন করলেন। বিদ্রোহীরা সনাতনত্বে প্রত্যাবর্তন করলেন। লিবারাল ও সেকুলার রাজনারায়ণ বসু ইসলাম সম্পর্কে কৌতূহলী ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তিনিও ১৮৭৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট হলে ‘হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বে’র উপর বক্তৃতা দিলেন। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব তার কবিসুলভ কল্পনার চমৎকারিত্বে, অনায়াস উপমার অজস্রতায়, অসাধারণ বাকপটুতায় ভক্তমণ্ডলীকে সম্মোহিত ও আপ্লুত করে ফেললেন। বর্তমান প্রজন্মের কাছে যথেষ্ট পরিচিত নন বলে আপ্লুত দু-একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘মানুষের মন তো সরষের পুটুলি, গিঁট খুলে ছড়িয়ে পড়লেই চিত্তির, আবার খুঁটে খুঁটে জড়ো করাই ভার। মনও যদি সংসারের কাজে কখনও ছড়িয়ে যায় তবে একজায়গায় তাকে গুটিয়ে আনা কঠিন’। ভক্ত জিজ্ঞেস করল: ‘ঈশ্বরকে তো দেখতে পাইনে?’ রামকৃষ্ণ বললেন: ‘পানা সরিয়ে দেখ, তবে তো জল পাবি’। ‘নর্তকির মত থাকবি’। রামকৃষ্ণ বলেছেন, ‘পশ্চিমের মেয়েদের দেখিসনি মাথায় জলের ঘড়া, হাসতে হাসতে কথা কইতে কইতে যাচ্ছে। তেমনি ঈশ্বরকে মাথায় রেখে কাজ করবি’। এসব উপমায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন সবাই। অতীন্দ্রিয় অলৌকিক তার ব্যক্তিসত্তায় লৌকিক রূপ গ্রহণ করেছে এমনই ভাবলেন তারা। পাশ্চাত্য শিক্ষার অভিমানস্ফীত সংশয়-আক্রান্ত বিদগ্ধজনের অন্তরে রহস্য ও ইন্দ্রজালের পুনর্বাসন ঘটলো। আবার অন্যদিকে যুক্তির পথ অনুসরণ করেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কৃষ্ণচরিত্রের নবব্যাখ্যান রচনা করলেন, বিশ্লেষণপ্রবণ আধুনিকদের কাজে তাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার দুঃসাধ্য প্রয়াসে। কৃষ্ণ চরিত্রের চারপাশে যে অলৌকিকত্বের ও ইন্দ্রজালের নির্মোক জমেছিল তাকে প্যারাডক্সিক্যাল যুক্তির জারকে কেলাসিত করে কৃষ্ণকে এক মহত্তম লৌকিক ঐতিহাসিক পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তার অন্বিষ্ট। পাশ্চাত্যে জার্মান গবেষক স্ট্রাউসের খ্রিস্টান চরিত্রের লৌকিকত্ব সংক্রান্ত গবেষণা বা ইংরেজ ঔপন্যাসিক হামফ্রে ওয়ার্ডের ‘রবার্ট এলসমিয়র’ নামক উপন্যাস হয়তো তাকে প্ররোচিত করে থাকবে। হিন্দু গৌরব পুনরাবিষ্কারে ম্যাক্স ম্যূলারের অবদানও কম কার্যকর হয়নি। স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মের লোকোত্তর সত্য প্রতিপাদনের জন্য পৃথিবীর পথে পথে বক্তৃতার জন্য বেরিয়ে পড়লেন। চারিদিকে সনাতন ধর্মের জয়জয়কার পড়ে গেল। বঙ্কিমচন্দ্র আরো একধাপ এগিয়ে তাঁর উপন্যাস ‘আনন্দমঠে’ হিন্দু মিলেনিয়াল স্বপ্নকে একটি রাজনৈতিক মাত্রা আরোপ করলেন, হিন্দু ধর্ম সংরক্ষণ আন্দোলন হিন্দু জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত হল। নতুন সৃষ্ট জাতীয়তাবাদের ধারণা জনগণকে রাজনীতির প্রশস্ত প্রাঙ্গণে টেনে নিল, তাদের জীবনে ছিল একটা উদ্দেশ্যপ্রাণতা বর্ণাশ্রমকে পাশ কাটিয়ে।

খ্রিস্টীয় ধর্ম প্রচার মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও একই উৎকণ্ঠার জন্ম দিল এবং প্রতিক্রিয়াও হিন্দু সংরক্ষণবাদিতার সমান্তরাল পথ অনুসরণ করে মুসলিম জাতীয়তাবাদে উপনীত হতে খুব একটা সময় নিল না। নেতৃত্ব দিলেন মুসলমানত্বের ব্যাখ্যাদানকারী হিসেবে আলেম শ্রেণী ও পীর সম্প্রদায়। ওয়াহাবি ও ফরায়েজি প্রভৃতি ধর্মীয় শুদ্ধি আন্দোলনের নামে বাঙালি সংস্কৃতিতে একটি ধর্মীয় বিভাজন রেখা টানা জরুরি হয়ে পড়ল। ঐ বিভাজন যে খুব স্পষ্ট হল বা সমাজ জীবনের সর্বত্র প্রযোজ্য হল তা নয়, তবে রাজনৈতিকভাবে তা কার্যকর হল। আলেম শ্রেণী দেখলেন ঐ ধর্মীয় কার্যক্রমসমূহের মধ্যে দিয়ে তারা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে উপনীত হলেন, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীও দেখলেন রাজনীতির ধর্মীয়করণ তাদের অতি দ্রুত ক্ষমতার সন্নিকটবর্তী করবে। দুই পক্ষই মুসলিম জাতীয়তাবাদে আশ্রয় খুঁজলেন। সংস্কৃতির ঐ বিভাজন এর যে দূরত্বের সূচক হল, তাই নয়, তা সাম্প্রদায়িক বিরোধেরও প্ররোচক হল।

হিন্দু ও মুসলিম জাতীয়তাবাদ দুই ক্ষেত্রেই যেটা ঘটল সেটা হল, ‘হিন্দুত্ব’ ও ‘মুসলমানত্ব’ অর্থাৎ ধর্মপরিচয় রাজনীতির নিয়ামক হয়ে উঠল; আবার অন্যভাবে এও বলা যায় যে, রাজনীতি নিজের প্রয়োজনে সংস্কৃতিকে অধিকার ও বিনির্মাণের চেষ্টা করল। অথচ জাতীয়তাবাদও অধিকাংশ রাজনৈতিক ধারণার মতই পাশ্চাত্য থেকে আগত এবং গণতন্ত্র, ব্যক্তির ধারণা, ধনতন্ত্র বা মানবাধিকারের মত একটি সেকুলার ধারণা। আসলে পাশ্চাত্য আর্থ-সামাজিক বিন্যাস ও প্রযুক্তি যে আধুনিকতার সূচনা করল তার প্রবণতা হল সর্বব্যাপী সেকুলারাইজেশনের দিকে প্রশাসন, আইন, বাণিজ্য, ব্যাঙ্ক, শিক্ষা, বিচার-ব্যবস্থা ও ক্ষমতার বৈধতা সবই সম্প্রদায় নিরপেক্ষ। ফলত মুসলিম জাতীয়তাবাদ আবির্ভূত হল ভুল সময়ে। এটা যে কতটা সত্য সেটা বোঝা যায় যখন দেখি পাকিস্তানি রাষ্ট্রের প্রথম প্রত্যুষেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করলেন যে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে ধর্মীয় ভাবনায় রাজনৈতিকভাবে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান বলে কেউ থাকবে না, সবাই হবে নতুন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের সদস্য। অর্থাৎ মুসলিম জাতীয়তাবাদের অবসান। এ রকম একটি সেকুলার রাষ্ট্রের সম্ভাবনায় আলেম শ্রেণী ও ধর্মীয় রক্ষণশীল অংশ ক্ষমতার খেলায় ধর্মের অস্ত্র ছেড়ে দিতে মোটেও রাজি ছিলেন না। কিছুদিনের মধ্যেই একদা পাকিস্তানবিরোধী জামাতে ইসলামী নেতা মওদুদী লাহোরে কাদিয়ানি-বিরোধী গণহত্যা সংগঠিত করে ধর্মীয় শুদ্ধিকরণের নামে ইসলামকে পাকিস্তানি রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করলেন। মুসলিম জাতীয়তাবাদ মুসলিম মৌলবাদে রূপান্তরিত হল। শুধু তাই নয় মৌলবাদী মৌলানারা হয়ে উঠলেন মুসলিম সমাজের কাছে ইসলামের একচ্ছত্র ব্যাখ্যাতা, আধুনিক-মনা সংস্কারকরা নন। ধর্মীয় শুদ্ধি আন্দোলন সংস্কার থেকে মুক্তি নয়, বরং সংস্কারে অধিকতর নিমজ্জনে পর্যবসিত হল। তবে মুসলিম জাতীয়তাবাদের অন্তর্নিহিত ফাঁকি অবশ্য আরো নাটকীয় ও ব্যাপকভাবে দেখা দিল বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধে-যে বিভাজন ধর্মের নামে প্রশমিত করা গেল না, যে রাষ্ট্রকে নিষ্ঠুরতম গণহত্যা চালিয়েও একত্র রাখা গেল না। অনিবার্য ও আধুনিক রাষ্ট্রীয় সেকুলার প্রবণতার বাঙালি অস্তিত্বের ঐতিহ্য-বাহিত সেকুলার প্রবণতার সমাপতন ঘটল মুক্তিযুদ্ধে। বাংলাদেশ একটি রাজনৈতিক অস্তিত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য যেমন কোন প্রচার করতে হয়নি, তার কোনও সুযোগও ছিল না। আমরা আপামর জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধের ডাকে স্বতঃস্ফুর্ত বিশ্বাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস অবশ্য ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভ্রান্তি এড়াতে পেরেছিল নেতৃত্বের আধুনিকতাসৃষ্ট বিশ্লেষণ-প্রবণতার দ্বারা। অবশ্য তাকেও সমাজের বিভিন্ন স্তরে ধর্মীয় গোঁড়ামির মুখোমুখি হতে হয়েছে বারবার। সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য গোষ্ঠী বা ব্যক্তির অভাব হয়নি।

তিন
ইউরোপীয় রেনেসাঁস রূপান্তরিত হয়েছিল আধুনিকতায়। বাংলাদেশের খণ্ডিত রেনেসাঁস জন্ম দিল পঙ্গু আধুনিকতার। কলোনিয়াল শিক্ষার মাধ্যমে হলেও পাশ্চাত্য আধুনিকতার ভাবাদর্শ যে যুক্তি ও মুক্তির আশা সঞ্চারিত করেছিল, কলোনিয়াল অধস্তনতা সেই মুক্তির সম্ভাবনাকে নস্যাৎও করেছিল। ফলত ঐতিহ্য আশ্রিত জাতীয়তাবাদে আধুনিকতার এজেন্ডা কোন প্রাধান্য পেল না। ঐতিহ্যে প্রত্যাবর্তনই অনেক বেশি গুরুত্ব লাভ করেছিল। বরং আধুনিক চিন্তার প্যারাডাইম যে উৎকণ্ঠার অবতারণা করেছিল জাতীয়তাবাদকে সেই উৎকণ্ঠার হাত থেকে অব্যাহতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন প্রায় সকলে। ফলে আধুনিকতা ব্যাহত হল। তবে আধুনিকায়ন ব্যাহত হল না। বিদেশাগত পুঁজি নিজস্ব প্রয়োজনেই রেললাইন, রাস্তাঘাট, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, অটোমবিল, শিল্প-কারখানা, নগর, বন্দর, ব্রিজ, খনি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বহুতল ভবন, সিনেমা, বেতার প্রভৃতি প্রকৌশলগত উদ্ভাবনা পাশ্চাত্যে প্রচলনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের দেশেও আমদানি করলেন। আমাদের জীবনযাত্রার বহিরঙ্গের রূপটিই পাল্টে গেল। বাহ্যত আমরাও নগরবাসী আধুনিক হয়ে উঠলাম। আধুনিকতার একটি মিথ্যে নির্মোকে আবৃত হয়ে বাস করতে লাগলাম। কিন্তু আমাদের মনোজগৎ দখল করে রাখলো মধ্যযুগীয় ভাবনা বিশ্বাস ও সংস্কার। পানি-পড়া, ঝাড়-ফুক, তুকতাক, পীর-মুর্শেদ, মাজার-খানকা শরিফ, যাদু টোনা, তাবিজ-কবজ, ভূত-প্রেতে বিশ্বাস থাকলো অবিচল তিনশো বছর আগের মতই। আধুনিকতা ও আধুনিকায়নের মধ্যে একটা বৈপরীত্য ও বিচ্ছেদ রচিত হল আমাদের মনে। ঐ বিচ্ছেদ-কল্পনা অবশ্য আমাদের মানসিক অব্যবস্থচিত্ততা ও জাঢ্যতারই উদাহরণ মাত্র। কিন্তু তার চেয়েও যেটি তাৎপর্যপূর্ণ ও বিব্রতকর সেটি হল, আধুনিকতা সম্পর্কে আমাদের বৈরিতা এবং যে কোন আধুনিক চিন্তার প্রত্যাখ্যান। আমরা প্রযুক্তি গ্রহণ করলাম কিন্তু মনোভঙ্গি গ্রহণ করলাম না। মৌলবাদীরাও এর ব্যতিক্রম নন। আধুনিকতা অবশ্য সব পেয়েছিল দেশ নয়, আধুনিকতা নিয়ে আমাদের শতেক আশাভঙ্গ আছে। কিন্তু সেসব সমালোচনাও আধুনিকতার ভেতর থেকেই উত্থিত হচ্ছে, যুক্তির ব্যবহার করেই বহমান চিন্তার আলোকে, অন্ধ-সংস্কার বা ভিত্তিহীন বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে নয়। আধুনিকতার বিকাশ এখনো অব্যাহতই আছে—কি চিন্তায়, কি প্রযুক্তিতে। ঊনবিংশ শতক ধরেই পুঁজিতন্ত্রের হাত ধরে আধুনিকতা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিশ্বের অসংখ্য দেশের অসংখ্য সংস্কৃতির ওপর পড়েছে তার প্রভাব। সে প্রক্রিয়া এখনও চলছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির মত তথ্যপ্রযুক্তির জটাজলে পৃথিবী একটি মহাগ্রামে পরিণত হয়েছে। হয়তো এটা একটা অতিশয়োক্তি। তবে এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, বাংলাদেশ ও তার সংস্কৃতিও এখন সেই বৈশ্বিক প্রক্রিয়ার বাইরে নয়। বাংলাদেশও আধুনিকতার ‘দ্বিতীয় বিপ্লবে’ প্রবেশ করতে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল কোন ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ও কোন মানস উপকরণ নিয়ে? তৃতীয় বিশ্বের একদা উপনিবেশভুক্ত দরিদ্র দেশগুলির সবার জন্যই এই প্রশ্নের মীমাংসা অত্যন্ত জরুরি। প্রত্যেককেই তার নিজস্ব ঐতিহ্যের বিচিত্রতা ও মানস সংশ্লেষণের দার্ঢ্য ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা নিয়ে এই আধুনিকতায় প্রবেশ করতে হবে। অন্যথায় দ্রুতধাবী গোলকায়ন যে আবর্তের মধ্যে নিয়ে আমাদের ফেলবে তার সবটাই আনন্দকর বা কল্যাণকর হবে এমন ভাবনায় সংশয় প্রকাশ করি।

বস্তুতপক্ষে এই বিশ্বায়নের জটিল নির্মম আশ্লেষ ১৯১৪ থেকে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকে যেভাবে নাড়া দিয়েছে তার আগে এভাবে আমরা অনুভব করিনি। বিশ্বব্যাপী পুঁজিতন্ত্র ও তার সহযোগী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আগ্রাসনের ফলে আমাদের সমাজব্যবস্থা পূর্ববর্তী একশো বছর ধরে বিপর্যস্ততা ও পরিবর্তনের মুখে পড়েছিল। কিন্তু এমন মহাযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরিসমাপ্তি পর্যন্ত মারণাস্ত্রের বিবর্তন ও নির্বিচার হত্যার যে বৈনাশিক প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হল এবং যে তিন কোটি লোককে হত্যা করা হল তা হঠাৎ বহির্বিশ্বের অভিজ্ঞতাকে নিয়ে এল ঘরের মধ্যে, যদিও এর সামাজিক অভিঘাত আমাদের সংস্কৃতি চিন্তায় যথাযথ স্থান পায়নি। তা যে শুধু আমাদের সমাজকে ফেলে দিল তাই নয়, তা আমাদের মনের অগোচরে বদলে দিল আমাদের জীবনমৃত্যু সম্বন্ধে ভাবনাকেও। যুদ্ধ হয়ে উঠল আবেগহীন নিষ্ঠুরতার প্লাবন ও পরিচয়হীন মৃত্যুর অজস্রতা। যুদ্ধশেষে যারা ফিরে এল নন্দিত হল বীর রূপে, আমাদের সন্তান বা ভাই বা কারো স্বামী, তারাই কিন্তু নিরাবেগ অনুশোচনাহীন নিষ্ঠুর হত্যাকারী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইংরেজ কবি উইলফ্রেড ওয়েন একটি কবিতায় লিখেছিলেন:

Merry it was to laugh there—
Where death becomes absurd and life aburder
For power was on us as we slashed bones bare
Not to fear sickness or remorse of murder. (1917)

ন্যায় অন্যায়ের বোধ তলিয়ে গিয়েছিল বিস্ফোরণের সঙ্গে উচ্ছ্রিত রক্তের তলায়। আমরা সে মৃত্যু মেনে নিলাম। কারণ সে মৃত্যু ছিল সংবাদপত্র বাহিত পরোক্ষ মৃত্যু মাত্র। তা আমাদের চোখে দেখতে হয়নি।

বাংলাদেশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পায়ে পায়ে এল মন্বন্তর। দশ লক্ষ বিত্তহীন, আশ্রয়হীন, অসহায় নারী-পুরুষ-শিশু কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় খেতে না পেয়ে মারা গেল। নাগরিকদের অভ্যস্ত জীবনযাত্রার কোন ব্যাঘাত না ঘটিয়ে। অবশ্য এবার মৃত্যু চোখে দেখতে হল, কিন্তু ঐ পরিব্যাপ্ত করুণ মৃত্যু আকীর্ণ রাজপথে চলমান জনস্রোতের মধ্যে ঐ হতভাগ্যদের প্রতি এমন নিষ্ঠুর উদাসীনতাও সম্ভবত আর কখনো দেখা যায়নি। কখন যে আমাদের নিজেদেরই অগোচরে আমাদের ভাবনায় আমরা নিঃসাড় ও অমানবিক হয়ে পড়েছি আমরা বুঝতেই পারিনি। তবে ঐ মৃত্যুতে আমাদের প্রত্যক্ষ হাত ছিল না। সমগ্র সমাজের হাত প্রতিবেশী হত্যার রক্তে রঞ্জিত হল এর কিছুকাল পরেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার বছরকালের মাথায় কলকাতায় শুরু হল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা জাতীয়তাবাদী অধিকার সংরক্ষণের নামে। এবার হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই অংশবিশেষ প্রত্যক্ষ উন্মত্ত অগ্নিসংযোগ অবাধ লুণ্ঠন ও নির্মম হত্যায় অংশগ্রহণ করল এবং বৃহত্তর অংশ যারা দর্শক তারাও ঐ বীভৎস হত্যাযজ্ঞে উৎসাহিত সমর্থন জানালেন, কেউ প্রকাশ্যে, কেউ মনে মনে। নৈতিক অবক্ষয় অমানবিকতা ও পাশবিকতার যে পাতাল-যাত্রায় আমরা দাঙ্গায় লিপ্ত গুণ্ডাদলের মানসিক সহযাত্রী হয়েছিলাম তা কি সত্যিই আমাদের লজ্জিত করে? আমরা কোন অপরাধ বোধ-দ্বারাও বিড়ম্বিত হইনি। কারণ সমাজের অন্য সকলের সঙ্গে থাকতে চাই, তাদের অনুমোদন অনেক প্রয়োজন। তপন রায় চৌধুরী তার বাঙালনামায় লিখেছেন এই পাশবিক কাজগুলির জন্য যেন আমাদের কোন দায়িত্ব নেই। আমাদের কুকর্মের জন্য আমাদের কোন লজ্জাও নেই। আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনে উত্তর পুরুষকে তা জানানো প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার ভিত্তিতে স্বাধীনতা লাভ ঘটল। তবে ঐতিহাসিক গণবিস্মৃতি (amnesia) যেন মুছে ফেলল ঐ কলঙ্ক। একি তবে গোপন গ্লানি অতিক্রম করার মানসিক প্রতিবর্ত?

এরই পঁচিশ বছর পরে এল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম বিনষ্টির ও নৃশংসতম গণহত্যার দশ মাস। হাজার হাজার গ্রাম আধুনিক সমর প্রযুক্তি ব্যবহার করে মুহূর্তে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছিল। লক্ষাধিক মহিলা সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। আনুমানিক ত্রিশ লক্ষাধিক পুরুষ ও নারী আহত ও নিহত হয়েছিলেন। ধর্মনির্বিশেষ প্রায় এককোটি লোক ভিটামাটি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। মনুষ্যত্বের এমন ব্যাপক অবমাননা নির্যাতন ও সন্ত্রাস বাংলাদেশে কেউ আগে দেখেনি। এর সবই যে বিজাতীয় বহিরাগত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারাই সংগঠিত হয়েছিল তা নয়। আল বদর, আল শামস, রাজাকার প্রভৃতি নামে সেনাবাহিনীর সহযোগী সন্ত্রাসী বাহিনীর গড়ে তোলা হয়েছিল স্থানীয় ইসলাম ধর্মানুসৃত দলের কর্মীদের নিয়ে। তাদের নামকরণে খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়কার ধর্মীয় অনুষঙ্গ জড়িত আলবদর, রাজাকার প্রভৃতি অভিধা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল জনগণকে বিভ্রান্ত করে বৈধতা আদায় করার জন্য। গণমৃত্যুর আতঙ্কবেষ্টিত হওয়া সত্ত্বেও জনগণকে অবশ্য বিভ্রান্ত করা যায়নি। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রাণিত জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদেরই গোপনে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে আগাগোড়া। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পাঠিয়েছে তাদের প্রাণাধিক সন্তানদের। প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় প্রকল্প বর্বরোচিত শক্তি প্রদর্শন করা সত্ত্বেও পরাভূত হল।
পরাভূত হল আত্মগোপন ও সাময়িকভাবে পশ্চাদ্গমন করল বটে কিন্তু নিশ্চেষ্ট হল না। তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবার ও মুক্তিযুদ্ধের চার নেতার হত্যা— পরবর্তী পর্যায়ে মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন আপতিক হতে পারে না। শুধু তো প্রত্যাবর্তনই করল না, সংঘবদ্ধ সন্ত্রাস ও গুপ্ত হত্যার যে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলল তার আক্রমণের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শ। পাকিস্তানি ও আফগান মৌলবাদীদের সঙ্গে এদের সংযোগ খুব দুর্নিরীক্ষ্য নয়। বৈশ্বিক মৌলবাদও যে উৎসমূলে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ ও আন্তর্জাতিক পুঁজিতন্ত্রের বিকাশের সঙ্গে অন্বিত এসব সযত্নকৃত গোপন তথ্য এখন ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছে। সেই দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করার স্থান এই নিবন্ধে নেই। শুধু স্মরণ করা যেতে পারে যে আরব অভিযান টি. ই. লবেসের এবং মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ গুপ্তচর হ্যারি ফিলবির শিক্ষাগুরু কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এডওয়ার্ড গ্রানভিল ব্রাউন মিশরীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনবিরোধী জামাল উদ্দিন আফগানীরও পৃষ্ঠপোষক ও সহায়ক ছিলেন, ঠিক যেমন লর্ড কার্জন ইবনে সাউদকে ব্রিটিশ সহায়তা দিয়েছেন জাতীয়তাবাদী রশীদ রিয়াদকে ক্ষমতাচ্যুত করে ওয়াহাবী মৌলবাদ প্রতিষ্ঠায় এবং লর্ড ক্রোমার ইভলিজ বেয়ারিং পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন অধিকতর মৌলবাদী আব্দুহুর। মৌলবাদের বৈশ্বিক প্রসারও তাই ধর্মীয় চেতনার পুনরাবিষ্কার নয়।

জনগণ যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষভাবে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার প্রধান কারণ এই যে সমাজে আমাদের চেতনা নির্মিত হয় তা কোন একটি ডিসকোর্স দ্বারা পরিচালিত হয় না। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক এই ডিসকোর্সত্রয়ের কোন একটি বিশেষ মুহূর্তে প্রাধান্য পায় যথা বাঙালি জাতীয়তাবাদ। আরো এই কারণে যে, সংস্কৃতির কোন নির্দিষ্ট গণ্ডী বা সীমারেখা নেই, তা সব সময়েই বাস্তবকে অতিক্রম করে যায়, সংস্কৃতি নিজেই নিজের বাস্তবকে তৈরি করে। জাতীয়তাবাদের একজন প্রখ্যাত তাত্ত্বিক বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন মনে করেন, জাতীয়তাবাদ একটি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রয়োজন সৃষ্ট সংস্কৃতি-সঞ্জাত মানস-নির্মাণ। একটি জাতি হচ্ছে একটি ‘imagined community’—একটি গোষ্ঠী নিজেকে যেভাবে ভাবতে ভালবাসে এবং তার জন্য প্রাণ বিসর্জন করতেও দ্বিধা করে না। তবে তার প্রধান লক্ষ্য স্বাধীনতা হলেও জাতি কোন সমসত্ত্ব সংগঠন নয়। তার সদস্যদের মধ্যে আছে স্তর, অবস্থান, ক্ষমতা, শিক্ষা, বিশ্বাস ও রুচির ভিন্নতা, যাকে বলা যায় জাতীয়তাবাদের অন্তর্লীন বিরোধ। ভূপৃষ্ঠের শিলাবিন্যাসের মতই সমাজের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিন্যাসের Fault-line-গুলিও স্বতই আমাদের চোখে পড়ে না। ভূ-গর্ভের শিলাচ্যুতি যেমন উপরিতলে ভূমিকম্পন হিসেবে দেখা দেয়, তেমনি ক্ষমতার বিন্যাসে স্তরচ্যুতি ও সমাজে উপপ্লব, বিকল্প ভাবনা, নৈরাজ্য, সাংস্কৃতিক উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা হিসেবে দেখা দেয়। রাষ্ট্র তখন মরিয়া হয়ে সংস্কৃতিকে ব্যবহার করে ঐ উৎকণ্ঠা প্রশমনের জন্য ও বিকল্প ভাবনাসমূহ প্রতিহত করার জন্য। রাষ্ট্রানুমোদিত সংস্কৃতির একটি রচিত ভাষ্য মিডিয়াসমূহের মাধ্যমে, শিক্ষার-পাঠক্রমে, ঐতিহাসিক তথ্য গোপনীয়তার মাধ্যমে প্রচারিত হতে থাকে—যাকে বলা যায় সাংস্কৃতিক বলপ্রয়োগ। তবে বলপ্রয়োগ কেবলই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেই সীমাবদ্ধ থাকে না। একটি নির্যাতন ও নিপীড়নের প্রক্রিয়াও চালু হয়, যার লক্ষ্য হয় বিরোধী সমালোচনাপ্রবণ বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের কণ্ঠরোধ করা এবং তাতে ব্যর্থ হলে খুন করে ফেলা। বল প্রয়োগ বেশিদিন গোপনও করা যায় না। আইন শৃঙ্খলা রক্ষার নামে ‘কোবরা’, ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’, ‘র‍্যাব’ প্রভৃতি নিষ্ঠুর উৎপীড়নের প্রক্রিয়া প্রকাশ্যে চলে আসে। মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলিও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায় তাদের হত্যা ও নির্যাতনের কার্যক্রমে। একটি নিরোধ, আতঙ্কের ও অসহিষ্ণুতার পরিমণ্ডল সৃষ্টি হয়। বিকল্প ভাবনাকে তাই বলে প্রতিহত করা যায় না, কারণ তা জনসাধারণের আশা আকাঙ্ক্ষাকে স্পর্শ করে। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী এবং জনগণের মধ্যে বিরোধের বিন্দুতে বিকল্প ভাবনার অবস্থান। তা বিলম্বিত হতে পারে, উৎকণ্ঠা জড়িত হতে পারে কিন্তু তার যৌক্তিক অনিবার্যতাকে সাধারণ লোক অস্বীকার করতে পারে না। উৎপীড়নের অন্যায় ও নিষ্ঠুরতা জনসাধারণের মনে সংস্কৃতির সরকারি ভাষ্যের বৈধতা সম্পর্কেও সংশয়ের জন্ম দেয় এবং তারই প্রতিক্রিয়ায় বিকল্প ভাবনাকে অনিবার্য করে তোলে। তবে রেনেসাঁস চর্চার সীমাবদ্ধতার কারণে এবং মৌলবাদমুখী সংঘাতপ্রবণ রাজনীতির আগ্রাসনের কারণে মুসলিম সমাজে একটা চিন্তার অস্বচ্ছতা ও ভয় থেকেই গেছে। তাই ঐ বিকল্প ভাবনা ভবিষ্যতে কতটা গভীরে যাবে, বা কতটা ব্যাপক হবে তা বলা কঠিন। সংস্কৃতির সবটুকু প্রকাশ্য নয় সে কথা আগেই বলেছি।

আধুনিকতার প্রশ্নটি আবার সামনে চলে এসেছে। বিশ্বায়ন ও তথ্য বিপ্লব এর প্রধান কারণ। তথ্য প্রযুক্তি একদিকে যেমন উৎপাদন প্রক্রিয়া ও প্রশাসনের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে বণিক ও প্রশাসককে শক্তিশালী করেছে ঠিক তেমনি সংবাদ ও তথ্যের আদান-প্রদানের মাধ্যম হয়ে জনসাধারণকেও চিন্তার দিক থেকে সক্ষম ও শক্তিশালী করেছে। তথ্যের উন্মুক্ত প্রবাহ সংবাদ নিয়ন্ত্রণ ও চিন্তার নিরোধ প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। তবে এর অন্য পিঠও একটা আছে। তথ্যের উন্মুক্ত প্রবাহ নির্বিচার তথ্যের প্লাবনে ভোক্তার আহরণের উত্তেজনায় তার যতটা সময় নিয়ে নিচ্ছে তাকে চিন্তার ও সংশ্লেষণের ততটা সময় দিচ্ছে না। তাছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, অর্থনীতি, দর্শন, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের নব নব শাখায় যে তত্ত্বরাজি সমাহৃত হচ্ছে, যে ডিসকোর্সসমূহ রচিত হচ্ছে তা আমাদের বৌদ্ধিক সংশ্লেষণ ক্ষমতার চাইতে অনেক বেশি। ফলত সংস্কৃতির মাধ্যমে যে সমন্বিত অর্থায়নের সম্ভাবনার কথা ভাবা হয়েছিল তাই নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এর ফলে বিরোধ ও অসহিষ্ণুতা হয়তো কমবে, কমাই উচিত, কিন্তু উৎকণ্ঠা ও অর্থের বুভুক্ষা প্রশমিত হবে না।

সাধারণ মানুষ এ সমস্ত ক্ষেত্রে বৌদ্ধিক ও আবেগগত আশ্রয় খোঁজে পীর ফকিরের কাছে, সহজ বোধগম্য সমাধানের আশায়। কিন্তু ভবিষ্যতের তথ্য-সমৃদ্ধ শিক্ষিত সংশয়ী মানুষ তেমন আশ্রয়ে শান্তি পাবে কি? জাতীয়তাবাদের নির্মাণে সর্বত্রই বুদ্ধিজীবীদের মুখ্য ভূমিকা ছিল। তারাই ঔপনিবেশিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিকল্প ভাবনা হিসেবে জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব নির্মাণ করেছিল ও তথ্য সন্নিবেশ করেছিল। তার আগে সাধারণ লোক তাদের নিজস্ব গোষ্ঠীকে সমসত্ত্ব একক পরিচয়ে দেখতে পায়নি বা ভাবতে পারেনি। ঐ আত্মপরিচয় লাভ তাদের জীবনের একটা নতুন তাৎপর্য দিয়েছিল, সঙ্কট থেকেও মুক্তি। শুধু জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা বলেই নয়, আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তারা পালন করেছিল। পূর্ব ও পশ্চিমের ভাবনা জগতের মধ্যে তারা সেতুবন্ধ রচনা করেছিল, তারা ছিলেন। পাশ্চাত্য আধুনিকতার ব্যাখ্যাদাতা ও উপনিবেশের সংশ্লেষক। ভবিষ্যতেও সেই ভূমিকাই তাদের আবার পালন করতে হবে। মার্কস বলেছিলেন, পুঁজিবাদ বুদ্ধিজীবীদের ওপর থেকে অতীন্দ্রিয় প্রভাব বলয় অপসারিত করে সবাইকেই বৃত্তিজীবীর পার্থিব দৈনন্দিনতায় পর্যবসিত করেছিল। সব মানুষের মনের গভীরেই transcendent halo-এর একটা আকাঙ্ক্ষা থেকে যায়। কে বলতে পারে যে ঐ হৃতবিভাব গৌরব বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীরা আবার পুনরুদ্ধার করবেন না?

নতুন লেখার নোটিফিকেশন পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

কপিরাইট সংক্রান্ত

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।

মন্তব্য করুন