একদিকে ধনী ও প্রভাবশালী, অন্যদিকে শিক্ষিত ও সমাজসংস্কারক। এমন সুষম সমন্বয় সচরাচর মেলে না। ১৮১৪ সালে কলকাতায় জন্ম নেয়া রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের মাঝে ছিলো এর সবকিছুই। কলকাতার হেয়ার স্কুল এবং হিন্দু কলেজ পড়ুয়া দক্ষিণারঞ্জন কলকাতা পৌরসভার প্রথম ভারতীয় কালেক্টর, মুর্শিদাবাদের নবাব নাজিমের দেওয়ান, বর্ধমানরাজের ডেপুটি কালেক্টর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেন। পাশাপাশি একাধিক পত্রিকা সম্পাদনার মত মহতি পেশার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।
কলেজে ভর্তি হয়েই শিক্ষক হিসেবে পান হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওকে। সহপাঠি হিসেবে পান কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামগোপাল ঘোষ এবং মাধবচন্দ্র মল্লিকের মত একঝাঁক বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্রদের। অন্যদের মত তিনিও সুশিক্ষক ডিরোজিও’র বাগ্মীতায় মুগ্ধ হন এবং সকলের সাথে মিলে ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন সমাজের প্রগতিশীল মানুষরা তাদের এই দলটির নাম দেয় ইয়ং বেঙ্গল।
ছাত্রাবস্থাতেই তিনি ‘জ্ঞানান্বেষণ’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ভারত পত্রিকা ও সমাচার হিন্দুস্তানিসহ আরও কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। নিজ পত্রিকা ছাড়াও অন্য পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। এমনকি সাংবাদিক সমাজের নেতৃত্বেও তিনি ছিলেন। সেসময় ব্রিটিশ সরকার কতৃক সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের জোরালো বিরোধিতা করেন রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়।
১৮৩১ সালে ডিরোজিওর মৃত্যুর পর তাঁর হাতে গড়া সমাজসংস্কার আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে ক’জন শিষ্য অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে দক্ষিণারঞ্জন অন্যতম। কর্মজীবনে নিজের যোগ্যতা এবং ক্ষমতার প্রভাব কাজে লাগিয়ে সমাজের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেন। ১৮৪৯ সালে নারী শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় স্থাপনে ভারত প্রেমী ব্রিটিশ রাজকর্মচারী জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন (বেথুন সাহেব) কে জমি দান করেন। সেই জমিতে বেথুন বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পরেও নানান ধরণের সাহায্য সহযোগীতা অব্যাহত রাখেন।
তাঁর সমাজসেবা শুধু জমি ও অর্থ দানেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। গোঁড়া হিন্দু সমাজে নিষ্পেষিত, নিগৃহীত ও বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াতে তিনি কখনও পিছপা হননি। ইয়ং বেঙ্গলে তাঁর সহযোদ্ধা সমাজ ও প্রচলিত রীতির বিরোধী রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে স্বজনদের দ্বারা বিতাড়িত হলে দক্ষিণারঞ্জনের আশ্রয় লাভ করেন।
কিন্তু তখনকার সমাজে রক্ষনশীলরাই ছিল প্রভাবশালী। যে রক্ষণশীল সমাজের হাত থেকে অনেককেই রক্ষা করেছেন, সেই সমাজের রোষানল থেকে তিনিও রেহাই পাননি। সমাজের পশ্চাৎপদ রীতিনীতি উপেক্ষা করে বর্ধমানের রাজা তেজচন্দ্রের বিধবা রানীকে বিবাহ করেন দক্ষিনারঞ্জন। আর এর ফলে কলকাতার সুহৃদজনেরা তাঁকে ত্যাগ করলে ১৮৫১ সালে তিনি সপরিবারে লক্ষ্ণৌ চলে যান। জ্ঞানী ও বিচক্ষণ দক্ষিণারঞ্জন লক্ষ্ণৌতে সুখ্যাতি অর্জন করতে খুব বেশি সময় নেননি। ১৮৬১ সালে সেখানে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর তিনি লক্ষ্ণৌ ক্যানিং কলেজও প্রতিষ্ঠা করেন।
এতো ব্যস্ততার মাঝেও তাঁর প্রিয় কাজ সম্পাদনার কথা ভুলে থাকতে পারেননি। লক্ষ্ণৌ টাইমস পত্রিকার স্বত্ব কিনে নিজেই সম্পাদনা শুরু করে দেন। পাশাপাশি লক্ষ্ণৌর সহকারী অবৈতনিক কমিশনার এবং জমিদারদের শিক্ষায়তন ওয়ার্ড ইনস্টিটিউটের অবৈতনিক কমিশনার ছিলেন।
কিছুদিন পর প্রাদেশিক সরকার গঠনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় ব্রিটিশ সরকারের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হলে নিজের প্রভাব প্রতিপত্তিতে ভাটা পড়ে। ফলে, সমাজ উন্নয়ন কাজ ব্যহত হতে থাকে। কৌশলী দক্ষিণারঞ্জন সিপাহী বিদ্রোহে সরকারকে সহায়তা করে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে সফল হন।
১৮৭১ সালে লর্ড মেয়ো দক্ষিণারঞ্জনকে রাজা উপাধি দেন। এর সাত বছর পর ১৮৭৮ সালের ১৫ই জুলাই লক্ষ্ণৌতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তৎকালীন সমাজের গোড়ামি ও পশ্চাৎপদতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যান।
তথ্যসূত্রঃ বাংলাপিডিয়া, Wikipedia.